বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ নির্ধারণের জন্য বহুল প্রচলিত ক্যালেন্ডার হিজরি ক্যালেন্ডার। আরব দেশে উদ্ভব বলে আমাদের দেশে এটি আরবি ক্যালেন্ডার নামেই সাধারণের মাঝে বেশি প্রচলিত। জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তি নির্ভর নয় বলে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এই ক্যালেন্ডারের হিসাব সহজেই রাখতে পারত। প্রকৃতিনির্ভর অত্যন্ত সাদামাটা এই পঞ্জিকা কীভাবে চালু হলো, সে গল্পই আমরা করছিলাম এই সিরিজে। আজ রইল তার দ্বিতীয় পর্ব।
বর্ষগণনা কেন হিজরত থেকে শুরু?
আমরা পূর্বের আলোচনায় জেনেছি, আলী (রা)-এর প্রস্তাবে সহমত ব্যক্ত করে সবাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, নবগঠিত ইসলামি পঞ্জিকার ভিত্তিবর্ষ হবে হিজরতের বছর।
কিন্তু কেন? বর্ষগণনার ক্ষেত্রে হিজরত প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কী? অথচ মহানবী (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তিসহ আরো একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে সাল গণনা শুরু করা যেত। নিবন্ধের প্রথমদিকে কিছুটা আলোচনা অবশ্য হয়েছে। এখন একটু সবিস্তারে জানার চেষ্টা করব আমরা।
আমরা দেখেছি, হিজরি সন গণনার ক্ষেত্রে হিজরতের ঘটনাটি যখন আলী (রা) কর্তৃক প্রস্তাবিত হলো, তখন প্রায় সকলেই তাতে সম্মত হলেন। হিজরতের ঘটনা নিঃসন্দেহে ইসলামের ইতিহাসে এক মাইলফলক।
কিন্তু সন গণনার তো আরো অনেক অনুষঙ্গ ছিল। যেমন, কারো জন্মের ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে একটা সাল গণনা করা, কিংবা মহানবী (সা)-এর নবুয়ত প্রাপ্তি, মক্কা বিজয় অথবা নবীজীর ওফাত। বিশেষত, বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মকে কেন্দ্র করে সাল গণনার রেওয়াজ তো সে সময় ছিলই। যেমন, বর্তমান খ্রিস্টাব্দ সন, যা যিশুখ্রিস্টের জন্মকে কেন্দ্র করে গণনা করা হয়। কিন্তু, ইসলামি বর্ষপঞ্জির ক্ষেত্রে এতসব অনুষঙ্গ থাকতে কেন হিজরতের ঘটনাকে প্রাধান্য দেয়া হলো?
এ প্রশ্নের উত্তর আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) দিতে গিয়ে বলেন,
সুহাইলি (রহ.) এ বিষয়ে রহস্য উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম সাল গণনার বিষয়ে হিজরতকে প্রাধান্য দিয়েছেন সূরা তাওবার ১০৮ নম্বর আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে।
সেখানে প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। এই ‘প্রথম দিন’ আম বা ব্যাপক নয়। এটি রহস্যাবৃত।
এটি সেই দিন, যেদিন ইসলামের বিশ্বজয়ের সূচনা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরাপদে, নির্ভয়ে নিজ প্রভুর ইবাদত করেছেন। মসজিদে কূবার ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ফলে সাল গণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম সেই দিনকেই বেছে নিয়েছেন। [1]
আর অন্য উপলক্ষ কেন চূড়ান্ত বিবেচনায় স্থান করে নিতে পারেনি, সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি,
মহানবী (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, হিজরত ও নবুয়তপ্রাপ্তি- এ চার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করা যেত। কিন্তু জন্ম ও নবুয়তের তারিখ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য আছে।
আর মৃত্যু শোকের স্মারক। তাই অগত্যা হিজরতের মাধ্যমেই সাল গণনা শুরু করা হয়েছে।
তাহলে, চূড়ান্তভাবে ঠিক হয়- হিজরি ০১ সন গণনা করা হবে, যে বছর মহানবী (সা)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের বছর।
হিজরি সনের সূচনামাস
সন গণনা হবে কোন বছর থেকে, এ বিষয় মীমাংসা হবার পর এবার আলোচনা শুরু হয় প্রচলিত আরবি মাসগুলোর কোনটি দ্বারা বছর গণনা শুরু হবে, সে বিষয়ে। আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) রজব থেকে শুরু করার প্রস্তাব দেন। তাঁর যুক্তি ছিল, এটি চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে প্রথমে আসে।
প্রখ্যাত সাহাবি তালহা (রা.) রমজান থেকে শুরু করার কথা বলেন। কেননা, এটি বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। তবে, উসমান (রা.) প্রস্তাব করেন যে, মাস শুরু হোক মুহররম থেকে। অবশেষে, মুহররম থেকেই মাস গণনা শুরুর প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। [2]
ঐতিহাসিকভাবে, মহানবী (সা) যে দিন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে আসেন, সে দিন ছিল রবিউল আউয়াল মাস। ফলে, নতুন চালু হওয়া হিজরি সনের সূচনাটি ঐ দিন থকে আরো প্রায় দু’মাস এগিয়ে মুহাররম থেকে গণ্য করা হয়, যে সময় নবীজী (সা) মক্কাতে ছিলেন।
বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, মহানবী (সা)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালীন গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো নিম্নরূপ,
- ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর: মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন মহানবী (সা)।
- ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ৮ রবিউল আউয়াল: মদিনার পার্শ্ববর্তী স্থান কুবায় এসে পৌঁছেন।
- ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল: ইয়াসরিব বা মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন মহানবী (সা)।
অবশ্য গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে মেলাতে গেলে হিজরতের ঐ তারিখটি কোনটি, তা নিয়ে দুটি শক্তিশালী মত দেখা যায়।
একটি মত- আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণা অনুযায়ী, ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল থেকে ইসলামি হিজরি বর্ষপঞ্জি গণনা শুরু হয়। অর্থাৎ, আজ থেকে ১৩৯৯ (সৌর) বছর আগের সেই দিনটির তারিখ হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ছিল, ০১-০১-০১ (১লা মুহাররম, ০১ হিজরি)।
তবে আরেকটি অধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো, দিনটি ছিলো ১৫ জুলাই, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ।
নতুন পঞ্জিকা, পুরাতন মাস
উমার ফারুক (রা) যে নতুন পঞ্জিকা চালু করেছিলেন, তাতে কিন্তু সপ্তাহের নাম, মাসের নাম, কিংবা প্রচলিত তারিখ ইত্যাদি পুনর্বিন্যস্ত বা নবরূপে সংযোজিত হয়নি। বরং, চাঁদের উপর ভিত্তি করে আবহমানকাল থেকে গণনা করে আসা মাসগুলোকেই নতুন বর্ষপঞ্জিতে রাখা হয়েছে।
কারো কারো মতে, কেবল মুহাররম মাসটির নাম বদল করে দেয়া হয়েছে। প্রাক-ইসলামি যুগে মাসটি ‘সফরে উলা’ নামে অভিহিত হতো। নতুন হিজরি সনে কেবল বছরের সংখ্যাগুলো গণনা করা হয়েছে। তবে, প্রাচীনকালে আরবগণ এ মাসগুলোর সুনির্দিষ্ট ক্রম সব সময় মেনে চলত না।
তারা সৌরবর্ষ কিংবা ঋতু পরিক্রমার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে কোনো কোনো বছর অতিরিক্ত মাস জুড়ে দিত। এ মাসগুলোকে ইন্টারক্যালারি মাস বা মলমাস বলা হয়। নতুন হিজরি বর্ষপঞ্জিতে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এতে আরবীয় প্রকৃত মাসগুলোর সুসজ্জিত ক্রমকে স্থিরতা দেয়া হয়েছে।
নতুন বর্ষপঞ্জিতে মাসের সংখ্যা
যেটা বলছিলাম, নতুন বর্ষপঞ্জিতে নতুন কোনো মাস সংযোজিত হয়নি, কোনো মাস বিয়োজিত হয়নি, কিংবা কোনো মাস প্রতিস্থাপিতও হয়নি। আরবদেশে বহুল প্রচলিত মাসগুলোই ধারাবাহিকভাবে নতুন বর্ষপঞ্জিতে বিন্যস্ত হয়েছে। ফলে, নতুন হিজরি ক্যালেন্ডারে ১২টি মাসই রয়ে গেল।
মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে মাসের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে,
নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস ১২টি, এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ মাস; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।
[কুরআন, সূরা তাওবাহ, ০৯, আয়াত ৩৬]
মাসের ক্রমধারা
আরবদেশে প্রচলিত মাসগুলোকে আত্মীকরণ করার পাশাপাশি মাসগুলোর একটি সুসংহত ক্রম নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে এ পঞ্জিকায়। আগেকার দিনে আরবেরা এ ক্রম সবসময় অনুসরণ করত না, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য ও সৌরবর্ষের সাথে হিসেব মিল রাখার জন্য (এটাকে ইন্টারক্যালেশন বা নিবেশন বলা হয়) কখনো কখনো এর ব্যত্যয় ঘটাত।
কুরআনের একটি আয়াত থেকে সৌরবর্ষ ও চান্দ্রবর্ষের হিসাবের পার্থক্যটির নমুনার উদাহরণ পাওয়া যায়,
তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশো বছর, অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে।
[কুরআন; সূরা কাহাফ ১৮:২৫]
প্রতি ১০০ সৌর বছরে, চান্দ্র বছরে পার হয় ১০৩ তিন বছর, অর্থাৎ চান্দ্র বছরের গণনায় আরো তিন বছর অতিবাহিত হয়। সেই হিসেবে, ৩০০ সৌরবর্ষে অতিক্রম হয় অতিরিক্ত প্রায় নয় চান্দ্র বছর। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, সৌরবর্ষ হয় ৩৬৫ দিনে, আর চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ দিনে। ফলে, সৌরবর্ষ ও চান্দ্রবর্ষের মধ্যে ১১ দিনের পার্থক্য থেকে যায়। এর মানে দাঁড়ায়,
প্রতি ৩ সৌরবর্ষ = প্রতি ৩ চান্দ্র বর্ষ + ১ চান্দ্র মাস
তাই, সৌরবর্ষের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য প্রতি তিন চান্দ্রবর্ষের পর একটি অতিরিক্ত নিষ্ক্রিয় মাস পালন করা হয়, যা পরে গণনা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ফলে, চান্দ্রবর্ষের সাথে সৌরবর্ষের হিসেবের ভারসাম্য রক্ষা হয়। অতিরিক্ত ঐ মাসকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইন্টারক্যালারি মান্থ’। আর বাংলায় একে ‘অধিক মাস’ বা ‘অধিমাস’ বা ‘মলিন মাস’ বা ‘মলমাস’ ইত্যাদি বলা হয়। তবে, ‘মলমাস’ পরিভাষাই বেশি প্রচলিত। ভারতবর্ষের ক্যালেন্ডারেও এই ‘মলমাস’ সংযোজনের উদাহরণ খুবই সাধারণ।
আরব দেশের লোকজনও এরূপ মলমাস গণনা করত। ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে এরূপ মাস সংযোজনকে বর্জন করা হয়েছে। ফলে, হিজরি সন সর্বতোভাবেই একটি বিশুদ্ধ চান্দ্রসনে পর্যবসিত হয়েছে।
মলমাস বর্জন প্রসঙ্গে নিম্নের হাদিস প্রণিধানযোগ্য,
‘নভোমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন যে বিন্যাসে আল্লাহ তাআলা মাহকালকে বিন্যস্ত করেছিলেন, আবার সে বিন্যাসেই তা ফিরে এসেছে। বারোমাসে এক বছর, এর মধ্যে চারটি মাস মহিমান্বিত।’ [মুসলিম]
নীতিনির্ধারকদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে মুহাররম মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ হিসেবে, হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসগুলো হলো,
১) মুহাররম, ২) সফর, ৩) রবিউল আউয়াল, ৪) রবিউস সানি, ৫) জমাদিউল আউয়াল, ৬) জমাদিউস সানি, ৭) রজব, ৮) শাবান, ৯) রমজান, ১০) শাওয়াল, ১১) যিলক্বদ, ও ১২) যিলহজ্ব
আমাদের সমাজে এই বারোটি মাসকে ‘বারো চান্দ’ও বলা হয়ে থাকে। কেননা, চাঁদ দেখেই এই মাসগুলোর গণনা আরম্ভ হতো। আমরা এ সিরিজের পরের লেখায় জানার চেষ্টা করব, নব-প্রবর্তিত এই হিজরি ক্যালেন্ডারের অন্যান্য দিক সম্বন্ধে।