১৯৯৫ সালের ২০ মার্চ, টোকিওর সাবওয়েতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো ৫ জন লোক। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে নিলো তারা। অল্প সময়ের মাঝেই স্টেশনে ট্রেন এসে থামলো। লোকগুলো একে অন্যকে চোখের ইশারায় কী যেন বোঝালো, তারপর চুপচাপ হাতে থাকা জিনিসটি মেঝেতে রেখে ছাতার এক খোঁচায় তাতে ছিদ্র করে দিলো, দিয়েই হাঁটা দিলো তারা। ততক্ষণে সেই প্যাকেজ থেকে পুরো স্টেশনে ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত সারিন গ্যাস।
সেদিন ৫ জনের দলটির পরিকল্পিত এ আক্রমণে মারা যায় ১২ জন মানুষ, অসুস্থ হয়ে পড়ে সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি। পুরো দেশবাসী হতভম্ব হয়ে যায়, স্থবির হয়ে যায় টোকিওর জীবনযাত্রা। স্টেশনটি যেন সেদিন চেনাই যাচ্ছিল না। চারদিকে কেবল অসুস্থ মানুষ, হাসপাতালগুলো ভরে গিয়েছিল তাদের আর্তনাদে।
পরবর্তীতে জানা যায়, এর সাথে জড়িত ছিল জাপানের এক গুপ্তসংঘ, নাম তার অম শিনরিকো। এই অম শিনরিকোর কিছু বর্বরতার কাহিনীই তুলে ধরা হবে আজকের লেখার মধ্য দিয়ে।
১
১৯৮৯ সালের কথা। সুতসুমি সাকামতোর তখন একের পর এক সুখবর আসছে। তার স্ত্রী কিছুদিন আগে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন, আইনজীবী হিসেবে তার প্রসার ধীরে ধীরে বাড়ছিল, বিশেষ করে টোকিওর অম নামক এক গুপ্তসংঘের বিরুদ্ধে তার লড়াই তাকে সবার নজরে এনে দিচ্ছিল। সেই সাকামতোই একদিন সপরিবারে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। আর কোনো সন্ধানই পাওয়া যায় নি তার। পুলিশ অনেক খোঁজ করেছিল, কিন্তু সবই বিফলে যায়।
১৯৯৬ সালে আসা যাক। অম শিনরিকোর এক সদস্য তমোমাসা নাকাগাওয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অবশেষে সমাধান হয় সাকামতোর অন্তর্ধান রহস্যের। জানা যায়, সাকামতোর এহেন দুঃসাহসে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল অমের উচ্চপদস্থ নেতৃবৃন্দ। তাই তাকে নৃশংসভাবে খুনের মধ্য দিয়েই সবকিছুর সমাপ্তি টানতে চেয়েছিল তারা।
প্রথমে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে সাকামতোকে খুন করা হবে। কিন্তু সেদিন সরকারি ছুটি পড়ে যাওয়ায় অমের পক্ষ থেকে ৬ জন লোক বেরিয়ে পড়ে সাকামতোকে তার বাসাতেই খুনের উদ্দেশ্যে। রাত তখন আনুমানিক ৩টা, সাকামতো এবং তার স্ত্রী গভীর ঘুমে মগ্ন। এমন সময়ই ঘরে ঢুকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় আইনজীবীকে। এরপর তার স্ত্রীকে পেটাতে পেটাতে আধমরা করে তাকেও একই কায়দায় খুন করা হয়। বাবা-মায়ের মতো নির্মম মৃত্যু নেমে আসে নিষ্পাপ শিশুটির ভাগ্যেও। লাশ তিনটি পরবর্তীতে দূরে এক গ্রামে ড্রামে ভরে রেখে আসে তারা। এভাবেই দুনিয়ার বুক থেকে হারিয়ে যায় সাকামতোর নাম-নিশানা।
২
অমের নেটওয়ার্ক ছিলো বেশ বড়। বিশাল বড় সেই সংগঠনটি চালাতে তাই খরচও পড়তো অনেক। এ খরচ যোগাতে তারা মূলত ভীতি প্রদর্শনের পথকেই বেছে নিয়েছিল। কোনো শহরে কার্যক্রম পরিচালনার আগে তারা খবর ছড়িয়ে দিত যে, অম সেখানে তাদের কাজ শুরু করতে চাচ্ছে। যদি নগরবাসী সেটা না চায়, তাহলে তারা যেন অমকে কয়েক লাখ ডলার চাঁদা প্রদান করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সেটা পেয়েও যেত। এছাড়া নিয়মিত বিভিন্ন সভা এবং সদস্যদের পদমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অনুষ্ঠিত আচারগুলোর জন্যও সদস্যদের কাছ থেকে অনেক অর্থ নেয়া হতো।
তবে সবচেয়ে বেশি করা হতো অপহরণ। এজন্য্য তারা তাদের সদস্যদের নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদ করতো। যদি কারো ধনী আত্মীয় থাকতো, তাহলে সেই সদস্যকে নিয়মিত চাপ দেয়া হতো যেন সেই আত্মীয়কে অপহরণ করে তার কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করা যায়। এমনকি একবার দুই মেয়ে তাদের বাবাকে পর্যন্ত অপহরণ করে ৬ কোটি ইয়েন আদায় করেছিল। ১৯৯৫ সালে সংগঠনটির কোষাগারে ১.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার ছিল বলে জানা যায়।
৩
১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পুলিশ বাঞ্জাওয়ার্ন খামারবাড়িতে অভিযান চালায়। সেটাও ছিল অমেরই এক আস্তানা। সেখানে পুলিশ অনেকগুলো ভেড়ার দেহাবশেষ খুঁজে পায়। পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেই ভেড়াগুলোর উপর সারিন গ্যাস নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়েছিল। পরবর্তীতে সেখানে পুলিশ আরো ভয়াবহ সব রাসায়নিক অস্ত্রের সন্ধান পেতে শুরু করে। আসলে সেখানে অম শিনরিকো ভয়াবহ বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরির কাজ চালাচ্ছিল।
১৯৯৩ সালে এ খামারবাড়িটি কিনে নেয় অম। এরপর থেকেই সেখানে তাদের পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়। সেই বছরেরই ২৮ মে তারা ভয়াবহ এক বোমার পরীক্ষা চালায় যার শব্দ কয়েক মাইল দূর থেকেও শোনা গিয়েছিল। এমনকি সেখানে পাওয়া ইউরেনিয়ামের সক্রিয় খনি থেকে ধারণা করা হয় যে, অম শিনরিকোর কাছে হয়তো পারমাণবিক অস্ত্রও আছে, তবে এ ব্যাপারে পুলিশ পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
৪
১৯৯০ সালের এপ্রিল মাস থেকে নিয়মিতভাবেই বড় ধরনের কোনো হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করে আসছিল অমের নেতৃত্বস্থানীয় অপরাধীরা। সেই বছরের এপ্রিলে তারা ভ্যানে করে বটুলিনাম বিষ স্প্রে করে ছড়িয়েছিল টোকিওতে। সৌভাগ্যক্রমে ব্যাকটেরিয়ার সেই প্রকরণটি তুলনামূলক কম ক্ষতিকর ছিল। ২ বছর পরে তারা আক্রমণ চালায় অ্যানথ্রাক্স স্প্রে করার মাধ্যমে। যদি তাদের হামলা সফল হতো, তাহলে মারা যেত হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু সেবারও কৌশলগত ভুলের কারণে তেমন কোনো ক্ষতিই হয় নি।
এরপরও থেমে যায় নি অমের সদস্যরা। ১৯৯৪ সালে মাৎসুমোতো শহরে তারা হামলা চালায় সারিন গ্যাস দিয়ে। সেবার মারা গিয়েছিল ৮ জন মানুষ, আহত হয় কম করে হলেও ৫০০ জন।
৫
শত্রুকে শেষ করে দিতে ভয়াবহ সব উপায় বেছে নিত অম শিনরিকো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা নার্ভ এজেন্ট ভিএক্স তৈরি করেছিল। এটা এমনই শক্তিশালী যে, এর সামনে কিছুক্ষণ আগে আলোচনা করা সারিনও কিছু না। কারো শরীরে এটা প্রবেশ করালে অ্যান্টিডোট দেয়ার মতো সময়ও পাওয়া যাবে না। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে ভিএক্স ব্যবহার করে ১০ জনের মতো মানুষকে শেষ করে দিয়েছিল গুপ্তসংঘটি। মাত্র ১ জন বেঁচে গিয়েছিল; টানা ৪৫ দিন হাসপাতালে থাকার পর সেই লোকটি চিরতরে কোমায় চলে যায়।
অনেককেই অপহরণের পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে খুন করা হতো। তারপর মৃতদেহটি অমের মাইক্রোওয়েভ অভেনে ভস্মীভূত করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো সেই ছাই, যাতে কেউই তার সন্ধান পেতে না পারে! টোকিও সাবওয়েতে হামলার পর পুলিশ যখন অমের আস্তানায় অভিযান চালায়, তখন তারা সেখানে ৮টি এমন মৃতদেহের ভস্মের সন্ধান পেয়েছিল।
৬
অম তাদের সোনালী সময়টা দেখেছে ১৯৯৫ সালের দিকে। সে সময় তাদের সদস্য সংখ্যা ছিলো ৫০,০০০ এর কাছে। এদের এক বিরাট অংশ বাস করতো রাশিয়ায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এদের মাঝে ক্ষমতাধরদের সংখ্যাও ছিল অনেক, যা বেশ শক্তিশালী করে তুলেছিল অম শিনরিকোর হাত দুটো।
অর্ধ দশকেরও কম সময়ের মাঝে তারা মস্কোতে নিজস্ব মতাদর্শে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে। এমনকি তারা কোম্পানি চালু করার কথাও ভেবেছিল, যাতে সেখানকার কর্মীদের ব্রেইনওয়াশ করে তাদেরকেও অমের অংশে পরিণত করা যায়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তারা ভ্লাদিভস্তক থেকে নিজেদের মতবাদ প্রচার করে রেডিও সম্প্রচারও শুরু করে দেয়। এমনকি মিলিটারি অ্যাটাক হেলিকপ্টারও আছে তাদের।
৭
টোকিওর সাবওয়েতে হামলার জাপান জুড়ে পুলিশ অমের আস্তানায় অভিযান চালাতে শুরু করে। অমের সদস্যদের ধরার পাশাপাশি তাদের কাছে সারিনের মতো থাকা অন্যান্য ভয়াবহ অস্ত্র জব্দ করাই ছিল এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। তবে খুঁজতে গিয়ে তারা যা পেল তাতে জাপানী পুলিশের আক্কেল গুড়ুম হবার দশা হয়েছিল।
অমের বিভিন্ন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে পাওয়া গিয়েছিল টনের পর টন সারিনের অস্তিত্ব। শুধু তা-ই নয়, তাদের ৮০ জনের মতো সদস্যের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল যারা সোডিয়াম সায়ানাইড, মাস্টার্ড গ্যাস, ফসজিন গ্যাস, টাবুন এবং ভিএক্স বানাচ্ছিল। সবগুলোই সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। এ তো গেলো কেমিক্যাল ওয়েপনের কথা। পাশাপাশি অ্যানথ্রাক্স, ইবোলার জীবাণু দিয়ে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বানানোর কাজটিও তারা করে যাচ্ছিল সমান তালে।
আস্তে আস্তে অমের বিস্তৃত জাল সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে টোকিও পুলিশের। তারা একে-৪৭ বানানোর কাজে হাত দিয়েছিল, নিজস্ব প্যারামিলিশিয়া বাহিনীর থাকার বন্দোবস্ত করতে বানাচ্ছিল এপার্টমেন্ট, এমনকি কোথাও থেকে ড্রোন সংগ্রহ করে সেটায় কিছুটা পরিবর্তন এনে এমন ব্যবস্থা করেছিল যাতে সেখান থেকে নার্ভ এজেন্ট স্প্রে করে গণহত্যা চালানো যায়!
৮
শুরুতে টোকিওর সাবওয়েতে যে হামলার কথা বলা হয়েছে, ওটা আসলে অমের জন্য একটা ‘ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ’ বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কারণ এরপর তারা নেমেছিল আরো বড় হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে। ১৯৯৫ সালের ৫ মে তাদের দুজন কর্মী সায়ানাইডের ব্যাগ শিঞ্জুকু স্টেশনের রেখে চলে যায়। বোম বিষ্ফোরিত হয়ে সেই সায়ানাইড ছড়িয়ে পড়লে অন্তত ১০,০০০ লোকের জীবননাশ হতে পারতো।
তবে এখানেই ঘটে যায় সবচেয়ে অলৌকিক ঘটনাটি। কী মনে করে স্টেশন পরিষ্কারের দায়িত্বে থাকা এক মহিলা ব্যাগটি দেখে সেটি হাতে করে অন্য জায়গায় রেখে আসেন। তার এই টানাহেঁচড়ার ফলে বোমের টাইমিং মেকানিজম ঠিকমতো কাজ করে নি। তারপরও যখন টাইম কাউন্ট জিরোতে নেমে এসেছিল, তখন ব্যাগটিতে বিষ্ফোরণের পরিবর্তে আগুন ধরে যায়। এই আগুনই সায়ানাইড ছড়িয়ে দিতে পারতো। তবে আরেকজন এই আগুন দেখে সাথে সাথেই তা নেভানোর ব্যবস্থা করলে সেই সম্ভাবনাও নাকচ হয়ে যায়, রক্ষা পায় হাজার হাজার প্রাণ। পরেও অম আবার একই প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, আবারো সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
১৯৯৫ সালেই একে একে কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল ওয়েপনের ল্যাবরেটরি, অস্ত্রশস্ত্র জব্দের মতো ঘটনাগুলো অমকে আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হতে বাধ্য করে। প্রায় ৩০ জন সদস্যের মৃত্যু ও ৬,০০০ এর কাছাকাছি সদস্য আহত হবার পর অবশেষে মনে হতে থাকে, অম বুঝি এবার তবে ক্ষান্ত হলো। কিন্তু আসলেই কি তা-ই!
৯
অম শিনরিকো আজ নিজেদের পরিচয় দেয় ‘আলেফ’ নামে। তারা আবারও নিজেদের সংগঠিত করছে। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে টোকিও পুলিশ জানিয়েছিল, আলেফের তৎকালীন সদস্য সংখ্যা ১,৩০০ এর কাছাকাছি। এছাড়া প্রতি বছর আরো নতুন ২০০ জনের মতো আসছে তাদের দলে।
নাম পাল্টালেও কাজের ধরণ আজও পাল্টায়নি। আজও কর্মীদের ব্রেইনওয়াশ চলছে, চলছে আত্মীয়দের জোর করে সংঘে নাম লেখানোর মতো কাজকারবার। ২০০০ সালের আলেফের বেশ করেকজন সদস্য বিভিন্ন নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের উপর তথ্য সংগ্রহ করার সময় গ্রেফতার হয়। ২০০১ সালে আলেফের আরো কয়েকজনকে আটক করা হয়, যারা পরিকল্পনা করছিল রাশিয়ায় বোমা হামলার।
১৯৯৫ সালে টোকিওর সারিন হামলার শিকার হওয়া মানুষগুলোকে আজও ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়। তাদের বিশ্বাস, মূলধারার গণমাধ্যম অম শিনরিকোর ব্যাপারে কোনো খবর প্রকাশ না করলেও গুপ্ত সংঘটি আসলেই সংঘটিত হচ্ছে, আগের চেয়ে আরো ভয়াবহ হামলার উদ্দেশ্যে।
ফিচার ইমেজ- Huffington Post