“আমাদের কোনো চিরস্থায়ী বন্ধু নেই, এবং আমাদের কোনো চিরস্থায়ী শত্রু নেই। কেবল আমাদের স্বার্থই চিরস্থায়ী, আর আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সেই স্বার্থ অনুযায়ী চলা।”– ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোনের এই উক্তিটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। বাস্তবিক অর্থেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু/বন্ধু বলতে কিছু নেই, রয়েছে শুধু চিরস্থায়ী স্বার্থ। এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজ নিজ স্বার্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, আবার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই নিজ নিজ স্বার্থে রাষ্ট্র দুইটি ৪ দশকব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্ক গড়ে উঠার প্রক্রিয়াটিকেও অনুরূপভাবে স্বার্থের মাপকাঠি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাংশ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই যুদ্ধ চলাকালে ভারত ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত স্বার্থে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল, অন্যদিকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। ‘মিত্ররাষ্ট্র’ পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় ও সোভিয়েত প্রভাব বিস্তার রোধ, চীনের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলোর বাংলাদেশের ঘটনা থেকে উৎসাহ লাভ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে সোভিয়েত সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা– এসব কারণ বিবেচনা করে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরে তৃতীয় ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে চীন সোভিয়েত হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয়–বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ ও চীন উভয়কেই দক্ষিণ এশিয়ায় সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশ ছিল তৃতীয় বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র, যেটি ইউরোপীয়, মার্কিন বা জাপানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নয়, বরং তৃতীয় বিশ্বেরই আরেকটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অস্তিত্ব ছিল এবং এজন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রকেই অস্বস্তিতে ফেলেছিল। তদুপরি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তান তীব্র বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার প্রসঙ্গ তুলছিল। এমতাবস্থায় বাংলাদেশি সরকারের মূল উদ্দেশ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং এজন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করা ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
এজন্য বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। চীন একটি স্বীকৃত বৃহৎ শক্তি ও বাংলাদেশের নিকটবর্তী রাষ্ট্র, এজন্য চীনের স্বীকৃতি অর্জন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র, সুতরাং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য অন্যান্য ৪টি স্থায়ী সদস্যের পাশাপাশি চীনের সমর্থনও বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল। তদুপরি, একটি অনুন্নত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তৎকালে চলমান স্নায়ুযুদ্ধ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার প্রয়োজন অনুভব করছিল এবং বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য প্রচুর বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন ছিল। এজন্য শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে যেমন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব ও চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সর্বোপরি, সোভিয়েত–ভারতীয় জোটের ওপর বাংলাদেশের ‘মাত্রাতিরিক্ত’ নির্ভরতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও জনসাধারণের একাংশের নিকট অগ্রহণযোগ্য ছিল এবং একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে মুজিবও বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পর এই বিষয়গুলো চীনের প্রতি বাংলাদেশের নীতিকে পরিচালিত করেছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, কারণ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ‘কঠোর বক্তব্য’ প্রদান করলেও কার্যত চীন তার মিত্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কিছুই করতে পারেনি বা করেনি। এজন্য পাকিস্তানের দৃষ্টিতে নিজ অবস্থান সমুন্নত করা এ সময় চীনের জন্য প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া চীনা–সোভিয়েত দ্বন্দ্ব ও চীনা–ভারতীয় দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত ও ভারতীয়–প্রভাবাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে চীন তার দক্ষিণ সীমান্তের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছিল। সর্বোপরি, সোভিয়েত ও ভারতীয় সহায়তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ পরোক্ষভাবে চীনের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতিও হুমকিস্বরূপ ছিল।
চীনা–অধিকৃত সোভিয়েত সীমান্তবর্তী সিনকিয়াং/জিনজিয়াং অঞ্চল ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী তিব্বত অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে যথাক্রমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত সমর্থন করছিল এবং এই রাষ্ট্র দুইটির সাহায্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ চীনের অঞ্চল দুইটির বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দিতে পারত। এছাড়া, পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড (পশ্চিম পাকিস্তান/পাকিস্তান) থেকে বিচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ানের স্বাধীনতার দাবিকে জোরালো করতে পারত।
এসব বিবেচনা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাথমিক বছরগুলোতে চীন পাকিস্তানের তীব্র বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের প্রতিধ্বনি করতে থাকে। ১৯৭২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে এবং ২৫ আগস্ট প্রস্তাবটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হয়। চীন এই প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে এবং বাংলাদেশকে ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদ’ ও সোভিয়েত ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদে’র ঘাঁটি হিসেবে আখ্যায়িত করে। এটি ছিল জাতিসংঘে চীনের ব্যবহৃত প্রথম ভেটো। জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের দুইটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেনি, যেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে সকল বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার এবং পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের পুনর্বাসন। এই দাবিটি ছিল আংশিকভাবে মিথ্যা, কারণ ১৯৭২ সালের মার্চেই বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া ও সোভিয়েত প্রতিনিধি ভিক্তর ইসরায়েলিয়ান তীব্র তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন, এবং নিজেকে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর ‘প্রকৃত প্রতিনিধি’ হিসেবে বিবেচনা করা সত্ত্বেও চীন তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, এই ব্যাপারটি নিয়ে সোভিয়েতরা সাফল্যের সঙ্গে প্রচারণা চালাচ্ছিল। তদুপরি, তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই চীনের এই অবস্থানের সঙ্গে একমত ছিল না। এজন্য চীনের পক্ষে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশের জাতিসংঘে যোগদান আটকে রাখা সম্ভব ছিল না।
জাতিসংঘে চীনের বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান বাংলাদেশি সরকারকে ক্ষুব্ধ করে, কিন্তু চীন যাতে আরো শত্রুভাবাপন্ন না হয়ে উঠে এই উদ্দেশ্যে চীনের প্রতি সরাসরি নিন্দা জ্ঞাপন থেকে বাংলাদেশ বিরত থাকে। বাংলাদেশ এটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে, কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘে প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ চীনা–সোভিয়েত বৈরী সম্পর্কের কারণে চীনের ওপর সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সীমিত। এজন্য বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তৎপর হয়। এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ খাজা মুহাম্মদ কায়সারকে বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করে। কায়সার ইতোপূর্বে চীনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং চীনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এজন্য চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কায়সারকে বার্মায় প্রেরণ করা হয়।
তদুপরি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের কাছে একটি পত্র প্রেরণ করেন এবং চীনের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাছাড়া, চীনা–পাকিস্তানি সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাঙালি রাজনীতিবিদদের ভূমিকাকেও বাংলাদেশ তুলে ধরতে থাকে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ গ্রহণের পরও চীন তার বাংলাদেশবিরোধী নীতি অব্যাহত রাখে এবং ১৯৭৩ সালেও বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে।
অবশ্য চীনা কূটনীতিবিদরা বাংলাদেশিদেরকে ইঙ্গিত করেন যে, বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে চীনের নীতিগত কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের পুনর্বাসন এবং ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আগ পর্যন্ত চীন বাংলাদেশের প্রতি বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে। তাছাড়া, এ সময় সোভিয়েত নৌবহর চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে মাইন ও ডুবে যাওয়া নৌযানসমূহ অপসারণের কাজে নিয়োজিত ছিল এবং বাংলাদেশে একটি স্থায়ী সোভিয়েত নৌঘাঁটি স্থাপিত হতে পারে এই আশঙ্কাও চীনাদের মধ্যে ছিল।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে।
প্রথমত, ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ‘ইসলামি সম্মেলন সংস্থা’র সামিটে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদের চাপে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এই সম্মেলনে যোগদান করেন এবং এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি–বাংলাদেশি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ভারতীয়–সোভিয়েত জোট থেকে মুসলিম বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশের আংশিক ঝুঁকে পড়াকে চীন ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭৪ সালের মার্চে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর মাইনমুক্ত করার কাজ শেষ হয় এবং সোভিয়েত নৌবহর বাংলাদেশ ত্যাগ করে। এটিকেও চীনারা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে।
তৃতীয়ত, ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ভারতের নয়াদিল্লিতে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের পাকিস্তানে পুনর্বাসন, পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের বাংলাদেশে পুনর্বাসন ও বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে পুনর্বাসনের ব্যাপারে তিন পক্ষ একমত হয়।
সর্বোপরি, ১৯৭৪ সালের জুনে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফর করেন এবং এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি–বাংলাদেশি সম্পর্ক কার্যত স্বাভাবিক হয়।
এই পরিস্থিতিতে চীন তার আগেকার কঠোর বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব থেকে সরে আসে এবং বাংলাদেশের প্রতি তুলনামূলক নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয় এবং ১৯৭৪ সালের আগস্টে চীন বন্যাদুর্গতদের সহায়তার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে ১০ লক্ষ (বা ১ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার সমমূল্যের ত্রাণসামগ্রী প্রদান করে, যার মধ্যে ছিল ৫,০০০ টন চাল। সর্বোপরি, জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশের ক্ষেত্রে চীন তার আপত্তি অপসারণ করে নেয় এবং ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর মধ্য দিয়ে চীনা–বাংলাদেশি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়, যদিও তখন পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
অবশ্য চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়েই চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল।
প্রথমত, ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং এ সময় বাংলাদেশ প্রচুর ভারতীয় পণ্য আমদানি করত। কিন্তু কিছু কিছু ভারতীয় পণ্যের (যেমন: তৈরি পোশাক) মান নিয়ে বাংলাদেশের ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল এবং এ ধরনের পণ্যের জন্য চীন একটি বিকল্প উৎস হতে পারত।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ এ সময় ভারত থেকে সিমেন্ট আমদানি করত এবং এক্ষেত্রে প্রতি টন সিমেন্টের মূল্য ছিল ৫০ মার্কিন ডলার। কিন্তু চীন প্রতি টন সিমেন্ট ৩৫ মার্কিন ডলার মূল্যে ২০,০০০ টন সিমেন্ট বাংলাদেশের কাছে রপ্তানি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তদুপরি, এক্ষেত্রে তারা চীনা জাহাজে বাংলাদেশকে সিমেন্ট ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করতে সম্মত ছিল, যার ফলে বাংলাদেশের জন্য পরিবহন খরচ অনেক কমে যেত।
তৃতীয়ত, এ সময় পাট ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছিল এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে পাট রপ্তানি করতে পারেনি। এ সময় চীনে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল এবং চীন আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত সামগ্রী ক্রয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
চতুর্থত, ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করার বিনিময়ে ভারতকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রদান করতে হয়। কিন্তু এ সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল সীমিত এবং চীন ‘বিনিময় প্রথা’র মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে আগ্রহী ছিল। বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়া ও চামড়াজাত সামগ্রী ও অন্যান্য পণ্য আমদানির বিনিময়ে চীন বাংলাদেশকে চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানির প্রস্তাব করেছিল, এবং অর্থনৈতিকভাবে এই প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশের জন্য আকর্ষণীয়।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের জ্বালানির চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। এ সময় বাংলাদেশে বাৎসরিক ১৫ লক্ষ টন অপরিশোধিত তেল ও প্রচুর পরিমাণ কয়লার চাহিদা ছিল এবং চীন এই চাহিদা পূরণ করতে আগ্রহী ছিল।
সর্বোপরি, চীন ও বাংলাদেশ উভয়েই উভয়ের জন্য বৃহৎ একটি বাজার হয়ে উঠতে পারত এবং এজন্য উভয় রাষ্ট্রই বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ইচ্ছুক ছিল। এছাড়া, চীনা বৈদেশিক সহায়তাও বাংলাদেশের জন্য আকর্ষণীয় ছিল, কারণ চীনা অর্থনৈতিক সহায়তা হয় অনুদান হিসেবে নয়ত দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হিসেবে প্রদান করা হত।
এই প্রেক্ষাপটে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা কূটনৈতিক সম্পর্কের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। চীন এ সময় বাংলাদেশে একটি বাণিজ্যিক মিশন স্থাপনেরও প্রস্তাব করে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবের বিরোধী ছিল না, কিন্তু এর সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের শর্ত জুড়ে দেয়। চীন তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিল না, ফলে এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
বস্তুত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়–সোভিয়েত জোটের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা, বিশেষত ভারতের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা হ্রাস করা, কিন্তু ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার কোনো ইচ্ছা বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের ছিল না। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতীয়–সোভিয়েত জোট ও চীনা–পশ্চিমা জোটের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা, কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়া নয়। অন্যদিকে, চীনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ভারতীয়–সোভিয়েত জোট থেকে পুরোপুরিভাবে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসা, যেটি সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
১৯৭৫ সালের এপ্রিলে দুইটি ঘটনা বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন করে। প্রথমত, ভারত ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ ফারাক্কা বাঁধ চালু করে, যার ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণ পানি সঙ্কটের আশঙ্কায় ভুগতে থাকে। দ্বিতীয়ত, এ সময় ভারতীয় সৈন্যরা সিকিম দখল করে নেয়, যার ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ভারতের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশি রাজনৈতিক শ্রেণির মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়। এমতাবস্থায় চীনা প্রচারমাধ্যমে ভারতের উভয় পদক্ষেপেরই তীব্র নিন্দা জানায় এবং চীনা সরকার চীনের ক্যান্টন শহরে চলমান বসন্তকালীন বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়, যদিও তখনো বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ৪ সদস্যের একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদলকে এই মেলায় অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণ করে। ১৯৭৫ সালের মে পর্যন্ত এই মেলা চলে এবং এসময় চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪টি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশি কূটনীতিবিদরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। চীনা কূটনীতিবিদরা জানান যে, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি স্থগিত আছে, যদিও এ ব্যাপারে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বলে তারা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের আশ্বাস প্রদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। খন্দকার মোশতাক আহমেদের রাষ্ট্রপতিত্বে গঠিত নতুন সামরিক–প্রভাবাধীন সরকার বাংলাদেশকে ভারতীয়–সোভিয়েত জোট থেকে বের করে আনে এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। চীন দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের নতুন সরকারের রাজনৈতিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এবং এরপর ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।