ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ভিরিনিগদে অস্ট-ইন্ডিসচে কোম্পানি
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
তিনটি নাম দিয়ে আসলে একটি কোম্পানিকেই বোঝানো হয়। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ডাচ ভাষায় বলে ‘ভিরিনিগদে অস্ট-ইন্ডিসচে কোম্পানি’ বা ভিওসি (VOC)। কোম্পানির আরেক নাম ‘ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। কারণ নেদারল্যান্ডের সকল বড় বড় ব্যবসায়ী ও কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থে এক হয়ে একটি বড় কোম্পানি গঠন করেছিল। তাই উপরের নামগুলো আসলে একটি কোম্পানিরই ভিন্ন ভিন্ন নাম।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠার কারণ জানতে হলে ইতিহাসে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ১৬০২ সালে পর্তুগাল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে নেদারল্যান্ডের সাথে সকল প্রকার বাণিজ্যিক বন্ধন ছিন্ন করে। পর্তুগাল উচ্চমূল্যের জন্য তার উপনিবেশগুলোতে ঠিকমতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছিল না। স্পেনের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে পর্তুগিজদের ব্যবসায় ধ্বস নামে। এর সুযোগ নেয় নেদারল্যান্ডস। আর কিছুকাল পূর্বেই স্বাধীন হওয়া নেদারল্যান্ডসের জন্য অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে যাওয়া জরুরি ছিল। এভাবেই ১৬০২ সালে এক চার্টারের মাধ্যমে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই চার্টারের বলে তারা এশিয়ায় ২১ বছর মসলার একচেটিয়া ব্যবসা করার অধিকার লাভ করে।
আজকের দিনে সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর নাম উঠলে অ্যাপল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, গুগলের মতো কোম্পানিগুলোর নাম অবধারিতভাবেই আসবে। কিন্তু আপনি শুনে অবাক হবেন, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের কাছে এই তিনটি কোম্পানির সম্মিলিত মূলধনও কিছুই না। বর্তমান সময়ের হিসেবে কোম্পানির মূলধন ছিল ৭৯ ট্রিলিয়ন ডলার! ৭৯ ট্রিলিয়ন ডলার জাপান ও জার্মানির মোট জাতীয় উৎপাদনের সমষ্টির সমান!
আজ থেকে চারশো বছর আগেই এই কোম্পানি বিভিন্ন দেশে ৭০,০০০ লোককে নিয়োগ দিয়েছিল কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য, কল্পনা করা যায়? দু’শো বছরের ইতিহাসে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রায় ১০ লাখ মানুষকে এশিয়ায় পাঠিয়েছে। পুরো ইউরোপ মিলিয়েও এত মানুষকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়নি!
১৬০২ সালের চার্টার অনুযায়ী কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসার অধিকারের পাশাপাশি এশিয়ান শাসকদের সাথে চুক্তি করার, দুর্গ নির্মাণ করার, উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার, সেনাবাহিনী সাথে রাখার, প্রয়োজনে যুদ্ধ করার– মোটকথা মুনাফা ও ব্যবসা ঠিকঠাক রাখার জন্য যা যা করা দরকার, সব করার অধিকার লাভ করে।
১৬০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হলেও ডাচ বণিকরা পর্তুগিজ আধিপত্যকে টক্কর দিচ্ছিলেন এক দশক আগে থেকেই। ১৫৯৮ সালে এই সময়টিতে ডাচরা বেশ কিছু বাণিজ্যতরী এশিয়ায় প্রেরণ করে। এগুলোর মধ্যে জ্যাকব ভ্যান নেক এর জাহাজ সর্বপ্রথম ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। কিছু তরী প্রায় ৪০০ গুণ লাভ করে ফিরে আসে, যেটা ডাচ বণিকদের এশিয়ার প্রতি চরমভাবে প্রলুব্ধ করে।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গঠন কিছুটা জটিল প্রকৃতির। এটিই পৃথিবীর প্রথম যৌথমূলধনী বহুজাতিক কোম্পানি। অনেকেই বলে থাকেন আজকে অ্যাপল, মাইক্রোসফট প্রমুখ কোম্পানির পূর্বসূরি হলো ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
কোম্পানিতে দুই ধরনের শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। শেয়ারহোল্ডাররা একাধিক বাণিজ্যতরীতে বিনিয়োগ করতে পারতেন। তাই ব্যবসা করতে যাওয়া অনেকগুলো জাহাজের মাঝে কোনো জাহাজ ফিরে না এলে শেয়ারহোল্ডারদের পুঁজি একদম নিঃশেষ হয়ে যেত না। একজন ব্যবসায়ী চাইলে একই সময়ে শতাধিক জাহাজে বিনিয়োগ করতে পারতেন, যাতে তার মূলধন হারাবার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে আসে।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফলে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম পৃথিবীর বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিণত হয়। আমস্টারডামে পৃথিবীর প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানি গঠিত হওয়ার পর দ্রুতই তা এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়ায় তাদের প্রথম বাণিজ্য ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিম জাভার বান্টেনে। ডাচরাই একমাত্র বিদেশি শক্তি, যাদের জাপানে ব্যবসা করার অনুমতি ছিল। জাপানে তারা চিনি ও বস্ত্র রপ্তানি করতো, বিনিময়ে জাপান থেকে রূপা নিয়ে আসতো।
এশিয়ায় ডাচরা সবগুলো ঘাঁটি মিলিয়ে একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এই নেটওয়ার্কের কেন্দ্র বানানো হয় ইন্দোনেশিয়ার বাটাভিয়াকে (বর্তমানে জাকার্তা)। বাটাভিয়া ১৬১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন জেন পিটারসেন কোয়েন জাকার্তা পোর্ট দখল করেন। বাটাভিয়ায় ডাচরা একটি বিশাল দুর্গ স্থাপন করেন। এই স্থানটিকে তারা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেয়। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল এখান থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। এছাড়াও এখানে গভর্নর জেনারেলের বাসভবন স্থাপন করা হয়, যিনি এশিয়ায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে গণ্য হতেন।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে আলাদা করে জেন পিটারসেন কোয়েনের কথা বলতে হয়। ১৬১৪ সালের নভেম্বরে কোয়েন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি কোম্পানির যেকোনো স্বার্থে সেনাবাহিনীর ব্যবহারকে তীব্রভাবে সমর্থন করতেন। ইন্দোনেশিয়ার রাজপুত্রকে তিনি সবসময় স্থানীয় বিদ্রোহী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন। বিনিময়ে একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার আদায় করে নেন। ১৬১৪ থেকে ১৬১৮ সালের মাঝে তিনি মালাক্কায় লবঙ্গ ও বান্দুং দ্বীপপুঞ্জে জায়ফলের একচেটিয়া ব্যবসায়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলেন।
১৬৫৯ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শ্রীলঙ্কায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ডাচদের আগে পর্তুগিজরা এখানে ব্যবসা করতো। ১৬৫৯ সালের মধ্যেই পুরো শ্রীলঙ্কায় ডাচরা নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। পর্তুগিজরা শ্রীলঙ্কা থেকে বিতাড়িত হয়।
১৬৫২ সালে কোম্পানিটি উত্তমাশা অন্তরীপে (কেপ অব গুড হোপ) একটি মিলিটারি ক্যাম্প স্থাপন করে। এই স্থানটিতে ডাচ জাহাজগুলো প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়ার জন্য থামতো। এখানে পরবর্তীতে ডাচ উপনিবেশ গড়ে ওঠে, যেটাকে ‘কেপ কলোনি’ নামকরণ করা হয়।
কেপ কলোনিতে প্রথমে ডাচরা সাধারণ ব্যবসায়িক কোম্পানি হিসেবেই ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দাস ব্যবসার বিশাল সম্ভাবনা দেখে সেখানে কলোনি স্থাপন করতে মনোযোগী হয়। প্রথমদিকে সেখানে মাত্র দু’শো ডাচ ছিল, আর স্থানীয় ‘খোইখোই’রা ছিল সংখ্যায় প্রায় বিশ হাজারের মতো। ডাচদের ক্ষুদ্র উপস্থিতি খোইখোইরা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রসারের কারণে ডাচদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অপরদিকে দাসপ্রথার কারণে খোইখোইদের সংখ্যা কমতে থাকে।
১৬৬০ সালের দিকে ডাচদের সাথে খোইখোইদের প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, এ সুযোগে ডাচরা নিজেদের ফার্মের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ১৭১৩ সালে কেপ কলোনিতে গুটিবসন্ত হানা দেয়, খোইখোইরা গণহারে মারা যেতে থাকে। তাদের সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অবশ্য উপনিবেশগুলোতে কীভাবে ছোঁয়াচে রোগগুলো হানা দেয়, সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। স্থানীয় জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বারবার ভাইরাস বহনের মতো নির্মম পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া তাদের কর্মচারীদের পর্যাপ্ত বেতন দিতো না বলে অভিযোগ ছিল। কর্মচারীদের কোম্পানির চাকরির পাশাপাশি ব্যক্তিগত ব্যবসায় পরিচালনার অধিকার ছিল না। যেসব কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়ে তারা এশিয়ায় পাঠাতো তাদের বেতন এতই কম ছিল যে তারা বাড়িতে ফিরে ঠিকমতো পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করতে পারতো না। ফলে একসময় কর্মচারীরা বাড়তি আয়ের আশায় আকণ্ঠ দূর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়।
কোম্পানির আরেকটি বড় সমস্যা ছিল শেয়ারহোল্ডারদের আয়ের চেয়ে বেশি প্রদান করা। ১৭৩০ সালের পর থেকে এই নীতির কারণে তাদেরই চরমভাবে ভুগতে হয়। এর ফলে তাদের মূলধনে ঘাটতি দেখা দেয়। স্বল্পমেয়াদী ঋণের মাধ্যমে তারা ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৭৮০ সালের চতুর্থ অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। এ যুদ্ধের ফলে ডাচদের অর্ধেক জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। একদিকে যুদ্ধের ধকল, এবং অপরদিকে ভুল নীতি ও সীমাহীন দুর্নীতির জন্য চরম অর্থসংকটে নিপতিত হয় কোম্পানি।
আঠারো শতকের শেষ দিকে কোম্পানি দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায়। ১৭৯৯ সালে সালে ডাচ সরকার কোম্পানির চার্টার বাতিল করে এবং কোম্পানির সকল সম্পদ রাষ্ট্রীয়করণ করে ফেলে। এভাবে পরিসমাপ্তি ঘটে দু’শো বছর পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো এক ব্যবসায়িক কোম্পানির।
‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস’ নামের বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-