১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করার পর এই শাসনক্ষমতা ধরে রাখাটাই ইংরেজদের মূল চিন্তা ছিল। আর সে কারণেই ইংরেজরা তৈরি করে ‘Divide and Rule’ নীতি। এই ক্রূর রাজনীতির প্রধান শিকার ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত সকল দিক দিয়েই মুসলিমরা হয় প্রথম শিকার। তবে স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেওয়া। ধুরন্ধর ইংরেজরা অতি সূক্ষ্মভাবে হিন্দুদের দিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধির প্রয়াস চালায়। আর ফলস্বরূপ যুগ যুগ ধরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করা দুটি জাতির মধ্যে প্রচলিত হয় ‘আমরা’ আর ‘তোমরা’ পরিচয়। ইংরেজরা চলে গেছে, কিন্তু এই রাজনৈতিক প্রেতাত্মা এখনও উপমহাদেশে বিরাজমান। চলুন জানা যাক, কী করে ইংরেজরা শুরু করেছিল মুসলিমদের শিক্ষার ধ্বংসযজ্ঞ।
পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা বাংলার হিন্দুদের জমিদারী, তালুকদারী, সরকারি চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করে নেয়। যেহেতু বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মুসলিম ছিলেন, কাজেই চতুর রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর জয়কে মুসলিমদের উপর হিন্দুদের জয় হিসেবে চিত্রিত করার পরিকল্পনা করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও নবকৃষ্ণ দেবসহ কয়েকজন হিন্দু রাজা ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সাথে কয়েক মাসব্যাপী ক্লাইভের আলাপ-আলোচনা চলে। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ের উৎসব বিরাটাকারে দুর্গাপূজার মাধ্যমে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগে দুর্গাপূজা বসন্তকালে উদযাপিত হতো। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রচেষ্টায় পুরোহিত সম্প্রদায় দেবীর ‘অকালবোধন’ করেন, পূজা নিয়ে আসা হয় শরৎকালে। সেই থেকে শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরু। এভাবেই অতি সূক্ষ্মতার সাথে রাজনীতিকে ধর্মের সাথে মিলিয়ে দেয় ইংরেজরা।
ইংরেজদের এই সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ নীতির ফাঁদে পা দেন অনেক উচ্চ শিক্ষিত ও প্রতিভাবান হিন্দু। মুসলিম দলনের অন্যতম পন্থা হিসেবে ইংরেজরা শুরু করে মুসলিমদের শিক্ষা সংস্কৃতি ধ্বংস ও সেই সাথে এসবের সামাজিক উৎস ও মূল ব্যবস্থাপনা কাঠামোর বিনষ্টকরণ।
মুসলিম শাসনামলে সম্রাট, নওয়াব, জমিদার, জায়গীরদার ও ধনী ব্যক্তিবর্গের অর্থানুকূল্যে মুসলিমদের জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। মুসলমানদের রাজনৈতিক চেতনার বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস নানাভাবে বন্ধ করে দেয়। ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ের পথ হাতছাড়া হয়ে যায়। এই আইনানুযায়ী, সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের শেষ দিন সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত জমিদার পরিশোধ করতে না পারলে তার জমিদারী নিলামে তোলা হতো। এই আইন সূর্যাস্ত আইন নামেও পরিচিত। জমিদারের নায়েব গোমস্তারা পরিকল্পিতভাবে খাজনা দেওয়া থেকে বিরত থাকতো এবং নিলামে ওঠা জমিদারী কিনে নিয়ে নিজেই জমিদার বনে যেতো। সূর্যাস্ত আইনের ফাঁকে প্রতারিত জমিদাররা প্রায় ক্ষেত্রেই ছিল মুসলিম এবং প্রতারক গোমস্তারা ছিল হিন্দু। এসব প্রতারণামূলক কাজে ইংরেজ কর্মকর্তাগণ প্রেরণা ও প্রশ্রয় দিতেন। এটিও তাদের‘Divide and Rule’ নীতিরই অংশ ছিল।
তাদের লক্ষ্য ছিল শাসকশ্রেণী থেকে মুসলিমদের উৎখাত করে হিন্দুদের প্রাধান্য বিস্তার করতে সাহায্য করা, হিন্দু সমাজে একটি নতুন শ্রেণীর উত্থান করে নিজেদের শাসনের ভিত্তি মজবুত করা। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘকালব্যাপী চলতে থাকে। ১৮১৯ সালে ঢালাওভাবে মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থিক উৎস বন্ধের আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এরপর নতুন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে ইংরেজরা বিরত থাকে। কিন্তু আড়ালে সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৮২৮ সালে প্রবর্তিত একটি আইনের মাধ্যমে ধর্মীয় ও মহৎ কাজে ব্যয়ের জন্য উৎসর্গীকৃত বার্ষিক মোট ৪৫ লক্ষ টাকার একটি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এভাবে আরও কিছু সম্পত্তি ক্রমাগত ছিনিয়ে নেয়ার ফলে কয়েক কোটি টাকার বার্ষিক আয়ের উৎস মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যায়। বর্তমান মুদ্রামানে এর মূল্য দাঁড়াবে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
কিছুকাল আগপর্যন্ত শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত মুসলমানরা তাদের শিক্ষার আর্থিক উৎস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ হারিয়ে ধীরে ধীরে এক অশিক্ষিত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। কয়েকশ বছরব্যাপী প্রতিষ্ঠিত একটি সুদৃঢ় শিক্ষা ব্যবস্থাকে কয়েক দশকের মধ্যে এভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার নজির ইতিহাসে বিরল।
১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত অংশগ্রহণে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহের পর উপমহাদেশের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি রানী ভিক্টোরিয়া গ্রহণ করেন। ইংরেজরা তাদের শাসনভিত্তি দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে জোরেশোরে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু করে। এই কার্যক্রমে হিন্দুরা স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দিলেও ইংরেজ শিক্ষা তথা ইংরেজদের সহযোগিতার প্রশ্নে দোমনা হয়ে পড়ে মুসলিমরা। এরই মধ্যে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে অফিস-আদালতে ফার্সির স্থলে ইংরেজী সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হলে তারা আরও বিপাকে পড়ে যায়।
ইংরেজী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুসলিমদের এই ঘৃণা চলে বহুদিন ধরে। এমনকি একসময় ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলেও কয়েক যুগ ধরে চলে ইংরেজ সরকারের চাকরি গ্রহণে বিতৃষ্ণা। আর সেই সাথে মুসলমানদের নিচে ফেলে হিন্দুদের উপরে ওঠানোর ইংরেজদের জাতি বিভেদমূলক সাম্প্রদায়িক কূটকৌশলও বজায় থাকে। এমন অবস্থা দেখেই ইংরেজ রেভারেন্ড ও জে লং বলেন,
“অসংখ্য প্রাসাদের ধ্বংসস্তুপ ও শোচনীয় দুরবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজেই বোঝা যায়, এদেশে মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের পথে দ্রুত আগাইয়া যাইতেছে। একসময় যাহারা একটি বিশাল রাজ্য শাসন করিয়াছেন, আজ তাঁহাদের বংশধরগণ অতি কায়ক্লেশে জীবন যাপন করিতেছেন। বর্তমানে বাংলার কোনো সরকারি অফিসে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারী পরিদৃষ্ট হয় না। অথচ, মুসলমান দফতরী ও পিয়নে সব পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।”
নেতৃস্থানীয় হিন্দুগণ দ্রুত ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলে ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। অনেকেই একে উপমহাদেশের প্রথম সরাসরি রাজনৈতিক সংগঠন মনে করে থাকেন। ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে ভারতীয়দের মনে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জাগে।
ব্রিটিশ সিভিলিয়ান অফিসার অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের উৎসাহ ও উদ্যোগে ১৮৮৫ সালে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেস’। উল্লেখ্য, এই নবনির্মিত রাজনৈতিক দলটিও ছিল হিন্দুপ্রধান। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন মুসলিম নেতা কংগ্রেসে যোগ দিলেও প্রায় গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ই কংগ্রেসকে তাদের নিজের সংগঠন বলে মানতে পারেনি। সিপাহী বিপ্লবে পরাজিত হওয়ার পর মুসলিমদের ইংরেজবিদ্বেষ আরও চরমে ছিল। আর হিন্দুগণ এ সময় দ্রুত ইংরেজদের সাথে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে চলতে শুরু করলে হিন্দু-মুসলিম সদ্ভাবের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে আসে। স্যার সৈয়দ আহমেদ খানসহ তৎকালীন প্রখ্যাত মুসলিম নেতাদের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালে ঢাকায় গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। এভাবেই ক্রমে মুসলিমরা সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে বুঝতে পারে, ইংরেজী শিক্ষাকে অবজ্ঞা করে নিজেদের ভাগ্যোন্নতি সম্ভব নয়। আর তাই স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে শুরু হয় আলীগড় আন্দোলন। মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ও মুসলিম সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আত্মোন্নয়নের প্রয়াস চালায় মুসলিমরা।
১৯০৫ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। পূর্ববঙ্গ ও আসামকে যুক্ত করে একটি প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার অংশবিশেষ নিয়ে তৈরি হয় দুটি আলাদা প্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে যায়, পূর্ববঙ্গের রাজধানী হয় ঢাকা। পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা মনে করে, নতুন প্রদেশে মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে, উন্নতি ত্বরান্বিত হবে এবং পূর্ববঙ্গ কলকাতার অধীন একটি সেবাদানকারী পশ্চাৎভূমি হয়ে থাকবে না। শিক্ষাদীক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে যাবে এই প্রদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী। কিন্তু হিন্দুরা মনে করে, তাদের বিভক্ত করে দুর্বল করার লক্ষ্যেই এই দ্বিখণ্ডীকরণ। তাই ছড়িয়ে পড়ে বিপ্লববাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। চলতে থাকে ইংরেজ প্রশাসকদের উপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড। নেতৃস্থানীয় হিন্দুরাও ক্রমাগত অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। এতসব বিড়ম্বনায় পড়ে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয় ব্রিটেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর মতামত যাচাই না করে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে মনঃক্ষুণ্ণ হন মুসলিমরা। ছয় বছরব্যাপী লাগাতার আন্দোলন ও অসন্তোষের ফলে রদ হয় বঙ্গভঙ্গ, কিন্তু সেই সাথে রুদ্ধ হয়ে যায় পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির পথ।
যে বিভক্তির বীজ ইংরেজরা সুকৌশলে শাসন গ্রহণের পরপরই ভারতবাসীর মনে গেঁথে দিয়েছিল, তা থেকে বেরোনো একপ্রকার মুশকিলই ছিল। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে দুটি জাতি আত্মমগ্ন হয়ে পড়াটাও অনিবার্য ছিল। এই অনিবার্যতার পথ ধরেই আসে দেশভাগ, যে বিভক্তির ছাপ আজও রয়ে গেছে। তবে সুদীর্ঘকাল ধরে অর্থনীতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সুকৌশলে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে পিছিয়ে রাখার যে প্রবণতা ইংরেজনীতির ইতিহাসে দেখা যায়, তা থেকেই স্পষ্ট যে উপমহাদেশে ১৯০ বছর ধরে তারা এমনি এমনিই টিকে থাকেনি।
তথ্যসূত্র- উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত- সিরাজুল হোসেন খান (প্রকাশকাল-২০০২; পৃষ্ঠা- ২৮-৩২)
ফিচার ইমেজ: pravsworld.com