কাল্ট (Cult) বা বিশেষ ধর্মবিশ্বাস নিয়ে স্বভাবতই মানুষের মনে একরকম নেতিবাচক মনোভাব বিদ্যমান। সুনির্দিষ্ট শব্দের বেড়াজালে ব্যাপারটি সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয়। আমেরিকান হেরিটেজ অভিধান (ডিকশনারি) কাল্ট (Cult) শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে মোটামুটি এভাবে যে, একটি ধর্ম বা ধর্মের উপদল যারা উগ্রপন্থী বা ভুল হিসেবে বিবেচিত, একজন স্বৈরাচারী বা আধ্যাত্মিক নেতার অধীনে একদল অনুসারী যারা লৌকিকতা বর্জিত বা প্রথাসিদ্ধ জীবন যাপন করে না। এরকম সংঘ বা ধর্ম বিশ্বাসের অনুসারীদের অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনযাপন, পরিবার, চাকরি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য অনুসারীদের সাথে যৌথভাবে বসবাস করতে হয়। এই বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের সাথে প্রচলিত ধর্মের সাধারণ পার্থক্য হলো, তাদের কার্যক্রম মূলত প্রথাগত সমাজের বাইরে এবং অল্প সংখ্যক অনুসারী নিয়ে পরিচালিত। এরকম কিছু ধর্মবিশ্বাস ও অনুসারীদের কথা তুলে ধরা হবে, যারা কুখ্যাতি অর্জন করেছে তাদের কার্যক্রম বা রক্তাক্ত পরিণতির মধ্যদিয়ে।
১) অর্ডার অব সোলার টেম্পল
১৯৯৪ সালের ৪ ও ৫ অক্টোবর সুইজারল্যান্ড এবং কানাডায় অর্ডার অব সোলার টেম্পলের ৫৩ জন সভ্য আগুনে পুড়ে এক সাথে আত্মাহুতি দেন। নিহতদের মধ্যে প্রতিষ্ঠাতা ম্যাম্ব্রো ও জুরেটও ছিলেন। পরের বছরের ডিসেম্বরে আরো ১৬টি মৃতদেহ ফ্রান্সে পাওয়া যায় যাদের মৃত্যু হয়েছিল পূর্ববর্তীদের মতোই। ১৯৮৪ সালে জেনেভায় প্রতিষ্ঠিত অর্ডার অব সোলার টেম্পলের অনুসারীদের বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীর ধ্বংসের দিন ঘনিয়ে আসছে, পৃথিবীতে তারা মারা গেলেও সিরিয়াস নামক তারকার কেন্দ্রে ঘূর্ণায়মান নতুন গ্রহে তাদের পুনর্জন্ম হবে এবং সেখানে তাদের নিয়ে যাবে ম্যাম্ব্রোর আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মেয়ে ইমানুয়েলে।
সংঘটির আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা জুরেট একইসাথে নিজেকে যীশু খ্রিস্ট এবং মধ্যযুগের একজন ধর্মযোদ্ধা যার কিনা পুনর্জন্ম হয়েছে বলে দাবি করত। ম্যাম্ব্রোর ছেলে এলি অবশ্য বাবার মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বাবার আধ্যাত্মিক শক্তি ও ভবিষ্যতবাণী ভুয়া আখ্যায়িত করা শুরু করলেন। এরপর এলির পথ ধরে অনেক অনুসারী সংঘটি ত্যাগ করেন। ১৯৯৪ সালে দুজন নেতা প্রচার করতে শুরু করেন পৃথিবীতে তাদের দিন শেষ, সময় এসেছে নতুন গ্রহে তাদের পুনরুত্থানের। ঘনিষ্ঠ ১২ জন সহচর নিয়ে যীশু খ্রিস্টের ন্যায় ম্যাম্ব্রো শেষ নৈশভোজের আয়োজন করে। তাদের প্রচার ও মতবাদের ভিত্তিতে কানাডা, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে অর্ডার অব টেম্পলের অনুসারীরা অন্য গ্রহে পাড়ি জমানোর আশা নিয়ে গণহারে আত্মাহুতি দেয়। আত্মহত্যাকারীদের মৃতদেহের মধ্যে সংঘত্যাগী প্রতিষ্ঠাতা ম্যাম্বোর ছেলে এলির দেহও পাওয়া যায়, তবে তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছেন নাকি খুন হয়েছেন তা আজও রহস্য রয়েছে গেছে।
২) ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান
উগ্র ও চরমপন্থি ডেভিড কোরেশ চার্চ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান নামের একটি অপ্রথাগত বিশ্বাসীদের দলে যোগ দেন, দলটির নেতা লয়েস রডেনের সাথে ঘনিষ্ঠতার দরুন কোরেশ পরবর্তী নেতা নির্বাচিত হন। কোরেশ সবচেয়ে বিতর্কিত ছিল তার নতুন মতবাদের জন্য। তার মতে, সকল নারী তার আত্মিক পত্নী, এমনকি অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু এবং বিবাহিতরাও। কোরেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র মজুদ ও শিশুদের যৌন নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ ছিল। ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ানের একজন সদস্য জানান, কোরেশের স্ত্রী ছিল ১৯ জন এবং ১২ বছরের নিচে প্রায় ১৩ জন শিশুর সাথেও তিনি যৌনকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন।
নিষ্ঠুর কোরেশ নিজেকে ঈশ্বরের সন্তান মনে করতেন, তার অনুসারীদের রক্তাক্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতন করতেন যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিল। টেক্সাসের ওয়েকোতে অবস্থিত ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ানদের সদর দপ্তরে আমেরিকার দ্য ফেডারেল ব্যুরো অব অ্যালকোহল, টোব্যাকো অ্যান্ড ফায়ার-আর্মস (ATF) ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না চরমপন্থি কোরেশ, কোনো অবস্থাতে আত্মসমর্পণ করতে রাজি ছিলেন না তিনি। অভিযানে এফবিআই যুক্ত হয় কোরেশের ধ্বংসাত্মক ও আগ্রাসী আচরণের কারণে।
সপ্তাহব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে চলে কোরেশকে আত্মসমর্পণ করানোর ব্যর্থ চেষ্টা। অনুসারীদের অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শহীদ হওয়ার নির্দেশ দিয়ে একরকম যুদ্ধ শুরু করেন তিনি, মারাত্মক গোলাগুলি শুরু হয় কর্তৃপক্ষের সাথে। প্রায় ৫১ দিনের অবরোধ ও গোলাগুলি শেষে কোরেশসহ ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ানের ৭৬ জন সদস্য নিহত হয়, এর মধ্যে ২৩ জন শিশুও ছিল। পুরো ঘটনাটি এতটাই জটিল ও বিপদজনক ছিল যে, অভিযানে ১২টি ট্যাংক ও ৪টি ভারী যুদ্ধযান ব্যবহার করতে হয়েছিল।
৩) দ্য পিপলস টেম্পল
১৯৫০ সালে জিম জোন্স নামের একজন প্রচারক ইন্ডিয়ানাপোলিসে পিপলস টেম্পলের শুরু করেন, যিনি ছিলেন বর্ণবাদ বিরোধী ও সমাজতান্ত্রিক ঘরানার। এই কারণে জোন্সের প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে তার পিপলস টেম্পলে অনেক বেশি আফ্রো-আমেরিকান যোগ দিয়েছিল। জোন্স খ্রিস্টান ধর্মের সাথে জোর দিতেন সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র এবং সাদা-কালোদের সম অধিকারে। ১৯৬৫ সালে জোন্স তার অনুসারীদের নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসেন। পরবর্তী ৫ বছরে তার অনুসারী সংখ্যা একশ থেকে প্রায় হাজারের কাছাকাছি হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দেশ গুইয়ানায় অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন জোন্সটাউন। জোন্সটাউন ও পিপলস টেম্পল নিয়ে সংবাদপত্রে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হলে জোন্স ভীত সন্ত্রস্ত ও অপমানিত বোধ করেন। পিপলস টেম্পলের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল আর্থিক অনিয়ম, শারীরিক নির্যাতন ও শিশু নির্যাতন।
অভিযোগের ভিত্তিতে আমেরিকার কংগ্রেস সদস্য লিও রাইয়ান জোন্সটাউন পরিদর্শনে যান ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭৮ সালে। পরিদর্শন শেষে রাইয়ান স্বেচ্ছায় জোন্সটাউন ত্যাগকারীদের নিয়ে আমেরিকায় ফিরতে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে থাকেন। এই সময়ে পিপলস টেম্পলের অনুসারীরা রাইয়ানসহ আরো অনেককে গুলি করে হত্যা করে। জোন্সটাউনে ফিরে জোন্স সবাইকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, আমেরিকার কংগ্রেস সদস্য রাইয়ানকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে আমেরিকান সরকার তাদের ও তাদের সন্তানদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাবে। সকলকে সমবেত করে ভীত ও অস্থির জোন্স সবাইকে একসাথে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিতে থাকেন।
প্রথমে শিশুদের সায়ানাইড প্রয়োগ করে হত্যা করার পর প্রাপ্তবয়স্করা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করে। যারা স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করতে রাজি হয়নি তাদের গুলি করে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা। ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর, মাত্র একদিনে প্রায় ৯১৮ জন আত্মহত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে প্রায় ২৭৬ জন শিশু ছিল। একদিনে প্রায় হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী জোন্স অবশ্য সায়ানাইড খেয়ে মারা যায়নি, তার মৃত্যু হয়েছিল মাথায় গুলি লেগে।
৪) রাজনীশপুরাম
স্বঘোষিত ভগবান, রাজনীশ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে ১৯৮১ সালে পাড়ি জমায় আমেরিকায়। সেখানে নিজের নামে শহর গড়ে তুলে এবং সমালোচনার ঝড় তুলে পাঁচ বছরের মধ্যেই আবার সব শেষ হয়ে যায়। রাজনীশের বেশ ভালো সংখ্যক অনুসারী ছিল, যাদের বেশিরভাগ আমেরিকার বাইরে ও শহরাঞ্চল থেকে এসেছিল। আমেরিকায় পৌঁছানো মাত্রই রাজনীশ ওরিগনে বিশাল এক অঞ্চল কিনে নেয় এবং তার অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তোলে রাজনীশপুরাম নামে একটি শহর। নিজের নামে শহর গড়ে তোলার প্রায় তিন বছর পর্যন্ত রাজনীশ জনগণের সাথে কথা বলেননি।
মা আনন্দ শীলা ছিলেন এই আধ্যাত্মিক গুরুর একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী যিনি এই পুরো শহরটি পরিচালনা করতেন। সে সময় বিশাল এই শহরের মাসিক পরিচালনা ব্যয় ছিল ২.৫ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় একা হাতেই সামলাতেন শীলা। স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও নিয়মের তোয়াক্কা করতো না রাজনীশপুরামের বাসিন্দারা; সমস্যার শুরু এখান থেকেই। রাজনীশ জাগতিক সুখে বিশ্বাসী ছিলেন, অবাধ যৌনাচারের প্রচার করতেন এবং এই আধ্যাত্মিক গুরুর ৯৩টি রোলস রয়েস ছিল।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকার পরও, খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি রাজনীশের অবজ্ঞা কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। তাদের ক্রমাগত উগ্র ও অসহনশীল আচরণ স্থানীয়দের চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। বলতে গেলে, এটি ছিল প্রথাগত ও অ-প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার একটি দ্বন্দ্ব। ১৯৮৫ সালের দিকে আমেরিকায় প্রথম জৈব-রাসায়নিক আক্রমণের জন্যে দায়ী করা হয় মা শীলা আনন্দসহ রাজনীশপুরামের কিছু নেতাকে, যারা একটি রেস্টুরেন্টের খাদ্যে বিষক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিল এবং এই ঘটনায় প্রায় ৭৫০ জন আক্রান্ত হয়। এরপর শীলাসহ অভিযুক্তরা পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে যায় এবং রাজনীশপুরামের কার্যক্রম প্রায় থেমে যায়। ১৯৯১ সালে রাজনীশ মারা গেলেও তার মতবাদ এখনো জীবিত।
৫) দ্য চিলড্রেন অব গড
১৯৬০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বার্গ ক্যালিফোর্নিয়ার হানিংটন সৈকতে একদল হিপ্পির আগমনের খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে খুব সহজেই নিজের প্রথাবিরোধী আচরণে মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করে ফেললেন। অনেকে তাদের চাকরি ছেড়ে ও নিজের সঞ্চয় বার্গের হাতে তুলে দিয়ে গুরুর বাড়িতে বসবাস শুরু করে। ক্যালিফোর্নিয়া ভূমিকম্পে আক্রান্ত হবে এই ভবিষ্যতবাণী করে বার্গ তার অনুসারীদের নিয়ে আরিজোনায় চলে যান। ১৯৭০ সালে সারা দেশে বার্গ তার মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে লাগলেন। ১৯৭৪ সাল নাগাদ ৭০টি দেশে সংঘটির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪,০০০। অনুসারীরা বার্গকে ডাকত ‘মোসেস’ নামে এবং নিজেদের পরিচয় দিত ‘দ্য চিলড্রেন অব গড’ হিসেবে। অবাধ যৌনাচার ও যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে বার্গ তার অনুসারীদের উৎসাহ দিতেন। বার্গের অনুসারীদের বিরুদ্ধে শিশুদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। দলটি আমেরিকার ‘অ্যান্টি কাল্ট’ আন্দোলনের সদস্যদের রোষানলে পড়ে। যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলে নতুন সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়াকে বার্গ ‘ফ্লার্টি ফিশিং’ নামে অবহিত করত। ১৯৮২ সালের দিকে অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্কের কারণে সংঘটিতে ব্যাপকহারে যৌনবাহী রোগ ছড়িয়ে পড়লে তারা এই চর্চা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে সংঘটি দ্য ফ্যামিলি ইন্টারন্যাশনাল পরিচয়ে যথেষ্ট সক্রিয়।
৬) দ্য ইউনিফিকেশন চার্চ
চার্চটির প্রতিষ্ঠাতা সান মিউঙ মুনের দাবি, ১৬ বছর বয়সে তিনি দৈববাণীর মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তিনি পৃথিবীতে এসেছেন যীশু খ্রিস্টের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে। এরপর থেকেই নিজেকে একজন মুক্তিদাতা হিসেবে প্রচার করতে থাকেন তিনি। মুন মনে করেন, তার প্রতি একান্ত বাধ্যতা একমাত্র মুক্তির পথ। ১৯৫০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন এই ধর্ম গুরু। নিজের ধর্ম গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৭০ সালে আমেরিকায় চলে আসেন। ১৯৮২ সালে একসাথে প্রায় ৬,০০০ দম্পতির বিয়ে পরিচালনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন মুন, যা এই ধর্মের একটি অন্যতম সম্মেলন হিসেবে বিবেচিত।
মুনের অনুসারীরা তাদের ভবিষ্যৎ সঙ্গী নির্বাচনের ভার ছেড়ে দেয় তাদের ধর্মগুরুর উপর। বিশ্বে শান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনানুযায়ী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থেকে সদস্য নিয়ে তাদের একটি দম্পতি হিসেবে গড়ে তুলে মুন। তিনি মনে করেন, এটি বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে একটি ঐক্যের পৃথিবী গড়ে তুলতে সহায়ক। একজন ধর্মপ্রচারকের পাশাপাশি মুন একজন সফল ব্যবসায়ীও। মাছ ধরার উপকরণ থেকে শুরু করে অস্ত্র, গাড়ি এবং সংবাদপত্রসহ আরো অনেক ব্যবসায় চার্চটির মালিকানা রয়েছে। চার্চটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অপহরণ ও শিশুদের মগজ ধোলাই করার অভিযোগ রয়েছে। চার্চটি দ্য ফ্যামিলি ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস অ্যান্ড ইউনিফিকেশন নামে এখনো সক্রিয়।
৭) MRTCG
দলটি বিশ্বাস করতো রোমান ক্যাথলিক চার্চ ঈশ্বরের দশটি আদেশ ত্যাগ করেছে। তাই তারা ঈশ্বরের দশটি আদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে তোলে ‘মুভমেন্ট ফর দ্য রিস্টোরেশন অব দ্য টেন কমান্ডমেন্টস অব গড’। সংঘটির প্রতিষ্ঠাতা ছিল চারজন সাবেক রোমান ক্যাথলিক যাজক, দুই জন নান ও একজন পতিতা। উগান্ডার এই সংঘটির নেতারা একইসাথে বিশ্বাস করতো দ্রুতই ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে কেয়ামত সংগঠিত হবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণীর পর অনুসারীরা তাদের সহায় সম্বল সব বিক্রি করে দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
কিন্তু আদতে এমন কিছু না ঘটলে সংঘটির নেতারা আবারো ভবিষ্যতবাণী করে কেয়ামতের এবং সেই সাথে আরো বলে যে, কুমারী মেরি বিশ্বাসীদের স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আসবেন। নির্ধারিত দিনটি ছিল ১৭ মার্চ, ২০০০ সাল। অনুসারীরা ১৬ই মার্চ সমবেত হয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্বর্গে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। পরদিন পুলিশ আবিষ্কার করে ধ্বংসস্তূপ, শত শত মৃতদেহ ও মাথার খুলি। প্রথমে গণ আত্মহত্যা মনে হলেও পরে উন্মোচিত হয় পুরো ঘটনা। সমবেত স্থানে বোমা বিস্ফোরণ করা হয়েছিল এবং পুরো ঘটনার পরিকল্পনাকারীরা হলো সংঘটির উচ্চপর্যায়ের নেতারা। ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হবে না এবং সবকিছু বেচে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া অনুসারীদের হাত থেকে বাঁচতে এই গণহত্যা চালানো হয়। এই ঘটনায় প্রায় ৯২৪ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৭৮ জন ছিল শিশু। কুখ্যাত এই পরিকল্পনাকারীরা এই বিস্ফোরণে হয় নিহত হয়েছে, নতুবা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
৮) ম্যানসন ফ্যামিলি
কৈশোর ও যৌবনের শুরুর সময়টা বিভিন্ন অপরাধের কারণে চার্লস ম্যানসন কাটিয়েছে কিশোর সংশোধানাগার এবং জেলে। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পেলে ম্যানসন জেল থেকে বাইরের দুনিয়ায় যেতে অস্বীকৃতি জানান। মুক্তি লাভের পর, ম্যানসন সান ফ্রান্সিসকোতে চলে আসেন এবং সেখানে দ্য ফ্যামিলি নামের একটি ছোট বিশ্বাসী দলের প্রতি আকৃষ্ট হন। অন্যসব অ-প্রথাগত বিশ্বাসীদের মতো ম্যানসন ফ্যামিলি অবশ্য শুরুতে প্রচলিত ধর্মভিত্তিক ছিল না। যদিও পরে ম্যানসন শয়তানের চর্চা, সায়েন্টোলোজি, উদ্ভট অর্চনাসহ আপাত দৃষ্টিতে মনে হওয়ার মতো করে ধর্মভিত্তিক চর্চাও করেছেন।
ম্যানসন মনে করতেন নিকট ভবিষ্যতে কালোদের সাথে সাদা চামড়ার লোকদের একটি জাতিগত যুদ্ধ সংগঠিত হবে এবং সেই যুদ্ধে কালোরা জয়ী হবে, কিন্তু যুদ্ধশেষে সঠিক নেতৃত্ব সাদারাই দিবে। ম্যানসনের পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ম্যানসন ফ্যামিলির অনুসারীরা নিরাপদে লুকিয়ে থাকবে এবং যুদ্ধ শেষ হলে তারা সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিবে। এই যুদ্ধ শুরু উদ্দেশ্য নিয়ে ম্যানসন তার অনুসারীদের খুন করতে নির্দেশ দেন এবং পুরো দায়ভার কালোদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার পায়তারা করেন। ১৯৬৯ সালে আসন্ন যুদ্ধ শুরু করতে ম্যানসন ফ্যামিলি লস এঞ্জেলসের হলিউডের নিকটে একটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে খুন করেন ৭ জনকে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন রোমান পোলানাস্কির স্ত্রী অভিনেত্রী শ্যারন টেট, যিনি গর্ভবতী ছিলেন। পরের রাতে ম্যানসন ফ্যামিলির হাতে নিহত হয় আরো ২ জন। সবাইকে ক্রমাগত ছুরিকাঘাত করে হত্যা করার পর দেয়ালে নিহতদের রক্ত দিয়ে বার্তা লিখে রেখেছিল ম্যানসন ফ্যামিলি।
টেটের হত্যাকারী স্বীকারোক্তি দেন যে, তিনি টেটকে প্রায় ১৬ বার ছুরিকাঘাত করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ম্যানসন ও তার অনুসারীদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলেও রাজ্যে মৃত্যদণ্ড নিষিদ্ধ করা হলে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এই বছরের ১৭ ই নভেম্বরে ৮৩ বছর বয়সে ম্যানসন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন।
ফিচার ইমেজ- youtube.com