আঠারো শতকের একটা সময় পর্যন্ত লন্ডন তথা ব্রিটেনে কোনো প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনী গড়ে ওঠেনি। এরপর ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টারে জন্ম হয়েছিল অবস্থিত বিশ্বের প্রাচীনতম মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনীর। এই বাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের নামই হল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। এ নামটিই ব্রিটেনের মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থার একরকম সমার্থক হয়ে গেছে। আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসকে কে না চেনে! কল্পনার শার্লক হোমস কাজ করতেন বাস্তবের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। ফলে একটা শহরভিত্তিক বাহিনী হওয়া সত্ত্বেও এর রয়েছে বিশ্বজোড়া পরিচিতি। অনেকের কাছে এটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনী।
এই প্রসিদ্ধি একদিনে তৈরি হয়নি। ইতিহাসের অনেকটা পথ পেরিয়ে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পরিণত হয়েছে আজকের এই মহীরুহে। প্রথম কিস্তিতে এই বাহিনী গড়ে ওঠার পূর্বে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই কিস্তিতে কীভাবে এবং কাদের সহায়তায় এই বাহিনী গড়ে উঠলো, কেনইবা এই বাহিনীর এমন নামকরণ হলো, সেই ইতিহাসই তুলে ধরা হবে।
কর্নেল থমাস ডি ভেইল কর্তৃক বো স্ট্রিট ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গঠন
লন্ডনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটতে থাকায়, সরকার অপরাধীদের শায়েস্তা করবার জন্য শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অর্পণ করে। তাদের মধ্যে একজন হলেন স্যার থমাস ডি ভেইল। খুব অল্প বয়সে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পরেই ঐ কাজ ছেড়ে তিনি মার্লবরোর সেনাবাহিনীতে ‘প্রাইভেট’ অর্থাৎ সাধারণ সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। অংশ নেন স্পেনের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধেও। যুদ্ধশেষে থমাস স্পেন থেকে দেশে ফেরার পর ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।
অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী থমাসকে ঐ ‘হাফ-পে’ কর্মকর্তার চাকরি খুশি করতে পারেনি। তাই সব ছেড়েছুড়ে তিনি নিজেই একটি অফিস খুলে বসেন। তার কাজ ছিল সাধারণ মানুষ ও সরকারি দফতরের মধ্যে যোগাযোগ ঘটানো। তার কাছে আসা বিভিন্ন লোকেদের করা অভিযোগের ভিত্তিতে আইনী-আবেদনপত্র তৈরি করা, সাক্ষী-সাবুদ জোগাড় করা এবং তা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মহলে উপস্থাপন করবার মাধ্যমে সমাধানের ব্যবস্থা করতেন থমাস। এর বিনিময়ে তিনি অভিযোগকারীর কাছ থেকে নিতেন ‘সম্মানী’। মামলা পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র যোগাড়ের জন্য তিনি গোয়েন্দাগিরিও করতেন। অপরাধীদের জেরা করতে পারার ব্যাপারে বেশ নামডাক ছিল তার।
তার এই অধ্যবসায় ও নিষ্ঠাপূর্ণ কাজের জন্য সরকারের ওপর-মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ১৭২৯ সালে তাকে মিডলসেক্স এবং ওয়েস্টমিনস্টারের শান্তি কমিশনে নিযুক্ত করা হয়। শান্তি কমিশনে নিযুক্ত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি লিচেস্টার ফিল্ডে তার প্রথম অফিস খোলেন। সেখানে সংঘটিত নানা অপরাধের ফৌজদারি কার্যক্রমের শুনানি শুরু হয়। তারপর বিভিন্ন শহরে কাজ করার পর ১৭৪০ সালে তাকে বো স্ট্রিট এলাকায় নিযুক্ত করা হয়। ওই সময়ে বো স্ট্রিট অঞ্চলে প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট-আদালত স্থাপন করা হয়। টমাস ডি ভেইলকে এই কোর্টের প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা হয়।
বো স্ট্রিট রানার্স: লন্ডনের প্রথম পেশাদার পুলিশবাহিনী
সরকার লন্ডন শহরের অপরাধ নির্মূলের জন্য যে চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়োগ করেন, তাদের মধ্যে থমাস ডি ভেইলের মতোই আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন লেখক হেনরি ফিল্ডিং। থমাস ডি ভেইলের মৃত্যুর পর বো স্ট্রিট ম্যাজিস্ট্রেট-আদালতের পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে হেনরি ফিল্ডিং নিযুক্ত হন। নিয়োগ পাওয়ার পর ১৭৪৯ সালে তার তত্ত্বাবধানে ছ’জন ব্যক্তি নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘বো স্ট্রিট রানার্স’ নামে প্রথম পেশাদার পুলিশ বাহিনী। শুরুতে অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরকম অর্থসহায়তা পেতেন না তারা। এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার বিনিময়ে এলাকার লোকজনই অর্থ দিয়ে সাহায্য করতো তাদের।
১৭৫৪ সালে হেনরি ফিল্ডিংয়ের মৃত্যুর পর তার ভাই জন ফিল্ডিং ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন। তিনি এসেই বাহিনীকে আরো জনবান্ধব করবার উদ্যোগ নেন। নাগরিকদের শান্তি ও নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন করার জন্য বাহিনীর একটি উপদলকে দিনের বিভিন্ন সময়ে পায়ে হেঁটে পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়।
পরবর্তীকালে আরেকটি উপদল বানানো হয়, যারা মূলত ঘোড়া নিয়ে শহর টহল দিতো। ১৭৯২ সালের মধ্যে ‘বো স্ট্রিট রানার্স’ বাহিনীতে আটজন সদস্য কর্মরত ছিলেন। সে বছরই সরকারিভাবে বাহিনীর প্রত্যেকের জন্য ২৫ শিলিং সাপ্তাহিক বেতন চালু করা হয়। ১৮০৫ সালে এই বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রথম ইউনিফর্ম বা উর্দির ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৩৯ সাল অবধি অব্যাহত ছিল এ বাহিনীর কার্যক্রম।
জন্ম নিলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যগণ দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নতুন দক্ষ ও সুশৃঙ্খল পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। ১৮২৯ সালের ১৯ জুন পার্লামেন্টে কার্যকর হয় ‘মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট’। শুরু হয় নতুন এক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার কার্যক্রম। ১৮৩৯ সালে পুরোপুরিভাবে বো স্ট্রিট রানার্স বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটবার পর নতুন পুলিশ বাহিনী লন্ডনের নিয়ন্ত্রণ বুঝে পায়। নতুন বাহিনীর সদর দফতর স্থাপিত হয় ফোর হোয়াইট হল প্লেসে।
যা-ই হোক, নতুন বাহিনীর এই সদর দফতর ছিল ওয়েস্টমিনস্টারের রাজপ্রাসাদের একটি অংশ। তারও আগে এই জায়গাটা ছিল স্কটল্যান্ডের রাজা-রানীর বাড়ি। স্কটল্যান্ডের রাজা-রানী যখন ইংল্যান্ডের কোর্ট পরিদর্শনের সময় ওই বাড়িতে থাকতেন। ওদিকে এখানকার ইয়ার্ড থেকেই পরিচালিত হতো থমাস ডি ভেইলের প্রাক্তন অফিস। এ দুয়ে মিলে ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড‘ নামটি আলাদা করে পরিচিতি পেয়ে যায়। এভাবেই মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনীর সদর-দফতর হিসেবেই কেবল নয়, বাহিনীটির নাম হিসেবেও জুড়ে যায় ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’।
বাহিনীর প্রথম ভবনটির স্থাপত্যকলায় ছিল গ্রিক উপকথার ছোঁয়া; বিশাল প্রাচীর, সুউচ্চ মিনার। পরবর্তীতে এই বাহিনীর জনবল বৃদ্ধির সাথে সাথে বদলেছে এর ভবন, এর ঠিকানা। ১৯৬৭ সালে দফতরটি চলে আসে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের কাছাকাছি। ঝকঝকে, তকতকে লম্বা-লম্বা করিডোরওয়ালা নতুন কার্যালয়ের অধিকাংশ ঘরই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে ঠাসা অফিস ব্লকে রয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিস্ট্রিক্ট-এর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। দোতলায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রিত তথ্যকেন্দ্র। রয়েছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, ওয়েস্ট লন্ডন ট্রাফিক কম্পিউটার। একটি তলা জুড়ে রয়েছে অপরাধকর্মের অন্তত কয়েক টন ওজনের নথিপত্র। ঐ তলাতেই আরো আছে একটি স্পেশাল ডকুমেন্ট কনভেয়ার সিস্টেম।
ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এ ভবনটি আবুধাবির একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। বর্তমানে স্কল্যান্ড ইয়ার্ডের কার্যালয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউসের কাছে ওয়েস্টমিনস্টারের কার্টিস গ্রিন বিল্ডিংয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৪ সালের আগ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের টহলরত সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেন না। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় পুলিশদের ওপর বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে কর্তৃপক্ষ পুলিশ সদস্যদের আত্মরক্ষার্থে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অনুমতি দেয়। তবে আগ্নেয়াস্ত্র সাথে রাখা অনুমোদিত হলেও ব্যবহারের ব্যাপারে রয়েছে অত্যন্ত কড়া বিধিনিষেধ। এখনো লন্ডনের ৯০ শতাংশ মেট্রোপলিটন পুলিশ সদস্য বন্দুক ছাড়াই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডই প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা প্রথম অপরাধী শনাক্ত করার জন্য অপরাধীদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের এই তাত্ত্বিক ধারণাটিকে ব্যবহারিকভাবে প্রথম প্রয়োগ করেন স্যার এডওয়ার্ড হেনরি। উনিশ শতকের শেষের দিকে হেনরি ‘বেঙ্গল পুলিশ ফোর্স’-এর মহাপরিদর্শক হিসেবে ভারতবর্ষে আসেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে আঙুলের ছাপ নিতে থেকেন। লক্ষ করলেন, প্রতিটি মানুষের হাতের ছাপ ভিন্ন এবং তাদের বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। পরবর্তীকালে তিনি এ নিয়ে একটি বইও লেখেন। ১৯০১ সালে লন্ডনের পুলিশ কমিশনার নিযুক্ত হবার পর আঙুলের ছাপ সংগ্রহের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট শাখা প্রতিষ্ঠা করেন হেনরি।
সারা লন্ডন শহরের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য অসংখ্য সিসিটিভি-ক্যামেরা বসানো আছে। এর মাধ্যমে, কোথাও কোনো অপরাধ ঘটলেই তাৎক্ষণিকভাবে তার ফুটেজ পেয়ে যায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। ফুটেজ থেকে অপরাধী শনাক্তকরণের জন্য তাদের রয়েছে বিশেষায়িত একটি চৌকস দল।
২০০৯ সাল থেকে ফেসিয়াল রিকগনিশন টেস্ট নামক এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই এ দলের সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়। দলের নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যরা মানুষের মুখের বৈশিষ্ট্য দেখেই অপরাধী শনাক্ত করার বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন হয়ে থাকেন। ২০১১ সালে লন্ডনে যখন জাতিগত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, তখন বিশেষ প্রযুক্তি আর সফটওয়্যার ব্যবহার করে শুধুমাত্র একজন অপরাধীকেই চিহ্নিত করা গিয়েছিল। কিন্তু চেহারা দেখে অপরাধী শনাক্তের অসাধারণ দক্ষতা দিয়েই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সদস্যরা ৪০০০ লোকের ভেতর থেকে প্রত্যক্ষ ১৮০ জন দাঙ্গাকারীকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ১৫০ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমায় যে পরিমাণ তদন্তমূলক কাজ হয়েছে, সেসব তদন্তের নথিপথ সংরক্ষণের জন্য ১৮৭৫ সালে লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি জাদুঘর। অপরাধীদের কাছ থেকে অপরাধ সংক্রান্ত বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণ, অপরাধীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, তদন্তকালীন বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য এখানে সযত্নে রক্ষিত আছে। এ জাদুঘর সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং অপরাধ তদন্তের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা এটি পরিদর্শনে আসতে পারেন।