চুয়িং গামের মজার ইতিহাস

আধুনিক সময়ে চুয়িং গাম শিশু-কিশোরদের কাছে অতি পরিচিত একটি খাবার। প্রতিটি মুদি দোকানেই বিভিন্ন স্বাদের, রংয়ের, আকার কিংবা মূল্যের চুয়িং গাম দেখতে পাওয়া যায়। শিশুরা এসব দেদারসে কেনে। আমাদের দেশে মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি কিংবা বৃদ্ধদের কাছে এর তেমন আবেদন না থাকলে ইউরোপে বা আধুনিক দেশগুলোতে সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে এটি দারুণ এক খাদ্য। খেলোয়াড়েরা খেলার বা অনুশীলনের সময় যেন গলা শুকিয়ে না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে প্রায়শই চুয়িং গাম চিবিয়ে থাকেন। সেলিব্রিটি ব্যক্তিত্বদের ফেলে দেয়া চুয়িং গাম কুড়িয়ে এনে পরবর্তীতে নিলামে বিশাল অংকে বিকোনোর খবরও শোনা গিয়েছে বেশ কয়েকবার। এই খাবারটির রয়েছে এক মজাদার ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, চুয়িং গাম চিবানো হতো সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আজ থেকে নয় হাজার বছর পূর্বে উত্তর ইউরোপের বাসিন্দারা একধরনের গাছের ছাল চিবোতেন। গবেষকদের মতে, সম্ভাব্য দুটি কারণে সেই সময় তারা গাছের ছাল চিবাতেন। একটি হচ্ছে সেটি চিবানোর ফলে তারা একটি আলাদা স্বাদ লাভ করতেন, আরেকটি হচ্ছে দাঁতের ব্যথা সারানোর জন্য তারা এরকমটা করে থাকতেন৷ আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন মায়া সভ্যতায়ও চুয়িং গাম চাবানোর নিদর্শন পাওয়া যায়। মায়া সভ্যতায় স্যাপোডিল্লা গাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে জমে যাওয়া রস চিবানো হতো। সাধারণত ক্ষুধা মেটাতে কিংবা তৃষ্ণা নিবারণ করতেই এমনটা করতো মায়ানরা। এরপর মেক্সিকোর বিখ্যাত আজটেক সভ্যতায়ও একইভাবে স্যাপোডিল্লা গাছ থেকে উৎপন্ন চুয়িং গাম খাওয়া হতো।

ইতোপূর্বে চুয়িং গাম চর্বণের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ নিয়মের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও আজটেক সভ্যতায় চুয়িং গাম চিবানোর নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল। শিশু ও অবিবাহিত নারীরা প্রকাশ্যেই চিবোতে পারতেন। বিবাহিত নারী এবং বিধবাদের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল ব্যক্তিগত পরিসরে উপভোগ করার। তারা মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে এমনটা করতেন। অপরদিকে পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে একেবারেই আড়ালে চিবোনোর কঠোর নিয়ম ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দাঁত পরিষ্কার করা।

Image source: Wikimedia Commons

উত্তর আমেরিকায় পাইন গাছের সদৃশ ‘স্প্রুস ট্রি’র সর্জরস চিবানোর চল ছিল। পরবর্তীতে ইউরোপীয়রা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করলে তারাও চিবানোর সংস্কৃতি অব্যাহত রাখে। ১৮৪০ সালের দিকে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে জন কার্টিস নামের একজন ব্যক্তি চুয়িং গাম শিল্পের সূচনা করেন। তিনি স্প্রুস গাছের রস সংগ্রহ করে সেটি গরম পানিতে সিদ্ধ করতেন। এরপর সেই রস জমিয়ে সুবিধা মতো কাটা হতো। কেটে ছোট টুকরো করার পর সেগুলোতে ভুট্টা থেকে উৎপন্ন ময়দা মাখানো হতো, যাতে একসাথে অনেকগুলো রাখলে একটির সাথে আরেকটি লেগে না যায়। এভাবে বানানো চুয়িং গামের স্বাদ খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না। ফলে তিনি ও তার পরের চুয়িং গাম উৎপাদকরা প্যারাফিন তেলসহ বিভিন্ন উপাদান যোগ করার সিদ্ধান্ত নেন।

নিউ ইয়র্কের থমাস অ্যাডামস নামের একজন ব্যক্তির সাথে নির্বাসিত মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট এ্যান্টনিও লোপেজ ডি সান্তা আন্নার দেখা হয়। নির্বাসিত প্রেসিডেন্টের কাছে থাকা স্যাপোডিল্লা গাছের নির্যাস থেকে উৎপাদিত চুয়িং গাম ‘চিকল’ থমাস অ্যাডামসের নজরে আসে। তারা দুজনে ‘চিকল’ নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করেন। নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট লোপেজ চেয়েছিলেন রাবারের বিকল্প হিসেবে আমেরিকায় তারা চিকলের প্রসার ঘটাবেন। কিন্তু পরীক্ষাগুলোতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না আসায় তারা হতাশ হয়ে পড়েন। থমাস অ্যাডামস দেখতে পান, চিকল যদি উন্নতমানের চুয়িং গাম তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ভালো সম্ভাবনা আছে। ১৮৮০ সালের দিকে তিনি একটি কোম্পানি তৈরি করেন, যেটি পুরো আমেরিকায় চিকল থেকে তৈরিকৃত চুয়িং গাম সরবরাহ করতো।

বিশ শতকে চুয়িং গামের বাজার বড় হতে থাকে। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় উইলিয়াম রিংলে জুনিয়র নামের একজন ব্যক্তি সাবানের বিপণন করতেন। তিনি তার পণ্য বিপণনের জন্য বিক্রেতাদের বিভিন্ন বাড়তি সুবিধা দেয়া শুরু করেন। যেমন- কোনো বিক্রেতা যদি পাইকারি হারে নির্দিষ্ট পরিমাণ সাবান ক্রয় করতো, তবে তিনি বেশ কিছু বেকিং পাউডারের ক্যান ফ্রি দিতেন। পরবর্তীতে দেখা গেল বাজারে সাবানের চেয়ে বেকিং পাউডারই বেশি বিকোচ্ছে৷ এরপর তিনি সাবান বাদ দিয়ে বেকিং পাউডারের বিপণন শুরু করেন এবং বাড়তি সুবিধা হিসেবে বিক্রেতাদের কিছু চুয়িং গামের প্যাকেট ফ্রি দিতেন। একপর্যায়ে বাজারে চুয়িং গামের বিশাল চাহিদা তৈরি হয়। ১৮৯৩ সালের দিকে তিনি চিউয়িং গাম তৈরির দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন (জ্যুসি ফ্রুট এবং রিংলে’জ স্পিয়ারমিন্ট)। চুয়িং গামের বিজ্ঞাপনের পেছনে তিনি বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিলেন। এটি তাকে আমেরিকার অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করে।

Image source: Days of the year

এদিকে ১৮৮৫ সাল থেকেই চুয়িং গাম উৎপাদন করে যাচ্ছিল ফ্র্যাঙ্ক ফ্লিয়ার নামের একজন ব্যক্তির নিজস্ব কোম্পানি। তিনি চেয়েছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলো যেরকম চুয়িং গাম বিক্রি করছে, তার চেয়ে ভিন্ন ঘরানার কিছু বিক্রি করবেন। ১৯০৬ সালে তিনি বাবল গাম বাজারে আনেন, যার নাম দিয়েছিলেন ‘ব্লিবার-ব্লাবার’৷ কিন্তু এটি সেভাবে আলোড়ন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ১৯২৮ সালে ফ্র্যাঙ্ক ফ্লিয়ারের প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী ওয়াল্টার ডাইমার আরও উন্নত বাবল গাম তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেন। ওয়াল্টার ডাইমারের উদ্ভাবিত কৌশলের বাবল গামের নাম দেয়া হয় ‘ডাবল বাবল’। এই বাবল গাম বাজারে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন স্বাদের ও বর্ণের চুয়িং গাম তৈরি করে চলেছে।

Language: Bangla
Topic: History of chewing gums
References:
1. Chew on This: The History of Gum - History
2. A Brief History of Chewing Gum - Smithsonian Magazine
3. The History of Chewing Gum, From Chicle to Chiclets - Serious Eats

Related Articles

Exit mobile version