প্রুশিয়া থেকে জার্মানি (পর্ব-৩৩): ফ্রান্সে আগ্রাসন এবং যুদ্ধের আপাত সমাপ্তি

নেপোলিয়নের কাছে ফ্রান্স এবং জার্মানির মিত্রদের থেকে অতিরিক্ত সেনা সহায়তা এসে পৌঁছলে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় পাঁচ লাখ। ওদিকে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মোট প্রায় তিন লাখ, প্রুশিয়ার দুই লাখ আটাশ হাজার, সুইডেনের ত্রিশ হাজার মিলিয়ে শত্রুদের বাহিনী প্রায় ছয় লাখ। প্রুশিয়ার জনসংখ্যার শতকরা ছয় ভাগ ছিল এই যুদ্ধে।  

নেপোলিয়ন তিন লাখ সৈন্য নিয়ে ছিলেন ড্রেসডেনে। এদিকে শোয়ার্জেনবার্গের ২,২৫,০০০ সৈন্য এল্বে নদী বরাবর, ব্লুশা ১,১০,০০০ সেনা নিয়ে সিলিসিয়াতে, এবং বার্নাডোটের ১,২৫,০০০ বাহিনী অবস্থান নিয়েছে উত্তরে, বার্লিনের কাছে। বার্নাডোটের বিপরীতে আছেন মার্শাল ডেঁভো এবং উদিনোতের ১,২০,০০০ সেনা। কোয়ালিশনের পরিকল্পনা খুব সহজ, দক্ষিণে বোহেমিয়া, উত্তরে বার্লিন আর পূর্বে ব্রেস্লাউ থেকে অগ্রসর হয়ে তিন দিক থেকে ফরাসিদের ঘিরে ফেলা। তাদের রসদপত্র সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করে দিলে আপসেই তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে। নেপোলিয়নের সাথে সম্মুখযুদ্ধে জড়ানোর কোনো ইচ্ছে তাদের নেই।

আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। ফরাসিদের জার্মান মিত্ররা উদিনোতের নেতৃত্বে বার্লিনের দিকে এগিয়ে গেলে বার্নাডোট তাদের হটিয়ে দেন। উদিনোতের সহায়তায় ১০,০০০ ফরাসি ব্র্যান্ডেনবার্গের মধ্য দিয়ে যাবার সময় তাদেরকেও আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এসব সফলতায় বড় ভূমিকা রেখেছিল প্রুশিয়ান মিলিশিয়া বাহিনী ল্যান্ডওয়েহ। ২৬ অগাস্ট ব্লুশা ম্যাকডোনাল্ডের ৬৭,০০০ সেনাদলের অর্ধেকই নিশ্চিহ্ন করে দেন। কিন্তু ড্রেসডেনের কাছে নেপোলিয়নের হামলায় শোয়ার্জেনবার্গ ৩৫,০০০ হতাহত ফেলে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন। এটিই ছিল নেপোলিয়নের সর্বশেষ বড় বিজয়।

ফিল্ড মার্শাল শোয়ার্জেনবার্গ; Image Source: Wikimedia Commons

শোয়ার্জেনবার্গকে তাড়িয়ে নেপোলিয়ন ড্রেসডেন থেকে বের হয়ে এবার ব্লুশা আর বার্নাডোটকে খুঁজতে থাকলেন। কিন্তু দুজনেই তাকে ফাঁকি দিল। এদিকে ফরাসিদের রসদপত্র ফুরিয়ে আসছিল। ফ্রান্স থেকে এত দূরে রসদ পাঠানো কঠিন কাজ, আবার অব্যাহত যুদ্ধে নেপোলিয়নের প্রতি জনগণও তিতিবিরক্ত। তিনি যদি ফ্রান্সে ফিরে যেতে চান তা-ও সমস্যা, কারণ স্থানীয় মিলিশিয়া আর রাশান কোস্যাক বাহিনী নিশ্চিতভাবেই চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। একমাত্র সমাধান কোথাও ঘাঁটি গেড়ে শত্রুদের এগিয়ে আসতে প্রলুব্ধ করা। নেপোলিয়ন লাইপজিগে শিবির করে তাই অপেক্ষা করতে লাগলেন চূড়ান্ত লড়াইয়ের।

ব্যাটল অফ লাইপজিগ

লাইপজিগের লড়াই তৎকালীন ইউরোপের ইতিহাসের বৃহত্তম সম্মুখযুদ্ধ, যেখানে দুই পক্ষের প্রায় অর্ধ মিলিয়ন লোক অংশ নেয়। একে ব্যাটল অফ পিপল বা ব্যাটল অফ ন্যাশন্স’ও বলা হয়। এর কারণ এতে অংশ নিয়েছিল ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান, অস্ট্রিয়ান, পোলিশ, ডাচ, ব্রিটিশ, সুইডিশসহ আরো অন্যান্য বহু জাতির লোক।  

১৪ অক্টোবর রাত, ১৮১৩।

লাইপজিগের আশেপাশে ১,৭৭,০০০ সেনা জমায়েত করেছেন নেপোলিয়ন। দক্ষিণদিকে তাদের প্রধান মার্শাল মুরাত। ১৫ অক্টোবর সকালে তার সাথে সংঘাত বাধল শোয়ার্জেনবার্গের। তবে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যেই এই সংঘাত সীমাবদ্ধ ছিল। এদিকে নেপোলিয়নের অগোচরে ব্লুশা এগিয়ে আসছিলেন উত্তর-পশ্চিম থেকে।

লাইপজিগে দুই পক্ষের অবস্থান; Image Source: themaparchive.com

১৬ তারিখ ব্লুশা উত্তর আর শোয়ার্জেনবার্গ দক্ষিণ থেকে হামলা করলে প্রচন্ড সংঘর্ষ শুরু হলো। ১৯,০০০ কোয়ালিশন সেনার ছোট একটি দল গাছপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে চলে গেল পশ্চিমে, সেদিক থেকে তার হঠাৎ করে হামলে পড়ল ফরাসিদের উপর। দিনশেষে দেখা গেল দক্ষিণ দিকে ফরাসিরা অবস্থান ধরে রেখেছে, কিন্তু উত্তর-পশ্চিমে প্রুশিয়ান জেনারেল ইয়র্কের তীব্র আক্রমণে তাদের পিছিয়ে যেতে হয়েছে। সব মিলিয়ে কোয়ালিশনের ৩০,০০০ এবং ফরাসিদের ২৫,০০০ সেনা হতাহত হয়েছে। 

ইত্যবসরে বার্নাডোট আর সমর্থক পোলিশদের একটি দল এসে পৌঁছলে কোয়ালিশন বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়াল তিন লাখে। নেপোলিয়নের জার্মান মিত্ররাও তাকে পরিত্যাগ করতে থাকে। ১৬ অক্টোবরের যুদ্ধের সময় বাভারিয়ার ৩০,০০০ সেনা অস্ট্রিয়ান তাঁবুতে চলে যায়। নেপোলিয়ন পালিয়ে যাবার চিন্তা করলেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন আর দু’একদিন দেখবেন। বলা তো যায় না, যদি শত্রুরা কোনো কৌশলগত ভুল করে বসে।

১৭ তারিখ সবাই বিশ্রাম নিল, জানা ছিল এস্পার-ওস্পার হবে পরদিন। এর ভেতরেই শহরের চতুর্দিকে কোয়ালিশন বাহিনী সংযুক্ত হয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে লাইপজিগ ঘিরে ফেলে। ১৮ তারিখ আক্রমণ শুরু হলে প্রুশিয়ান জেনারেল বুঁলো পূর্বদিকে পার্থে নদী অতিক্রম করে আক্রমণ শানালেন। ফরাসিরা শহরের উপকণ্ঠে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো। যুদ্ধ চলাকালীন ৪,০০০ স্যাক্সোন আর ফরাসিদের একটি কন্টিনজেন্ট তেড়ে যায় বার্নাডোটের সেনাদের দিকে। কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ করেই স্যাক্সোনরা উল্টো ঘুরে ফরাসিদের উপর গুলি চালিয়ে বসে।

বার্নাডোট যখন ফরাসি মার্শাল ছিলেন তখন তিনি স্যাক্সোনদের এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার ব্যবহারে তারা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে এখন তাকে দেখে ফরাসিদের পক্ষ ত্যাগ করে তার দলে ভিড়ে যায়। ফলে ফরাসি লাইনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে মার্শাল নেই বেপরোয়া চেষ্টা করেন প্রতি-আক্রমণ চালাতে, কিন্তু নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ রকেট ব্রিগেডের ছোঁড়া রকেটের আঘাতে তিনি ব্যর্থ হন।       

লাইপজিগের যুদ্ধ© Vladimir Moshkov

শহরের পতন আসন্ন বুঝতে পেরে ৩০,০০০ সেনা রেখে বাকিদের নিয়ে রাতের আঁধারে নেপোলিয়ন পেছন দিকে এহস্টা নদীর সেতু ধরে পালিয়ে গেলেন। এই ৩০,০০০ এর দায়িত্ব ছিল শত্রুদের দেরি করিয়ে দেয়া। ১৯ তারিখ কোয়ালিশন আক্রমণ চালালে তারা দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিতে থাকে। শহরের উপকণ্ঠে প্রথম ঢুকে পড়ে বুঁলোর প্রুশিয়ানরা, যাদের অনেকে ছিল মিলিশিয়া। এরা শিকার হলো দালানকোঠা আর ছাদে লুকিয়ে থাকা ফরাসি বন্দুকধারীদের। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রায় ১,০০০ প্রুশিয়ান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রাস্তাঘাটে বেধে গেল হাতাহাতি যুদ্ধ। সংকীর্ণ এক গলিপথে আরো ৪০০ প্রুশিয়ান মিলিশিয়া প্রাণ হারায়।  

ফরাসি ও কোয়ালিশন বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ © Fritz Neumann

এদিকে শহরে ঢুকবার একটি দরজা, গ্রিমা গেটের সামনে ফরাসিদের একটি দল আটকে যায়। ফটক প্রহরারত সেনাদের উপর কাউকে আর ভেতরে ঢুকতে না দেবার নির্দেশ জারি হলে ফরাসিরা পড়ে যায় অগ্রসরমান প্রুশিয়ানদের সামনে। তারা মনের সুখে ফরাসিদের কচুকাটা করতে থাকে। দুপুরের মধ্যে উত্তর আর পূর্ব দিক থেকে দলে দলে কোয়ালিশন সেনারা শহরে প্রবেশ করলে পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ফরাসিরা এহস্টা সেতুর দিকে ছুটে যায়। নেপোলিয়নের নির্দেশে এক কর্পোরাল আগেই সেতুর তলায় বোমা বসিয়েছিলেন, উদ্দেশ্য ফরাসিরা সবাই পালিয়ে যাবার পর সেতু ধ্বংস করে দেয়া। ফলে কোয়ালিশন বাহিনীর পিছু নিতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু অগ্রসরমান শত্রুসৈন্য দেখে সেই কর্পোরাল সময়ের আগেই বোতাম টিপে দিলে সেতুভর্তি ফরাসি সৈন্য আর মালামাল নিয়ে বিশাল বিস্ফোরণে সব তলিয়ে গেল।

লাইপজিগের পরাজয়ের সাথে সাথে নেপোলিয়নের আক্রমণাত্মক যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ৭৩,০০০ ফরাসি সেনা এখানে তাকে বিসর্জন দিতে হয়। জার্মানিতে তার ক্ষমতার অবসান হয়েছে, ফ্রান্সের রাস্তা উন্মুক্ত। কোয়ালিশনের ৫৪,০০০ হতাহতের মধ্যে ১৬,০০০ ছিল প্রুশিয়ান। মূলত প্রুশিয়ান সেনাদলই কোয়ালিশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়। প্রুশিয়ান জেনারেলরাও মিত্রদের সমীহ আদায় করে নেন।

প্যারিসে নেপোলিয়ন

মাইয়েন্সে কিছুদিন থাকার পর নভেম্বরের ৯ তারিখে নেপোলিয়ন প্যারিসে পৌঁছালেন। রাশিয়া আর প্রুশিয়া চাইছিল একেবারে প্যারিস পর্যন্ত আক্রমণ চালিয়ে নেপোলিয়নের ক্ষমতাকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু অস্ট্রিয়ার চাওয়া শান্তিপূর্ণ সমাধান। ফলে মেটেরনিখ শান্তি প্রস্তাব বয়ে নিয়ে এলেন। নেপোলিয়ন সম্রাট থাকবেন। ফ্রান্স তার প্রাকৃতিক সীমানায় ফিরে যাবে, যা হলো জার্মানির সাথে রাইন, স্পেনের সাথে পিরেনিজ পর্বতমালা, এবং অস্ট্রিয়ার সাথে আল্পস। তাদের দাবি ছিল অবিলম্বে এই প্রস্তাব গ্রহণ কর, নাহয় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নাও। নেপোলিয়ন এবারও ভুল করলেন, সরাসরি প্রস্তাব গ্রহণ না করে সরকারি কর্মকর্তাদের আলোচনার টেবিলে ঠেলে দিলেন। ফরাসিদের বিতর্কের মাঝেই ডিসেম্বরের ২ তারিখে প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হল। ১১ তারিখ প্রাক্তন স্প্যানিশ রাজা সপ্তম ফার্ডিন্যান্ডের সাথে চুক্তি করে নেপোলিয়ন স্পেন সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেন, ফলে ফার্ডিন্যান্ড আবার স্প্যানিশ সিংহাসনে সমাসীন হলেন।     

ফ্রান্সে আগ্রাসনের পরিকল্পনা

কোয়ালিশনের মাথারা জড়ো হয়েছিলেন বাসেলে। এখানে ১৮ জানুয়ারি, ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ক্যাস্টারলেই এসে হাজির। তিনি চান বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডস মিলিয়ে একটি রাষ্ট্র, যা ভবিষ্যৎ ফরাসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাফারের কাজ করবে। একই উদ্দেশ্যে প্রুশিয়ার সীমানা পশ্চিমে আরো বৃদ্ধি করতে তিনি রাজি ছিলেন। তিনি ৫ মিলিয়ন অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দেন, যা খরচ হবে যুদ্ধ এবং স্পেন ও পর্তুগালের ক্ষয়ক্ষতি মেরামতে। কোয়ালিশন সদস্যদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব ঘোচাতে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

এদিকে ফ্রান্স রক্ষার জন্য নেপোলিয়নের হাতে ৬০,০০০ সেনা রাইন জুড়ে মজুত, আরো ৩০,০০০ আছে রিজার্ভে। তার বিপক্ষে কোয়ালিশনের পরিকল্পনা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ফ্রান্সে হামলা করা। তাদের নেতৃত্বে থাকবেন শোয়ার্জেনবার্গ আর ব্লুশা। হামবুর্গে তখনও ডেভোঁর বাহিনীকে আটকে রেখেছেন বার্নাডোট। বুলো আছেন নেদারল্যান্ডসে ২০,০০০ সেনা নিয়ে, আর ওয়েস্টফ্যালেয়ার দিকে ফার্দিন্যান্দ নামে এক সেনা অফিসার শিবির করেছেন। ইতালিতে আছে ৭৫,০০০ অস্ট্রিয়ান, যাদের মুখোমুখি প্রিন্স ইউজিন ফরাসি বাহিনী নিয়ে।

এদিকে স্পেন থেকে বেরিয়ে এলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়েলেসলি, মার্শাল সল্টের বাধা অগ্রাহ্য করে রওনা হলেন ফ্রান্সের দিকে। নেপোলিয়নের এতদিনের বিশ্বস্ত মার্শাল মুরাত, যার স্ত্রী সম্রাটের আপন বোন এবং যাকে নেপোলিয়ন নেপলসের রাজা বানিয়েছিলেন, তিনি ১৮১৪ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখ অস্ট্রিয়ানদের পক্ষে যোগ দিয়ে তাদের সহায়তায় ৩০,০০০ সেনা প্রেরণ করেন।

ফ্রান্সে অভিযান

৩১ ডিসেম্বর, ১৮১৩।

প্রুশিয়ানদের নিয়ে ব্লুশা রাইন পার হয়ে ফরাসি সীমানায় প্রবেশ করলেন। তার দক্ষিণ-পশ্চিমে শোয়ার্জেনবার্গ। নেপোলিয়ন ব্রিয়েনের কাছে জানুয়ারির ২৯ তারিখ ব্লুশার উপর হামলা করেন, উদ্দেশ্য শোয়ার্জেনবার্গের সাথে তার সম্মিলন রোধ করা। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন। ফ্রান্সের উত্তরে লাঁ রঁথিয়েতেও ব্লুশা ফরাসিদের পিছু হটতে বাধ্য করেন। ব্লুশা প্যারিসের দিকে আগালে ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ শ্যাম্পুবেয়ারে মার্শাল নেই আর মারমন্ট তার বাহিনীর একাংশকে বিধ্বস্ত করে দেন।

এদিন থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ছয় দিনের ক্যাম্পেইন (Six Days Campaign), যাতে নেপোলিয়ন ছোট ছোট সংঘর্ষে কোয়ালিশন বাহিনীকে পরাজিত করলেও বড় কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম হননি। এরপর ব্লুশা শ্যালনসে নিজেকে সংগঠিত করেন। নেপোলিয়ন তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেছেন। ১৬,০০০ সেনা হতাহত। কিন্তু কোয়ালিশনের লোকবল আর সম্পদের পরিমাণ ফরাসিদের থেকে অনেক বেশি, ওদিকে নেপোলিয়ন তার ক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন।

ছয় দিনের ক্যাম্পেইন; Image Source: weaponsandwarfare.com

শোয়ার্জেনবার্গ প্যারিসের দিকে যেতে থাকলে ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ নেপোলিয়ন তাকে বাধা দেন। শোয়ার্জেনবার্গ তোঁয়া শহরের দিকে পিছিয়ে গেলেন, সেখান থেকে সরে যান ফ্রান্সের উত্তরপূর্বে লাঙ্গ শহরের দিকে। নেপোলিয়ন তাকে অনুসরণ করে সেইন নদীর পূর্বদিকে চলে আসেন। ওদিকে ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ পূর্ব ফ্রান্সের শ্যাঁটিওনে (Châtillon-sur-Seine) কোয়ালিশন সদস্যরা বৈঠকে বসে। ফরাসি প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যালেনকোর্ট। কোয়ালিশন দাবি করল প্রাকৃতিক সীমানা নয়, ফ্রান্সকে তার ১৭৯২ সালের পূর্ববর্তী সীমান্তে ফিরে যেতে হবে। ক্যালেনকোর্ট এককথায় তা নাকচ করে দেন। মার্চের ৯ তারিখ শুঁমো (Treaty of Chaumont) শহরের চুক্তিতে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া আর  প্রুশিয়া যতক্ষণ ফ্রান্স ১৭৯২ পূর্ব সীমানায় ফিরে না যাচ্ছে ততক্ষণ লড়াই জারি রাখার শপথ নিল। এতে মূল ভূমিকা পালন করেন ক্যাস্টারলেই। সব সদস্য ফরাসি আগ্রাসন প্রতিহত করতে বিশ বছরের জন্য একটি জোট গঠনেও সম্মত হয়।

ফেব্রুয়ারির শেষদিকে ব্লুশা এনে (Aisne) অঞ্চলের দিকে যাত্রা করেন। এখানে মার্চের ৩ তারিখ সঁসো শহরের পতন হলো। ক্রেওন শহরের কাছে ফরাসিদের সাথে সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই ৬,০০০ সেনা হতাহত হয়। এনে’র রাজধানী লাওনের দিকে ব্লুশা চলে যান। মার্চের ৯ তারিখ নেপোলিয়ন সেখানে আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। সেই রাতেই মার্শাল মারমন্টের অধীনস্থ বাহিনী ব্লুশার দলের হাতে ভেঙে পড়ে।     

নেপোলিয়ন আছেন বিরাট ছোটাছুটির মধ্যে। তিনি ব্লুশার দিকে আগালে শোয়ার্জেনবার্গ প্যারিসের দিকে যান, আর শোয়ার্জেনবার্গের দিকে আসলে ব্লুশা খোলা রাস্তা পান। ব্লুশার দিকে তার ব্যস্ততার সুযোগে ইতোমধ্যেই শোয়ার্জেনবার্গ ম্যাকডোনাল্ড আর উদিনোতকে ঠেলতে ঠেলতে অনেকদূর নিয়ে গেছেন। ২০-২১ তারিখ উব অঞ্চলের কাছে তার সাথে সংঘর্ষের পর নেপোলিয়ন লরেইনে পিছিয়ে গেলেন। মার্চের ২৫ তারিখ ফরাসি মার্শাল মারমন্ট আর মর্টিয়ার পরাজিত হন। ২৯ তারিখে কোয়ালিশন বাহিনী চলে এলো প্যারিসের উপকণ্ঠে। ৩০ তারিখ নিস্ফল লড়াইয়ের পর মারমন্ট আর মর্টিয়ার শহর রক্ষায় অপারগতা প্রকাশ করলেন। ৩১ তারিখ বিজয়ী কোয়ালিশন বাহিনী প্যারিসে প্রবেশ করে, সর্বাগ্রে জার আলেক্সান্ডার, তার পেছনে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম, সাথে শোয়ার্জেনবার্গ।

প্যারিসে বিজয়ী কোয়ালিশন বাহিনী; Image Source: Wikimedia Commons

সমাপ্তি 

১৮১৪ সালের এপ্রিলের ২ তারিখ ফরাসি সিনেট নেপোলিয়নকে পদচ্যুত করে। ৬ তারিখে ষোড়শ লুইয়ের ভাইকে অষ্টাদশ লুই হিসেবে তারা ফ্রান্সের সিংহাসন গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। ইতোমধ্যে নেপোলিয়ন প্যারিসের উপকণ্ঠে ফন্টেনব্ল্যাঁ’তে এসে পৌঁছেন। তার ইচ্ছা অবশিষ্ট ৬০,০০০ সৈন্য নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লড়াই চালাবার। কিন্তু বাধ সাধলেন তার মার্শালরা। নেই নিজে সম্রাটের কাছে গিয়ে বললেন তাদের যুদ্ধ করে আর কোনো লাভ নেই, তিনি যাতে পদত্যাগ করেন।

নিরুপায় নেপোলিয়ন এপ্রিলের ১৩ তারিখ ফন্টেনব্ল্যাঁ’ চুক্তি মেনে নেন (The Treaty of Fontainebleau)। তার এবং স্ত্রী মেরি লুইসের পদবী বহাল রাখা হয়, যদিও তা ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। নেপোলিয়নের থাকার স্থান নির্ধারিত হয় ভূমধ্যসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এল্বা, যেখানে তার সার্বভৌম কর্তৃত্ব মেনে নেয়া হলো। তাকে বার্ষিক একটি ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। মেরি লুইসকে দেয়া হলো ইতালির কয়েকটি এলাকা, মূলত পারমা ডাচি আর পার্শ্ববর্তী অংশ। তবে নেপোলিয়নের সকল সম্পত্তি ফরাসি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ২০ তারিখ নেপোলিয়ন এল্বার উদ্দেশ্যে রওনা হন। নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক রক্ষী রাখার অনুমতি তার ছিল।

মে মাসের ২০ তারিখ অষ্টাদশ লুইয়ের ফরাসি সরকারের সাথে কোয়ালিশনের আরেকটি চুক্তি (Treaty of Paris) অনুযায়ী ফ্রান্স ১৭৯২ পূর্ব সীমানায় ফিরে যেতে সম্মত হয়। তবে যুদ্ধের জন্য কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাওয়া হলো না, এবং লুণ্ঠিত মালামাল ফেরতের কোনো শর্তও ছিল না। টোবাগো, সেন্ট লুসিয়া, মৌরিশাস, সেইচেলেসের উপনিবেশ ফ্রান্স তুলে দেয় ইংল্যান্ডের হাতে। স্যান ডোমিঙ্গো পেল স্পেন। ইউরোপের মানচিত্র নতুন করে আঁকতে কোয়ালিশন ভিয়েনাতে যে সম্মেলন আহ্বান করে তার ফলাফল মেনে নিতেও ফ্রান্স প্রতিশ্রুতি দেয়।

This is a Bengali language article about the rise and eventual downfall of Prussia and how it led to a unified Germany. Necessary references are mentioned below.

Reference

  1. Clark, C. M. (2007). Iron kingdom: The rise and downfall of Prussia, 1600-1947. London: Penguin Books.
  2. Abbott, J. S. C. (1882). The history of Prussia. New York, Dodd, Mead, and company.
  3. Geer (1921). Napoleon the First: An Intimate Biography. New York, Brentano's. pp. 186-205.
  4. Napoleonic Wars. Encyclopedia Britannica

Feature Image:istockphoto.com

Related Articles

Exit mobile version