মধ্য ও মধ্য–উত্তর অস্ট্রেলিয়ার ‘নর্দার্ন টেরিটরি’ প্রদেশের এলিস স্প্রিংস শহর থেকে ১৮ কি.মি. দক্ষিণ–পশ্চিমে রয়েছে একটি বিশাল সামরিক ঘাঁটি। ১৯৬৬ সালে অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭০ সালে এই ঘাঁটিটি স্থাপিত হয়। সেসময় ঘাঁটিটি পরিচিত ছিল ‘জয়েন্ট ডিফেন্স স্পেস রিসার্চ ফ্যাসিলিটি’ নামে। ১৯৮৮ সাল থেকে ঘাঁটিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘জয়েন্ট ডিফেন্স ফ্যাসিলিটি পাইন গ্যাপ’, কিন্তু এটি সংক্ষেপে ‘পাইন গ্যাপ’ নামেই পরিচিত। অস্ট্রেলীয় বা মার্কিন সশস্ত্রবাহিনী এই ঘাঁটিটি পরিচালনা করে না। এই ঘাঁটিটির সর্বেসর্বা হচ্ছে তিনটি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, এনএসএ এবং এনআরও।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ (সিআইএ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা। ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ (এনএসএ) মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি গোয়েন্দা সংস্থা, যেটির মূল দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে ও বাইরে নজরদারি চালানো। এবং ‘ন্যাশনাল রিকনিস্যান্স অফিস’ (এনআরও) মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা, যেটির মূল দায়িত্ব গোয়েন্দা স্যাটেলাইট নির্মাণ, উৎক্ষেপণ ও পরিচালনা করা। এই তিনটি সংস্থা যৌথভাবে পাইন গ্যাপ ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
পাইন গ্যাপ ঘাঁটিটি মূলত একটি আর্থ স্টেশন, এবং এখান থেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে বিশ্বের বিরাট এক অংশের ওপর নজরদারি চালিয়ে থাকে। এখান থেকে যে অঞ্চলগুলোর ওপর নজরদারি চালানো হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, চীন, পূর্ব ইউরোপ, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া ও ইউরোপের অবশিষ্ট অঞ্চল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই ঘাঁটিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের মূল ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নজর রাখতে পারে এবং তাদের সামরিক (ও বেসামরিক) কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
বলা বাহুল্য, এই ঘাঁটি সচল রাখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নীতির একটি অন্যতম লক্ষ্য। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট এই ঘাঁটিটির গুরুত্ব হ্রাস পায়নি। এই ঘাঁটিটি বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাগ্রে যেটির প্রয়োজন, সেটি অস্ট্রেলিয়ায় ক্ষমতাসীন একটি মার্কিনপন্থী ও অনুগত সরকার।
‘কমনওয়েলথ অফ অস্ট্রেলিয়া’ একটি উদার গণতান্ত্রিক ফেডারেল রাষ্ট্র। ১৯০১ সালে এটি ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বশাসন অর্জন করে, এবং পরবর্তীতে ক্রমশ কার্যত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু এখনো ব্রিটেনের রাজা/রাণীই অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান, এবং তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে একজন গভর্নর জেনারেল অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অবশ্য কার্যত অস্ট্রেলিয়ার মূল শাসনক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত।
স্বশাসন/স্বাধীনতা অর্জনের পরও অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্রিটেন (এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) অনুগামী। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এবং স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালেও তারা পুরোপুরিভাবে ইঙ্গ–মার্কিন জোটকে সমর্থন করে। অস্ট্রেলিয়া চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মিত্র, এবং অস্ট্রেলীয় রাজনীতিবিদরা বারংবার মন্তব্য করেছেন যে, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। বস্তুত স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রনীতি এতটাই মার্কিন-ঘেঁষা ছিল যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে তারা স্বেচ্ছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অংশগ্রহণ করে। মোট ৫০,১৯০ জন অস্ট্রেলীয় সৈন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এবং তাদের মধ্যে ৫২১ জন নিহত ও ৩,১২৯ জন আহত হয়। অর্থাৎ, অস্ট্রেলিয়া ছিল অনানুষ্ঠানিকভাবে একটি মার্কিন ‘স্যাটেলাইট’।
সিআইএ কর্মকর্তা ভিক্টর মার্চেট্টি অস্ট্রেলিয়ায় পাইন গ্যাপ ঘাঁটি স্থাপনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ততদিনই ঠিক থাকবে, যতদিন অস্ট্রেলীয় জনসাধারণ ‘সঠিক’ লোককে নির্বাচিত করবে। কিন্তু একজন অস্ট্রেলীয় রাজনীতিবিদ অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চালান। তিনি হলেন এডওয়ার্ড গগ হুইটল্যাম। অস্ট্রেলীয় বিমানবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য এবং আইনজীবী হুইটল্যাম ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির নেতা। আদর্শিক দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন সামাজিক গণতন্ত্রী (social democrat)। ১৯৭২ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে যে, অস্ট্রেলীয় জনসাধারণ একজন ‘ভুল’ লোককে নির্বাচিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হুইটল্যাম অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের নিয়ম বাতিল করেন, একটি সার্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, উচ্চশিক্ষাকে অবৈতনিক করে দেন এবং অসমর্থ ব্যক্তিদের জন্য আইনি সহায়তা প্রদানের নিয়ম প্রবর্তন করেন। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সংক্রান্ত আইন পাশ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ভূমি দখল ও তাদের ওপর গণহত্যা চালানোর মধ্য দিয়েই ব্রিটিশ অভিবাসীরা আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার গোড়াপত্তন করেছিল।
অভ্যন্তরীণ নীতির মতো বৈদেশিক নীতিতেও হুইটল্যাম তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করেন। হুইটল্যাম বিশ্বাস করতেন, কোনো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতি কোনো বিদেশি শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত না। তিনি ভিয়েতনাম থেকে অস্ট্রেলীয় সৈন্যদের সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করে নেন, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সমর্থন করেন, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলকে ‘শান্তি অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণাকে সমর্থন করেন, পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার বিরোধিতা করেন, এবং ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’–এর দিকে অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে যান। সাধারণত কোনো ধরনের বিপ্লব ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এতটা পরিবর্তন ঘটে না।
কিন্তু হুইটল্যামের পররাষ্ট্রনীতি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরোধী। তদানীন্তন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সোভিয়েত পুতুল’ হিসেবে বিবেচনা করত, এবং তাদের অতি ঘনিষ্ঠ মিত্র অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এরকম পরিবর্তন মোটেই তাদের পছন্দনীয় ছিল না। মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন হুইটল্যামকে ‘peacenik’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, আর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার হুইটল্যামকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘বেজন্মা’ হিসেবে।
অবশ্য অস্ট্রেলীয় রাজনীতিবিদরাও পিছিয়ে ছিলেন না। হুইটল্যামের দলের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মাস্তান’ এবং ‘ম্যানিয়াক’ হিসেবে অভিহিত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভিয়েতনামের ওপর বোমাবর্ষণকে তারা ‘বর্বরতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। হুইটল্যাম খোলাখুলি প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, সিআইএ কেন পাইন গ্যাপের ঘাঁটি পরিচালনা করছে? হুইটল্যাম এই ঘাঁটিটি বন্ধ করে দেবেন, এরকম একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। ভিক্টর মার্চেট্টির মতে, এই সম্ভাবনাটির ফলে হোয়াইট হাউজের কর্তাব্যক্তিদের ভিরমি খাওয়ার উপক্রম হয়, এবং তারা অস্ট্রেলিয়ায় চিলির অনুরূপ কিছু ঘটানোর চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে চিলিতে সিআইএ কর্তৃক পরিচালিত একটি সামরিক অভ্যুত্থানে চিলির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন।
অস্ট্রেলিয়ায় সিআইএর ব্যাপক প্রভাব ছিল। অস্ট্রেলীয় সমাজের সর্বস্তরে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল। অস্ট্রেলীয় রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সিআইএ এজেন্ট। অস্ট্রেলিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যেও অনেকে সিআইএর হয়ে কাজ করছিলেন। এমনকি হুইটল্যামের মন্ত্রিসভার একজন সদস্যও সিআইএর চর হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। তদুপরি, অস্ট্রেলীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘অস্ট্রেলিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন’–এর (এএসআইও) সঙ্গেও সিআইএ এবং ব্রিটিশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিক্রেট ইন্টেলিজেন্ট সার্ভিস’–এর (এসআইএস, ‘এমআইসিক্স’ নামে অধিক পরিচিত) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এবং স্বভাবতই তারাও হুইটল্যামের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।
সর্বোপরি, অস্ট্রেলিয়ার তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল স্যার জন কের ছিলেন কার্যত একজন সিআইএ এজেন্ট। সিআইএ কর্মকর্তারা তাকে অভিহিত করতেন ‘আমাদের লোক’ হিসেবে। কের ছিলেন ‘অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েশিন ফর কালচারাল ফ্রিডম’–এর সদস্য। অস্ট্রেলীয় অভিজাতদের সমন্বয়ে গঠিত এই ক্লাবটি স্রষ্টা, অর্থায়নকারী এবং পরিচালক ছিল সিআইএ। শুধু তা-ই নয়, কেরের যাবতীয় ভ্রমণ ব্যয় সিআইএ বহন করত, এবং তাদের অর্থায়নের মাধ্যমেই অস্ট্রেলীয় সমাজে কেরের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে, অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে সিআইএর প্রভাব ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত।
১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হুইটল্যাম পুনরায় বিজয়ী হন, এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথম বারের মতো লেবার পার্টির কোনো নেতা পরপর দুইবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়। কিন্তু এই ফলাফল ওয়াশিংটনের কাম্য ছিল না। এজন্য তারা যে কোনো মূল্যে হুইটল্যামকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চেষ্টা চালাতে শুরু করে, এবং এই উদ্দেশ্যে মার্শাল গ্রিনকে অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরণ করে। গ্রিনকে মার্কিন ‘ডিপ স্টেটে’র একজন সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং ‘দ্য ক্যুমাস্টার’ (The Coupmaster) হিসেবে অভিহিত করা হত। ১৯৬৫ সালে গ্রিন ইন্দোনেশিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এবং এসময় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইন্দোনেশীয় রাষ্ট্রপতি সুকর্ণকে উৎখাত করার পিছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
এই অভ্যুত্থানের পর ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যাগুলোর একটি সংঘটিত হয় এবং প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে কমিউনিস্ট সন্দেহে খুন করা হয়। বলাই বাহুল্য, এহেন ব্যক্তির অস্ট্রেলিয়ায় আগমন হুইটল্যামের জন্য কোনো শুভ সংকেত ছিল না। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পরপরই গ্রিন ‘অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ডিরেক্টর্স’ কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় গ্রিন খোলাখুলিভাবে অস্ট্রেলীয় সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করার জন্য অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানান।
হুইটল্যামকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা সিআইএর একার ছিল না। এমআইসিক্স এবং অস্ট্রেলীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিল। এমআইসিক্স সদস্যরা অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে হুইটল্যামের নিকট প্রেরিত গোপন বার্তাগুলো তাঁর কাছে পৌঁছানোর আগেই সেগুলোকে ডিকোড করছিল (অর্থাৎ সেগুলোর মর্মোদ্ধার করছিল)। হুইটল্যামের মন্ত্রিসভার বৈঠকগুলোতেও তারা আড়ি পাতার ব্যবস্থা করেছিল। অবশ্য হুইটল্যাম এই তথ্যগুলো জানতে পারেন।
১৯৭৫ সালের ৯ নভেম্বর গভর্নর জেনারেল স্যার কের ‘অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স সিগন্যালস ডিরেক্টরেট’ পরিদর্শন করেন। এই সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএর অনুরূপ, এবং হুইটল্যামকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনায় এরাও জড়িত ছিল। সংস্থাটির কর্মকর্তারা কেরকে জানান যে, অস্ট্রেলিয়ায় একটি নিরাপত্তা সঙ্কট চলছে, এবং এর জন্য তারা প্রধানমন্ত্রী হুইটল্যামকে দায়ী করেন।
১০ নভেম্বর হুইটল্যামকে তার সহকর্মীরা একটি অতি গোপনীয় টেলেক্স বার্তা দেখায়। এই বার্তাটি প্রেরণ করেছিলেন সিআইএর পূর্ব এশিয়া ডিভিশনের প্রধান থিওডোর শ্যাক্লে। শ্যাক্লেই ১৯৭৩ সালে চিলিতে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালনা করেছিলেন। তার এই বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে, অস্ট্রেলিয়ার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হুইটল্যাম অস্ট্রেলিয়ার জন্য একটি ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’! এই অতি গোপনীয় বার্তাটি হুইটল্যামের লোকজন ইন্টারসেপ্ট করেছিল, এবং এর মধ্য দিয়ে হুইটল্যাম তার বিরুদ্ধে সিআইএর পরিকল্পনা সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা লাভ করেন।
হুইটল্যামের পরিকল্পনা ছিল, পরবর্তী দিন অর্থাৎ ১১ নভেম্বর তিনি অস্ট্রেলীয় আইনসভায় অস্ট্রেলিয়ায় সিআইএর কার্যক্রম জনসম্মুখে ফাঁস করে দেবেন। কিন্তু সেটি আর তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১১ নভেম্বর গভর্নর জেনারেল কের হুইটল্যামকে ডেকে পাঠান, এবং নিজস্ব বিশেষ ক্ষমতাবলে তাকে বরখাস্ত করেন। এর মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর সাংবিধানিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। এটি ছিল কোনো গভর্নর জেনারেল কর্তৃক অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার প্রথম ও একমাত্র ঘটনা। গভর্নর জেনারেলের এরকম ক্ষমতা আদৌ রয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এজন্য হুইটল্যামকে বরখাস্ত করার ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক ঘটনাবলির মধ্যে একটি।
যা-ই হোক, এভাবে সিআইএ ও এমআইসিক্সের পরিকল্পনায় অস্ট্রেলীয় জনসাধারণের নির্বাচিত ‘ভুল ব্যক্তি’টি অপসারিত হন। ১৯৭৫ সালেই অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং এই নির্বাচনে যাতে অস্ট্রেলীয় জনসাধারণ আবার কোনো ‘ভুল ব্যক্তি’কে নির্বাচিত না করে, সেজন্য সিআইএ সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়। নির্বাচনে লেবার পার্টি পরাজিত হয়, এবং এর কয়েক বছরের মধ্যেই হুইটম্যান রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এর মধ্য দিয়ে ‘হুইটম্যান সমস্যা’র (the Whitman Problem) অবসান ঘটে, এবং অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতির এক বিশেষ অধ্যায় সমাপ্ত হয়।
হুইটম্যানের ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার তিন বছর স্থায়ী ‘কৌশলগত সার্বভৌমত্বে’র অবসান ঘটে। এরপর থেকে অস্ট্রেলিয়া আর কখনো স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের প্রচেষ্টা করেনি, কিংবা পাইন গ্যাপ গোয়েন্দা ঘাঁটি বন্ধ করার প্রচেষ্টাও করেনি। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ ‘মিত্র’, এবং জয়েন্ট ডিফেন্স ফ্যাসিলিটি পাইন গ্যাপ থেকে সিআইএ, এনএসএ ও এনআরও যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক শত্রুদের ওপর নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।