২৬ আগস্ট, তুরস্কের জাতীয় জীবনে এক বিশেষ দিন। এই দিনে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শহর ‘মানজিকার্ট’ ও ‘আহলাত’কে সাজানো হয় ভিন্ন রূপে। খোলা মাঠে সবুজ ঘাসের উপর সারি সারি গোল তাবু, তুরস্কের জাতীয় পতাকার সাথে প্রাচীন অঘুজ তুর্কী গোত্রগুলোর বাহারী সব পতাকা, সেই সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষজনকে মধ্যযুগীয় তুর্কী যোদ্ধার সাজে দেখা যায়। কেউ তীর-ধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদ করছে, কেউ বা ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিবছর এই বিশেষ দিনে যেন তুর্কী জাতির হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য মঞ্চস্থ হয় নতুন করে।
কিন্তু ২৬ আগস্টই কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের যেতে হবে প্রায় সাড়ে নয়শ বছর আগের এক দুনিয়ায়।
২৬ আগস্ট ১০৭১ খ্রিস্টাব্দ, সেলজুক সুলতান আল্প আরসালান মানজিকার্টের যুদ্ধে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করান বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানোসকে। যুদ্ধটি ছিল অসম। আল্প আরসালান মাত্র ১৫ হাজার সৈন্য নিয়ে ২ লক্ষাধিক যোদ্ধার সুসজ্জিত বাহিনীকে পরাজিত করেন সেদিন। এই যুদ্ধজয়ের মাধ্যমেই সেলজুকরা নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্বের বুকে, কোণঠাসা হয়ে পড়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। সেই সাথে প্রথমবারের মতো আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করে তুর্কীরা। ইতিহাসে ঘটে যায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু রদবদল। এই বীরগাথার স্মরণে ২৬ আগস্টকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে পালন করা হয় তুরস্কে।
প্রেক্ষাপট
উমাইয়া শাসনামলে প্রথমবারের মতো সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মুসলমানরা। রোমান বাইজেন্টাইনদের বহু অঞ্চল তারা জয় করে নেয়। আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে উমাইয়া খিলাফতের সীমানা পৌঁছে যায় মধ্য এশিয়া থেকে স্পেনের কর্ডোভা পর্যন্ত।
কালের পরিক্রমায় উমাইয়াদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসে আব্বাসীয়রা। তারা পূর্বের উমাইয়া শাসকদের মতো সাম্রাজ্যের বিস্তারে বিশেষ জোর না দিয়ে অভ্যন্তরীণ কাঠামো ঢেলে সাজাতে শুরু করে। সেসময় আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ পরিণত হয় জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থানে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
আব্বাসীদের সোনালী সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। খলিফা হারুনুর রশিদের পরবর্তী শাসনামল দেখলে মনে হবে, আব্বাসীয়রা যেন প্রতিনিয়ত নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। আনাড়ি শাসকদের অদূরদর্শিতা তাদের ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়।
কোনো রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র যখন অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন শাসকরা অনেক বেশি ভাগ্যনির্ভর ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আব্বাসীয়দের ক্ষেত্রে হয়েছিল তা-ই। নবম শতাব্দীর শেষের দিকে এসে একসময়ের মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা আব্বাসীয় খলিফার পদটি কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। ঢালাওভাবে শুরু হয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে ছোট ছোট স্বাধীন আমিরাত। আব্বাসীয় খলিফাগণ কখনো ফাতেমি, কখনো বুওয়াইহি, কখনো বা তুর্কীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।
মুসলিম বিশ্বের এরূপ বিশৃঙ্খলার সুযোগ লুফে নেয় বাইজেন্টাইনরা। তাদের সামনে আব্বাসীয় শাসনাধীন অঞ্চলগুলো জয় করে নেবার সুযোগ তৈরি হয়। সেই লক্ষ্যে তারা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু হঠাৎ করেই বাইজেন্টাইনদের পথের কাঁটা হয়ে দৃশ্যপটে আসে সেলজুক তুর্কীরা।
সেলজুকদের উত্থান ও মানজিকার্ট যুদ্ধের পটভূমি
সেলজুকদের আদি নিবাস ছিল আজকের আধুনিক তুর্কীস্তান ও চীনের বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে। দোদাকের ছেলে সেলজুক ছিলেন তৎকালীন তুর্কী সম্রাটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনাকর্মকর্তা।
অঘুজ তুর্কীদের উপর সেলজুকের ছিল ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ। সাধারণ সৈনিকদের কাছেও তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। ঠিক এ কারণেই তুর্কী সম্রাট তাকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন। শুরু হয় মনোমালিন্য। ফলশ্রুতিতে সেনাপতির পদ ছেড়ে সেলজুক তার অনুসারীদের নিয়ে চলে আসেন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে এবং দীক্ষিত হন ইসলাম ধর্মে।
পরবর্তীতে সেলজুকের বংশধরেরা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তার নাতী তুগরিল বেগ একে একে জয় করেন নিশাপুর, জুরজান, তবারিস্তানসহ গজনির বেশ কিছু এলাকা। ১০৫৪ সালে আজারবাইজানে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তুগরিল বেগের পরবর্তী লক্ষ্য হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল। অল্প সময়েই তিনি রোমানদের বেশ কিছু এলাকা জয়ও করে নেন।
বাইজেন্টাইনরা ভেবেছিল- মুসলিমদের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে হারানো অঞ্চলগুলো ফিরে পাবে। কিন্তু সেলজুকদের উত্থান তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। উল্টো সেলজুকরাই বাইজেন্টাইন ভূখণ্ড দখল করে নিতে থাকে।
তুগরিল বেগের সাম্রাজ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা যুক্ত হতে থাকে। এই সাম্রাজ্য তার দাদার নামানুসারে ‘সেলজুক সাম্রাজ্য’ নামে পরিচিতি পায়।
তুগরিল বেগ ছিলেন নির্ভীক এক যোদ্ধা, সেই সাথে একজন দক্ষ কূটনীতিক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- সেলজুক সাম্রাজ্যের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির পাশাপাশি প্রয়োজন মুসলিম বিশ্বের সমর্থন। তাই তিনি তৎকালীন আব্বাসী খলিফা কায়িম বি আমরিল্লার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই সময় খলিফার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল বুওয়াইহি শিয়া শাসকদের। তবে খলিফা চাইছিলেন শিয়াদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে।
১০৫৫ খ্রিস্টাব্দ, তুগরিল বেগ খলিফার আমন্ত্রণে বাগদাদে আসেন এবং বুওয়াইহি শিয়াদের বিতাড়িত করেন। বুওয়াইহিদের অত্যাচার, দুর্নীতিতে খলিফা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। সেলজুকদের মিত্রতা তাকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করে। পরের বছর খলিফার সাথে এক সেলজুক শাহজাদীর বিয়ে হলে তাদের সম্পর্ক আরো পাকাপোক্ত হয়।
সুলতান আল্প আরসালান ও মানজিকার্টের যুদ্ধ
১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে তুগরিল বেগ মৃত্যুবরণ করেন। পরের বছর সেলজুক সালতানাতের সিংহাসনে বসেন সুলতান আল্প আরসালান। ততদিনে বাগদাদের পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। যদিও ফাতেমিদের সাথে দ্বন্দ্ব তখনও ছিল। কিন্তু সেসময় আল্প আরসালান মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেন বাইজেন্টাইনদের।
তুগরিলের শাসনামলে সেলজুকরা আজারবাইজানের রাজধানী আনি অবরোধ করলে বাইজেন্টাইনদের সাথে এক শান্তি চুক্তি হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ১০৬৪ সালে। ফলে সুলতান আল্প আরসালান ক্ষমতা লাভের পর বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে কোনো বাধা ছিল না।
অল্প সময়ের মাঝেই আল্প আরসালান তার সেনাবাহিনী সুসজ্জিত করেন ও দু’ভাগে বিভক্ত করেন। এরপর তিনি একইসাথে আজারবাইজান, কারাজ ও মাতাল্লা অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। বিভক্ত সেনাবাহিনীর একদিকের নেতৃত্বে ছিলেন আল্প আরসালান নিজে, অন্যদিকে তার সুযোগ্য পুত্র মালিক শাহ ও মন্ত্রী নিজাম-উল-মুলক।
একের পর এক সফল আক্রমণে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সুমারি দুর্গ, নাশিন ও আর্মেনিয়ার বিভিন্ন এলাকা চলে আসে সেলজুকদের নিয়ন্ত্রণে। এসব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে প্রশস্ত হয় আনাতোলিয়ার প্রবেশদ্বার।
১০৬৮ খ্রিস্টাব্দ, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন চতুর্থ রোমানোস। সিংহাসনে বসেই তিনি সেলজুক তুর্কীদের দমনের সিদ্ধান্ত নেন। দ্রুতই বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীকে নতুন রূপে সাজানো হয়। লক্ষ্য একটাই- তুর্কীদের জয়রথ থামিয়ে তাদের নাম-নিশানা মুছে দেওয়া। রোমানোস এই দায়িত্ব দেন বিশ্বস্ত সেনাপতি কোমনেনাসকে। কিন্তু আল্প আরসালানকে দমাতে রোমানোসের এই ফয়সালা কোনো কাজেই আসেনি। উল্টো কোমনেনাস নিজেই আরসালানের কাছে পরাজিত ও বন্দী হন।
১০৬৯ খ্রিস্টাব্দ, কোমনেনাসকে বন্দী করার পরও রোমানোসের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন আরসালান। এর পেছনে অবশ্য অন্য উদ্দেশ্য ছিল। সেসময় সেলজুকদের সাথে ফাতেমিদের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছিল। তাই সুলতান চাইছিলেন সাময়িকভাবে বাইজেন্টাইনদের সাথে শান্তি বজায় রাখতে ও ক্রমবর্ধমান ফাতেমিদের প্রভাব মোকাবিলা করতে।
বাইজেন্টাইনদের সাথে শান্তি চুক্তি থাকায় সেলজুকরা এবার নিশ্চিন্ত মনে নজর দেয় ফাতেমিদের দিকে। তাদের উদ্দেশ্য- যেকোনো উপায়ে সিরিয়া থেকে ফাতেমিদের বিতাড়িত করা, কারণ সিরিয়ার আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ সেলজুকদের হাতে থাকলে সহজেই মিশর থেকে ফাতেমিদের মূলোৎপাটন করা যাবে।
১০৭১ খ্রিস্টাব্দ, আলেপ্পো অভিযানে যেতে প্রস্তুত আরসালানের সেনাবাহিনী। এদিকে আবার রোমান সম্রাটের দূত এসেছে বিশেষ এক বার্তা নিয়ে। রোমানোস চান ১০৬৯ সালের শান্তিচুক্তি নবায়ন করতে। সুলতান এই প্রস্তাবে খুশিই হলেন। কারণ, এই মুহুর্তে তার একমাত্র লক্ষ্য হলো ফাতেমিদের রুখে দেওয়া। তাই দুবার না ভেবেই চুক্তি নবায়নে সম্মতি দিলেন।
কিন্ত, রোমানোসের মনে ছিল আরেক পরিকল্পনা। আরসালান যখন চুক্তির কথা ভেবে নিজেকে বাইজেন্টাইনদের থেকে নিরাপদ মনে করছিলেন, ঠিক তখন রোমানোস এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রস্তুত করছিলেন সেলজুকদের চিরতরে ধ্বংস করে দিতে। আদতে শান্তি চুক্তি নবায়নের বাহানা ছিল সুলতানকে ধোঁকা দেওয়ার কৌশল মাত্র।
চূড়ান্ত যুদ্ধ
সুলতান আল্প আরসালান যখন ফাতেমিদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, রোমানোস তখন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলেন বিশাল এক নৌবাহিনী। ১০৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শান্তি চুক্তি নবায়ন হয়। আগস্টের মাঝেই রোমনোস ২ লাখেরও বেশি সেনা প্রস্তুত করেন সেলজুকদের ধ্বংস করতে।
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের চৌকস সেনাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল রোমানোসের বাহিনী। ফলে তারা ভীষণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসে সেলজুক ভূখণ্ডের দিকে। আরসালান আসন্ন আক্রমণের খবর পেয়ে ঘাবড়ে যান। কারণ, সেসময় মাত্র ১৫ হাজার সদস্যের একটি সেনাদল তার সাথে ছিল। সেলজুকদের বাকি সৈন্যদলগুলো সালতানাতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করছিল। এত অল্প সময়ের মাঝে সকল সেনাকে একত্রিত করা ছিল অসম্ভব।
এই পরিস্থিতিতে সুলতান আরসালান সন্ধির প্রস্তাব দেন। কিন্তু রোমানোসের সামনে ছিল সুনিশ্চিত বিজয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি সন্ধির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। রোমানোস জয়ের ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, যুদ্ধের পর বিজিত অঞ্চলগুলোর দায়িত্ব ভাগাভাগির কাজও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আল্প আরসালানের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল:
১. রোমানোসের সকল শর্ত মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করা,
২. যুদ্ধের পথ বেছে নিয়ে বীরের ন্যায় লড়ে যাওয়া।
সুলতান দ্বিতীয়টি বেছে নিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তাকে মানসিকভাবে উৎসাহ যোগান তার মন্ত্রী নিজাম-উল-মুলক।
১০৭১ সালের ২৫ আগস্ট; মানজিকার্ট (পশ্চিম তুরস্কের শহর) প্রান্তরে বিশাল রোমান বাহিনীর মুখোমুখি হন সুলতান আল্প আরসালান। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয় পরদিন; জুমার সালাতের পর।
যুদ্ধের কৌশল
পরপর সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নিয়েছে রোমানোসের বাহিনী, যারা সংখ্যায় ২ লাখেরও বেশি। বিপরীতে ১৫ হাজার সৈনিকের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে সুলতান আল্প আরসালান।
রোমান সেনাদের চোখে-মুখে বিজয়ের আনন্দ। আরসালান কিছুটা গম্ভীর, তবে মোটেও হতাশ নন। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেই তিনি যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই মৃত্যু কিংবা পরাজয়ের ভয় একেবারেই নেই। সুলতান জানেন- তার সেনারাও তারই মতো জীবনের পরোয়া করছে না। তবুও শেষবারের মতো সেনাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন,
আমাদের সামনে রোমান বাহিনী, যারা সংখ্যায় অনেক। আমরা এমন একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি- যদি বিজয় অর্জন করি তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবো, অথবা শহীদ হবো। আজ আমি সুলতান হয়ে আদেশ করছি না। আজ আমিও তোমাদের মতোই একজন। তোমরা চাইলে আমাকে অনুসরণ করতে পারো, অথবা এই যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে নিরাপদে ঘরে ফিরে যেতে পার।
সেনারা জানাল,
সুলতান! আমরা আপনার সিদ্ধান্তই অনুসরণ করবো। আপনার সহযোদ্ধা হয়ে জীবন উৎসর্গ করবো, অথবা বিজয় অর্জন করবো।
সেনাদের মনোবল দেখে আনন্দিত হলেন সুলতান। আল্প আরসালান যেমন ছিলেন রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা, তেমনি ছিলেন একজন অসাধারণ সমরকুশলী। শত্রুপক্ষের তুলনায় ছোট সেনাদল নিয়ে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয় তা তিনি ভালো করেই জানতেন।
বাইজেন্টাইন সেনারা গতানুগতিক ফর্মেশনে পজিশন নিলেও আরসালান কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি অর্ধচন্দ্রাকার ভঙ্গিমায় গোটা বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। এতে শত্রুপক্ষের চোখে সেলজুকদের সেনাসংখ্যা কিছুটা বেশি মনে হচ্ছিল। চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হলে সুলতানের এই কৌশল বাজিমাত করে দেয়।
রোমানোসের সেনারা সারিবদ্ধভাবে আক্রমণে এগিয়ে আসে; তাদের মূল লক্ষ্য সেলজুকদের মধ্যভাগ। অন্যদিকে সেজুকরা অর্ধচন্দ্রাকার ভঙ্গিমাতেই অগ্রসর হয় এবং আকস্মিকভাবে প্রতিপক্ষের ডান ও বাম পার্শ্ব ধরে আক্রমণ করে বসে। এতে রোমানোসের বিশাল বাহিনী যখন ডান বাহু আর বাম বাহু সামলাতে ব্যস্ত, তখন তাদের মধ্যভাগ হয়ে যায় একেবারে ফাঁকা। সুযোগটা লুফে নেয় আল্প আরসালানের সৈনিকেরা। প্রতি-আক্রমণে তছনছ করে দেয় রোমানোসের বাহিনীর মধ্যভাগ। বিশাল বাহিনী এলোমেলো হয়ে যায়। আক্রমণ সামলাতে না পেরে বাহিনীর একাংশ পিছু হটে।
সুলতানকে দেওয়া কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তার সৈনিকেরা। নিজেদের শেষ শক্তি দিয়ে একের পর এক আক্রমণে জারি রাখে তারা, মানজিকার্ট যুদ্ধের ময়দানে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করে তুর্কীদের এক অসাধারণ বীরগাথা।
যুদ্ধের শেষ মূহুর্তে বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানোস এক সাধারণ সেলজুক সৈনিকের হাতে আটক হন। বন্দী হওয়ার পর রোমানোস তার সম্ভাব্য পরিণতি অনুমান করতে পারেন। তিনি ভেবেছিলেন- নিশ্চয়ই তার সাথে ভীষণ বাজে আচরণ করা হবে। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না যে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরেক চমক!
আল্প আরসালান ও রোমানোসের ঐতিহাসিক কথোপকথন
সুলতান আল্প আরসালানের সামনে হাজির করা হলো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মহান অধিপতি রোমানোসকে।
সুলতান প্রথমেই তাকে বললেন, “ধ্বংস হও তুমি, আমি কী তোমাকে সন্ধির প্রস্তাব পাঠাইনি?”
রোমানোস উত্তরে বললেন, “আমি তোমার বন্দী। এখন যা ইচ্ছা আমার সাথে করতে পারো।”
“তুমি যদি আমাকে বন্দি অবস্থায় পেতে, তাহলে কী করতে?” সুলতান জানতে চাইলেন।
রোমানোস বললেন, “লাঞ্ছিত করে আমার রাজধানীর রাস্তায় প্রদর্শন করতাম।”
সুলতান ফের জানতে চাইলেন, “তোমার কী ধারণা? আমি তোমার সাথে কীরূপ আচরণ করবো?”
উত্তরে রোমানোস বললেন, “হয়তো আমি যা করতাম তা-ই করবে। অথবা এখনই আমার মৃত্যুদণ্ড দেবে।”
সুলতান তখন অবাক করে দিয়ে বললেন, “তোমার জন্য রয়েছে এর চেয়ে কঠিন শাস্তি; আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব।”
রোমানোস সেদিন অবাক হয়েছিলেন সুলতানের মহানুভবতা দেখে। অবশ্য একেবারে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া হয়নি। মুক্তিপণ বাবদ ১৫ লাখ স্বর্ণমুদ্রা ও বাইজেন্টাইনদের হাতে থাকা মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হয় রোমানোসকে।
সুলতান ক্ষমা করে দিলেও রোমানোসের শেষ পরিণতি ভালো হয়নি। তার বন্দী হওয়ার খবর শুনে নির্বাচিত করা হয় নতুন সম্রাট। ফলে তিনি আর বাইজেন্টাইন সিংহাসনে বসতে পারেননি।
যুদ্ধ-পরবর্তী প্রভাব
গুরুত্বের বিবেচনায় মানজিকার্টের যুদ্ধকে তুলনা করা ইয়ারমুক যুদ্ধের সাথে। অনেক ঐতিহাসিকগণ দ্বিতীয় ইয়ারমুক যুদ্ধ বলেন। এরকম দাবি মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। ইয়ারমুক যুদ্ধে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য শাম অঞ্চলের এলাকাগুলো হারিয়েছিল, যা আর কোনোদিনই ফেরত পায়নি। মানজিকার্ট যুদ্ধে হাতছাড়া হয় আনাতোলিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যার ফলে গোটা এশিয়া মাইনর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তুর্কীরা।
তুর্কীরা মানজিকার্টের যুদ্ধে পরাজিত হলে সেদিনই সেলজুকদের নাম-নিশানা মুছে যেত। আর তেমন কিছু হলে অঘুজ তুর্কী গোত্রগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। বাগদাদে পুনরায় ফাতেমি শাসকরা কর্তৃত্ব কায়েম করতো। উমাইয়াদের জয় করা ভূখণ্ডগুলো সহজেই দখল করে নিত বাইজেন্টাইনরা। আর যদি যুদ্ধে হেরে যাবার পরও কোনোভাবে সেলজুকরা টিকে যেত, তবুও তারা হয়তো বাইজেন্টাইন আর ফাতেমিদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না।