প্রায় চারশ বছর আগে, ষোল শতকে আফ্রিকায় গড়ে ওঠে এক রাজ্য, দাহোমি রাজ্য। নারী যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত ‘দাহোমি আমাজন’ সৈন্যদলের জন্য এই রাজ্য ইতিহাসের পাতায় সুপরিচিত। আগুজি যোদ্ধাদল, মিনো ইত্যাদি নামে নারীদের এই সেনাদল পরিচিত। কীভাবে গঠিত হয়েছিল আর কেমন ছিল এই যোদ্ধারা, তা নিয়ে আজকের আয়োজন।
বর্তমান আফ্রিকার দেশ বেনিনে অবস্থিত ছিল দাহোমি। দাস ব্যবসার মাধ্যমে এ রাজ্য ধনী হয়ে ওঠে। ঠিক কখন এবং কেন দাহোমিরা তাদের প্রথম নারী সৈন্য নিয়োগ দেয় সে ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। সবচেয়ে প্রচলিত মতানুসারে দাহোমি সাম্রাজ্যের তৃতীয় রাজা ওয়েগবাজা হাতি শিকারের জন্য নারীদের সমন্বয়ে এই সৈন্যদল গঠন করেন, যাদের দলকে বলা হত জিবেতো।
এ ঘটনার সত্যতা ধরা হয় রেপিন নামে ফ্রেঞ্চ নৌবাহিনীর একজন চিকিৎসকের বিবৃতিকে। তিনি দাবী করেন, ২০ জন জিবেতোর একটি দল ৪০টি হাতির পালকে তাড়া করে ৩টি হাতি শিকারে সফল হতে দেখেছেন। পরবর্তীতে ওয়েগবাজার পুত্র আগাজা নারীদের সমন্বয়ে একটি রক্ষী দল গঠন করেন। সন্ধ্যার পর প্রাসাদরক্ষী দলের নারীদেরই কেবল প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি ছিল, পুরুষ রক্ষীরা প্রবেশ করতে পারত না। বলা হয়ে থাকে, আগাজাই এই নারী রক্ষীদলকে সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত করেন এবং পার্শ্ববর্তী সাভি গোত্রের সাথে যুদ্ধে পুরুষ সৈন্যদের পাশাপাশি অংশ নিয়ে দাহোমি আমাজনের নারী যোদ্ধারা তাদের পরাজিত করেন। পুরুষ সেনাদের কাছে এই যোদ্ধারা পরিচিত ছিল ‘মিনো’ নামে। ফন ভাষায় যার অর্থ ‘আমাদের মা’।
কাদের নিযুক্ত করা হতো যোদ্ধা হিসেবে?
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে, নারী দাসদেরকেই বাছাই করা হতো দাহোমি আমাজনের সদস্য হিসেবে। তবে সাধারণ দাহোমি নারীদেরও নেয়া হতো। এমনকি ৮-১০ বছরের মেয়েকেও যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। রাজার যেসকল স্ত্রী পর্যাপ্ত সুন্দরী থাকতো না তারাও নিয়োগ পেত এই দলে। যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হত সবাই ছিল রাজার ‘তৃতীয় শ্রেণী’র স্ত্রী। বাকিদেরও রাজার সাথে একপ্রকার আনুষ্ঠানিক বিয়ে দেয়া হতো এবং যেহেতু রাজার এদের কারো সাথেই কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হতো না, তাই প্রায় বেশিরভাগ নারী যোদ্ধাই সারাজীবন কুমারী রয়ে যেত এবং জীবন উৎসর্গ করতো দাহোমি রাজ্যের জন্য যুদ্ধে।
সন্তান ধারণ করাও ছিল তাদের জন্য বারণ, যাতে মূল কাজ অর্থাৎ যুদ্ধে কোনো বাঁধা না সৃষ্টি হয়। ১৭২৫ সালে এক ফ্রেঞ্চ দাস ব্যবসায়ী জিন পিয়েরে থিবোল্টের কাছ থেকে এই ব্যাপারের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। এর চার বছর পরেই দাহোমির সংখ্যায় সবচেয়ে বড় শত্রু ‘ইয়োরুবা’ গোত্রের কাছ থেকে বন্দর পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে এই নারী যোদ্ধারা লিখিত ইতিহাসে নিজেদের নাম সংযোজন করে।
কেন এই নারী সেনাদল?
ঠিক কেন নারী যোদ্ধাদল গড়ে উঠেছিল দাহোমিতে, তার যথাযথ কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ ব্যাপারে কোনো ইতিহাসবিদেরই দ্বিমত নেই যে পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা চিন্তা নিয়ে দাহোমিরা নারী পুরুষ সমান ভেবে নারীদের সৈন্যদলে নিযুক্ত করেছিল। কেননা বেশিরভাগ সময়েই নারী যোদ্ধাদের মতামত খুব একটা গুরুত্ব পেত না, রাজার আদেশেই তাদের যুদ্ধের জীবন বেছে নিতে হতো। একজন সাধারণ নারীর মতো স্বামী বা সন্তান বেছে নেয়ার অধিকার ছিল না তাদের। তাহলে কেন নারীদের যোদ্ধা হিসেবে তৈরী করতে হলো দাহোমিদের? সম্ভবত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো তাদের শত্রুরা সংখ্যায় এতই বেশি ছিল যে যোদ্ধাদের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত না করে দাহোমি রাজাদের উপায় ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ইয়োরুবা গোত্রই তাদের চেয়ে সংখ্যায় দশগুণ বড় ছিল।
আরেকটি কারণ ছিল পুরুষদের সংখ্যা হ্রাস। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা আর্থার আর্ডলি উইলমটের লেখা থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি দাহোমিতে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক নারী লক্ষ্য করেন। যার কারণ হিসেবে তিনি যুদ্ধের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি এবং দাস ব্যবসার উল্লেখ করেন। মূলত এই দুটি কারণই প্রধান ছিল পুরুষের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে যাওয়ার। ফলে দাহোমির রাজাদের কাছে নারী শক্তিকে কাজে লাগানো ছাড়া অন্য উপায়ও ছিল না। রাজা গেজোর সময় নারী যোদ্ধাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়।
এর কারণ হিসেবে দেখা হয় ইয়োরুবা গোত্রের কাছে যুদ্ধে পরাজয়। পর্যটক স্যার রিচার্ড বার্টন ১৮৬০ সালে দাহোমিতে যান এবং আমাজনদের কাছ থেকে দেখেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, রাজা গেজো দাহোমি আমাজনদের প্রাসাদের আঙিনাতেই রাখতেন। তাদের সরবরাহ করা হতো পর্যাপ্ত পরিমাণ তামাক, মদ এবং দাসী। যখন কোনো আমাজন প্রাসাদের বাইরে বের হত, একজন দাসী তার আগে আগে একটি ঘন্টি নিয়ে হেঁটে যেত। সেই ঘন্টির আওয়াজ ছিল পুরুষ যোদ্ধাদের সতর্ক করার জন্য, যাতে তারা নির্দিষ্ট দূরত্বে সরে যায়।
দাহোমি আমাজনের বিশেষত্ব
দাহোমির নারী যোদ্ধারাই যে তাদের সময়ের একমাত্র নারী ছিলেন যারা সামরিক কাজে অংশ নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। কিছু সংখ্যক সমসাময়িক নারী শাসক, নারী দেহরক্ষীর ঘটনা জানা যায়। কিন্তু দাহোমি আমাজনের বিশেষত্ব হলো তাদেরকে প্রস্তুত করার ধরণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ। পুরুষদের মতোই কঠোর প্রশিক্ষণ দেয়া হত তাদের। নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম ছিল।
তারা কেবল অন্দরমহল কিংবা প্রাসাদের রক্ষী হিসেবে থাকত না, যুদ্ধের ময়দানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করত। রাজ্য ও রাজার জন্যে যুদ্ধ করা ও প্রায়শঃ জীবন দেয়াই দাহোমির নারী যোদ্ধাদের বাকীদের চেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড় করায়। উনিশ শতকের শেষে অর্ধেকেই অন্তত ৬ থেকে ১৫ হাজার দাহোমি আমাজনের মৃত্যু ঘটে বিভিন্ন যুদ্ধে। তাদের দেয়া প্রশিক্ষণ ছিল তাদের স্নায়ুকে ইস্পাতের মতো কঠিন করে গড়ে তোলার জন্য। প্রায়ই প্রশিক্ষণার্থীদের পরীক্ষা করা হতো যুদ্ধবন্দীদের শাস্তি দেয়ানোর মাধ্যমে।
এমনকি নারী যোদ্ধারা বন্দী হত্যায়ও নিয়োজিত ছিল। এক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হত তাদের, যার নাম ছিল ‘অসংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ’। এই প্রশিক্ষণে এক বাৎসরিক অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থী যোদ্ধারা ১৬ ফুট উঁচু একটি বেদীতে দাঁড়িয়ে ঝুড়িতে বাঁধা অবস্থায় একজন করে যুদ্ধবন্দী নিয়ে নিচে দাঁড়ানো জনতার ভীড়ে ছুড়ে মারত। বেশিরভাগ সময়েই মৃত্যু ঘটতো বন্দীর।
শেষ যুদ্ধ
দাহোমি রাজ্যের পতন ঘটে ১৮৯৪ সালে, ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৮৯০ সালের দিকে দাহোমি সাম্রাজ্যের শেষ রাজা বেহানজিন ফ্রেঞ্চ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, যা ‘ফ্রাংকো-দাহোমিয়ান যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের সূত্রপাতও হয় দাহোমিদের দ্বারাই। ১৮৭০ সাল থেকেই নিজেদের সৈন্যদল নিয়ে দাহোমিদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। একের পর এক গোত্রের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে তারা। নারী যোদ্ধাদের দুর্ধর্ষতার উপর ভিত্তি করেই মূলত এসব আক্রমণ চালাতে থাকে দাহোমিয়ান রাজারা। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন ফ্রান্সের একটি ক্ষুদ্র উপনিবেশের উপর আক্রমণ চালিয়ে বসে তারা। বলা হয়ে থাকে, একজন নারী যোদ্ধার ছোড়া এক আঘাতে গোত্র প্রধানের মাথা কেটে তা হাতে করে তাদের রাজার জন্য নিয়ে আসে ফ্রান্সের পতাকায় মুড়ে।
এ ঘটনায় ফ্রান্সও ক্রোধোন্মত্ত হয়ে ওঠে। যুদ্ধ ঘোষণা করে দাহোমি রাজ্যের বিরুদ্ধে। ফ্রেঞ্চরা প্রথমেই অনুধাবন করেছিল যে, দাহোমিয়ানরা হাতে হাতে যুদ্ধে বেশ পারদর্শী হলেও অস্ত্র চালনায় এখনো কিছু কমতি রয়ে গেছে। এই সুযোগই কাজে লাগায় ফ্রান্স। তাদের গুলি ও বেয়নেটের সামনে ধূলিসাৎ হয়ে যায় দাহোমিয়ানরা। ফ্রান্সের ব্যাপক যুদ্ধাস্ত্রের সামনে তাদের শেষ যুদ্ধে ১,৫০০ জন নারী যোদ্ধার মাঝে কেবল ৫০ জন যুদ্ধ শেষে সক্রিয় দায়িত্ব পালনে সক্ষম অবস্থায় ছিল।
দাহোমি আমাজনদের উপর বেশ কিছু গবেষণামূলক বই লিখেছেন স্বনামধন্য ইতিহাসবিদেরা। স্ট্যানলি বি আলপার্নের ‘আমাজন’স অফ ব্ল্যাক স্পার্টা’, এডনা জি বে শার্লটসভিলের ‘ওয়াইভস অফ দ্য লেওপার্ড’ ও স্যার রিচার্ড বার্টনের ‘এ মিশন টু গেলেলে, কিং অফ দাহোমি’ উল্লেখযোগ্য।
দাহোমি রাজ্যের পতন ঘটে ফ্রান্সের হাতে। ফ্রান্সের অধীনে যাওয়ার পর দাহোমি আমাজন ভেঙে দেয়া হয়। সর্বশেষ দাহোমি নারী যোদ্ধা হিসেবে ধারণা করা হয় নাওয়ি নামে এক নারীকে, এক বেনাইনিজ ইতিহাসবিদকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যিনি দাবী করেন, তিনি ১৮৯২ সালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে তিনি প্রায় একশ বছরের বেশি বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার সাথেই শেষ হয়ে যায় অকুতোভয় নারী যোদ্ধাদের দল দাহোমি আমাজন।
ফিচার ইমেজ- tumblr.com