আর তারপর? তারপর তারা সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলো- সব গল্প কি এমন হয়? ডিজনি আমাদের মন ভোলাতে কত ধ্রুপদী গল্পে পরিবর্তন ঘটিয়েছে তার হিসেব নেই। এই পরিবর্তন আর বিকৃতির স্রোতে ডুবে গেছে অসংখ্য শক্তিশালী বাস্তব ঘটনা, পোকাহানতাসের ঘটনা তাদেরই অন্তর্গত।
পোকাহানতাস তার আসল নাম না। ১৫৯৬ সালে জন্মানো মেয়েটির আসল নাম মাতোয়কা। মাতোয়াকার বাবা ছিল পোহাতান আদিবাসীদের শক্তিশালী রাজা। কয়েক বছর পর জন স্মিথের লেখায় বেরিয়ে এলো কীভাবে এই রাজার সুন্দরী কন্যা তার জীবন রক্ষা করেছিল। রঙ চড়িয়ে বলা সেই গল্প নিয়ে সন্দেহ থাকলেও বিতর্ক হলো না।
জন স্মিথের ভাষ্যে শোনা গল্পের মতোই প্রচলিত গল্পে পোকাহানতাসকে দেখানো হয় এমন এক তরুণী, যে কি না নিজ গোত্রের লোকেদের ছেড়ে এক ইংরেজ যুবকের প্রেমে পড়ে। কিন্তু পোকাহানতাসের বাস্তব গল্প এর কাছাকাছি কিছু নয়। এমনকি পোহাতানদের কাছ থেকে স্মিথের জীবন বাঁচানোর ঘটনার সময় পোকাহানতাসের বয়স ১১ কী ১২ বছর। বর্তমানের ঐতিহাসিকেরা এটাও সন্দেহ করেন, জীবন বাঁচানোর ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কি না। যদি ঘটেই থাকে, সেটা একটা সাধারণ প্রথাও হয়ে থাকতে পারে, যেখানে অতিথির প্রাণ নেওয়ার ভান করা হয়।
পোকাহানতাসের মৃত্যুর ৪০০ বছর পর তার অস্তিত্ব ও বাস্তবতা খুঁজে পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন ঐতিহাসিকেরা। পোকাহানতাস বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত ক্যামিলিয়া টাউন্সেন্ড। তিনি গবেষণা করেছেন কেন পোকাহানতাসের ঘটনা এভাবে বিকৃত হয়েছে, আমাদের সংস্কৃতিতে এর প্রভাব ঠিক কতটুকু। আমেরিকান আদিবাসীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি উপনিবেশকারী আর আদিবাসীদের ভেতর প্রথম দিককার সম্পর্ক বের করতে চাইছিলেন। এক্ষেত্রে তো প্রকৃষ্ট উদাহরণ পোকাহানতাস। তাই পোকাহানতাসকে দিয়ে শুরু করলেন। হাজার হাজার বইয়ের মাঝে অবাক হয়ে দেখলেন, অনেকগুলো বই কোনো ঐতিহাসিকের লেখা নয়। অনেক ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি করা তথ্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নিয়েছেন।
এরপর তিনি সত্যিকারের নথিপত্রের দিকে চোখ দিলেন। ঐসময়ের যেসব কাগজপত্র তখনো টিকে ছিল সেগুলো থেকে বুঝতে পারলেন, পৃথিবীর মানুষকে ভুল দেখানো হয়েছে, ভুল জানানো হয়েছে।
জন স্মিথ আর অন্যান্য উপনিবেশকারীরা থাকতো পোহাতানসহ অন্যান্য আদিবাসীদের গ্রামের কাছাকাছি। স্মিথকে উপনিবেশকারীদের মাঝে প্রধান হিসেবে বরণ করে নেওয়ার প্রথা পালন করেছিল পোকাহানতাসের বাবা। চারদিনের এই প্রথার একটা অংশ ছিল নেতাকে বলি দেওয়ার ভান করা। এখন, যে দুটো কারণে পোকাহানতাস এখানে স্মিথের জীবন রক্ষার চেষ্টা করতে পারে না- প্রথমত, মা হারা পোকাহানতাস বড় হয়েছিল বাবার ভালোবাসায় আর নজরবন্দী হয়ে। রাজার মেয়ে হিসেবে পোহাতানদের সব ধরনের সংস্কৃতির সাথে ভালোভাবে পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয় ছোটবেলাতেই। সুতরাং সে যেহেতু আগেও একই রকম অনুষ্ঠান দেখেছে, সে জানতো এখানে সত্যি সত্যি প্রাণ নেওয়া হবে না। দ্বিতীয়ত, অনুষ্ঠানটি দেখা তো দূরে থাক, এর ধারেকাছে পোকাহানতাসের আসার কথা নয়। কারণ পোহাতানরা তাদের বাচ্চাদের এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে রাখতো। ফলে সুন্দরী নারী ওরফে ১১-১২ বছরের পোকাহানতাসের বাবার ধারালো অস্ত্রের নিচে মাথা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
প্রধান হওয়ার পর কখনো কখনো স্মিথ গ্রামে ঢুকে বন্দুক দেখিয়ে গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে খাবার দাবার কেড়ে নিতো। এসব কারণে স্মিথের উপর অত্যন্ত বিরক্ত ছিল তারা। এক আদিবাসী নারী স্মিথকে বলেছিল, “নিজেকে ধর্মের বাহক বলে দাবী করো, আবার সব ফসল কেড়ে নিয়ে পুরো শীত আমাদের না খাইয়ে মারো, এই তোমার ধর্ম?” পোহাতান রাজা অনেক উপনিবেশকারীর সাথেই ভালো সম্পর্ক রেখেছিলেন। এদের মাঝে সবচাইতে ভালো সম্পর্ক ছিল স্মিথের সাথে। কিন্তু তিনি পরে তার এই ভুল বুঝতে পারেন। স্মিথ দাবী করেন, এ সময় রাজা তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছিলেন। কিন্তু পোকাহানতাস জেমসটাউনে এসে তার বাবার পরিকল্পনা সম্পর্কে খুলে বলে, ফলে প্রাণে বাঁচে স্মিথ।
এই ঘটনাটিও স্মিথের মনগড়া ও প্রচলিত। ভার্জিনিয়ার ইতিহাস নিয়ে বই লেখার সময় এসব তথ্য উল্লেখ করেছিলেন স্মিথ। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এর আগের চিঠিপত্রে বা অন্য কোথাও এসব বলেননি তিনি। ভার্জিনিয়ার ইতিহাস লেখার সময় তার সহকর্মীদের আর কেউ বেঁচে ছিল না, আর আদিবাসীরা তার লেখা বই পড়বে না। সুতরাং তার দেওয়া তথ্য সত্য নাকি মিথ্যা এটা যাচাইয়ের জন্যেও কেউ থাকবে না।
পোকাহানতাসের সাথে স্মিথের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না। তার বিয়ে হয় আদিবাসী এক পুরুষের সাথে। সেখানে তার এক বাচ্চাও হয়। এরপর তাদের গ্রাম জুড়ে শুরু হয় উপনিবেশকারীর উৎপাত। তার স্বামী কিছুদিনের জন্য যখন বাইরে ছিল এক ইংরেজ এসে দাবী করে পোকাহানতাসের স্বামী তাকে পিতলের কলসির বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। পিতলের কলসি যে শুধুই একটা বাহানা তা গ্রামবাসীরা জানতো, কিন্তু অস্ত্রের সামনে তারা কিছু করতে পারেনি। পরবর্তীতেও তারা পোকাহানতাসকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেনি নিজেদের ও পোকাহানতাসের ক্ষতি হবে ভেবে।
কিছুকাল পর পোকাহানতাসের সাথে তার বড় বোন ও স্বামীর দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ভয়ংকরভাবে বিষণ্ন পোকাহানতাস জানায়, তাকে অনেকবার ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণ নামক অপরাধের সাথে পোহাতান গোষ্ঠীর পরিচয় ছিল না। তারা বুঝলো অন্যায় কিছু হয়েছে, কিন্তু সেটা কত বড় অন্যায় তা বোঝেনি। তাদের কাছে সকল অন্যায়ের শাস্তি ছিল গোত্র থেকে বের করে দেওয়া, যা উপনিবেশকারীদের জন্য খাটে না।
আটক থাকাকালীন পোকাহানতাসের গর্ভে থমাসের জন্ম হয়। ইংরেজদের ভারী পোশাক সহ্য করতে পারতো না সে। ছিঁড়ে ফেলতো। তাকে তথাকথিত সভ্য বানানোর জন্য খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পোকাহানতাস ওরফে মাতোয়কা হয়ে ওঠে রেবেকা। প্রশ্ন উঠতে পারে, রেবেকাকে খ্রিষ্টান বানানো পর্যন্ত মানা গেল সাদা উপনিবেশকারীদের অত্যাচার। কিন্তু জন রলফের সাথে তার বিয়ের ব্যাপারটা কি তাদের ঔদার্য নয়?
জন রলফ রেবেকা বা পোকাহানতাসকে এমনিই দয়াপরবশ হয়ে বিয়ে করে বসেননি। পোহাতানদের মাঝে তামাক দিয়ে একধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই জ্ঞান শুধুমাত্র পোহাতান গোত্রীয়দের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাণের বিনিময়েও তারা গোপন এই বিদ্যা বাইরের কারো সাথে বলতো না। এই চিকিৎসা এতই ভালো ছিল যে জন রলফ এটা শেখার বিভিন্ন চেষ্টা চালান। তার সব প্রচেষ্টার শেষটা ছিল রেবেকাকে বিয়ে করা। রলফ সফল হয়েছিলেন। তাকে তামাক চিকিৎসা শেখানো হয়। কিন্তু বিপদে পড়ে আদিবাসী গ্রামটি। তাদের চারধারে ভিড়তে থাকে লোভী ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকেরা। তাদের জন্য এমন অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি।
যদি আমরা ভাবি, এসব কিছুর জন্য একমাত্র ডিজনি দায়ী, তাহলে আমরা ভুল করবো। দায়ভার চলে যায় জন স্মিথের কাঁধ পর্যন্ত। তারা তাদের গল্প বলার ধরনে পোকাহানতাসকে নায়িকা করে, ইতিবাচক চরিত্র রূপে দাঁড় করিয়েছে। অর্থাৎ সাদা চামড়ার মানুষদের যে সহায়তা করবে সে ভালো, যে নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে শহুরে জীবনধারা বেছে নেবে সে সভ্য, যে তার প্রভুদের রক্ষা করতে চাইবে সে সাহসী ও প্রশংসার যোগ্য।
তারা আমাদেরকে সেটাই দেখিয়েছে যা তারা আমাদের মাথায় গেঁথে দিতে চায়, পোকাহানতাসের বিকৃত গল্প আমেরিকার আদিবাসীদের মাঝে বহুকাল যাবত অপরিচিত থাকলেও বর্তমান প্রজন্ম আসল ইতিহাস না জেনেই এটাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
অনেকের মতে, পোকাহানতাস তার আগের ঘর মোছা, কাপড়কাচা ডিজনি রাজকন্যাদের চেয়ে তো অন্তত ভালো। সে বুদ্ধিমতী, সাহসী ও শক্তিশালী। কিন্তু যে পাখিটা উড়তে চেয়েছিল, তার ডানা কেটে, পালক ছিঁড়ে যে অত্যাচারটা করা হয়েছে, তার বদলে খাঁচায় আটকা সেই পাখির মিষ্টি গানের প্রশংসা পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত। পোকাহানতাসের ইতিহাস, পৃথিবীর ইতিহাসকে শাসক ও শক্তিশালীরা যেভাবে বিকৃত করেছে তারই একটি উদাহরণ মাত্র।