অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আইবেরিয়া উপদ্বীপ (বর্তমান স্পেন এবং পর্তুগাল) বিজয়ের মাধ্যমে স্পেনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। অন্ধকার ইউরোপে তৎকালীন স্পেন ছিল আলোকবর্তিকাস্বরূপ। কর্ডোভা ছিল মুসলিম স্পেনের রাজধানী। তৎকালীন কর্ডোভার গ্রন্থাগারগুলো শুধু বাগদাদের গ্রন্থাগারের সাথেই তুলনা করা যাবে। তখন প্রায় চার লক্ষ বই ছিল কর্ডোভার গ্রন্থাগারে।
এটা তখনকার কথা, যখন ছিল না কোনো ছাপাখানা। বই শুধু লিখেই সংগ্রহ করতে হতো। আর এই কাজটি করতেন লিপিকাররা। বর্তমান যুগে মুদ্রণশিল্পের এত অভাবনীয় উন্নয়নের পরও আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার সুফিয়া কামাল গণগ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষ, যা কর্ডোভার প্রায় অর্ধেক।
স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রেও ছিল চমকপ্রদ সব দৃষ্টান্ত। আলহামরার প্রাসাদ সম্পর্কে সরোজিনী নাইডু বলেছেন, সেটা নাকি তাজমহলের চাইতে অধিকতর অনিন্দ্যসুন্দর। আর স্যার আমীর আলী বলেছেন, “আলহামরার দৃশ্য বর্ণনা অত্যন্ত শক্তিশালী কলমের দ্বারাই শুধু সম্ভব।” অন্যদিকে তখন কর্ডোভার জনসংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লক্ষ। তাদের জন্য বাসগৃহ ছিল প্রায় সোয়া দুই লক্ষ। এতে বোঝাই যায়, সবার জন্যই বাসস্থানের ভালো ব্যবস্থা ছিল।
কর্ডোভা কেন্দ্রীয় মসজিদ, কর্ডোভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন, যা কালের পরিক্রমায় টিকে থাকা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এই মসজিদের কেবল ছাদঢাকা অংশের আয়তনই ছিল প্রায় সাড়ে ২২ হাজার বর্গ মিটার, যা আমাদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের আটগুনেরও বেশি বড়।
কর্ডোভার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো কর্ডোভা সেতু। এটি স্পেনের অন্যতম প্রধান নদী ওয়াদিল কাবীরের ওপর নির্মিত হয়েছিল, যার দৈর্ঘ্য প্রায় চারশো মিটার। এটি প্রায় তেরশ বছর আগে নির্মিত। তখন মানুষ পরিবহন মাধ্যম বলতে কেবল ঘোড়া-গাধা-খচ্চরের কথাই চিন্তা করত। বর্তমানকালের মতো উন্নতমানের নির্মাণরীতি-কৌশল ও যন্ত্রপাতিও তখন ছিল না।
ভৌগোলিক পরিচয়
বর্তমান বিশ্বের মানচিত্রে স্পেন ও পর্তুগাল মিলেই আইবেরিয়ান উপদ্বীপ গঠিত। হিস্পানিয়া বা আন্দালুসিয়া নামেও এটি পরিচিত। আয়তনে প্রায় ছয় লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এই উপদ্বীপটি উত্তরে পিরেনিজ পর্বতমালা দ্বারা ফ্রান্স থেকে পৃথক, আর দক্ষিণে প্রায় ১৩ কিলোমিটার প্রস্থের জিব্রাল্টার প্রণালী একে আফ্রিকার মরক্কো থেকে পৃথক করেছে। ত্রিকোণাকার এই উপদ্বীপটির উত্তর সীমানায় আছে বিস্কে উপসাগর, পশ্চিমে সুবিশাল আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণ আর পূর্বে আছে ভূমধ্যসাগর। আইবেরিয়ান উপদ্বীপের অভ্যন্তরে বিশাল এলাকা জুড়ে আছে সুবিস্তৃত মালভূমি, যা মেসেতা মালভূমি নামে পরিচিত। এটি উপদ্বীপের প্রায় অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়ে অবস্থিত।
তাগুস নদী আন্দালুসিয়ার প্রধান ও সর্ববৃহৎ নদী। নদীর মধ্যে দৈর্ঘ্যের ক্রমানুসারে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোয়াদিয়ানা, ডুরো, ইবরো, গোয়াদালকুইভির এবং মিনহো। টলেডো ছিল তৎকালীন স্পেনের রাজধানী। এছাড়া কর্ডোভা (মুসলিম স্পেনের রাজধানী), ভ্যালেন্সিয়া, মালাগা, আলমেরিয়া, কেডিজ, লিসবন, গ্রানাডা, মুরসিয়া, তারিফ হচ্ছে উপদ্বীপটির কিছু বিখ্যাত শহর ও বন্দর। পরবর্তী সময়ে বিভক্ত মুসলিম আন্দালুসের বিভিন্ন রাষ্ট্র এই শহরগুলো কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল।
নামকরণ
গ্রিকরা এর নাম দিয়েছিল ‘আইবেরিয়া’, আর রোমানরা দিয়েছিল ‘হিস্পানিয়া’। অন্যদিকে, অতীতে সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন জাতি স্পেনে বসবাস করত। এই জনগোষ্ঠীকে ভান্দাল গোত্র বলা হতো। আর বাসিন্দাদের নামের সাথে মিল রেখে এ ভূখণ্ডকে আরবরা বলত ভান্ডালুসিয়া। আন্দালুসিয়া মূলত ‘ভান্ডালুসিয়া’ শব্দেরই অপভ্রংশ। কালের বিবর্তনে এই আন্দালুসিয়া ‘আন্দালুস’ নাম ধারণ করে।
ইসলামপূর্ব স্পেনের শাসনব্যবস্থা
ফিনিশীয়রা প্রথমে স্পেনের বিভিন্ন ভূমধ্যসাগরীয় নগর ও বন্দর পত্তন করে শাসন করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে তাদের শক্তি কমে আসলে তিউনিসিয়া-কেন্দ্রিক কার্তাজেনরা স্পেন শাসন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ইতালির রোম শহরকে কেন্দ্র করে রোমান সাম্রাজ্যের পত্তন হলে তারাই কার্তাজেনীয়দেরকে উচ্ছেদ করে সেখানে নিজেদের রাজত্ব গড়ে তোলে। রোমানরা প্রায় দীর্ঘ ৫০০ বছর ধরে সেখানে রাজত্ব করে।
গথ রাজত্ব
খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দীর শে দিকে পশ্চিমা গথ জাতি এলারিকের নেতৃত্বে রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশের বিভিন্ন নগরী দখল করে নেয়। ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট থিয়োডোসিয়াসের মৃত্যু হলে গথ নেতা এলারিক পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী নেতারূপে আবির্ভূত হন। এলারিকের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন আটাউল্ফ। রোমান সাম্রাজ্য তাকে গল (বর্তমান ফ্রান্স) এর দক্ষিণাংশ আর স্পেন শাসনের অনুমতি দেয়। ধীরে ধীরে রোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে, আর গথ জাতিও প্রতিপত্তি লাভ করতে থাকে। বিশেষ করে ভ্যালিয়ার শক্তিশালী নেতৃত্বে গথরা পুরো উপদ্বীপের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে গথ নেতা ইউরিক ‘সম্রাট’ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করেন। সুপরিচিত পশ্চিমা গথ জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা এই ইউরিকই। স্পেনে মুসলিম আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তিনশো বছরেরও (৪০৯-৭১২ খ্রিস্টাব্দ) বেশি সময় ধরে গথরা শাসন ক্ষমতায় ছিল। গথিক শাসন ছিল ধ্বংসলীলা, গণহত্যা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্দয়ভাবে দমন এবং আক্রমণকারী বর্বরদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পরিপূর্ণ। উঁচু-নিচুর ব্যবধান, আস্থাহীনতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ইহুদিদের দুর্ভোগের ইতিহাস গথ শাসনের ব্যর্থতার স্বাক্ষর বহন করে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা
তৎকালে স্পেনের সমাজ মোটামুটি শাসক আর শাসিত এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। রাজা, ধর্মযাজক, যুবরাজ ও সামন্ত প্রভুরা ছিল শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে বর্গাকার, ভূমিদাস, ক্রীতদাস ও ইহুদিরা ছিল শাসিত শ্রেণীভুক্ত। অন্যদিকে, স্পেনের অর্থনীতির সিংহভাগ ছিল ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। তারাই ছিল স্পেনের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার দরুন তারা মিল-কারখানা, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেশত্যাগ করেন। ফলে, স্পেনের অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ে। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই অর্থনীতি অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানদের প্রচেষ্টায় পুনর্জীবন লাভ করে।
ধর্মীয় অবস্থা
স্পেনে ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল অনুপস্থিত। গথরা ছিল আর্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু ৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রথম রিকার্ড ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণ করেন এবং একে স্পেনের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। আর এরপরই স্পেনের ইহুদিদের দুর্দিনের শুরু। ক্যাথলিকরা আর্য খ্রিস্টানদের চেয়ে ধর্মের ব্যাপারে বেশি কট্টর ছিল। তারা ইহুদিদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্যে বিরামহীন চেষ্টা করতে থাকে।
অবশেষে, ৬১১ খ্রিস্টাব্দে গথ রাজা সিসুবুত নতুন আইন করেন, যাতে উল্লেখ ছিল- যেসব ইহুদি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নির্বাসনে পাঠানো হবে। এর ফলে ৬১২ থেকে ৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার ইহুদিকে বলপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। অতঃপর, উত্তর আফ্রিকার ইহুদিদের সাথে একত্র হয়ে স্পেনের ইহুদিরা গথ শাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। পরে তাদের এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়।
রডারিকের সিংহাসনে আরোহণ
মুসলিম বাহিনী স্পেন বিজয়ের বছরখানেক আগে স্পেন শাসন করতেন গথ সম্রাট ওটিজা। তিনি ৭০২ খ্রিস্টাব্দে তার পিতা এজিকার উত্তরাধিকার নির্বাচিত হন। ওটিজা পূর্ববর্তী গথ শাসকদের মতো এতটা অত্যাচারী ছিলেন না। তিনি ইহুদিদের সাথে যথেষ্ট সদয় ব্যবহার করতেন। কিন্তু, তৎকালীন পাদ্রীরা এটা ভালো চোখে দেখেনি। তাদের সাথে জনসাধারণের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় জনগণের ওপর তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
তারা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে জনগণকে অনুপ্রাণিত করে। পরবর্তী সময়ে ইহুদিদের সাহায্যের অভিযোগে পাদ্রী ও অভিজাতদের একাংশের সহযোগিতায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করে ক্ষমতায় আসেন জনৈক সেনাপতি রডারিক। তিনি ওটিজার পুত্র যুবরাজ আচিলাকে রাজধানী টলেডো থেকে গ্যালিসিয়ায় নির্বাসনে পাঠান। এই রডারিকের আমলেই স্পেন মুসলিমদের অধীনে চলে আসে।
তৎকালীন উত্তর আফ্রিকা
তৎকালীন সমগ্র উত্তর আফ্রিকা (সিউটা ব্যতীত) ছিল উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ নিযুক্ত গভর্নর ইয়ামেনী বংশোদ্ভূত মূসা ইবনে নূসাইরের শাসনাধীন। তিনি কায়রোয়ান শহর থেকে সমগ্র মাগরেব (বর্তমান তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া ও মৌরিতানিয়া) শাসন করতেন। মাগরেবের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল বর্বর জাতিভুক্ত।
অন্যদিকে, আফ্রিকা তথা মরক্কোর উত্তর উপকূলের সিউটা দুর্গটি ছিল রোমানদের দখলে। কাউন্ট জুলিয়ান ছিলেন সেই দুর্গের অধিপতি। তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল সম্রাটের পক্ষ থেকে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কাউন্ট জুলিয়ানের সাথে স্পেনের রাজা ওটিজার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় এর দরকারও ছিল। কারণ, মুসলিমদের আসন্ন আক্রমণ থেকে সিউটার নিরাপত্তার জন্য কনস্ট্যান্টিনোপলের চেয়ে স্পেন বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
ওটিজা তার এক কন্যার সাথে জুলিয়ানের বিয়েও দিয়েছিলেন। তাই স্বভাবতই ওটিজার সিংহাসনচ্যুত হওয়ার ফলে স্পেনের সাথে জুলিয়ানের সম্পর্কটাও ভেঙে যায়। এছাড়াও জুলিয়ান তৎকালীন রীতি অনুযায়ী তার কন্যা ফ্লোরিডাকে রাজকীয় আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার রপ্ত করার জন্যে টলেডোর রাজপ্রাসাদে পাঠান। ওটিজার পতনে টলেডোর স্থানে ক্ষমতায় আসেন রডারিক। কিন্তু রডারিক বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হওয়া সত্ত্বেও বলপূর্বক ফ্লোরিডার শ্লীলতাহানি করেন। এতে কাউন্ট জুলিয়ান গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং অপমানের প্রতিশোধ নেবার শপথ করেন।
এর ফলে কাউন্ট জুলিয়ান, সেভিলের প্রধান ধর্মযাজক ও কয়েকজন খ্রিস্টান সর্দারকে সাথে নিয়ে কায়রোয়ানে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম শাসক মূসা ইবনে নূসাইরের কাছে গিয়ে স্পেন আক্রমণের অনুরোধ করেন আর সাথে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়ে আসেন। মূসা ইবনে নূসাইর জুলিয়ানের আবেদন গুরুত্বের সাথে নেন আর স্পেন আক্রমণের অনুমতির জন্যে খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিকের দরবারে চিঠি লেখেন।
এভাবেই চলমান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেই স্পেনের ইতিহাসে সূচিত হতে যাচ্ছে এক নতুন যুগের। যে যুগে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত স্পেন পরিণত হয় সমগ্র ইউরোপের আলোকবর্তিকায়, আর দারিদ্রে ক্লিষ্ট স্পেন পরিণত হয় ইউরোপের সমৃদ্ধতম দেশে।