প্রায় কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ গিরিপথ পেরিয়ে ক্লান্ত গাধাগুলো মরুর বুকে নিজেদেরকে সমর্পণ করে দিলো। মাথার উপর প্রজ্বলিত সূর্য যেন তার সব তেজ ঢেলে দিয়েছে জর্ডানের সেই দুর্গম গিরি অঞ্চলে। সূর্যের তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মরুভূমির শুকনো বালি। কিছুক্ষণ পর পর পানি পান না করলে তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই মুসাফির শেখ ইব্রাহিম বিন আবদুল্লাহর। তিনি তাকিয়ে আছেন তার সামনে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল স্তম্ভের দিকে। প্রাণহীন নিশ্চুপ মরুপ্রান্তরে যেন এক অদ্ভুত কাব্যের রচনা করে দিয়েছে সেই স্তম্ভগুলো। তার সফরসঙ্গী একজন স্থানীয় পথপ্রদর্শক। ওয়াদি মুসা উপত্যকার প্রতিটি স্থানের সাথে তার বাল্যকাল থেকে পরিচয়। তার সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলে উঠলেন,
“শেখ! এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত হবে না। আবহাওয়া বড্ড খারাপ। সূর্যাস্তের আগে চলুন আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেই”।
কিন্তু শেখ ইব্রাহিম আর এক পা-ও নড়তে চান না। পথপ্রদর্শক বেদুইন অবাক হয়ে যান। আজ সন্ধ্যার আগে শেখ নিজের মানত পূর্ণ করার লক্ষ্যে নবী হযরত হারুন (আ) এর সমাধিক্ষেত্রে একটি ছাগল কুরবানি করবেন। দেরি করলে বড্ড ঝামেলায় পড়তে হবে। তিনি পুনরায় শেখকে ডাকলেন। শেখ একবার মাথা ঘুরে তাকালেন। সামান্য মুচকি হাসি দিয়ে ফের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সুউচ্চ স্তম্ভগুলো দিকে। তিনি আর কোথাও যেতে রাজি নন। বোকা বেদুইনের অলক্ষ্যেই তিনি পৌঁছে গেছেন তার গন্তব্যস্থলে। বহু বছরের অধরা পেত্রার রহস্য তার হাতে ধর্ণা দিয়েছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা শেখ তিনি নন।
সবচেয়ে মজার কথাটি চুপিচুপি বলি। হারুনের সম্মানে কুরবানীর পুরো ব্যাপারটি ছিল একটি নির্জলা মিথ্যামাত্র। বাস্তবে তিনি একজন অভিযাত্রী। যার সন্ধানী চোখের ক্ষুধা নিবারণের রসদ লুকিয়ে আছে পেত্রার দুর্লভ ঐশ্বর্যে! আমাদের আজকের প্রবন্ধে পেত্রা আবিষ্কারের সেই রোমাঞ্চকর অভিযানের ঘটনা বর্ণিত হবে।
আমি পেত্রা বলছি
পৃথিবীর ইতিহাসে পেত্রা একটি রহস্যের নাম। সুপ্রাচীন এই নগরীর অন্তরে লুকিয়ে আছে হাজারো ঐতিহাসিক নিদর্শন, যার মাত্র ১৫% ইতিহাসবিদগণ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রাচীনকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী পেত্রা যেন হঠাৎ করে কালের অতল গহ্বরে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়ে যায়। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে জেনে নিতে হবে পেত্রা সম্পর্কে।
জর্ডানের দুর্গম মরুপ্রান্তরে অবস্থিত পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে পেত্রা নগরীর অবস্থান। পেত্রা নগরীর নামকরণের সাথে গ্রিক শব্দ ‘পেত্রা’-র মিল পাওয়া যায়, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘পাথর‘। সেই অনুযায়ী পেত্রার নাম ‘পাথুরে শহর’। বাস্তবিক অর্থেও পেত্রাকে পাথরের নগরী বলা হয়ে থাকে, কারণ পেত্রা নগরীর সীমানা ঘিরে আছে লালচে পাথরশিলার বেষ্টনী। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভূক্ত পেত্রার বুকে দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে মন্দির, সমাধিক্ষেত্র, ভাস্কর্য, সৌধ, ওবেলিস্ক এবং হাজারো ধর্মীয় স্থাপনা। জর্ডান সাম্রাজ্যের অধীনে পেত্রার যাত্রা শুরু হলেও ৩য় শতাব্দীতে তা রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। নাবাতিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে পেত্রাকে জর্ডানের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো।পেত্রা নগরীর প্রবেশদ্বার অত্যন্ত দুর্গম। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ গিরিপথ পেরিয়ে তবেই দেখা মিলবে এই রহস্যময় নগরীর। শহরের প্রথমেই যে স্থাপনাটি আপনার নজরে পড়বে, সেটির নাম ‘আল-খাজনেহ’। এটি পেত্রা নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কোষাগার ছিল। কিন্তু অনেকে এই তথ্যটি ভুল বলে দাবি করেন। তাদের মতে, আল-খাজনেহ একটি স্মৃতিসৌধ ব্যতিত আর কিছু নয়।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পেত্রা নগরীকে ঘিরে ইতিহাসবিদগণের আগ্রহের কারণ কী? ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে জানা যায়, প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে নাবাতিয়ান শাসনামলে পেত্রার মতো অত্যাধুনিক এবং সমৃদ্ধ নগরী নির্মাণের জন্য উপযোগী যন্ত্রপাতি ছিল না। তাহলে পেত্রা নির্মাণে নাবাতিয়ানরা কি বহিরাগত কারও সাহায্য নিয়েছিলো? এর কোনো উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই ধারণা করা হয়, পেত্রার অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
৪০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে পেত্রা বিশ্ববাসীর নিকট পরিচিতি লাভ করে। নাবাতিয়ানদের সুপরিকল্পিত শাসনব্যবস্থার কারণে পেত্রা বাণিজ্যিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ নগরী হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতিহাসে পেত্রা প্রাচীনতম নগরীগুলোর মাঝে অন্যতম। নাবাতিয়ানরা পেত্রার সাহায্যে আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে লেভান্তের বড় একটি অঞ্চলের সকল ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতো। পেত্রার বুকে উন্নতমানের সেচ ব্যবস্থার দ্বারা ফসল ফলানো হতো। পরবর্তীতে রোমান সম্রাট ট্রাজান পেত্রাকে রোম সাম্রাজ্যের অন্তুর্ভূক্ত করেন। ক্যালেণ্ডারের হিসাব অনুযায়ী সময় তখন ১০৬ খ্রিস্টাব্দ।
রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে পেত্রার অবনতি ঘটতে থাকে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে রোমানদের সমুদ্রপথে বাণিজ্য করাকে দায়ী করা হয়। মাত্র দুইশত বছরের মাথায় পেত্রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে এক প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে পেত্রার সামগ্রিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অর্থনৈতিক মন্দার মুখে ব্যবসায়ীরা পেত্রা ত্যাগ করতে থাকে। ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে পেত্রা। পরবর্তীতে ৭০০ সালে মুসলিম শাসকরা পেত্রা দখল করে নেয়। এককালের সমৃদ্ধ নগরী পেত্রা ততদিনে রূপ নিয়েছে সামান্য গ্রামে। তাই পেত্রার প্রতি শাসকদের গুরুত্ব কম ছিল। প্রথম ক্রুসেডের সময় পেত্রা মুসলিমদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেন জেরুজালেমের রাজা প্রথম বালডউইন। ১২১৭ সালে মুসলিমরা পুনরায় পেত্রা জয় করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে মামলুক সুলতান বেবারের আমলে পেত্রা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মানুষ পেত্রার নাম ভুলে যায়। ইতিহাসের পাতায় পেত্রা একটি রূপকথা হিসেবে টিকে থাকে। আরবের বেদুইনরা পেত্রার সঠিক অবস্থান জানলেও তা বাইরের মানুষদের নিকট প্রকাশ করতো না।
সেই অজেয় পেত্রাকে পুনরায় পৃথিবীর সামনে উন্মুক্ত করতে যেই অভিযাত্রী এগিয়ে আসেন, তার নাম জোহান লুডউইগ বুর্কহার্ট। রোমাঞ্চকর এক অভিযানের মাধ্যমে তিনি জয় করেন রহস্যময় পেত্রাকে।
জোহান লুডউইগ বুর্কহার্ট
১৭৮৪ সালে সুইজারল্যাণ্ডের লুজান শহরে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত অভিযাত্রী বুর্কহার্ট। ছোটবেলা থেকেই অভিযানের নেশায় মত্ত থাকতেন বুর্কহার্ট। লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান অভিযান পরিচালনা করেন। বুর্কহার্ট অনুসন্ধানের কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নাইজার নদীর উৎস আবিষ্কার করে তিনি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্মানসূচক অর্ডার অফ জোহান ফ্রিডরিখ ব্লুমেনবাখ উপাধি অর্জন করেন।
১৮০৯ সালে বুর্কহার্ট ইউরোপ ছাড়িয়ে পাড়ি দেন আরবের বুকে। লেভান্ত অঞ্চলে তিনি আরবি ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করেন। বলতে গেলে এই অঞ্চলের মানুষ এবং ভাষার প্রতি প্রেমে পড়ে যান তিনি। তাই তার জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। তিনি লেভান্ত থেকে ফিলিস্তিন অঞ্চলে যাত্রা করেন। সেখানে আরবের ইতিহাস, ভূগোল এবং ভাষা নিয়ে বিশদ জ্ঞানার্জন করেন। বুর্কহার্টের নিকট আরব উপদ্বীপ একটি রোমাঞ্চকর স্থান হিসেবে মনে হতে থাকে। তিনি ১৮১৩ সালে নীল নদ উপত্যকা এবং পরবর্তীতে সিনাই উপদ্বীপ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। সাধারণের চোখ ফাঁকি দেয়া ভৌগোলিক রহস্যকে অন্ধকার থেকে আলোতে টেনে আনতে দক্ষ বুর্কহার্ট আরবের মানুষের সাথে মিশে যেতে চাইলেন। কারণ আরবের মানুষদের নিকট আস্থাভাজন হতে হলে তাকে একজন আরবের ন্যায় জীবনযাপন করতে হবে। এমনকি তাদের ন্যায় ধর্মীয় বিশ্বাসে সাদৃশ্য আনাও খুব জরুরী। আরবের মানুষদের প্রধান ধর্ম ছিল ইসলাম। তিনি মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন। আরবের বুকে মুক্তভাবে চলাফেরার উদ্দেশ্যে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর তার নতুন নাম রাখা হয় শেখ ইব্রাহিম বিন আব্দুল্লাহ। মুসলিমদের ন্যায় তার মুখে শোভিত হতে থাকে লম্বা দাঁড়ি। মুসলিম শেখ এবার হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা এবং মদিনার প্রতি যাত্রা শুরু করেন। তিনি প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে মক্কার ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু তিনি বেদুইনদের নিকট নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখেন। তিনি নিজেকে ভারতীয় দাবি করতেন। স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে ইসলাম গ্রহণ করলেও শেখ ইব্রাহিম খুব দ্রুত মুসলিমদের ন্যায় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। নীল নদের উৎস সন্ধানে পরিচালিত অভিযান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন তিনি। এবার তিনি লেভান্ত অঞ্চলের দিকে পূর্ণ মনোযোগ প্রদান করেন।
কায়রোর পথে পেত্রার হাতছানি
প্রায় চার বছর সিরিয়ায় অবস্থান করার পর শেখ ইব্রাহিম যেন হাঁপিয়ে উঠলেন। আর ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না তার। এবার সিদ্ধান্ত নিলেন পুনরায় বিশ্বভ্রমণে বের হবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। এবার তার গন্তব্যস্থল ঠিক করা হলো সুদূর মিশরের রাজধানী কায়রোতে। সিরিয়া থেকে কায়রো ভ্রমণের জন্য দুটি পৃথক রাস্তা ব্যবহৃত হতো। সরাসরি সমুদ্র সৈকত ধরে ভ্রমণের মাধ্যমে কায়রো পৌঁছানো অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কিন্তু তিনি ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেন। মৃত সাগরের তীর ধরে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন ইব্রাহিম। বুর্কহার্টের ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতায় উঁকি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের পেছনে তার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তিনি লেখেন, “কায়রো যাত্রায় সেবার আমি দুর্গম পথে যাত্রা করেছিলাম। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল যতটুকু সম্ভব এই অঞ্চলের ভূগোল সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা।”
১৮১২ সালের ১৮ জুন তিনি দামেস্ক ত্যাগ করেন। সফরসঙ্গীদের নিয়ে সারাদিনের যাত্রা শেষে একটি নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রাবিরতি নেন তিনি। তখন স্থানীয় বেদুইনদের সাথে আলাপচারিতায় মেতে উঠেন অনেকেই। ক্লান্ত ইব্রাহিম ওরফে বুর্কহার্ট বিশ্রামরত অবস্থায় কান পেতে তাদের আলোচনা শুনছিলেন। কয়েকজন বেদুইন ওয়াদি মুসার নিকটে অবস্থিত একটি শহর সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সেখানে হযরত হারুন (আ)-এর সমাধিক্ষেত্র অবস্থিত বলে গুজব প্রচলিত রয়েছে। আরও গুজব রয়েছে যে, এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরের বুকে লুকিয়ে আছে হাজারো বছরের অর্জিত গুপ্তধন। বুর্কহার্ট নড়েচড়ে বসলেন। বেদুইনদের গল্প অনুযায়ী তিনি সেই শহরের একটি মানচিত্র কল্পনা করলেন। তিনি ডিডোরাস সিসুলাস, স্ত্রাবো এবং জোসেফাসসহ প্রমুখ ইতিহাসবিদের পাণ্ডুলিপি থেকে হারানো শহর পেত্রা সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছিলেন। বেদুইনদের বর্ণনার সাথে পেত্রার অনেক মিল খুঁজে পেলেন তিনি। যে করেই হোক, তার একবার সেই শহরে যাওয়া দরকার। তাই মনে মনে একটি উপায় বের করলেন। তার ডায়েরি থেকে জানা যায়,
“আমি হযরত হারুনের (আ) সম্মানে একটি ছাগল কুরবানি করবো বলে তাদের জানালাম। এই উপত্যকার শেষমাথায় হয়তো তার সমাধি খুঁজে পাওয়া যাবে। তারা নির্দ্বিধায় আমার কথা মেনে নিলো। তারপর আমি নিজের দলকে অপেক্ষায় রেখে রওয়ানা দিলাম সেই রহস্যময় নগরকে একবার পরখ করে দেখার জন্য”।
স্থানীয় একজন বেদুইনকে তিনি পথপ্রদর্শক হিসেবে ভাড়া করেন। দুজন মিলে গাধার পিঠে চড়ে রওয়ানা দেন সেই রহস্যপুরীর উদ্দেশ্যে। দুদিনের ক্লান্ত ভ্রমণ শেষে তারা তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যান। কিন্তু পাহাড় দিয়ে ঘেরা শহরটির প্রবেশদ্বার গিরিপথটি প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। খুব সাবধানে এগোতে থাকেন তারা। গিরিপথ পেরিয়ে সবার প্রথমে বুর্কহার্টের নজরে পড়ে অগণিত সমাধিক্ষেত্র। পাহাড়ের বুক কেটে যেন এক অসাধারণ সাফল্যগাঁথা রচিত হয়েছে সেগুলোর গায়ে। প্রথম দেখাতেই তিনি বুঝতে পারেন, এই শহরই পেত্রা। তিনি তার উচ্ছ্বাস গোপন রাখতে ব্যর্থ হন। গাধার পিঠ থেকে নেমে তিনি বিভিন্ন স্থাপনা পরখ করে দেখতে থাকেন। শহরের পরিত্যক্ত মন্দিরগুলোর দেয়ালখচিত নকশা দেখার সময় বেদুইন পথপ্রদর্শক চিৎকার করে উঠেন, “তুমি একজন কাফের! তুমি হারুনের দোহাই দিয়ে প্রতারণা করছো।”
বেদুইনের কথায় টনক নড়ে বুর্কহার্টের। তিনি দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে হারুনের সমাধির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তার পেছনে পড়ে থাকে প্রায় ছয়শত বছর পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে থাকা শহর পেত্রা।
কায়রোর চিঠি
কায়রোর মাটিতে পা রেখেই কাজে লেগে যান বুর্কহার্ট। বহুদিন পর তিনি রোমাঞ্চিত অনুভব করছেন। অনুসন্ধানী বুর্কহার্ট পুনরায় জেগে উঠেছেন। তিনি আফ্রিকা অ্যাসোসিয়েশন বরাবর পত্র প্রেরণ করেন। চিঠির পাতায় বুর্কহার্ট লেখেন,
“জেবেল শেরা পাহাড়ের পাদদেশে ওয়াদি মুসা নামক একটি উপত্যকা রয়েছে। সেই উপত্যকার শেষ মাথায় লুকিয়ে আছে পৃথিবীর প্রাচীন রহস্য পেত্রা। পেত্রার বুকে আমার পূর্বে কোনো ইউরোপীয় আদৌ পদার্পণ করেছে বলে আমার মনে হয় না।”
তিনি তার সহকর্মীদেরকে তার আবিষ্কারের খবর জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। বুর্কহার্টের পত্র পেয়ে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। নদীর উৎস সন্ধানী বুর্কহার্ট এবার বাজিমাত করে ফেললেন। ইউরোপের বুকে তার কৃতিত্বগাঁথা উচ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু সেই কিংবদন্তি বুর্কহার্ট এর কিছুই জানতেন না। তিনি তখন শেখ ইব্রাহিমের পরিচয়ে আরবে চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি তার খ্যাতির সম্মাননা এক মুহূর্তের জন্যও উপভোগ করতে পারেননি। বুর্কহার্ট নাইজার নদীর নতুন উৎস অনুসন্ধানে পুনরায় অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিধাতার মর্জি বুর্কহার্টের সিদ্ধান্তের সাথে মিললো না। তিনি আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। ১৮১৭ সালে বুর্কহার্ট পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে এক অন্তিম যাত্রায় শামিল হন। এক কিংবদন্তি অভিযাত্রীর যাত্রা শেষ হয় মহাযাত্রার সূচনায়।
শেখ ইব্রাহিম বিন আব্দুল্লাহ ওরফে জোহান বুর্কহার্ট-এর আবিষ্কৃত পেত্রাকে ঘিরে আজও ইতিহাসবিদগণের আগ্রহ শেষ হয়নি। পেত্রার বুকে হাজারো গবেষক রাতদিন পরিশ্রম করে বুর্কহার্টের কৃতিত্বকে পূর্ণতা দান করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছেন। অদূর ভবিষ্যতে আমরা পেত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবো। এর মাধ্যমে প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের সীমিত জ্ঞানের সমৃদ্ধি অর্জিত হবে। বুর্কহার্টের ন্যায় নির্ভীক অভিযাত্রীরা অনন্তকাল বেঁচে থাকুক। তাদের অদম্য সাহসের নিকট বার বার পরাজিত হোক পেত্রার ন্যায় দুর্জেয় রহস্যপুরী। পেত্রার পাথুরে সভ্যতার গায়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকুক তাদের জয়গান।
ফিচার ইমেজ: The Daily Beast