জুলাই ২২, ১৯৪৬; কিং ডেভিড হোটেল, জেরুজালেম। রাত ১২টা ২২ মিনিটে হোটেল সুইচবোর্ডের টেলিফোন অপারেটরের কাছে একটা কল এলো। হিব্রু ও ইংলিশে বলা হলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই হোটেলে বড় ধরনের এক বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে। তাই হোটেলে অবস্থানকারী সবাই যেন নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। কিন্তু বিষয়টাকে অতটা গুরুত্ব দেওয়া হলো না। এর কয়েক মিনিট পরেই, রাত ১২টা ২৭মিনিটে কিং ডেভিড হোটেলের পাশেই অবস্থিত ফ্রান্স কনস্যুলেটে একটা কল এলো এবং একই কথা বলা হলো।
এবার বিষয়টাকে একটু গুরুত্বের সাথেই নেওয়া হলো। কনস্যুলেটের জানালা আটকিয়ে পর্দা নামিয়ে দেওয়া হলো যাতে ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে। একটু পর, রাত ১২টা ৩১ মিনিটে আরেকটি কল এলো ‘প্যালেস্টাইন পোস্ট’ পত্রিকার অফিসে এবং একই রকম কথা বলা হলো। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্যালেস্টাইন সিআইডিকে জানানো হলো ও কিং ডেভিড হোটেলের টেলিফোন অপারেটরকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে জানানো হলো যে, একটা কিছু ঘটতে চলেছে।
টেলিফোন অপারেটর হোটেলের একজন ম্যানেজারকে বিষয়টি বললেন। কিছুক্ষণ পরেই হোটেলের বেজমেন্টে কিছু দুধের পাত্র পাওয়া গেল যেগুলোতে ছিল মূলত বিস্ফোরক পদার্থ। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাত ১২টা ৩৭ মিনিটেই ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলো। কয়েকশ কিলোগ্রাম বিস্ফোরকের আঘাতে কেঁপে উঠলো ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের প্রাণকেন্দ্র কিং ডেভিড হোটেল। নিহিত হলো বিভিন্ন দেশ ও ধর্মের ৯১ জন মানুষ, আহত হলো আরও ৪৬ জন। কিন্তু কারা ছিল এই ঘটনার পেছনে? আর এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ডই বা কে? চলুন দেখা যাক একটু পেছনে ফিরে।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদীদের জন্য কথিত আবাসভূমি বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ব্রিটেনের অবস্থানের কথা ঘোষণা করেন, যা ঐতিহাসিকভাবে ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালের ২৯ এপ্রিল স্যান-রেমো কনফারেন্সে ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট প্রদান করা হয়। ১৯২২ সালের জুলাই মাসে লিগ অব ন্যাশনস ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট প্রদান করে ও এর একটা খসড়া প্রণয়ন করা হয় যা ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কার্যকর হয়। একদিকে ফিলিস্তিনে অবস্থিত আরব জাতি, অন্যদিকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য আগত ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুত ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় ইহুদীরা। ফলে দ্বন্দ্ব তখন থেকেই শুরু হয়। তবে আমরা দেখবো ব্রিটিশদের সাথে ইহুদীদের দ্বন্দ্ব শুরু হলো কীভাবে।
১৯২৩ সালে ভ্লাদিমির জি’ইভ যেবতিনস্কি বেটার ও পরবর্তীতে রিভিশনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, কবি, ঔপন্যাসিক ও বিভিন্ন ভাষায় জ্ঞানসমৃদ্ধ একজন পন্ডিত ব্যক্তি। তার প্রতিষ্ঠিত বেটার পার্টি মূলত তরুণ ইহুদীবাদী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। যেবতিনস্কির কথা ছিল- ইহুদীদের দাবি একদম পরিষ্কার, আর তা হলো ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তার মতে, এটাই ছিল তাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত প্রতিশ্রুত ভূমি। আরবদের আক্রমণ প্রতিহত করতে তিনি ‘হাগানাহ’ নামে একটি আত্মরক্ষামূলক বাহিনীও তৈরি করেন। এর কাজ ছিল যেকোনোপ্রকার আক্রমণ প্রতিহত করা, কিন্তু স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো আক্রমণ করা যাবে না। পরবর্তীতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের আগপর্যন্ত এটাই ইহুদী এজেন্সি স্বীকৃত প্রধান সামরিক বাহিনী ছিল।
১৯২২ সালে ব্রিটিশ মিনিস্টার অব সেটেলমেন্ট, উইনস্টন চার্চিল, ফিলিস্তিনের ভূমিকে দু’ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জর্ডান নদীর পশ্চিমাংশ (পশ্চিম তীর) হবে ইহুদীদের জন্য প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র ও পূর্বাংশ দেওয়া হবে হাশেমী শাসকদের। যেবতিনস্কি চার্চিলের এ মতের বিরোধিতা করেন। তার ধারণা ছিল, শুধুমাত্র পশ্চিম তীর আগত লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের ধারণ করতে পারবে না। তাই তিনি জর্ডান নদীর উভয় তীরই দাবি করেন। তিনি ‘The Eastern Bank of the Jordan‘ নামে একটি কবিতাও রচনা করেন। এখানে তিনি পুরো জর্ডানকেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড বলে উল্লেখ করেন।
রিভিশনিস্ট পার্টির সাথে বামপন্থী ইহুদীদের লেবার পার্টির দ্বন্দ্ব শুরু হয় যেবতিনস্কির একগুঁয়ে আচরণের জন্য। তার চিন্তা ছিল ইউরোপের সকল ইহুদীকে একত্র করে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার। আর লেবার পার্টি চেয়েছিল নির্দিষ্ট সংখ্যক ইহুদীদের নিয়ে এক সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। যেবতিনস্কির ইহুদীদের একত্রীকরণের একগুঁয়ে আচরণের জন্য সেই সময়কার লেবার পার্টির প্রধান বেন গুরিওন তাকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর কিছুদিন পরেই লেবার পার্টির চেইম আর্লোসরফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যিনি ছিলেন ইহুদী এজেন্সির পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রধান। এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে রিভিশনিস্ট পার্টির তিনজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে ইহুদী অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। এ ঘটনার ফলে বেটার পার্টির অনেকে তাদের চাকরি হারায় এবং যেবতিনস্কির ‘ইহুদী একত্রীকরণ’ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
ঠিক এই সময় যেবতিনস্কির আত্মরক্ষামূলক হাগানাহ থেকে একদল সদস্য আলাদা হয়ে ‘ইর্গুন’ নামক সশস্ত্র সংগঠন গঠন করে। তারা তাদের প্রধান হিসেবে যেবতিনস্কিকেই নির্বাচন করে। তিনিও তা গ্রহণ করেন, কারণ ইতোমধ্যেই তার প্রতিষ্ঠিত হাগানাহ বামপন্থী লেবার পার্টির প্রভাবে চলে গিয়েছিল। ইর্গুনের ধারণা ছিল, আর্লোসরফের হত্যার পেছনে ব্রিটিশদের হাত ছিল। ব্রিটিশরা ইহুদীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যই এরকম ঘটনা ঘটিয়েছে। এছাড়াও, ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইনে ইহুদীদের আগমন সীমাবদ্ধ করে দেয়, যা যেবতিনস্কির ‘ইহুদী একত্রীকরণ’ নীতির পরিপন্থী। তাই প্যালেস্টাইনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, এখান থেকে ব্রিটিশদের আগে হটাতে হবে।
যেবতিংস্কির প্রধান সহযোগী ছিলেন মেনাখেম বেগিন (যিনি পরবর্তীতে ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন এবং ১৯৭৯ সালে মিশরের সাথে ক্যাম্প-ডেভিড চুক্তি করে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাতের সাথে একযোগে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।) বেগিন ১৯৪২ সালে ইর্গুনে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে সেখানকার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বেগিন ছিলেন তখন ভারতবর্ষে ব্রিটশদের বিরুদ্ধে চলমান ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’ দ্বারা প্রভাবিত। তিনি ১৯৪৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যে কাজ করতে প্যালেস্টাইনে অবস্থিত ইহুদীদের প্রধান সংস্থা ইহুদী এজেন্সি ও এর দ্বারা পরিচালিত সামরিক বাহিনী হাগানাহ সাহস পায়নি, সেই কাজ ইর্গুন করেছিল।
অবশ্য ইহুদী এজেন্সি এই বিদ্রোহকে সরাসরি সমর্থন করেনি। ইর্গুন বেগিনের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের উপর ছোটখাট হামলা শুরু করে। ব্রিটিশদের থেকে ইহুদী এজেন্সির উপর চাপ আসতে থাকে। ইর্গুনকেও অনেক সমালোচনা শুনতে হয়। কিন্তু একটা ঘটনা সব মোড় পাল্টে দিল।
১৯৪৬ সালের ২৯ জুন, ব্রিটিশ পুলিশ ও আর্মি একযোগে জেরুজালেম, হাইফা ও তেল আবিবে অবস্থিত ইহুদীদের প্রধান প্রধান কার্যালয়গুলোতে ‘অপারেশ অগাথা’ নামক এক অপারেশন পরিচালনা করে। দিনটি ছিল শনিবার। ইহুদীরা শনিবারে তাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখে, কারণ এটা তাদের সাপ্তাহিক পবিত্র দিন। এই সুযোগেই অপারেশনটি পরিচালিত হয়। এ অপারেশনে অনেক ইহুদী নেতাকে গ্রেফতার ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জব্দ করা হয়।
ঐসকল নথিপত্রের মধ্যে ইহুদীদের ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ইর্গুনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক তথ্য ছিল। ফলে সেগুলো ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রকাশ হয়ে গেলে ইসরায়েল রাষ্ট্র হওয়ার স্বপ্নও দূর হয়ে যেতে পারে। এজন্য তখন মাত্র একটি পথই খোলা ছিল। আর তা হলো এমন কিছু করা যা বিশ্বের সামনে এ বিষয়টা তুলে ধরবে যে, ফিলিস্তিনে শান্তি বজায় রাখতে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ব্যর্থ হয়েছে। ফলে মেনাখেম বেগিন হাগানাহ ও ইহুদী এজেন্সির সাথে পরামর্শ করে ব্রিটিশদের উপর বড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
যদিও হাগানাহ ও ইহুদী এজেন্সির তেমন একটা ইচ্ছা ছিল না, তবুও ইর্গুন ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিং ডেভিড হোটেলেই ছিল ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সচিবালয় ও সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর। তাছাড়া ইর্গুন জানতে পেরেছিল জব্দকৃত নথিপত্র সেখানেই সংরক্ষিত আছে। ফলে ২২ জুলাই, ১৯৪৬ সালে ইর্গুনের কয়েকজন সদস্য আরবদের পোষাক পরিহিত অবস্থায় হোটেলের ওয়েটার সেজে দুধের পাত্রের মধ্যে বিস্ফোরক পদার্থ নিয়ে কিং ডেভিড হোটেলে প্রবেশ করে। তারপর তারা হোটেলের বেজমেন্টে তা রেখে দেয়।
বিস্ফোরণের ঠিক আগমুহূর্তে হাগানাহ থেকে অপারেশনটি বাতিল করার জন্য বলা হয়। কিন্তু মেনাখেম বেগিন তা শোনেননি। ফলে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের প্রাণকেন্দ্র কিং ডেভিড হোটেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিস্ফোরণের আঘাতে তছনছ হয়ে যায়। প্রাণ হারায় প্রায় শ’খানেক মানুষ।