মুয়াম্মার আল–গাদ্দাফি ১৯৬৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ২০১১ সালের লিবীয় গৃহযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্র লিবিয়ার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। লিবিয়ার ভেতরে ও বাইরে অনেকের কাছে তিনি ছিলেন মহান বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক, আবার অনেকের কাছে তিনি ছিলেন খামখেয়ালি, স্বৈরাচারী একনায়ক। কিন্তু গাদ্দাফি সম্পর্কে একটি বিষয় প্রায় সুস্পষ্ট। সেটি হলো– তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন, এবং সেই সূত্র ধরে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের কঠোর সমালোচক ছিলেন। ইসরায়েলকে তিনি ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরব জনগোষ্ঠীর ওপরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া ‘বোঝা’ হিসেবে বিবেচনা করতেন।
গাদ্দাফি লিবিয়ার রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করে লিবিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করেছিলেন। লিবীয় জনসাধারণের মধ্যে ইদ্রিসের অজনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ ছিল ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে লিবিয়ার নিষ্ক্রিয় অবস্থান। স্বাভাবিকভাবেই শাসনকালের প্রাথমিক পর্যায়ে গাদ্দাফি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তার অন্যতম একটি কারণ ছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান। গাদ্দাফির শাসনকালের প্রথম দিকে লিবিয়ার সঙ্গে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছিল, তার নানাবিধ কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সমর্থন।
গাদ্দাফি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের বিরতিহীনভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে বিশ্বাস করতেন। ১৯৭০ সালে তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি ‘জিহাদ তহবিল’ গঠন করেছিলেন। ১৯৭২ সালে ইসরায়েলবিরোধী গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তিনি প্রাক্তন মিসরীয় রাষ্ট্রপ্রধান গামাল আব্দেল নাসেরের নামে ‘নাসেরীয় স্বেচ্ছাসেবক কেন্দ্র’ চালু করেছিলেন।
১৯৭২ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির মিউনিখে অলিম্পিক গেমস চলাকালে ফিলিস্তিনি সংগঠন ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’–এর সদস্যরা একদল ইসরায়েলি খেলোয়াড়কে খুন করে এবং ৫ জন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর মিলিট্যান্টও পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়। গাদ্দাফি নিহত ফিলিস্তিনিদের মরদেহ লিবিয়াতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন এবং বীরের মর্যাদায় দাফন করেন।
১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি–দখলকৃত সিনাই উপদ্বীপের আকাশে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী একটি লিবীয় যাত্রীবাহী বিমানকে ভূপাতিত করে, যার ফলে ১০৮ জন যাত্রী নিহত হয়।
১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে লিবিয়া সক্রিয়ভাবে মিসর ও সিরিয়াকে সমর্থন করে। লিবীয় বিমানবাহিনীর ২টি ‘মিরেজ–৫’ স্কোয়াড্রন ও লিবীয় সেনাবাহিনীর ১টি আর্মার্ড ইউনিট এই যুদ্ধের সময় মিসরে প্রেরিত হয়েছিল, এবং লিবিয়া মিসর ও সিরিয়াকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছিল। ১৯৭০ এবং ১৯৮০–এর দশক জুড়ে লিবিয়া ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ‘ফাতাহ’কে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সমর্থন করে এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি গ্রুপকেও সাহায্য করে। অর্থাৎ, গাদ্দাফির শাসনামলের প্রথম কয়েক দশকে তিনি কঠোর ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু গাদ্দাফি কি তার ইসরায়েলবিরোধী আদর্শিক অবস্থানে অনড় ছিলেন? নাকি তার ইসরায়েল বিরোধিতা ছিল রিয়েলপলিটিকের (Realpolitik) অংশ? এই প্রশ্নটি উত্থাপন করা যায়, কারণ গাদ্দাফির শাসনাধীন লিবিয়া এবং ইসরায়েলের মধ্যেকার আপাতদৃষ্টিতে ‘চিরস্থায়ী দ্বান্দ্বিক’ সম্পর্কের অন্তরালে অন্তত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে লিবিয়া ও ইসরায়েল পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত ছিল। সেই ক্ষেত্রটি ছিল ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতার যুদ্ধক্ষেত্র।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইতালি বর্তমান ইরিত্রিয়া দখল করে নিয়ে সেটিকে একটি ইতালীয় উপনিবেশে পরিণত করে। ১৯৩৫–১৯৩৬ সালের ইতালীয়–ইথিওপীয় যুদ্ধে ফ্যাসিবাদী ইতালি ইথিওপিয়া দখল করে নেয় এবং ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া ও ইতালীয় সোমালিল্যান্ডকে একত্রিত করে ‘ইতালীয় পূর্ব আফ্রিকা’ নামক একটি বৃহৎ উপনিবেশ গঠন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেন ইতালীয় পূর্ব আফ্রিকা দখল করে নেয় এবং ইথিওপিয়া স্বাধীনতা ফিরে পায়। বিশ্বযুদ্ধে শেষে ইরিত্রীয় জনসাধারণের মতামতকে উপেক্ষা করে ইরিত্রিয়াকে ইথিওপিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে একটি ফেডারেশন গঠন করা হয় এবং ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি এই ফেডারেশনের শাসক নিযুক্ত হন।
এই ফেডারেশনের অধীনে ইরিত্রিয়া আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছিল এবং ইরিত্রিয়ার নিজস্ব আইনসভা ছিল। কিন্তু ইথিওপীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ইরিত্রীয়রা সন্তুষ্ট ছিল না। তারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ‘ইরিত্রীয় মুক্তি ফ্রন্ট’–এর (Eritrean Liberation Front, ‘ELF’) নেতৃত্বে ১৯৬১ সালে ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৬২ সালে ইরিত্রিয়ার স্বায়ত্তশাসন ও আইনসভা বিলুপ্ত করে ইথিওপীয় সরকার ইরিত্রিয়াকে ইথিওপিয়ার একটি প্রদেশে পরিণত করে। এর ফলে ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ আরো তীব্রতর হয়।
ইথিওপিয়া কোনোক্রমেই ইরিত্রিয়াকে হাতছাড়া করতে রাজি ছিল না। কারণ, স্থলবেষ্টিত ইথিওপিয়ার অর্থনীতি ও নৌশক্তির জন্য লোহিত সাগরের তীরবর্তী ইরিত্রিয়া ছিল অপরিহার্য। তদুপরি, ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকরা ইরিত্রিয়াকে পূর্ব আফ্রিকার শিল্পকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, এজন্য ইথিওপিয়া মোট উৎপাদিত দ্রব্যের প্রায় ২৭% আসতো ইরিত্রিয়া থেকে এবং ইথিওপিয়ার প্রায় ৬০% শিল্পকারখানা ইরিত্রিয়ায় অবস্থিত ছিল।
সে সময় পূর্ব আফ্রিকায় ইথিওপিয়া ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইথিওপীয় সশস্ত্রবাহিনীর সিংহভাগ অস্ত্রশস্ত্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবা ইরিত্রীয় স্বাধীনতাকামীদের অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছিল। ইরিত্রীয় স্বাধীনতাকামীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মুসলিম, এজন্য ইরাক, সিরিয়া, সুদান, সৌদি আরব ও সোমালিয়াসহ বিভিন্ন আরব ও মুসলিম রাষ্ট্র ইএলএফকে সমর্থন করে। ১৯৬৯ সালের পর থেকে গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন লিবিয়াও ইএলএফকে সমর্থন করতে শুরু করে।
১৯৭০ সালে ইএলএফের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং ইএলএফের একটি অংশ ইরিত্রীয় গণমুক্তি ফ্রন্ট (Eritrean People’s Liberation Front, ‘EPLF’) নামে পৃথক একটি সংগঠন গঠন করে। নিজেদের মধ্যে রক্তাক্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও ইরিত্রীয় যোদ্ধারা ইথিওপীয় সশস্ত্রবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে ইরিত্রীয় যুদ্ধের সমস্ত সমীকরণ পাল্টে যায়।
১৯৭৪ সালে ইথিওপীয় সেনাবাহিনীর একদল মার্ক্সবাদী কর্মকর্তা ইথিওপীয় রাজতন্ত্রকে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে এবং একটি মার্ক্সবাদী–লেনিনবাদী বিপ্লবী সামরিক সরকার ইথিওপিয়ার শাসনভার গ্রহণ করে। অভ্যুত্থানের নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মেঙ্গিস্তু হাইলে মারিয়াম বিজয়ী হন এবং ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইথিওপিয়ার সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটে এবং বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত বলয়ভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে ইথিওপিয়া ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত বলয়ভুক্ত অন্য রাষ্ট্রগুলো ইরিত্রীয় স্বাধীনতাকামীদের সহায়তা প্রদান বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, ১৯৭৭ সালে ইথিওপিয়ার জাতিগত সোমালি–অধ্যুষিত ওগাদেন অঞ্চলে সোমালিয়া আক্রমণ চালালে ইথিওপীয় সৈন্যরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেসময় কিউবান ও দক্ষিণ ইয়েমেনি সৈন্য এবং সোভিয়েত ও পূর্ব জার্মান সামরিক উপদেষ্টাদের সহায়তায় ইথিওপিয়া সোমালি আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। ইরিত্রীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করার জন্যও সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টারা ইথিওপীয় সরকারকে সহায়তা করতে শুরু করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন লিবিয়াও রাতারাতি পক্ষ পরিবর্তন করে ফেলে এবং ইরিত্রীয় স্বাধীনতাকামীদের পরিবর্তে ইথিওপীয় সরকারকে সহায়তা করতে শুরু করে। লিবিয়ার এই পক্ষ পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে লিবিয়ার ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব। সেসময় অধিকাংশ আরব রাষ্ট্রই গাদ্দাফিকে ‘খামখেয়ালি’ এবং ‘হঠকারী’ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল এবং গাদ্দাফির অতি সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতিকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখছিল। ১৯৭৭ সালে লিবিয়া ও মিসরের মধ্যে একটা ছোটখাটো যুদ্ধও হয়েছিল। অন্যদিকে, বিভিন্ন কারণে গাদ্দাফি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি ও পশ্চিম জার্মানিসহ পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন। এজন্য অস্ত্র আমদানির জন্য গাদ্দাফি ক্রমশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যদিও মস্কোও এই বর্ণাঢ্য রাষ্ট্রনায়ককে পুরোপুরি বিশ্বাস করত না এবং গাদ্দাফিরও সোভিয়েত কমিউনিজমের প্রতি কোনো আস্থা ছিল না।
এমতাবস্থায় গাদ্দাফির লিবিয়া নতুন মিত্ররাষ্ট্রের সন্ধান করছিল। ইথিওপিয়ায় আপাতদৃষ্টিতে পশ্চিমাবিরোধী মেঙ্গিস্তু সরকারের আবির্ভাব লিবিয়াকে এরকমই একটি মিত্রের সন্ধান এনে দেয়। পূর্ব আফ্রিকার বৃহত্তম রাষ্ট্র ইথিওপিয়ার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন লিবিয়াকে অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ এনে দেয়। এজন্য লিবিয়া ইথিওপিয়াকে বিপুল পরিমাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে এবং ইরিত্রীয় স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইথিওপিয়াকে রসদপত্র সরবরাহ আরম্ভ করে।
এই পরিবর্তনশীল সমীকরণে ইসরায়েল ছিল সবচেয়ে বাস্তববাদী চলক। ১৯৬০–এর দশকে ইসরায়েল ইথিওপিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এই সম্পর্ক সৃষ্টির পেছনে ইসরায়েলের নানাবিধ কারণ ছিল।
প্রথমত, ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ছিল শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি মিত্রহীন রাষ্ট্র। এই আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য ইসরায়েল বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অনারব রাষ্ট্রের (যেমন: ইরান, তুরস্ক ও ইথিওপিয়া) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল। উল্লেখ্য, সাধারণভাবে মধ্যপ্রাচ্য বলতে পশ্চিম এশিয়া ও মিসরকে বুঝানো হয়, অন্যদিকে, ‘বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য’ বলতে পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব আফ্রিকাকে বুঝানো হয়ে থাকে, এমনকি কখনো কখনো মধ্য এশিয়াকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা হয়।
দ্বিতীয়ত, ইরিত্রিয়ার ওপর ইথিওপিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকায় লোহিত সাগরের দক্ষিণ উপকূল এবং কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাব-এল-মান্দেব প্রণালী ইথিওপিয়ার সন্নিকটে ছিল। আরবরা যাতে বাব-এল-মান্দেব প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ না পেয়ে যায় এবং ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় সমুদ্রবন্দর এইলাত–এর (Eilat) লোহিত সাগরীয় প্রবেশপথ যাতে উন্মুক্ত থাকে সেজন্য ইথিওপিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইসরায়েলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একই কারণে আরব–সমর্থিত ইরিত্রীয় স্বাধীনতাকামীরা যেন বিজয়ী হতে না পারে সেটাও ছিল ইসরায়েলের উদ্দেশ্য।
তৃতীয়ত, শিল্পক্ষেত্রে অনুন্নত ইথিওপিয়া শিল্পোন্নত ইসরায়েলের উৎপাদিত শিল্পজাত পণ্যের জন্য একটি আদর্শ বাজারে পরিণত হতে পারত। ইথিওপিয়ায় শিল্পজাত দ্রব্য ও অস্ত্রশস্ত্র রপ্তানি করে ইসরায়েলের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ ছিল।
সর্বোপরি, ইথিওপিয়ায় ইসরায়েলের সেনা ও বিমানঘাঁটি ছিল। ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে মাত্র ৬ দিনের মধ্যে ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোকে পরাজিত করেছিল। এর মূল কারণ ছিল যুদ্ধের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ‘অপারেশন ফোকাস’ নামক একটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে মিসরীয় বিমানবাহিনীকে মাটিতে থাকা অবস্থাতেই প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। ইসরায়েলের এই অভাবনীয় সাফল্যের বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি ছিল– এই আক্রমণের প্রথম ধাপে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী নিজস্ব বিমানঘাঁটির পরিবর্তে ইথিওপীয় বিমানঘাঁটিগুলো ব্যবহার করেছিল। মিসরীয়রা ইসরায়েলের দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টোদিক থেকে অর্থাৎ ইথিওপিয়ার দিক থেকে আক্রমণ শুরু হওয়ায় তারা প্রথমে বুঝতেই পারেনি যে, কারা তাদের ওপর আক্রমণ করেছে!
এসব কারণে ইসরায়েল ইথিওপিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার জন্য ইথিওপিয়াকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে শুরু করে। তারা ইথিওপিয়াকে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। ১৯৬২ সালের পর থেকে ইসরায়েলি সামরিক উপদেষ্টারা ইথিওপিয়ার ‘ইমার্জেন্সি পুলিশ’ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। এটি ছিল ৩,১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ গেরিলাবিরোধী বাহিনী, যাদের মূল দায়িত্ব ছিল ইরিত্রীয় গেরিলাদের নির্মূল করা। ইরিত্রিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে বেশকিছু যৌথ ইথিওপীয়–ইসরায়েলি অর্থনৈতিক প্রকল্পও শুরু হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের সময় আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রচণ্ড চাপের মুখে ইথিওপিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এটি ছিল আরবদের শান্ত করার জন্য ইথিওপিয়ার একটি কৌশল মাত্র। কারণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও ইথিওপিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা পুরোদমে অব্যাহত ছিল।
১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ার ওয়াশিংটনপন্থী রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং তদস্থলে একটি মস্কোপন্থী সামরিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ক্রমশ মার্কিনবিরোধী হয়ে উঠা ইথিওপিয়ার সম্পর্কে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখে। কারণ, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে আরব–প্রভাবাধীন স্বাধীন ইরিত্রিয়া সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল মস্কোপন্থী ইথিওপিয়ার তুলনায় অধিক বিপজ্জনক।
১৯৭৭–১৯৭৮ সালে যখন ইথিওপিয়া প্রায় সম্পূর্ণভাবে সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, তখনো ইথিওপীয় সশস্ত্রবাহিনীতে বহুসংখ্যক ইসরায়েলি সামরিক উপদেষ্টা ছিল এবং তারা ইথিওপীয় সৈন্যদেরকে আরব–সমর্থিত ইরিত্রীয় গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। ইথিওপীয় বিমানবাহিনীর মার্কিন–নির্মিত ‘এফ–৫’ যুদ্ধবিমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে ইসরায়েলি কর্মীরা নিযুক্ত ছিল। শুধু তাই নয়, এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নতুন মিত্র ইথিওপিয়াকে যে বিপুল সংখ্যক ট্যাঙ্ক সরবরাহ করেছিল, সেই ট্যাঙ্ক চালনার ক্ষেত্রেও ইসরায়েলিরা ইথিওপীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। কারণ, ১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলিরা আরবদের কাছ থেকে প্রায় ৪০০টি সোভিয়েত–নির্মিত ট্যাঙ্ক দখল করে নিয়েছিল এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এই ট্যাঙ্কগুলোর ব্যবহার শুরু করেছিল।
ইসরায়েলিরা যেসব সোভিয়েত–নির্মিত ট্যাঙ্ক চালনার ক্ষেত্রে ইথিওপীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, সেই ট্যাঙ্কগুলো ইথিওপিয়ার নিজের অর্থে কেনা হয়নি। লিবিয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত পেট্রোডলার ব্যয় করে ইথিওপিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে এই সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করেছিল। শুধু তাই নয়, ইথিওপিয়া ইসরায়েলি সামরিক উপদেষ্টাদের যে বেতন প্রদান করতো, সেই অর্থও অনেক সময় লিবিয়া থেকেই আসতো। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮২ সালে যখন সোভিয়েত ও ইসরায়েলি সামরিক উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে ইথিওপীয় সৈন্যরা ইরিত্রিয়ায় নতুন করে অভিযান শুরু করে, তখনো লিবিয়া ইথিওপিয়াকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিল এবং লিবীয় বিমান ইথিওপীয় সৈন্যদের জন্য রসদপত্র নিয়ে ইরিত্রিয়ায় আসছিল।
এভাবে ভাগ্যের পরিহাসে ইসরায়েল এবং তীব্র ইসরায়েলবিরোধী লিবিয়া ইরিত্রিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরকে একই পক্ষে আবিষ্কার করে। কিন্তু ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকরা বরাবরই ছিল বাস্তববাদী, এজন্য নিজেদের স্বার্থে লিবিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা করতে তারা কোনো সংকোচ বোধ করেনি। কিন্তু তীব্র ইসরায়েলবিরোধী গাদ্দাফির জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা (তা যতই পরোক্ষভাবে হোক না কেন) ছিল বিব্রতকর। ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতার বিপক্ষে চলে যাওয়ায় এবং বিশেষত ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা করায় লিবিয়াকে (এবং ব্যক্তিগতভাবে গাদ্দাফিকে) কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু মিসর, সৌদি আরব ও সুদানসহ অধিকাংশ আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত লিবিয়াও এক্ষেত্রে আদর্শগত কট্টরবাদ পরিহার করে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ সহযোগিতার ব্যাপারটিকে বাস্তববাদী দৃষ্টিতে গ্রহণ করে।
কিন্তু ইরিত্রীয় যুদ্ধের ফলাফল লিবিয়া বা ইসরায়েলের অনুকূলে আসেনি। ১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিখাইল গর্বাচেভের নতুন পররাষ্ট্রনীতি অনুসারে ইথিওপিয়াকে সহযোগিতা করা বন্ধ করে দেয় এবং ১৯৯১ সালে ইথিওপিয়ায় মেঙ্গিস্তু সরকারের পতন ঘটে। ইথিওপিয়ার নতুন সরকার ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতার ওপরে একটি গণভোটের আয়োজন করে এবং ইরিত্রিয়ার জনসাধারণ বিপুলভাবে স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। অবশেষে ১৯৯৩ সালে ইরিত্রিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
কিন্তু এই পরাজয়ে ইসরায়েলিরা হতাশ হয়নি। বরাবরের মতো তারা বাস্তববাদিতার পরিচয় দিয়ে নিজেদের স্বার্থের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং ইরিত্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। অন্যদিকে, ১৯৯০–এর দশকে গাদ্দাফি তার ‘বিপ্লবী’ বা অতি সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতি বহুলাংশে পরিত্যাগ করে এবং লিবিয়া পূর্ব আফ্রিকার রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে লিবীয়–ইসরায়েলি পরোক্ষ সহযোগিতার অবসান ঘটে।