বিচ্ছিন্ন মাথা যখন স্যুভেনির

মিডিয়ার বদৌলতে আমরা প্রায়ই শুনি, অমুকের মাথার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন তমুক পণ্ডিত। ২১ শতকে বসে সত্যি সত্যিই এরকম মাথা শিকারের চিন্তা করলে যে কারও গা শিউরে ওঠার কথা। তবে প্রাচীনকাল থেকে এ ধরনের চর্চা যে একেবারেই ছিল না তা নয়।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে চিন রাজবংশের সময়ে চীনা যোদ্ধারা নাকি শত্রুর ছিন্ন মাথা কটিতে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। নিউ গিনির উপজাতিদের মধ্যেও শত্রুকে হত্যার পর মাথা বিচ্ছিন্ন করে সংগ্রহ করার আচার ছিল, যাতে শত্রুর আত্মা প্রতিশোধ নিতে না পারে। ইতিহাস ঘাটলে এরকম আরও কাহিনী পাওয়া যাবে। তবে এখন যে বিষয়টির কথা বলা হবে তা বেশিদিন আগের নয়। উনিশ শতকের শেষে আর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপ ও আমেরিকায় হঠাৎ করেই ট্রফি হিসেবে সংকুচিত ছিন্ন মাথার চাহিদা দেখা দেয়। জ্বি, আমাজনের আদিবাসীদের তৈরি করা সংকুচিত মাথাগুলো ছিল মানুষের। কিন্তু কেন আর কীভাবেই বা মানুষের মাথা বিচ্ছিন্ন করে তৈরি করা হত এই ভয়ংকর বস্তু? ভৌতিক, গা ছমছমে গল্পের থেকে কোনো অংশেই কম নয় এই সংকুচিত ট্রফি মাথার ইতিহাস।

ছবি দেখে এর আকার সাধারণ মাথার মতো মনে হলেও বাস্তবে মাথাগুলো এতটাই সংকুচিত করা হত, যা কি না কমলালেবুর সমান! শুনতে অদ্ভুত শোনালেও শৌখিন পশ্চিমারা সংগ্রহশালার শোভা বাড়াতে একসময় হুমড়ি খেয়ে কিনতে থাকে আদিবাসীদের সামাজিক আচারের এই বস্তু। তাদের ঘিরে সেই সময় তৈরি হয় ‘ট্রফি হেড’ এর জমজমাট বাজার। সেই সাথে পশ্চিমাদের শখের যোগান দিতে আমাজনের পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠীর মাঝে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ।

পপুলার কালচারে সংকুচিত মাথা

সংকুচিত মাথা (Shrunken Head) পপুলার কালচারে বেশ জনপ্রিয়। হ্যারি পটার এন্ড দ্য প্রিজনার অব আজকাবান, হোটেল ট্রান্সসিলভানিয়া, পাইরেটস অফ দ্য ক্যরিবিয়ান: অ্যাট ওয়ার্ল্ড এন্ড, দ্য মামি রিটার্নস এই মুভিগুলো দেখে থাকলে ইতোমধ্যে হাসতে হাসতেই এই ভয়ংকর বস্তুটির সাথে আপনার সাক্ষাত হয়ে গেছে।

লিকি কলড্রন যাওয়ার পথে নাইট বাসে হ্যারি এই মাথার দেখা পায়; source: yaplakal.com

কে জানে পশ্চিমারা পূর্বপুরুষদের বিকৃত রুচি ঢাকতেই বুঝি পপুলার কালচারে বস্তুটিকে ভয়ংকর অথচ কৌতুকপ্রদ হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে। তিন-গোয়েন্দাপ্রেমীরা রকিব হাসানের ‘ভীষণ-অরণ্য’তেও সংকুচিত মাথার কথা পড়ে থাকবেন। উইলার্ড প্রাইসের অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ অবলম্বনে রচিত ‘ভীষণ অরণ্যে’র মতো মূল বই ‘আমাজন অ্যাডভেঞ্চার’ এ আছে হিভারো ইন্ডিয়ানদের ট্রফি হেড তৈরির বর্ণনা।

হিভারোদের গল্প

হিভারোরা আমাজনের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। পৃথিবীতে এই একটিমাত্র জনগোষ্ঠীই মৃত ব্যক্তির মাথা সংকুচিত করে সংরক্ষণ করে থাকে। ইকুয়েডর এবং পেরুর আমাজন জঙ্গলে হিভারোদের শুয়ার, আছুয়ার, হুয়ামবিসা ও আগুয়ারুনা গোষ্ঠীর বাস। শুয়াররা স্থানীয় ভাষায় সংকুচিত মাথাকে বলে থাকে য্যানযা (tsantsa)। শত্রুর শিরোশ্ছেদ করার পর প্রক্রিয়াকরণ শেষে বিশেষ তরলে সিদ্ধ করে শুকিয়ে বানানো হয় এই য্যানযা।

ষোড়শ শতকে স্প্যানিশরা যখন এল ডোরাডো বা কল্পিত স্বর্ণনগরীর সন্ধানে দক্ষিণ আমেরিকা দখলের চেষ্টা চালায় তখন তাদের হিংস্র হিভারোদের সম্মুখীন হতে হয়। বলা হয়ে থাকে, ১৫৯৯ সালে হিভারোদের প্রতিরোধে প্রায় ২৫ হাজার স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক নিহত হয়। এই ঘটনার পর স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী হিভারো নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আর স্বর্ণখনির সন্ধান করার সাহস পায়নি।

হিভারোদের মধ্যে বহু ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ছিল। এই গোষ্ঠীগুলোর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ছিল সাধারণ ব্যাপার। প্রায়ই পার্শ্ববর্তী গ্রামে হানা দেওয়ার রীতি ছিল। তবে যুদ্ধে কোনো আত্মীয় খুন হলে সেই হত্যার প্রতিশোধ নেওয়াই নিয়ম। তা না হলে পুরো গোত্রের উপর মৃতের অভিশাপ পড়বে বলে ধারণা করা হত। শত্রুকে হত্যার পর ছিন্ন মাথা নিয়ে ফেরা গোত্রের বিজয় স্মারক হিসেবে বিবেচিত হত। পাশাপাশি বিশ্বাস ছিল শত্রুর মাথা সংরক্ষণ করলে, শত্রুর আত্মা কোনো ক্ষতি কর‍তে পারবে না।

ছেলেদের কাছে সংকুচিত মাথা তৈরির বর্ণনা করছেন এক শামান; source: allthatsinteresting.com

আধ্যাত্মিক বিশ্বাস

হিভারোরা মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। তারা তিন ধরনের আত্মার কথা বিশ্বাস করে।

১. ওয়াকানি: ওয়াকানি মানুষের সহজাত আত্মা। মানুষ এই আত্মা নিয়েই জন্ম নেয়। মৃত্যুর পর এই অদৃশ্য আত্মা জন্মস্থানে ফিরে গিয়ে পূর্বসূরিদের সাথে বাস করে।

২. আরুটাম: এই আত্মা জন্মগত নয়। একে অর্জন করতে হয়। আরুটাম অর্জনকারী যোদ্ধাকে মৃত্যুর ভয়ে তটস্থ থাকতে হয় না। তারা যেকোনো অপমৃত্যুকে প্রতিহত করতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয়। কেউ যদি আরুটাম অর্জিত ব্যক্তির মাথা সংরক্ষণ করে, তবে তার মধ্যে মৃত ব্যক্তির আরুটামও যুক্ত হয় বলে হিভারোরা মনে করে।

৩. মুইজাক: মুইজাক হলো অতৃপ্ত আত্মা। আরুটামবাহী যোদ্ধা নিহত হলে তার আত্মা মুইজাকে পরিণত হয়ে প্রতিশোধ নিতে ঘুরে বেড়ায়। তবে মৃত যোদ্ধাদের মাথার ট্রফি করলে মুইজাককে প্রতিহত করা যায় বলে বিশ্বাস করে হিভারোরা। সংকুচিত মাথার চোখ আর মুখ সেলাই করে দেওয়া হয়, যাতে আত্মা প্রতিশোধ নিতে মাথার বাইরে বের হয়ে না আসতে পারে।

তবে যুদ্ধক্ষেত্রে মাথা সংগ্রহ করতে না পারলে হিভারোরা তার বদলে স্লথের মাথার ট্রফি তৈরি করত। ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণ ছাড়াও এসব ট্রফি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও গোত্রের বিজয় উদযাপনে ব্যবহৃত হত।

বাণিজ্য

উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে আমাজনের প্রাচুর্যে আবারও নজর পড়ে ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীর। রাবার গাছ আর খনিজ সম্পদের লোভে আমাজনে পাড়ি জমায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আর মিশনারিরা। সেখানে হিভারোয়ান আদিবাসীদের সংস্পর্শে এসে ট্রফি মাথার সন্ধান লাভ বিস্মিত করে তোলে ইউরোপীয়দের।

ভিক্টোরিয়ানদের খেয়ালী স্বভাব আর পরাভৌতিক জিনিসপত্র নিয়ে আগ্রহের কারণে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ট্রফি মস্তক। শৌখিন সামগ্রী হিসেবে শুরু হয় ট্রফি সংগ্রহ। কিন্তু অভিজাত ইউরোপীয়দের এই শখ আর খেয়ালীপনা আমাজনের গহীন জঙ্গলে ডেকে আনে মৃত্যুদূত।

১৯১০-৩০ এর সময়কালে পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণে পরিণত হয় ট্রফি হেড। আমেরিকাতেও য্যানযা তখন আকর্ষণীয় স্যুভেনির। একটি ট্রফির বদলে আদিবাসীরা একটি বন্দুক পেলেই সন্তুষ্ট থাকত। এভাবে কখনো অস্ত্র, কখনো স্বর্ণ বা অর্থের বিনিময়ে চলতে থাকে ট্রফি ব্যবসা। ত্রিশের দশকে ২৫ মার্কিন ডলারে পাওয়া যেত একটি মাথা। 

পশ্চিমা সংগ্রাহক লেডি রিচমন্ড ব্রাউন তার সংগ্রহের মাথাগুলো প্রদর্শন করছেন (১৯২৫); Source: Getty Images

আদিবাসীদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়লে বাড়তে থাকে মৃত্যের সংখ্যা আর দ্বন্দ্ব। প্রতিশোধ গ্রহণের রীতি যেন আগুনে ঘি ঢালে। নিয়মিতভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে হানা দিতে থাকে যোদ্ধারা। এই হত্যাযজ্ঞ ট্রফির সরবরাহ আরও সুলভ করে। বাধ্য হয়ে পেরু ও ইকুয়েডরের সরকার য্যানযা বা ট্রফি বেচাকেনা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে। ১৯৪০ সালে যুক্তরাষ্ট্রও এ ধরনের ট্রফি আমদানি নিষিদ্ধ করে। তবে লন্ডন টাইমসের মতো স্বনামধন্য পত্রিকাতেও ১৯৫১ এবং ১৯৫২ সালে ট্রফি হেড বিক্রির বিজ্ঞাপন আসে। এ ধরনের একটি বিজ্ঞাপনে মাথার মূল্য ধরা হয়েছিল আড়াইশ ডলার।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সংকুচিত মাথা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বুখেনভাল্ড বন্দীশালা থেকে দুটি সংকুুুুুচিত মাথা উদ্ধার করা হয়। ১৯৪৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর টমাস জোসেফ ডড নাৎসিদের নৃশংসতার প্রমাণ হিসেবে নুরেমবার্গ আদালতে এই মাথা উপস্থাপন করেন। ধারণা করা হয়, বন্দীদের মাথা থেকে বানানো এই সংকুচিত মাথা বুখেনভাল্ডে পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহৃত হত।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সময় টমাস জোসেফ ডডের হাতে সংকুচিত মাথা; source: beverleyeddy.com

বর্তমান অবস্থা

স্যুভেনির হিসেবে য্যানযার জনপ্রিয়তা আর বেচাকেনা বন্ধে কড়াকড়ি আরোপের কারণে দ্রুতই নকল ট্রফির বিকল্প বাজার গড়ে ওঠে। হিভারোদের থেকে হাজার মাইল দূরে পানামা আর কলম্বিয়ায় মর্গের বেওয়ারিশ লাশ থেকে মাথা সংগ্রহ করে ট্রফি বানানো শুরু হয়। মানুষ ছাড়াও স্লথ আর বানরের মাথার স্মারক তৈরি হত। কখনো বা ছাগল ও অন্যান্য পশুর চামড়া দিয়ে দেওয়া হত মানুষের মাথার আদল। ধারণা করা হয়, জাদুঘর কিংবা ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় বর্তমানে যেসব মাথা আছে সেগুলোর ৮০ শতাংশই নকল।

বর্তমানে অ্যান্টিক এবং স্যুভেনিরের দোকানে যেসব মাথা বিক্রি হয় সেগুলোও নকল। এসব কৃত্রিম মাথার গায়ে তা স্পষ্ট করেই উল্লেখ থাকে। হিভারোদের তৈরিকৃত আসল সংকুচিত মাথাগুলো এখন সব মিউজিয়ামে বন্দী। ডিএনএ অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আফ্রো-ইকুয়েডোরিয়ান জনগোষ্ঠীর মাথার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, সত্যিকার মাথা কেনাবেচার ইতিহাসকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

বুখেনভাল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নাৎসি অফিসারের টেবিল থেকে উদ্ধারকৃত মাথা; source: stormfront.org

পরিশিষ্ট

হত্যা সবসময়ই নিন্দনীয়, তা বাণিজ্যিক স্বার্থে হোক কিংবা সামাজিক আচারের কারণে। পশ্চিমারা কার্যত আদিবাসীদের ব্যবহার করলেও, পশ্চিমা মিশনারিরাই হিভারোদের এই নির্মম প্রথা বন্ধ করতে ভূমিকা রেখেছে। তবে, বিশেষ কোনো উপলক্ষে স্লথ, বানর কিংবা অন্যান্য প্রাণীর মাথা দিয়ে স্মারক তৈরির মাধ্যমে হিভারোরা য্যানযার ঐতিহ্য এখনো টিকিয়ে রেখেছে।

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This is a bengali article on the history of shrunken heads. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: All That Is Interesting

Related Articles

Exit mobile version