দক্ষিণ ককেশাস/ট্রান্সককেশাস/ট্রান্সককেশিয়া অঞ্চলে অবস্থিত ক্ষুদ্র ‘বৃহত্তর তুর্কি’ (Turkic) রাষ্ট্র ‘আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র’ (আজারবাইজানি: Azərbaycan Respublikası)। ৮৬,৬০০ বর্গ কি.মি. আয়তন এবং প্রায় ১ কোটি ১ লক্ষ জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তরে রাশিয়া, উত্তর–পশ্চিমে জর্জিয়া, পশ্চিমে আর্মেনিয়া ও তুরস্ক এবং দক্ষিণে ইরান অবস্থিত। রাষ্ট্রটির ৯১.৬% অধিবাসী জাতিগত আজারবাইজানি এবং ৯৬.৯% অধিবাসী ইসলাম ধর্মাবলম্বী। রাষ্ট্রটির মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে ৮৫% শিয়া এবং ১৫% সুন্নি। শিয়া–অধ্যুষিত ও হাইড্রোকার্বন–সমৃদ্ধ এই বৃহত্তর তুর্কি রাষ্ট্রটিকে সুন্নি–অধ্যুষিত বৃহত্তর তুর্কি রাষ্ট্র তুরস্কের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বস্তুত আজারবাইজান ও তুরস্কের মধ্যবর্তী সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, এই রাষ্ট্র দুটিকে ‘এক জাতি, দুই রাষ্ট্র’ (তুর্কি: Bir millet, iki devlet; আজারবাইজানি: Bir millət, iki dövlət) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর এই শব্দগুচ্ছের প্রবর্তন করেন আজারবাইজানের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হায়দার আলিয়েভ।
উল্লেখ্য, হায়দার আলিয়েভ ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এসময় তুর্কি–আজারবাইজানি সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। কৌতূহলের ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৯৫ সালের মার্চে তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা আজারবাইজানের অভ্যন্তরে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আলিয়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু আজারবাইজানের যে রাষ্ট্রপ্রধান তুরস্ক ও আজারবাইজানকে ‘এক জাতি, দুই রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন, তাকে কেন তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা আজারবাইজানের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে চেয়েছিল? একটি ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তুর্কিরা আসলে কী অর্জন করতে চেয়েছিল?
আজারবাইজানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
১৮০৪–১৩ এবং ১৮২৬–২৮ সালের রুশ–ইরানি যুদ্ধে রাশিয়ার নিকট ইরানের পরাজয়ের ফলে বর্তমান আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ড রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর রাশিয়া জুড়ে গৃহযুদ্ধ ও বৈদেশিক সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু হয় এবং এই পরিস্থিতিতে ১৯১৮ সালে আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদীরা ‘আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ (আজারবাইজানি: Azərbaycan Demokratik Respublikası) নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১৯২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি বলশেভিকদের বিপ্লব/অভ্যুত্থান ও সোভিয়েত রুশ লাল ফৌজের আক্রমণের ফলে আজারবাইজানে জাতীয়তাবাদীদের শাসনের অবসান ঘটে এবং বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত ‘আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ (আজারবাইজানি: Азәрбајҹан Совет Сосиалист Республикасы, ‘আজারবাইজান সোভিয়েত সোসিয়ালিস্ত রেসপুবলিকাসি’; রুশ: Азербайджанская Советская Социалистическая Республика, ‘আজেরবায়দঝানস্কায়া সোভিয়েতস্কায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কায়া রেসপুবলিকা’) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রের মধ্যে একটিতে পরিণত হয়।
১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভ ‘কোম্মুনিস্তিচেস্কায়া পার্তিয়া সোভিয়েৎস্কোগো সয়ুজা’র (রুশ: Коммунистическая партия Советского Союза) মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয় এবং আজারবাইজানের ভূখণ্ডেও তা ছড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত সরকার কর্তৃক পূর্ণ বাক, মতপ্রকাশ ও সংগঠন সৃষ্টির স্বাধীনতা প্রদান করার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বারা অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোর মতো আজারবাইজানের অভ্যন্তরেও উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একদিকে আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদীরা আজারবাইজানের জন্য স্বাধীনতা বা অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দাবি করতে শুরু করে, অন্যদিকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত জাতিগত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত ‘নাগর্নো–কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে’ ও পার্শ্ববর্তী ‘আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে’ আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা নাগর্নো–কারাবাখকে আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাতে থাকে। পশ্চিমা, তুর্কি ও ইরানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এতদঞ্চলে সোভিয়েত কর্তৃত্ব দুর্বল করে ফেলার উদ্দেশ্যে আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে। একইভাবে, আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরাও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তা লাভ করে।
নাগর্নো–কারাবাখ ও আজারবাইজানের অন্যান্য অংশে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে জাতিগত সংঘাত আরম্ভ হয় এবং ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এটি সশস্ত্র সংঘাতে রূপ ধারণ করে। এদিকে ১৯৮৮ সালের জুলাইয়ে আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিজমবিরোধীরা ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’ (আজারবাইজানি: Azərbaycan Xalq Cəbhəsi) প্রতিষ্ঠা করে এবং ক্রমশ ক্ষমতাসীন আজারবাইজানি কমিউনিস্টদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’ আজারবাইজানের কিছু অঞ্চলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং রাজধানী বাকুতে কমিউনিস্টদের ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চালায়। এই পরিস্থিতিতে ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে সোভিয়েত সরকার আজারবাইজানে সৈন্য প্রেরণ করে এবং এই বিপ্লব/বিদ্রোহের প্রচেষ্টা দমন করে। এরপর আয়াজ মুতাল্লিবভ ‘আজারবাইজান কোম্মুনিস্ত পার্তিয়াসি’র (আজারবাইজানি: Azərbaycan Kommunist Partiyası) প্রথম সচিব (আজারবাইজানের শাসক) নির্বাচিত হন।
কিন্তু ১৯৯১ সালের ১৯–২১ আগস্ট ‘কোম্মুনিস্তিচেস্কায়া পার্তিয়া সোভিয়েৎস্কোগো সয়ুজা’র কট্টরপন্থীরা গর্বাচেভকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং এরপর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলো একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করে। ৩০ আগস্ট আজারবাইজানি আইনসভা প্রজাতন্ত্রটির স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মুতাল্লিবভ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে আজারবাইজানি জনসাধারণ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয় এবং আজারবাইজান স্বাধীনতা লাভ করে। একই সময়ে নাগর্নো–কারাবাখও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরপরই নাগর্নো–কারাবাখ সংঘাত আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেয়।
১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্মেনীয় সৈন্যরা আজারবাইজানিদের পরাজিত করে খোজালি শহর দখল করে নেয় এবং সেখানে তারা পলায়নরত আজারবাইজানি জনসাধারণের ওপর গুলিবর্ষণ করলে ২০০ থেকে ৬১৩ জন বেসামরিক আজারবাইজানি নিহত হয়। এই সঙ্কটের কারণে ৬ মার্চ মুতাল্লিবভ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আজারবাইজানি আইনসভার স্পিকার ইয়াগুব মাম্মাদভ আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি আর্মেনিয়ার সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, কিন্তু ৮ মে আর্মেনীয় সৈন্যরা শুশা শহর দখল করে নেয় এবং মাম্মাদভের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৪ মে আজারবাইজানি আইনসভা মুতাল্লিবভকে খোজালি সঙ্কটের দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করে এবং পুনরায় তাকে আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। কিন্তু ১৫ মে ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’ একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুতাল্লিবভকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং আজারবাইজানের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়। ইসা গাম্বার সাময়িকভাবে আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একই সময়ে আর্মেনীয় সৈন্যরা লাচিন দখল করে নেয়।
১৯৯২ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’র প্রার্থী আবুলফাজ এলচিবে বিজয়ী হন এবং ১৬ জুন তিনি আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। এলচিবে ছিলেন উগ্র আজারবাইজানি ও বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী এবং তীব্র রুশবিরোধী ও ইরানিবিরোধী। তিনি আজারবাইজান থেকে রুশ সৈন্যদের অপসারণ করেন, তুরস্কের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং ইরানি আজারবাইজানকে আজারবাইজানের সঙ্গে সংযুক্ত করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। তদুপরি, তিনি আজারবাইজানি ও বৃহত্তর তুর্কি সম্প্রসারণবাদী চিন্তাধারা ব্যক্ত করেন। কিন্তু তার শাসনকালেও আজারবাইজানি সৈন্যরা একের পর এক যুদ্ধে আর্মেনীয়দের কাছে পরাজিত হতে থাকে।
এলচিবে নাখচিভানের (আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র) শাসক হায়দার আলিয়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা চালান। আলিয়েভ ছিলেন আজারবাইজানি কেজিবির প্রাক্তন সভাপতি, ‘আজারবাইজান কোম্মুনিস্ত পার্তিয়াসি’র প্রাক্তন প্রথম সচিব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী। ১৯৯০ সালে তিনি নাখচিভানে চলে আসেন এবং সেখানকার আইনসভার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তিনি আজারবাইজানি আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন, কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুতাল্লিবভের সমর্থকদের চাপে তিনি বাকু থেকে নাখচিভানে ফিরতে বাধ্য হন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তিনি বাকুর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে কার্যত স্বাধীনভাবে নাখচিভান শাসন করতে থাকেন। এলচিবে আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আজারবাইজানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইসগান্দার হামিদভ নাখচিভান থেকে আলিয়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সেখানে সৈন্য প্রেরণ করেন, কিন্তু তার সৈন্যরা নাখচিভান বিমানবন্দর থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
এদিকে আজারবাইজানের গাঞ্জায় কর্নেল সুরাত হুসেয়নভ সেখানে মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যদের সমর্থনে একটি নিজস্ব মিলিশিয়া গড়ে তুলেছিলেন। এই মিলিশিয়াটি আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু এলচিবের সরকার হুসেয়নভকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করে এবং হুসেয়নভ ইচ্ছাকৃতভাবে এতদঞ্চলে রুশ প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে মার্দাকের্তের আশেপাশের গ্রামগুলোকে আর্মেনীয়দের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করে। ১৯৯৩ সালের ২৮ মে সর্বশেষ রুশ সৈন্যদল গাঞ্জা ত্যাগ করে এবং জুনে এলচিবে হুসেয়নভকে গ্রেপ্তার ও তার মিলিশিয়াকে নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে গাঞ্জায় সৈন্য প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদলের সঙ্গে ছিলেন আজারবাইজানি অ্যাটর্নি জেনারেল ইখতিয়ার শিরিনভ। আজারবাইজানি সৈন্যরা হুসেয়নভের মিলিশিয়ার কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং শিরিনভ তাদের হাতে বন্দি হন। শিরিনভ হুসেয়নভের চাপে এলচিবের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর হুসেয়নভ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো প্রায় বিনা বাধায় দখল করে নেন এবং নিজস্ব সৈন্যদল নিয়ে বাকু অভিমুখে অগ্রসর হন।
এই পরিস্থিতিতে ১৫ জুন আজারবাইজানি সরকার সঙ্কট নিরসনের জন্য আলিয়েভকে বাকুতে আসার আমন্ত্রণ জানায় এবং ১৮ জুন এলচিবে বাকু ছেড়ে পালিয়ে যান। ২৪ জুন আলিয়েভ আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি হুসেয়নভের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছান এবং হুসেয়নভকে আজারবাইজানের জাতীয় নিরাপত্তা, স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এর মধ্য দিয়ে হুসেয়নভের বিদ্রোহের অবসান ঘটে। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আলিয়েভ জয়ী হন। ১৯৯৪ সালের ১২ মে আলিয়েভ আর্মেনিয়ার সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদন করেন এবং এর মধ্য দিয়ে নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের অবসান ঘটে। অক্টোবরে হুসেয়নভ একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আজারবাইজানের শাসনক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং পরবর্তীতে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
আলিয়েভ, তুরস্ক এবং রাশিয়া
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের লক্ষ্য হচ্ছে বৃহত্তর তুর্কি মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত সকল জাতিকে একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসা এবং তুরস্ক ও আজারবাইজানের একত্রীকরণকে (কিংবা অন্ততপক্ষে উভয়ের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠ মৈত্রীকে) তারা এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করে। রুশ বিপ্লবের পর উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের শাসনাধীন ওসমানীয় রাষ্ট্র আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করে এবং একটি ওসমানীয়–আজারবাইজানি যৌথ সৈন্যদল বাকু দখল করে নেয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় রাষ্ট্রের পরাজয়ের পর উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের এই প্রকল্প সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তর তুর্কি প্রজাতন্ত্রগুলোর সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর তুর্কি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এক্ষেত্রে আজারবাইজানে আবুলফাজ এলচিবের ক্ষমতা লাভ ছিল তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
এলচিবে এবং তার দল ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’ ছিল তীব্র তুর্কিপন্থী ও রুশবিরোধী। এলচিবে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক যতদূর সম্ভব সীমিত রেখে তুরস্কের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী ছিলেন। নিজেকে ‘আতাতুর্কের সৈনিক’ হিসেবে ঘোষণাকারী এলচিবে ছিলেন একই সঙ্গে উগ্র আজারবাইজানি ও বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী এবং সম্প্রসারণবাদী। তার লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের আজারবাইজানি–অধ্যুষিত দেরবেন্ত থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি আজারবাইজানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। একই সঙ্গে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ ও তুরস্কের সমন্বয়ে একটি বৃহৎ তুর্কি ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনাও ছিল তার। তুরস্কের উগ্র জাতীয়তাবাদী দলসমূহ এবং তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
এজন্য এলচিবে ও ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’র ক্ষমতাচ্যুত হওয়াকে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা তাদের ‘বৃহৎ তুরান’ প্রকল্পের জন্য একটি বিরাট পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করে। এলচিবের উত্তরসূরী আলিয়েভ রিয়েলপলিটিক ও আর্মেনিয়ার সঙ্গে চলমান দ্বন্দ্বের কারণে তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন বটে, কিন্তু তার পররাষ্ট্রনীতি এলচিবের মতো উগ্র তুর্কিপন্থী ছিল না। আলিয়েভ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেন এবং তুরস্ক ও রাশিয়ার সঙ্গে আজারবাইজানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তিনি আজারবাইজানি আইনসভায় মন্তব্য করেছিলেন: আমাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাশিয়া একটি অত্যন্ত বৃহৎ রাষ্ট্র। নিঃসন্দেহে আজারবাইজান ও রাশিয়ার মধ্যেকার স্বাধীন নীতিভিত্তিক সম্পর্ক আরো ভালো, বিস্তৃত ও ফলপ্রসূ হওয়া উচিত। স্বাভাবিকভাবেই, এলচিবের মতো আলিয়েভ ‘বৃহত্তর তুর্কি ফেডারেশন’ গড়তে আগ্রহী ছিলেন না।
তদুপরি, আলিয়েভের অতীত ও তদানীন্তন কার্যক্রম তাকে তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের চক্ষুশূল করে তুলেছিল। সোভিয়েত শাসনামলে আজারবাইজানি কেজিবির সভাপতি ও ‘আজারবাইজান কোম্মুনিস্ত পার্তিয়াসি’র প্রথম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আলিয়েভ আজারবাইজানের অভ্যন্তরে বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের দমন এবং তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদের বিস্তার ঘটানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘পার্তিয়া কারকেরেন কুর্দিস্তানে’র (কুরমানজি কুর্দি: Partîya Karkerên Kurdistanê, ‘PKK’) সৃষ্টির পশ্চাতে আলিয়েভের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয় এবং এখন পর্যন্ত এই সংগঠনটি তুর্কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত।
সর্বোপরি, আলিয়েভ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন উগ্র তুর্কিপন্থী আবুলফাজ এলচিবে ও ‘আজারবাইজান খালক জাবহাসি’কে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে। তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা আলিয়েভের উত্থান ও এলচিবের পতনের পিছনে রুশ হস্তক্ষেপ দেখতে পাচ্ছিল। তাদের ধারণা ছিল, বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদকে রুখে দেয়ার জন্য রুশরা আজারবাইজানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগকে কাজে লাগিয়ে এলচিবেকে উৎখাত করেছে এবং আলিয়েভকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এলচিবে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি ও তার সমর্থকরা আলিয়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তুর্কি কর্মকর্তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশ ও তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে উৎসাহী ছিল। এর পাশাপাশি তুর্কি অপরাধ জগতের বেশ কিছু ব্যক্তিত্বও এই নিজস্ব স্বার্থে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশ, তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মিল্লি ইস্তিহবারাত তেশকিলাতি’ (তুর্কি: Millî İstihbarat Teşkilatı, ‘MİT’) ও তুর্কি পুলিশের বিশেষ বাহিনী ‘পোলিস ওজেল হারেকাত দাইরেসি’র (তুর্কি: Polis Özel Harekât Dairesi) কিছু কর্মকর্তা, তুর্কি উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ‘মিল্লিয়েতচি হারেকাত পার্তিসি’র (তুর্কি: Milliyetçi Hareket Partisi, ‘MHP’) আধা–সামরিক সংগঠন ‘উলকু ওজাকলারি’ (তুর্কি: Ülkü Ocakları) এবং তুর্কি অপরাধ জগতের কিছু সদস্য এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিল। পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল আলিয়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করে এলচিবেকে পুনরায় আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করা। তদানীন্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী তানসু চিলার এই পরিকল্পনা অনুমোদন করেন এবং ১৯৯৪ সালের শেষদিকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম আরম্ভ হয়।
(অবশিষ্ট অংশের জন্য ২য় পর্ব দেখুন)