প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ এর কথা কি মনে আছে আপনাদের? বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রের একটি পর্ব তৈরি হয়েছিল ‘স্ফটিক করোটি’ উদ্ধার নিয়ে। ছবিটির প্রধান চরিত্রে রয়েছেন একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। চরিত্রটি মিচেল হেজেস নামের সত্যিকারের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদের জীবন থেকে নেয়া বলে কথিত রয়েছে। ছবিটি দেখার পর থেকেই অনেকেরই মনে ব্যাপক কৌতুহল জাগে। প্রত্নতত্ত্ব এবং প্রাচীন রহস্যের বিষয়ে যাদের প্রবল আগ্রহ আছে তাদের কাছে ‘স্ফটিক করোটি’ এক অজানা রহস্যের নাম, যে রহস্য সমাধানের জন্য বিজ্ঞানী ও গবেষকদের চেষ্টার কোনো অন্ত নেই। কিন্তু আদতে কি এই রহস্যের সমাধান হয়েছে? তা জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে আসলে ‘স্ফটিক করোটি’ বিষয়টি কী? কেনই বা তা পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের কাছে এক অদ্ভুত ধাঁধার নাম?
স্ফটিক করোটি বিশ্বের প্রাচীন এক সভ্যতার অনন্য রহস্যে মোড়া নিদর্শন। বিশ্বের আদি দুই প্রাচীন সভ্যতার নাম মায়া ও অ্যাজটেক, যে সভ্যতায় প্রথম পাওয়া যায় স্ফটিক করোটি সংক্রান্ত তথ্য। মায়া সভ্যতার প্রাচীন পুরোহিত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অভিজ্ঞ পণ্ডিতদের তথ্যানুসারে, ১৩টি স্ফটিক করোটির মধ্যে মানব জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে আছে। আবার কারো মতে, করোটির মধ্যে এমন কিছু মহান আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ রয়েছে ।
প্রাচীন মায়া কিংবদন্তী অনুসারে তেরোটি স্ফটিক করোটির এক মহান ক্ষমতা রয়েছে। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, ১২টি স্ফটিক করোটিকে একটি বিশেষ অবস্থায় রেখে তার মাঝখানে প্রধান করোটি স্থাপন করার মাধ্যমে পূর্ণ হয় একটি চক্র। এই চক্রই নাকি সন্ধান দেবে মানব জাতির ভূত ও ভবিষ্যতের অজানা সব রহস্যের। খোঁজ দেবে চিরন্তন সত্যের। সেই ১৩টি করোটি লুকিয়ে রাখা আছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মাটির নিচে। আজ এমনি এক স্ফটিক করোটির উদ্ধার অভিযানের গল্প শোনাবো আপনাদের।
১৯২৭ সাল, এই স্ফটিক করোটির রহস্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যালবার্ট মিচেল হেজেস। অদ্ভুত এক স্বভাবের মানুষ ছিলেন এই হেজেস। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন রূপকথা বইয়ের পোকা। রূপকথার সব গল্প তাকে যেন প্রবলভাবে টানতো। বিশ্বাসও করতেন গল্পগুলো। তিনি বিশ্বাস করতেন সাগর তলে হারিয়ে যাওয়া কিংবদন্তী যত মহাদেশ ও আটলান্টিস সত্যিই এই পৃথিবীর বুকে একসময় ছিল। আর যৌবনে এসে তিনি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং একে পেশা হিসেবে নেয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেন। যখন আর্কিওলজিস্ট হিসেবে পেশাজীবন শুরু করলেন, হেজেসের মনোজগতে তখনও খেলা করে বেড়াতো রূপকথার সব মিথ ও তার সাথের নানা চরিত্র।
পরবর্তীতে এই পেশা তার জীবনে নেশার মতো হয়ে দেখা দিলো। তিনি বিশ্বাস করতেন মায়াদের নিয়ে প্রচলিত সব কাহিনী। স্ফটিক করোটি নিয়ে তৈরি এমনি এক মিথের সন্ধানে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন হেজেস। তিনি মনে করতেন, দূর অতীতে মায়া সভ্যতা ও আটলান্টিসের মধ্যে কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে। স্ফটিক করোটি রহস্যের সন্ধানে তাই তিনি তার পালিত অষ্টাদশী কন্যা অ্যানা সহ এক বিশাল দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অজানা সব গন্তব্যে।
অবশেষে তিনি ও তার দল উপস্থিত হলেন হন্ডুরাসের এক জঙ্গলে। অনেকেই জায়গাটিকে বলতেন ‘লুব্বাতুনের ধ্বংসস্তূপ‘। আবার ‘পতিত পাথরের শহর’ হিসেবেও ছিল তার ব্যাপক পরিচিতি। বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, এখানেই ছিল মায়াদের বিচরণভূমি, মায়া সভ্যতার অনন্য তীর্থক্ষেত্র। তিন বছর ধরে চললো একটানা খোঁড়াখুঁড়ি। এতো বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি করলেও খুব একটা সফলতার মুখ দেখতে পাননি হেজেস। দিন দিন আশার আলো ক্রমেই ফিকে হতে লাগলো হেজেসের দলের কাছে। বিরক্তি আর হতাশায় কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো।
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎই একদিন খোঁড়াখুঁড়ির এক পর্যায়ে হেজেসের মেয়ে অ্যানার নজরে এলো এক অদ্ভুত খুলি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, এ যেন কোনো মৃত মানুষের খুলি পড়ে রয়েছে মাটির নিচে। কিন্তু অ্যানা কাছে যেতেই তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। দেখা গেলো, প্রমাণ সাইজের একটা স্ফটিক পাথরের করোটি এটি। ফলে হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো হেজেস ও তার দলের মধ্যে। আর এই ঘটনার ঠিক কিছুদিন পর আরেকটি স্থান থেকে ঐ করোটির সঙ্গে মানানসই একটি চোয়ালের হাড়ও খুঁজে পাওয়া গেলো।
আবার নতুন উদ্যোমে আবিস্কারের নেশায় হেজেস ও তার বাহিনী পুরো এলাকাটি চষে ফেললেন। আর এভাবে খোঁজাখুঁজির ফলে একের পর এক আবিস্কৃত হতে লাগলো প্রি-কলম্বিয়ান সভ্যতার নানা নিদর্শন। এভাবে মাটির নিচ থেকে নিখুঁত একটি স্ফটিক করোটির সন্ধান পাওয়ায় অনেক প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞই অবাক হয়ে যান। তাদের বিশ্বাস জন্মাতে লাগলো মায়ানদের করা অদ্ভুত সব ভবিষ্যৎবাণীর সত্যতা সম্পর্কে।
এরপর উদ্ধার হতে লাগলো একটির পর একটি স্ফটিক করোটি। মেক্সিকো, টেক্সাস, গুয়াতেমালা থেকে পাওয়া গেলো আরো বেশ কয়েকটি স্ফটিক করোটি। ফলে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশঙ্কা এবং কল্পনা দুই-ই বাড়তে লাগলো। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়টিকে পুরোটাই ধাপ্পাবাজি বলে অভিমত দিলেন। তাদের মতে, প্রাকৃতিকভাবে এই ধরনের করোটি কখনোই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। তাদের ধারণা, কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং প্রচারের আলোয় নিজেদের রাখার জন্য অসৎ উদ্দেশ্যেই এসব করছেন। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে তৈরি হলো প্রবল রেষারেষি। যেসব প্রত্নতত্ত্ববিদ এসব করোটি উদ্ধার করছেন তাদের বক্তব্য আর সন্দেহবাদীদের মতামতের মধ্যে কার বক্তব্য সঠিক, তা নিয়ে শুরু হলো প্রবল বিতর্ক।
পরবর্তীতে স্ফটিক করোটিই শুধু নয়, পাওয়া যেতে লাগলো বেগুনী রঙের অ্যামিথিস্ট পাথর ও গোলাপি রঙের রোজ ক্রিস্টালের করোটিও। প্রশ্ন উঠল, প্রাকৃতিকভাবেই বা কীভাবে তৈরি হয় এরকম নিখুঁত করোটি?
রহস্য আরো তীব্র হলো যখন হেজেস ও তার দলের খুঁজে পাওয়া চোয়ালের হাড় ও করোটির মধ্যে জিগ স পাজলের মতোই চমৎকারভাবে যুক্ত হয়ে গেলো ক্রিস্টাল পাথরের টুকরো দুটি। প্রথমে এই চোয়ালের হাড় সহ এই স্ফটিক করোটি দেখে অনেকেই বলে উঠেন, এটি আস্ত একটি খুলি। হেজেস ও তার কন্যা অ্যানা সহ অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই স্ফটিক করোটি মায়াদের তৈরি নয়, বরং আরো প্রাচীন। অন্য কোনো উৎস হতে মায়াদের কাছে এই করোটি হস্তগত হয়েছে।
অ্যানাসহ অনেকেরই অভিমত, এই করোটি বিশ্বের বাইরের অন্য কোনো গ্রহের কোনো এক সভ্যতা হতে সৃষ্টি, যা মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতা থেকেও প্রাচীন এবং অনেক দিক থেকে অগ্রসর। জ্যোতির্বিদ্যা সহ নানা মহাজাগতিক বিষয়ে তাদের অগাধ জ্ঞান ছিল। পরবর্তীতে মায়ান পণ্ডিতেরা নাকি জ্যোতির্বিদ্যার অনেক ঘটনার সঠিক পূর্বভাস দিতে এবং গ্রহ ও নক্ষত্রের ওপর ভিত্তি করে তাদের তৈরি করা ক্যালেন্ডারের মূল উপকরণ হিসেবে এই স্ফটিক করোটির সাহায্য নিতো। মায়ারা বিশ্বাস করতো তাদের পূর্বপুরুষ নক্ষত্র হতে এসেছে।
তবে এই আবিস্কার নিয়ে সে সময় প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, এই করোটিগুলো কীভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে তৈরি। অনেকের মতে, হেজেসের আবিস্কৃত স্ফটিক করোটির রয়েছে নানা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। রহস্যময় এসব ক্ষমতা নিয়েও নানা জন নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই করোটির রহস্যময় ভূমিকা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা গল্পগাথা। তবে হেজেসের আবিস্কৃত এই করোটি সত্যিই কি মায়াদের সম্পদ, নাকি হেজেস ও তার দলের কারসাজি? আর করোটির অদ্ভুত ক্ষমতারই বা উৎস কী? সেই গল্প না হয় তোলা থাক আগামী পর্বের জন্য।