প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপি হায়ারোগ্লিফ মানেই যেন একগুচ্ছ রহস্যের হাতছানি। পৃথিবীর ইতিহাসে হায়ারোগ্লিফ বিভিন্ন সময়ে জন্ম দিয়ে গেছে নানা কিংবদন্তি ও ভয়ংকর গল্পের। প্রাচীর সভ্যতার পাঁড় ভক্ত হোক, বা সাধারণ রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ, সকলের কাছেই মিশরের পিরামিড ও মমির মতোহায়ারোগ্লিফও বহুকাল আগ থেকেই ছিল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
বিভিন্ন চিত্র ব্যবহারের কারণে হেরোডোটাস সহ প্রাচীন গ্রিসের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ মনে করতেন, এগুলো ছিল ঈশ্বরের পবিত্র লিপি। কারণ, হায়ারোগ্লিফ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ হায়ারো (পবিত্র) ও গ্লাইফো (লিখা) থেকে। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় হায়ারোগ্লিফকে ‘মেদু নেতজার’ নামে ডাকা হতো, যার অর্থ ‘দেবতাদের শব্দ’। কারণ বিশ্বাস করা হতো যে লেখা সরাসরি দেবতাদের কাছ থেকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে।
উৎপত্তিস্থল
অন্যান্য অনেক প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মতোই, মিশরীয় হায়ারোগ্লিফের মূল উৎস সম্পর্কে খুব কমই স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। তবে অবসর বসে ছিলেন না ভাষাবিদেরা, বিভিন্ন সময়ে তারা দিয়ে গেছেন বিভিন্ন মৌলিক ধারণার সন্ধান। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অনুমানটি হলো প্রাগৈতিহাসিক শিকারিদের ধারণা। গবেষণা অনুযায়ী, নীল নদের পশ্চিমে অবস্থিত মরুভূমিতে বসবাসরত শিকারি জনগোষ্ঠী যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এই ধাঁচের চিত্রের ব্যবহার প্রথম শুরু করেছিল। তাদের সেই যোগাযোগ পন্থার বিবর্তিত রূপই হলো হায়ারোগ্লিফিক।
মিশরের প্রাক-রাজবংশীয় সংস্কৃতিতে (দ্বিতীয় নাকাডার সময়কাল/খ্রিঃপূঃ ৩৫০০ – ৩২০০ অব্দ) এ রকম চিত্র খোদাই করা কিছু মৃৎপাত্র সেই সম্ভাবনার পালে আরও জোর হাওয়া প্রদান করে। এই মৃৎপাত্রগুলো সমাধিক্ষেত্রতেই সমাহিত করে দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করা হয় তখন থেকেই হায়ারোগ্লিফের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। অনেক ভাষাবিদের মতে, ফারাও রাজা মেনেসের রাজত্বকালে এই লিপির সূচনা হয়। তাদের মতে, হায়ারোগ্লিফের শুরু সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত লিখন পদ্ধতির পরপরই, আনুমানিক ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।
প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা মিশরীয়দের আগে লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল। সুমেরীয় এবং মিশরীয়; দুই সভ্যতাই চিত্রভিত্তিক লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করত। সুমেরীয়দের ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতি ‘ক্যুনিফর্ম’ দ্রুতই তাদের চিরাচরিত ধারাকে পালটে সরকারি ও দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার হতে থাকে। এদিকে হায়ারোগ্লিফও তার যাত্রা শুরুর পর দখল করে নেয় মিশরীয় রাজদরবারের কাহিনী সংরক্ষণের এক গুরুদায়িত্ব। তাই অনেক পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, মিশরীয়রা এই লিখনের ধারণা নিয়েছিল মেসোপটেমীয়দের থেকেই ধার করে। (প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার আদ্যোপান্ত জানতে এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন- মেসোপটেমিয়াঃ ইতিহাসের অনন্য সভ্যতা)
হায়ারোগ্লিফের বিবর্তন
হায়ারোগ্লিফ মারাত্মক জটিল প্রকৃতির ছিল বলে প্রাচীন মিশরীয়দের মাঝে পরে আরও দুটি লিখন পদ্ধতির প্রচলন ঘটে। একটি হলো, ‘হায়রাটিক’ এবং অপরটি ‘ডেমোটিক’। দুটি নামই গ্রিকদের দেওয়া। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় হায়রাটিক শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘পুরোহিত সম্পর্কিত’। হায়ারোগ্লিফ থেকে বিবর্তিত হয়েই হায়রাটিক লিপির উৎপত্তি। বলা যায়, এই লিপিটি হায়ারোগ্লিফিক লিপির সরল সংকলন।
হায়রাটিক লিপির উদ্ভব হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দের দিকে। মূলত, প্যাপিরাসে লেখার সুবিধা থেকেই উদ্ভব হয় হায়রাটিক লিপির। আর ডেমোটিক লিপি হলো হায়ারোগ্লিফিক বিবর্তনের সর্বশেষ ও সবচেয়ে সরল রূপ, যা প্রাচীন মিশরের সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন কাজে, চিঠিপত্র লেখালেখিতে ব্যবহার করত। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘ডেমোটিক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘জনপ্রিয়’। খ্রিঃপূঃ ৭০০ অব্দের দিকে প্রাচীন মিশরে উদ্ভব ঘটে এই লিপির। ডেমোটিক লিপির সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, এটা দিয়ে হায়রাটিক লিপির চেয়েও দ্রুত লেখা যেত। এই ডেমোটিকের সাথে আরবি হরফের কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
ক্রমশ ছন্দপতন ও মৃত্যু
টলেমির পর, খ্রিঃপূঃ ৩০০ অব্দে প্রাচীন মিশরের মাটিতে শুরু হয় মেসিডোনিয়ান বংশধরদের রাজত্ব। এর প্রায় ৬০০ বছর পর, ৩৮৪ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টান রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াস এক রাজকীয় ফরমান জারি করেন। সে ফরমানে মিশরে সকল প্রকার প্যাগান ধর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মূলত প্যাগান বলতে তাদেরকেই বোঝায়, যারা বহু দেব-দেবীর উপাসনা করে। সোজা বাংলায় যাকে পৌত্তলিক বলা যায়। পৌত্তলিকতা নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল হায়ারোগ্লিফ ধ্বংসের সূচনা। এই লিপিতে সর্বশেষ ৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিতে অবস্থিত দেবী আইসিসের মন্দিরের গায়ে লেখা হয়। হায়ারোগ্লিফের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়, ষষ্ঠ শতকে আইসিসের মন্দিরে বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে।
রহস্যভেদ
১৮২০ সালের আগে আধুনিক কোনো মানুষ মিশরীয় এই চিত্রলিপির মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারেনি। গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুতার্ক (খ্রিষ্টপূর্ব ১২০-খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬) মিশরীয় লিপিকে ধর্মীয় পবিত্র বিষয়াদি লেখার লিপি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ইহুদি ঐতিহাসিক যোসেফাস (৩৭ খ্রিষ্টাব্দ – ১০০ খ্রিষ্টাব্দ) মনে করতেন হায়ারোগ্লিফে লিখিত কাহিনীগুলো যতটা না ধর্মীয় ভাবধারাকে ফুটিয়ে তুলে, তার বেশি দৃষ্টিগোচর করে প্রাচীন মিশরীয় যুদ্ধ কাহিনী ও ঐতিহাসিক বিবৃতিকে।
হায়ারোগ্লিফের পূর্ণ রহস্যভেদের কাহিনীটা বেশ চমৎকার। এটি সম্ভব হয় ‘রোজেটা স্টোন’ নামক এক কৃষ্ণ প্রস্তরের মাধ্যমে। কী ছিল এই রোজেটা স্টোনে? খ্রিঃপূঃ ১৯৬ অব্দে রাজা পঞ্চম টলেমি মিশরের মেম্ফিস নগরীতে ঘটা করে এক আইন জারি করেন। বহু বছর অক্ষত রাখার উদ্দেশ্যে এই আইন ঠুক ঠুক করে খোদাই করা হয় বিশাল কালো পাথরে। তবে, সেটা লিখা ছিল মোট তিনটি ভাষায়। অর্থাৎ, মূল অর্থ একই, শুধু ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনুদিত। এর মধ্যে ছিল হায়ারোগ্লিফিক, ডেমোটিক, ও প্রাচীন গ্রিক ভাষা। ৭৬২ কেজি ওজনের কৃষ্ণ প্রস্তরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ও উচ্চতা যথাক্রমে ১১৪ সেন্টিমিটার, ৭২ সেন্টিমিটার, এবং ২৮ সেন্টিমিটার। দুর্ভাগ্যবশত প্রস্তরটির কোণার দিকের বেশ কিছু অংশ ভাঙা ছিল। এর উপর হায়ারোগ্লিফিক ১৪ লাইন, ডেমোটিকের ৩২ লাইন আর প্রাচীন গ্রীক ভাষায় ৫৩ লাইন লেখা ছিল।
১৯ জুলাই, ১৭৯৯ সালে রোজেটা স্টোন আবিষ্কার করেছিলেন সম্রাট নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পসের লেফটেন্যান্ট পিয়ের ফ্রাঁসো বুঁশ্যার। ব্রিটিশ পণ্ডিত থমাস ইয়াং ১৮১৪ সালে রোজেটা স্টোন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের পর ৮৬টি হায়ারোগ্লিফিক চিহ্নের অর্থ বের করতে সক্ষম হন। ১৮২১ সালে ফরাসি স্কলার শ্যাম্পোলিয়ন ‘ক্লিওপেট্রা’ নামের হায়ারোগ্লিফিক প্রতিরূপ আবিষ্কার করে ফেলেন। এরপরের বছর তিনি র্যামসেস নামের হায়ারোগ্লিফিক প্রতিশব্দ শনাক্ত করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, হায়ারোগ্লিফের প্রতিটি চিহ্ন র্যামসেসের প্রত্যেকটি বর্ণের আলাদা আলাদা উচ্চারণের প্রতিনিধিত্ব করছে। তার গবেষণা থেকেই প্রথম প্রমাণিত হয় যে, হায়ারোগ্লিফের সংকেতগুলোর আসল মর্মার্থ নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। একইসাথে একটি সংকেত পূর্ণ একটি শব্দ, বাক্য, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের রূপও নিতে পারে। ২ হাজার বছর আগে মারা যাওয়া হায়ারোগ্লিফের রহস্যোদ্ধার সম্ভবপর হয়েছে শুধুমাত্র এই রোসেটা স্টোনের কল্যাণেই।
হায়ারোগ্লিফে ছবির ব্যবহার
হায়ারোগ্লিফে ব্যবহৃত বিভিন্ন মানুষ, জীব-জন্তু, ও সামগ্রীর সংকেত দেখে সাধারণভাবে মনে হতে পারে হায়ারোগ্লিফ আসলে মানুষ, বিড়াল বা বকের কাহিনীই বিবৃত করছে। প্রকৃতপক্ষে, কিছু হায়ারোগ্লিফ প্রাচীন মিশরীয় ভাষার ধ্বনি প্রকাশ করত- ঠিক যেমনটা হতো রোমান বর্ণমালার ক্ষেত্রে। বাকিগুলো ছিল চিত্রলিপি, যা ধারণার প্রতিনিধিত্ব করলেও এতে কোনো ধ্বনি সংযুক্ত থাকত না।
একই প্রতীক বা সংকেত দিয়ে হায়ারোগ্লিফে মোট তিন ধরনের ভাব প্রকাশ করা যেত। প্রতীকে যে প্রাণী বা বস্তুর ছবি থাকত, অনেক সময় সরাসরি সেটাই বোঝাত। তা না হলে বোঝাত সেই প্রতীকের শুদ্ধ উচ্চারণ। আবার অন্য একটি প্রতীক কী অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই ব্যাখ্যার জন্যও এটি ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ প্রত্যেকেই একে অন্যের সাথে ছিল সম্পর্কিত।
ধনীদের লিপি হায়ারোগ্লিফ
শিকাগোর ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পিটার এফ. ডরম্যানের মতে, মিশরের অ্যাবিডস শহরের রাজকীয় সমাধিগুলোতেই একেবারে শুরুর দিকের হায়ারোগ্লিফ নিদর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হায়ারোগ্লিফ লেখার ধাঁচটা একটু অন্যরকম হলেও, শুরু থেকেই তা উচ্চমার্গীয় অনুষঙ্গের সাথে যুক্ত ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রাচীন মিশরীয় মন্দির, শবাধারের কথা। এগুলোর দেয়াল নিজেদের গায়ে হায়ারোগ্লিফের সেই ঐতিহাসিক সাক্ষী খোদাই করে রেখেছে। এ থেকে বোঝা যায়, রাজবংশের লোকদের জন্য ব্যবহার করা হতো হায়ারোগ্লিফ। অবশ্য, রাজবংশীয় ছাড়াও যারা প্রাচীন মিশরে যথেষ্ট সম্পদশালী ছিল, তাদেরকেও মাঝেমধ্যে নিজ সমাধিগৃহ ও ভাস্কর্যে হায়ারোগ্লিফ খোদাই করতে দেখা গিয়েছে।
খ্রিঃপূঃ প্রায় ৩১০০ অব্দের দিকে মিশরের সম্ভ্রান্ত কোনো এক লোককে অ্যাবিডসে সমাহিত করা হয়। প্রাচীন মিশরীয় রীতি অনুযায়ী, তার সাথে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্রও দাফন করে দেওয়া হয়, যাতে তিনি পরকালে তা ব্যবহার করতে পারেন। তার সমাধিক্ষেত্র থেকে যেসকল দ্রব্যাদি উদ্ধার করা গেছে, সেগুলোতে অন্তত পঞ্চাশ রকমের শনাক্তযোগ্য প্রতীক চিহ্নিত করতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে কিছু প্রতীক সংখ্যা, কিছু প্রতীক নির্দিষ্ট কিছু অবস্থান, আর কিছু প্রতীক প্রশাসনিক কার্যের সাথে সম্পৃক্ত।
হায়ারোগ্লিফ লেখার নিয়ম
হায়ারোগ্লিফিক লিখনে এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণের মাঝে কোনো ফাঁক নেই, নেই কোনো যতিচিহ্নের ব্যবহারও। এ থেকে বুঝা যায়, তা পড়তে হলে পাঠককে প্রাচীন মিশরীয় ব্যাকরণে হতে হবে তুখোড়। এছাড়াও, কোন দিক থেকে লেখা শুরু করতে হবে, তা নিয়েও হায়ারোগ্লিফের ক্ষেত্রে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। যেমন, ইংরেজি বা বাংলা বর্ণ লেখা শুরু হয় বামদিক থেকে, অনুভূমিকভাবে। কিন্তু হায়ারোগ্লিফ বাম থেকে ডানে, ডান থেকে বামে, অনুভূমিকের পাশাপাশি উল্লম্বভাবেও লেখা হতো। জেমস পি. অ্যালেন তার লিখা বই ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন অভ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার অফ হায়ারোগ্লিফিক্স’– এ উল্লেখ করেছেন প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার শেষ পর্যায়ে শুধুমাত্র মন্দিরের পুরোহিতেরাই এই হায়ারোগ্লিফের মর্মার্থ বুঝতে পারত।
বর্ণমালার ব্যবহার
টলেমিক শাসনামল (খ্রিঃপূঃ ৩৩২-৩০ অব্দ) এবং রোমান শাসনামলে (খ্রিঃপূঃ ৩০ অব্দ – ৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দ) মিশরে রোমান ও গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। খ্রিষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতকের দিকে, প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় ধারার উপর শক্তপোক্ত ভাবে চেপে বসে খ্রিষ্টান ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য। খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া মিশরীয়রা প্রাচীন মিশরীয় ভাষা থেকে কপ্টিক নামক এক ভাষার রূপান্তর ঘটাল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের দিকে ৩২ হরফের কপ্টিক বর্ণমালা উদ্ধার করা গেছে। কপ্টিকের হাত ধরেই প্রাচীন মিশরীয় লিখিত ভাষার গায়ে প্রথম বর্ণমালার ছোঁয়া লেগেছিল। খটরমটর সকল হায়ারোগ্লিফিক পাণ্ডুলিপির বদলে প্রচলন ঘটতে লাগল কপ্টিক পাণ্ডুলিপির। ডেমোটিক ভাষার অল্প কিছু সংখ্যক সংকেতই জায়গা করে নিতে পেরেছিল কপ্টিক বর্ণমালায়।
হায়ারোগ্লিফিক লিপির নীতিনির্ধারক
প্রাচীন মিশরের লিখন বিষয়ক যাবতীয় কিছুর কলকাঠি নাড়াতেন মিশরীয় বিজ্ঞ লিপিকরেরা। বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর তারা রাজসভার লিপিকরের আসনগুলোতে স্থান পেতেন। ঐতিহ্যের ধারা ঠিক রেখে, তারা নিজ ইচ্ছানুসারে অক্ষরগুলো সাজাতেন। লিখা ডান দিক থেকে শুরু হবে নাকি বাম দিক থেকে, উল্লম্বভাবে নাকি আনুভূমিক সমান্তরালে, সেটার নীতি-নির্ধারক ছিলেন কলমচিরা। তারা অবশ্য আরেকটা নিয়মের উদ্ভাবন ঘটিয়েছিলেন যার অনেকটা মিল পাওয়া যায়, কৃষকের জমিতে লাঙল দেওয়ার সাথে। কৃষক যেমন করে জমিতে লাঙল দেন; তেমন করে ডান থেকে বামে, আবার বাম থেকে ডানে। মানুষ অথবা প্রাণী চিত্রের মুখ বা হাত-পা যেদিকে মুখ করে আছে, সেই দিক থেকেই লিপি পাঠ শুরু করতে হতো।
লিপিকরেরা সংখ্যা লেখার জন্য যে নিয়মটা ব্যবহার করতেন তার সাথে বর্তমানের দশভিত্তিক নিয়মের সঙ্গে কিছুটা সদৃশ লক্ষ্য করা যায়। শুধু পার্থক্য হলো, তাদের সংখ্যার প্রতীকগুলোর স্থানীয় কোনো মান ছিল না, ছিল নির্দিষ্ট এক মান। যেমন, যে প্রতীক দিয়ে ১০ বোঝাতো, ২০ লেখার জন্য সেই প্রতীকটাই দুইবার লিখতে তো। আবার যেটা দিয়ে ১ বোঝাত, ৫ লেখার জন্য সে প্রতীকটাই পাঁচবার লিখতে হবে। তার মানে ২৫ লিখতে হলে হায়ারোগ্লিফে লিখতে হতো এভাবে – (১০) (১০) (১) (১) (১) (১) (১) এভাবে।
মিশরীয় উপকথায় হায়ারোগ্লিফ
মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ী, দেবতা ‘থট’ মিশরের বাসিন্দাদের মাঝে জ্ঞানের জ্যোতি ছড়িয়ে দেয়া এবং স্মৃতিশক্তিকে শান দিয়ে ধারালো করে তোলার জন্য তাদেরকে লিখন পদ্ধতি শিখিয়েছিল। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন দেবরাজ ‘রা’। তার মতে, মানবজাতিকে লিখন পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়ার ফলে তাদের স্মৃতিশক্তি ক্রমশ লোপ পাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লোকমুখে কাহিনী ছড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাসটাও সভ্যতা থেকে হারিয়ে যাবে মহাকালের গর্ভে। রা’র মতের বিরুদ্ধে গিয়েই থট মিশরীয়দের সবক দিয়েছিল লেখালিখির।
তবে, তিনি সকল মিশরীয়দের লিখা শিখিয়ে যাননি। শুধু রাজদরবারের লিপিকরেরাই সেই সুবিধার দ্বারস্থ হতে পেরেছিল। দেবতাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ায়, লিপিকরদের পবিত্র জ্ঞানের অধিকারী বলে ধরা হতো। প্রাচীন মিশরীয়রা সেজন্য হায়ারোগ্লিফকে ‘মেদু নেতজার’ নামে বলে অভিহিত করত, যার অর্থ ‘দেবতাদের শব্দ’। কারণ বিশ্বাস ছিল, এই লিখন পদ্ধতি সরাসরি দেবতা থট থেকে প্রেরণ করা হয়েছে।
প্রাচীন জাদুবিদ্যায় হায়ারোগ্লিফ
প্রাচীন মিশরে জাদু প্রথার সাথে উচ্চারিত ও লিখিত শব্দগুলোর বেশ নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আধ্যাত্মিক সকল কাজ সমূহে জাদু ও মন্ত্রের খোলাখুলি ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রাচীনকালে মিশরে জাদুবিদ্যা ছিল নাওয়া-খাওয়ার মতোই এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সবাই এটাকে দৈনন্দিন জীবনের এক অংশ বলেই ধরে নিত। সেই জাদু চর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান ছিল হায়ারোগ্লিফ লিপি। মিশরে প্রাচীন আমলের এমন বহু প্যাপিরাসের সন্ধান মিলেছে, যেগুলোতে জাদুকরী শব্দ ও উপকরণের তালিকা বিদ্যমান ছিল। এর মধ্যে আরোগ্যের মন্ত্র, সাপ ও বিছা কাটলে তা থেকে বাঁচার মন্ত্র, শত্রুকে অভিশাপ দেওয়ার মন্ত্র, দেবতাদের কাছে সাহায্য চাওয়ার মন্ত্র ছিল উল্লেখযোগ্য। নিউ কিংডম পিরিয়ডে (খ্রিঃপূঃ ১৫৫০ – ১০৬৯ অব্দ) এ রকম এক কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময় থেকে প্রাপ্ত এক মৃৎপাত্রে দেখা গিয়েছে, এক পুরুষ তার প্রিয় রমণীর হৃদয় রাঙানোর জন্য এক ‘লাভ স্পেল’ এর ব্যবহার করেছিল। মন্ত্রটা ছিল এরকম,
“হে দুই দিগন্তের বাজপাখি, সকল দেব-দেবীর জন্মদাতা, সূর্যদেব রা, আমার আকুতি শুনুন।”
বহনযোগ্য মাধ্যমে হায়ারোগ্লিফ
দেয়ালে চিত্রায়নের পাশাপাশি মিশরীয়রা বহনযোগ্য অনেক জিনিসে হায়ারোগ্লিফ লিখে রাখত, যাতে তা এক স্থান থেকে অপর স্থানে সহজে বহন করে নেওয়া যায়। এজন্য বিভিন্ন সময়ে কাঠ, গজদন্ত, সিরামিক, ধাতব বস্তু, হাড়, চামড়া এবং পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও, প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায় বহুল প্রচলিত মাটির তালেও হায়ারোগ্লিফ লেখার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে বহনযোগ্য লিখন মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তার সিংহাসনে আসীন হয়েছিল প্যাপিরাস। মিশরীয় লিপিকরেরা প্যাপিরাসের পাশাপাশি অন্যান্য পৃষ্ঠতলকেও লিখন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যে বোর্ডগুলো ছিল সাধারণত কাঠ দিয়ে তৈরি। অষ্টাদশ রাজবংশ (খ্রিঃপূঃ ১৫৫০-১২৯৫ অব্দ) পর্যন্ত, বোর্ডগুলোর উপর সাদা প্লাস্টারের এক মোলায়েম প্রলেপ থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এগুলো সহজেই ধোয়া এবং পুনরায় প্লাস্টারে আচ্ছাদিত করা যেত বলে, এর ব্যবহার ছিল প্রচুর।
প্রাচীন সভ্যতার অনন্য বিস্ময় ছিল এই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা তাদের সময়ের থেকে অনেক অগ্রগামী ছিল। সেই আমলেই তারা জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যসহ বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে ঈর্ষান্বিত সাফল্য অর্জন করেছিল। হায়ারোগ্লিফের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেই মিশরীরের তপ্ত ধূসর বালির নিচেই চাপা পড়ে যেত প্রাচীন মিশরের সমৃদ্ধ ইতিহাস।