বিখ্যাত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজিকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। গত ২ অক্টোবর তুরস্কের সৌদি কনসুলেটে প্রবেশ করার পর নিঁখোজ হয়ে যান তিনি। তুরস্কের পত্রপত্রিকা ছাড়াও নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, খাশোগজিকে সম্ভবত কনসুলেটের ভেতরেই হত্যা করে এরপর লাশ টুকরো টুকরো করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। খাশোগজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে সৌদি-তুরস্ক সম্পর্কও ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
একাধিক সূত্র থেকে ঘটনার বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া গেলেও সৌদি আরব এখনও পর্যন্ত খাশোগজিকে অপহরণ কিংবা হত্যার দায় অস্বীকার করে আসছে। বরং সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত ভিত্তিক গণমাধ্যমগুলো এটাকে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কাতার এবং তুরস্কের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেকে আবার এরকম যুক্তিও দেখাচ্ছেন যে, বিদেশের মাটিতে এরকম অপারেশনও কি সম্ভব? অথবা, সৌদি আরব কেন এরকম ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন করতে যাবে?
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সৌদি আরবের ইতিহাসে এধরনের অপহরণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিদেশের মাটিতে হত্যাকাণ্ড হয়তো তারা বেশি ঘটায়নি, কিন্তু ইউরোপের মতো মানবাধিকারের বিষয়ে সোচ্চার রাষ্ট্রগুলো থেকেও তারা সমালোচকদেরকে অপহরণ করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে একাধিকবার। এবং কোনোবারই এর জন্য তাদেরকে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়নি। আর এই জবাবদিহিতার অভাবই হয়তো তাদেরকে ধীরে ধীরে আরও দুঃসাহসী করে তুলেছে।
দেশের ভেতরে ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে গ্রেপ্তার করা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য নিয়মিত ঘটনা। গত কয়েক বছরে সৌদি আরব শত শত মানবাধিকার কর্মী এবং সমালোচককে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু যে ব্যাপারে সৌদি আরব অন্যদেরকে ছাড়িয়ে গেছে, তা হলো বিদেশের মাটি থেকেও সমালোচকদেরকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারে তারা রাজপরিবারের সদস্যদেরকেও ছাড় দেয় না। শুধুমাত্র গত তিন বছরেই সৌদি আরব তিনজন প্রিন্সকে ইউরোপের মাটি থেকে কিডন্যাপ করে দেশে নিয়ে গেছে। খাশোগজিও তাদের সেই ভয়াল থাবারই সর্বশেষ শিকার। চলুন জেনে নেওয়া যাক, সৌদি আরবের তিনজনকে প্রিন্সকে অপহরণ করার সেই অপারেশনের কাহিনী।
প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কি
প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কি বিন আব্দুল আজিজ ছিলেন বাদশাহ ফাহাদের ভ্রাতুষ্পুত্র। ২০০২ সালে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে যাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি সৌদি সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির সমালোচনা করতে শুরু করেন এবং সংস্কারের আহ্বান জানাতে থাকেন। কিন্তু তার সমালোচনা সহজভাবে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না বাদশাহ ফাহাদ এবং তার পুত্র প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন ফাহাদ। ফলে ২০০৩ সালে প্রিন্স আব্দুল আজিজ জেনেভার একটি প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান তার চাচাতো ভাই প্রিন্স সুলতানকে। নাশতার টেবিলে বসে আব্দুল আজিজ প্রথমে সুলতানকে অনুরোধ করেন সৌদি আরবে ফিরে গিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে ফেলতে। তার সাথে অনুরোধে যোগ দেন সৌদি ধর্মমন্ত্রী শেখ সালেহ আল-শেখ।
প্রিন্স সুলতান তাদের আহ্বানে সাড়া না দিলে ফোন করার অজুহাত দেখিয়ে উঠে যান প্রিন্স আব্দুল আজিজ। তার সাথে সাথে কক্ষ ত্যাগ করেন ধর্মমন্ত্রী শেখ সালেহও। এর পরপরই রুমে প্রবেশ করে মুখোশ পরা একাধিক ব্যক্তি। তারা প্রিন্স সুলতানের হাত বেঁধে ফেলে, তাকে আঘাত করে এবং তার ঘাড়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে চেতনানাশক প্রবেশ করিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে। কয়েক ঘণ্টা পরে যখন প্রিন্স সুলতানের জ্ঞান ফিরে আসে, তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন সৌদি আরবগামী একটি প্লেনের ভেতর।
প্রিন্স সুলতানের পরবর্তী ৭টি বছর কাটে কারাগারে এবং গৃহবন্দী অবস্থায়। ২০১০ সালে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে সৌদি সরকার তাকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দেয়। সেখানে গিয়েই তিনি সুইস কোর্টে প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন ফাহাদ এবং শেখ সালেহর বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু সুইস কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে মামলা বেশিদূর এগোয়নি। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ পেশ করার পরও সুইস কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে তদন্ত না করায় শেষপর্যন্ত সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।
২০১৬ সালে প্রিন্স সুলতানের বাবা তুর্কি বিন আব্দুল আজিজ মিসরে অসুস্থ হয়ে পড়লে সুলতান তাকে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় তিনি প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। ফ্রান্সে অবস্থিত সৌদি কনসুলেট তার শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে তার সাথে যোগাযোগ করে এবং তাকে বিশেষ বিমানে করে কায়রোতে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রিন্স সুলতানের সাথে সেসময় ব্যক্তিগত চিকিৎসা বোর্ডের সদস্য এবং আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান বডিগার্ডসহ মোট ১৮ জন সঙ্গী ছিল। তাদের সবাইকে তার সাথে নেওয়ার শর্তে তিনি রাজি হন।
সেই বছর ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে তিনি এবং তার ১৮ জন বিদেশী সঙ্গী সৌদি সরকারের দেওয়া প্লেনে ওঠেন। কিন্তু সেই প্লেনের ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট থেকে শুরু করে সবাই ছিল সৌদি সরকারের লোক। প্লেনটি কায়রোতে নিয়ে রিয়াদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ল্যান্ড করার এক ঘন্টা প্রিন্স সুলতান যখন বুঝতে পারেন তাকে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে তার আর কিছু করার ছিল না।
রিয়াদে ল্যান্ড করার পরপরই কয়েক ডজন সশস্ত্র পুলিশ প্লেনটিকে ঘিরে ফেলে। তারা প্রিন্স সুলতানকে টেনে বের করে নিয়ে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। পুরো সময়টা প্রিন্স সুলতান চিৎকার এবং ধস্তাধস্তি করছিলেন। তিনি তার বিদেশী সঙ্গীদেরকে অবিলম্বে তাদের দূতাবাসে যোগাযোগ করতে বলেন। কারণ তার ধারণা ছিল, তাদেরকেও আটকে ফেলা হবে। বিদেশি বডিগার্ড এবং ডাক্তার-নার্সরা অবশ্য কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। তার আগেই তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট এবং মোবাইল ফোনগুলো কেড়ে নেওয়া হয়। তিনদিন আটক রাখার পর অবশ্য তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কির কোনো সন্ধান এরপর আর পাওয়া যায়নি।
তুর্কি বিন বান্দার
তুর্কি বিন বান্দার আল-সৌদ ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের একজন সদস্য এবং সৌদি পুলিশ বিভাগের একজন মেজর। তার উপর ন্যস্ত ছিল সৌদি রাজপরিবারের নিরাপত্তা দেখাশোনার গুরুদায়িত্ব। কিন্তু সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে বিবাদের জের ধরে তাকে কারাবরণ করতে হয়। ২০০২ সালে মুক্তিলাভ করার পর তিনি প্যারিসে চলে যান এবং সেখান থেকে সৌদি সরকারের সমালোচনামূলক ইউটিউব ভিডিও তৈরি করতে শুরু করেন।
এ সময় সৌদি উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ আল-সালেম একবার তাকে সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফোন করলে তিনি সেটাও ইউটিউবে ফাঁস করে দেন। তাদের কথপোকথন থেকে জানা যায়, সৌদি কর্মকর্তারা তাকে সুলতান বিন তুর্কির মতো অপহরণ করারও হুমকি দিয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে তুর্কি বিন বান্দার যখন ব্যবসায়িক কাজে মরক্কোতে যান, তখন সৌদি সরকারের অনুরোধে মরক্কোর গোয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে এবং সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তর করে।
সৌদ বিন সাইফ আল-নাসের
সৌদ বিন সাইফ আল-নাসের ছিলেন ইতালিতে বসবাসকারী সৌদি রাজপরিবারের একজন সদস্য। প্রায়ই তিনি টুইটারে সৌদি প্রশাসনের সমালোচনা করতেন। ২০১৪ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি ক্ষমতা দখল করার পর সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিলে তিনি তাদের সমালোচনা করেন এবং তাদের বিচার দাবি করেন। এরপর ২০১৫ সালে এক বেনামী প্রিন্স বাদশাহ সালমানকে উৎখাতের আহ্বান জানালে সৌদ বিন সাইফ প্রকাশ্যে তার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন। ফলে তিনি সৌদি প্রশাসন তাকে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে।
ঐ আহ্বানের কিছুদিন পরই, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক রাশিয়ান-ইতালিয়ান কোম্পানি সৌদ বিন সাইফের সাথে যোগাযোগ করে। তারা উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোতে তাদের কোম্পানির শাখা খোলার ব্যাপারে তার পরামর্শ চায়। সৌদ বিন সাইফ মিটিংয়ে যোগ দিতে রাজি হলে তারা একটি প্রাইভেট বিমান পাঠায় তাকে মিলান থেকে কোম্পানির রোমের হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু রোমে না গিয়ে প্লেনটি যাত্রা করে সরাসরি রিয়াদের উদ্দেশ্যে। পুরো অপারেশনটিই ছিল সৌদকে গ্রেপ্তারের জন্য সৌদি গোয়েন্দাদের সাজানো নাটকের অংশ।