পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসে নারী শাসক বিরল। কিন্তু যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন, যোগ্যতার ছাপ রেখে ইতিহাসে অমলিন থেকেছেন। সেমিরামিস তাদেরই একজন। নব্য অ্যাসিরিয় শাসনামলে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে সেমিরামিস একাই শাসন করেছিলেন বিশাল সাম্রাজ্য। তার পাঁচ বছরের শাসনকাল ইউফ্রেতিসের স্রোতে মুছে যায়নি। বরং আজ পর্যন্ত তাকে ইতিহাসে প্রভাবশালী করে রেখেছে। অবশ্য একথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে কল্পকথারও অভাব নেই।
পর্যাপ্ত তথ্য না পাওয়া যাওয়ায় এখনো অনেকের কাছে রহস্যময়ী হয়ে আছেন তিনি। তিনি একজন সফল নারী শাসক নাকি দেবতার পরিত্যক্ত, ঘুঘু পাখির পালিত আর ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের নির্মাতা- সেই রহস্য এখনো টানে মানুষকে। তখনকার দিনে গল্পগুলো ছড়াত মুখে মুখে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে গল্পের চরিত্রের নামও বদলে যেত। সাহিত্যিকগণ নিজেদের মনমতো নাম ব্যবহার করেছেন সেমিরামিস ও তার পরিবারের গল্প লেখার সময়। ধারণা করা হয়, তার আসল নাম সামু-রমত। মৃত্যুর শত শত বছর পর থেকে গ্রিসের লেখক আর ঐতিহাসিকগণ তাকে আর তার আমলের অর্জন নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তারাই মূলত তার নাম বদলে রাখেন সেমিরামিস। তারপর তাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার ডালপালা থামানো যায়নি। কোনো কবির বিয়োগান্তক প্রেমের কবিতায় তিনি কুহকিনী সুন্দরী। কারোর গল্পে আবার তিনিই হলেন অফুরন্ত সামরিক শক্তির অধিকারী।
হাজার বছর পরেও তার আকর্ষণ যে বিন্দুমাত্র কমেনি, তার প্রমাণ ইতালীয় কবি দান্তে। তিনি ‘ইনফার্নো’তে সেমিরামিসকে যৌন অপরাধের দায়ে শাস্তি দিয়েছেন। ফরাসি লেখক ভলতেঁয়ার সেমিরামিসকে নিয়ে লিখেছিলেন বিয়োগান্তক নাটক। তাহলে সেমিরামিসের পেছনে এই সামু-রমত আসলে কেমন ছিলেন? হাজার হাজার বছর আগে কী এমন অর্জন করেছিলেন যে তাকে ঘিরে তৈরি কল্পকথা পুরো পৃথিবীকে বিমোহিত করে রেখেছে?
রক্ত-মাংসের সেমিরামিসের ইতিহাস ধোঁয়াশায় ভরা। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ দীর্ঘদিনের সন্ধানের পর চারটি ব্যবহৃত দ্রব্য ও ভাস্কর্য আবিষ্কার করেন, যা থেকে সেমিরামিসের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব ছিল। প্রাচীন শহর নিমরুদে (বর্তমান ইরাক) পাওয়া জ্ঞান ও লেখার দেবতা ‘নাবু’কে উৎসর্গ করা দুটি মূর্তিতে সামু-রমতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া দুটি স্টালির (বিশেষ ধরনের পাথরের স্তম্ভ, যাতে কারোর জীবন সম্পর্কিত বর্ণনা লেখা বা খোদাই করা থাকে) একটি পাওয়া যায় বর্তমানে তুর্কির একটি শহর কিজকাপানলি থেকে। অন্যটি পাওয়া যায় ইরাকের আশুর শহরে।
এই চারটি আবিষ্কার থেকে সেমিরামিসের সময়কালের মোটামুটি ধারণা করা যায়। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম ও নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ে অ্যাসিরিয় সম্রাজ্যে বাস করতেন তিনি। তার স্বামী ছিলেন রাজা পঞ্চম সামসি আদাদ, শাসনকাল ৮২৩ থেকে ৮১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সেমিরামিসের সন্তান রাজা তৃতীয় আদাদ নিরারি। তাকে নিয়ে এই প্রাথমিক তথ্যগুলো পাওয়ার পর ইতিহাসে তার গুরুত্ব বুঝতে পারেন ঐতিহাসিকগণ। সেমিরামিস আসিরীয় সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এক ক্রান্তিকালে। তার স্বামী সামসি আদাদ ছিলেন আসিরীয় সাম্রাজ্যের মহান শাসক দ্বিতীয় অশুর্নাশিরপালের পৌত্র। তিনি নিমরুদে বিশাল এক প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। খোদাই করা পাথরের তথ্যমতে, এই প্রাসাদে দশদিন ধরে চলা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ ভুরিভোজ করেছিল। দ্বিতীয় অশুর্নাশিরপাল সাম্রাজ্যের সব বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই ছিলেন নিষ্ঠুর এক সম্রাট। তার বর্ণনায় পাওয়া যায় বিভিন্ন রাজ্যের রাজারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। কোথাও কোথাও বিদ্রোহ সংগঠিত হয়ে উঠছিল। বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নগরের প্রধান ফটকের কাছেই একটি বিরাট স্তম্ভ বানান। তারপর বিদ্রোহী নেতাদের চামড়া শরীর থেকে ছাড়িয়ে সেই স্তম্ভ ঢাকেন। অনেককেই তিনি শূলে চড়ান।
তার বংশধর পঞ্চম সামসি আদাদের সাম্রাজ্য অনেক স্থিতিশীল ও সম্পদশালী হবে বলে আশা করা গেলেও তা হয়নি। সম্ভবত তিনি সিংহাসনের দাবিদার বড় ভাইয়েদের হারিয়ে দিতে অনেক অর্থ খরচ করে ফেলেছিলেন। ৮১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সামসি আদাদ যখন মারা যান তার সাম্রাজ্য তখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়েছে। সন্তান আদাদ নিরারি তখনও সাম্রাজ্যের ভার নেওয়ার মত যথেষ্ট বড় হয়ে ওঠেনি। ওদিকে বিদ্রোহীরা যেকোনো সময় হামলে পড়তে পারে ক্ষমতার জন্য, সেই আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। সাম্রাজ্যের এই সংকটের দিনে নিজের প্রতিনিধিত্ব দিয়ে হাল ধরেছিলেন সেমিরামিস। যদিও খোদাই করা পাথরের বর্ণনায় তার প্রতিনিধিত্ব পাওয়া কীভাবে সম্ভব হয়েছিল তার বর্ণনা নেই, কিন্তু বর্ণনা থেকে এটুকু স্পষ্ট হয় যে, তার যুগের অন্য নারীদের থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য শাসনের যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন ক্রমেই। যেমন কিজকাপানলি থেকে পাওয়া স্টালিতে বর্ণিত আছে যখন তার সন্তান নিরারি ইউফ্রেতিস নদী পার হয়ে আরপদ নগরের বিদ্রোহী রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, সেখানে সেমিরামিস উপস্থিত ছিলেন। নিঃসন্দেহে তার এই উপস্থিতি তার সময়ের নারীদের জন্য একদমই অস্বাভাবিক। স্টালিতে তার এমন উপস্থিতিই প্রমাণ করে সাম্রাজ্যে সেমিরামিসের মর্যাদা ঠিক কতখানি। আশুরের স্টালি বর্ণনা করে আদাদ নিরারি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই সেমিরামিস তার প্রজাদের ভেতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। বর্ণনাগুলো তাকে প্রায় পুরুষ শাসকের সমকক্ষ মর্যাদা দিয়ে বর্ণনা করেছে।
সেমিরামিস বা সামু-রমতের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে অজস্র গল্প রচিত হয়। আর সেকালের গল্পগুলো এক মুখ থেকে অন্য মুখে ঘোরার সময় নিজের বাস্তবের সাথে কল্পনার মিশেলে পরিণত হতো। খ্রিস্টপূর্বাব্দ পঞ্চম শতকে হেরোডটাস সামু-রমতকে সেমিরামিস নাম দেন। গ্রিক লেখক ডিওডোরাস সিকুলাস সেমিরামিসের কিংবদন্তিগুলোকে আরো মজবুত করে তোলেন। তিনি তার লেখায় সেমিরামিসের সূক্ষ্ম বর্ণনা করেন। তার মতে, সেমিরামিসের জন্ম হয়েছিল আশকেলনে (বর্তমান ইসরায়েল)। সিরীয় দেবী দারসেটো এবং এক সিরীয় যুবার সম্পর্কের পরিণতি সেমিরামিস। কিন্তু দেবী এই সম্পর্ক নিয়ে লজ্জিত হয়ে শিশুকন্যাকে পরিত্যাগ করেন। তারপর আত্মহত্যা করেন। তাকে ঘুঘু পাখিরা দেখাশোনা করতে থাকে। তারপর একদিন হারিয়ে যাওয়া মেষ খুঁজতে গিয়ে তাকে খুঁজে পায় অ্যাসিরিয়ার রাজার প্রধান মেষপালক। তিনি শিশুটিকে নিজের মেয়ের মতো বড় করতে থাকেন। নাম দেন সেমিরামিস।
সেমিরামিস অপরূপ সুন্দরী হয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। একদিন রাজকীয় গভর্নর ওনেস পরিদর্শনে এসে সেমিরামিসের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়েন। পালক পিতাকে রাজি করিয়ে বিয়ে করেন সেমিরামিসকে। তারপর স্ত্রীকে নিয়ে যান নিনভেহ শহরে। সুখেই ছিল ওনেস-সেমিরামিস। একদিন মধ্য এশিয়ার শহর ব্যাক্ট্রা দখল করতে পাঠানো হল ওনেসকে। তিনি স্ত্রীকেও সঙ্গে নিলেন। সেমিরামিস তখন থেকেই স্বামীর সাথে প্রত্যন্ত গ্রামে ঘোরার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার যুদ্ধকৌশলের কারণেই ব্যাক্ট্রা নতিস্বীকারে বাধ্য হয়। আসারিয়ার রাজা এই চমকপ্রদ খবর পেয়ে সেমিরামিসকে নিজ চোখে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেন। সেমিরামিসকে দেখে তার রূপে অভিভূত হয়ে পড়েন। ডিওডোরাসের মতে রাজার নাম ছিল নিনাস। নিনাস ওনেসকে প্রস্তাব দেন যেন ওনেস কোনো একজন রাজকুমারীকে বিয়ে করে নিজের স্ত্রীকে নিনাসের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু বীর নিনাস এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নিনাস প্রত্যাখ্যাত হয়ে থেমে যাননি। ওনেসের উপর একের পর এক হুমকি নেমে আসে। শেষপর্যন্ত ওনেস আত্মহত্যা করে। ভাগ্যের উপহাসে সেমিরামিস নিনাসকে বিয়ে করে অ্যাসিরিয়ার রানী বনে যান। তাকে বিয়ের কয়েক বছর পর নিনাস মারা যান। ঠিক এখানেই ইতিহাস আর রূপকথা মিলে যায়।
সেমিরামিস নিজের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের প্রতিনিধি হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। গ্রিক ঐতিহাসিকগণের মতে নতুন রানী তার মৃত স্বামীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য আর রাজ্যের সম্মান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নতুন নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। ইউফ্রেতিস নদীর তীরে নতুন শহর ব্যাবিলন তৈরি করার আদেশ নাকি তিনিই দিয়েছিলেন। ডিওডোরাস বলেন, সেমিরামিস শুধু শহর তৈরি করেই থেমে থাকেননি। রাজকীয় প্রাসাদ, মারদূকের মন্দির, নগরের প্রাচীর ও তার আদেশেই তৈরি। অনেক লেখক আবার দাবি করে বসেন, তিনি নির্মাণ করেছিলেন নেবুচাঁদনেজারের নামে খ্যাত সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত উদ্যান। এরপর সেমিরামিস তার সেনাবাহিনী নিয়ে পারস্য আর লিবিয়া আক্রমণ করেন। সবচেয়ে বড় সাহসিকতার পরিচয় দেন ভারত আক্রমণ করে। কিন্তু এই সাহস তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। মিশরে রানী ভবিষ্যদ্বাণী শুনেছিলেন, তার পুত্র নিনিয়াস তাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করবে। ভারত আক্রমণের পর সেমিরামিস এই কথার সত্যতা টের পেয়েছিলেন। ডিওডোরাসের বর্ণনায় যদিও তার ছেলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, সেমিরামিস কৌশলেই বিদ্রোহের পূর্বে ছেলেকে সাম্রাজ্য সঁপে দেন।
একেকজনের গল্পের শেষটা আবার একেকরকম। প্রথম শতকের ঐতিহাসিক জুলিয়াস হাইগিনাস বলেন, রানী চিতার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন। অপরদিকে তৃতীয় শতকের রোমান ঐতিহাসিক বলেন যে সামু-রামতের পুত্রই তাকে হত্যা করেছিল। ইতিহাসের সামু-রামত থেকে গল্পের সেমিরামিস হয়ে ওঠাটা আর দশটি কল্পকথার মতোই ছিল। যেহেতু ওই সময়ে নারী শাসক পাওয়া যেত না, তাই একজন নারী স্বর্গীয় না হলে নিশ্চয়ই এত বড় সাম্রাজ্য চালাতে পারবে না। সাথে সাথে তাকে হতে হবে অপরূপ সুন্দরী এবং ছলনাময়ী। এসব চিন্তাভাবনাই একজন রক্তমাংসের শাসককে কিংবদন্তি করে তুলেছে।
ফিচার ইমেজ: National Geographic