ইরাক–ইরান যুদ্ধ (১৯৮০–১৯৮৮) মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাক কর্তৃক ইরান আক্রমণের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ আরম্ভ হয় এবং ১৯৮৮ সালের ২০ আগস্ট ইরান কর্তৃক জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে বাগদাদ বা তেহরান কারোরই প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি, কিন্তু উভয় পক্ষের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। উভয় পক্ষের ৫ থেকে ১০ লক্ষ সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয় এবং আরো প্রায় ৫ লক্ষ সৈন্য বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। উভয় পক্ষ এই যুদ্ধের জন্য সরাসরি অন্তত ২২,৮০০ কোটি (বা ২২৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয় করে এবং যুদ্ধের ফলে উভয় পক্ষের অন্তত ৪০,০০০ কোটি (বা ৪০০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়। সামগ্রিকভাবে, এই যুদ্ধটি ছিল উভয় পক্ষের জন্য অত্যন্ত বিপর্যয়কর।
কিন্তু এই যুদ্ধের কতিপয় দিক ছিল, যেগুলো এই যুদ্ধটিকে ইতিপূর্বের অন্যান্য যুদ্ধ থেকে পৃথক রূপ প্রদান করে। অর্থাৎ, এই যুদ্ধ চলাকালে এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়, যেগুলো এর পূর্বে অনুষ্ঠিত কোনো যুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়নি।
প্রথমত, ইরাক–ইরান যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৮ দিন পর ১৯৮০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইরানি বিমানবাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন স্কর্চ সোর্ড’ (Operation Scorch Sword) পরিচালনা করে। এই অভিযানে ইরানি যুদ্ধবিমানগুলো বাগদাদ থেকে ১৭ কি.মি. দক্ষিণ–পূর্বে অবস্থিত ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লির ওপর বোমাবর্ষণ করে এবং সেটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের গোপন পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করা। এর ফলে ইরাকি সরকার তিন মাসের জন্য চুল্লিটির কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। এটি ছিল যুদ্ধ চলাকালে কোনো যুধ্যমান পক্ষ কর্তৃক প্রতিপক্ষের পারমাণবিক কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ পরিচালনার প্রথম ঘটনা।
অবশ্য এই আক্রমণের ফলে ইরাকি পরমাণু প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। ফ্রান্সের সহায়তায় ইরাক ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক চুল্লিটি মেরামত করে এবং পরমাণু প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু করে। অবশেষে ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েলি বিমানবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ‘অপারেশন অপেরা’র ফলে ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, ইরাক–ইরান যুদ্ধ ছিল ইতিহাসের একমাত্র যুদ্ধ যেটিতে উভয় পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবহার করেছে। যুদ্ধ চলাকালে উভয় পক্ষই একে অপরের শহরগুলোর বিরুদ্ধে বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালায়, যেটি ‘শহরসমূহের যুদ্ধ’ (War of the Citites) হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে ইরাক ও ইরানের মধ্যে মোট ৫টি অনুরূপ ‘ক্ষেপনাস্ত্র যুদ্ধ’ সংঘটিত হয় এবং এর ফলে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৮৮ সালে এই ধরনের আক্রমণ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। সেই বছরে ইরাকিরা সাত সপ্তাহব্যাপী ‘আল–হুসেইন’ ক্ষেপনাস্ত্র (মূলত পরিমার্জিত সোভিয়েত–নির্মিত ‘স্কাড’ ক্ষেপনাস্ত্র) ব্যবহার করে তেহরানের ওপর মোট ৪০ টন বিস্ফোরক নিক্ষেপ করে। এই আক্রমণের ফলে তেহরানের প্রায় ১০ লক্ষ বাসিন্দা শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
তৃতীয়ত, এটি ছিল ইতিহাসের একমাত্র যুদ্ধ, যাতে উভয় পক্ষের সামরিক হেলিকপ্টার বহরদ্বয় সরাসরি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০ সালের নভেম্বরে ইরানি বিমানবাহিনীর ২টি মার্কিন–নির্মিত ‘এএইচ–১জে সিকোবরা’ হেলিকপ্টার ইরাকি বিমানবাহিনীর ২টি সোভিয়েত–নির্মিত ‘মিল মি–২৫’ হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হয় এবং TOW ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইরাকি হেলিকপ্টার দুটিকে ধ্বংস করে দেয়। ১৯৮১ সালের ২৪ এপ্রিল ইরানি হেলিকপ্টারগুলো অনুরূপভাবে আরো দুটি ইরাকি ‘মি–২৫’ হেলিকপ্টার ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইরাকি হেলিকপ্টারগুলো ‘ইয়াকেবি’ মেশিনগানের সাহায্যে একটি ইরানি ‘সিকোবরা’ হেলিকপ্টার ধ্বংস করে।
১৯৮৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইরাকি হেলিকপ্টারগুলো আবার ইরানি হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং ‘ফালাঙ্গা’ ক্ষেপনাস্ত্রের সাহায্যে দুইটি ও ‘এস–৫’ রকেটের সাহায্যে একটি ইরানি ‘সিকোবরা’ হেলিকপ্টার ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অনুরূপ আরেকটি যুদ্ধে একটি ইরাকি ‘মি–২৫’ এবং একটি ইরানি ‘সিকোবরা’ হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়। ১৯৮৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি ইরাকি ‘মি–২৫’ হেলিকপ্টার ‘ইয়াকেবি’ মেশিনগানের সাহায্যে একটি ইরানি ‘সিকোবরা’ হেলিকপ্টার ধ্বংস করে এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি একটি ইরানি ‘সিকোবরা’ হেলিকপ্টার রকেটের সাহায্যে একটি ইরাকি ‘মি–২৫’ হেলিকপ্টার ধ্বংস করে। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালের ২২ মে একটি সংঘর্ষে ইরাকি হেলিকপ্টারগুলো একটি ইরানি ‘সিকোবরা’ হেলিকপ্টার ধ্বংস করে। তদুপরি, ইরাকিদের দাবি অনুযায়ী, তাদের হেলিকপ্টার বহর যুদ্ধ চলাকালে ইরানি বিমানবাহিনীর অন্যান্য মডেলের আরো ৪৩টি হেলিকপ্টার ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।
চতুর্থত, এই যুদ্ধ চলাকালে ইরাক ও ইরান উভয়েই পারস্য উপসাগরে অন্য রাষ্ট্রের তেলের ট্যাঙ্কারের ওপর ব্যাপক মাত্রায় আক্রমণ (অন্তত ৫২০টি) পরিচালনা করে। ইরানের তেল টার্মিনালগুলো থেকে তেল সংগ্রহ করার সময় বিদেশি ট্যাঙ্কারগুলো ইরাকি বিমানবাহিনীর জাহাজ–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্রসজ্জিত চালকবিহীন বিমানবহরের আক্রমণের সম্মুখীন হয়। অনুরূপভাবে, যেসব আরব রাষ্ট্র (যেমন: সৌদি আরব ও কুয়েত) ইরাককে সমর্থন করছিল, তাদের তেল টার্মিনালগুলো থেকে তেল সংগ্রহ করার সময় বিদেশি ট্যাঙ্কারগুলো ইরানি আক্রমণের সম্মুখীন হয়। ট্যাঙ্কারের ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য ইরানিরা প্রধানত গানবোট, উপকূল থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে।
সর্বোপরি, সাধারণত কোনো দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং রাষ্ট্র দুটিতে একে অপরের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ইরাক–ইরান যুদ্ধ ছিল এদিক থেকে ব্যতিক্রম। যুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে যুদ্ধ চলাকালীন অধিকাংশ সময় পর্যন্ত ইরাক ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং বাগদাদে ইরানি দূতাবাস ও তেহরানে ইরাকি দূতাবাস খোলা ছিল। কেবল ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি এসে ইরাক ও ইরান পরস্পরের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং একে অপরের ভূখণ্ডে অবস্থিত দূতাবাস বন্ধ করে দেয়।
সামগ্রিকভাবে, ইরাক–ইরান যুদ্ধ ছিল বেশ কয়েকটি দিক থেকেই অন্যান্য যুদ্ধের তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী। কিন্তু যুদ্ধের সময় উভয় পক্ষ যেরকম একরোখা ও অনমনীয় মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিল এবং যুদ্ধটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত করেছিল, সেটিই সম্ভবত এই যুদ্ধের সবচেয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল।