দশ ঘাটের জল খেয়ে বাঙালি আজ এ পর্যায়ে। কত না সংস্কৃতি এসে মিশেছে এই বাংলার পাড়ে। পারস্য, পর্তুগিজ, বিলিতি, চীনা, দিশি কত ঘাটের রান্নার স্রোত এসে মিলেছে বাঙালির পাতে। খাওয়া-দাওয়ার বৈচিত্র্য তাই বঙ্গ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগে বাংলার খাদ্যাভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। পার্সি, তুর্কি, আফগান, আরবরা তখন প্রায় পুরো ভারতের দখল করে রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত। এই রাজ্যবিস্তার করতে করতে নিজেদের অন্যান্য সংস্কৃতিসহ খাবারের অভ্যেসও ঢুকিয়ে দিয়েছে বাংলার প্রান্তরে। এরই মধ্যে আবার পনেরশো শতকে বাংলায় আসে পর্তুগীজরা, ষোড়শ শতকে হানা দেয় ইংরেজরা, ষোড়শের শেষার্ধে প্রবেশ করে ওলন্দাজ আর ফরাসিরা। মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায় ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায়। এ সকল ঘটনা বাংলার রান্নার ভূগোল পাল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাই সময়ে সময়ে যুগে যুগে একেক জাতির খাবারের স্বাদ সানন্দে গ্রহণ করেছে বাঙালি।
প্রাচীন যুগের খানাদানা
জানা যায়, প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ধান আমদানি করা হতো। অন্যান্য দেশে যখন শুকনো মাটিতে ধান চাষ হতো, তখন ভারতবর্ষেই প্রথম পানিতে ডোবানো জমিতে ধান চাষ শুরু হয়। আর বাংলার বা বাংলাদেশের ভৌগোলিক কারণেই, কি আদিবাসী-কৌম সমাজের উত্তরাধিকারের ফলেই কৃষিপ্রধান বাংলার প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে ভাত। এমন খোঁজই পাওয়া যায় চতুর্দশ শতাব্দীর ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ গ্রন্থে-
“ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা
মৌইলি মচ্ছা নলিতা গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা(ই) পুনবন্তা।”
অর্থাৎ, যে রমণী কলাপাতায় গরম ভাত, ঘি, মৌরলা মাছ এবং এবং নলিতা অর্থাৎ পাট শাক পরিবেশন করে স্বামীকে খাওয়ায়, সেই স্বামী ভাগ্যবান। নৈষধচরিতে ভাতের আরও বিস্তারিতো বর্ণনা আছে-
“পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন! সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়!’’
চতুর্দশ শতকেই ‘চর্যাপদে’র একটি বৌদ্ধ গানে দেখা যায় যে, বাড়িতে অতিথি এসেছে। অন্যদিকে হাঁড়িতে নেই ভাত তাই বলে কবি বিপদে পড়ে দুঃখ করছেন। কলাপাতায় গরম গরম ঘি আর ভাত দেওয়ার কথা জানা যায় ভট্টাচার্যের বাড়িতে মহাপ্রভুর ভোজনের বর্ণনায়, পঞ্চদশ শতকে কৃষ্ণদাশ কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে। এ থেকেই প্রমাণিত যে, ভাত প্রাচীন যুগ থেকেই ভাত ছিল বাঙালিদের প্রধান আহার্য। তখন থেকেই বাঙালিদের ভাতের প্রতি দুর্বলতা, ভাত না হলে যেন চলেই না। এই অভ্যাস আজও চলছে বৈকি। প্রকৃত বাঙালি বড়জোর ৩-৪ বেলা ভাত না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে, এর বেশি না, এমনটা আজো বিশ্বাস করা হয় বাঙালি সমাজে। যেমন দেশ ছেড়ে দূরে কোথাও গেলে বাঙালির ডালভাত-আলুভর্তা আর মরিচের কথা বড্ড মনে পড়ে!
এ গেলো ভাতের কিচ্ছা। ভাত কি শুধু শুধু খেয়েই পার হয়েছে? কখনোই না। তাই ভাতের স্বাদকে পরিপূর্ণ করতে ভাতের সাথে যোগ হয়েছে নানা ব্যঞ্জন। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ভাতের সাথে আহার্য কিছু খাদ্যের খোঁজ পাওয়া যায়। যেমন-
“নটে রাঙা তোলে শাক পালঙ্গ নলিতা
তিক্ত ফল তাঁর শাক কলতা পলতা
সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা
নটুয়া বেথুয়া তোলে ফীরে ক্ষেতে ক্ষেতে
মহুরী শুলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেটে।”
বিভিন্ন দেশীয় শাকপাতাও ভাতের সাথে খাওয়া হতো। কখনো ভর্তা, কখনো বা ঝোল-তরকারি। টক দই খাওয়ারও বেশ প্রচলন ছিল ভাতের সাথে বা আহার শেষে।
প্রাচীন কোনো গ্রন্থে ডাল খাওয়ার সন্ধান পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ বা পূর্ব-ভারতে কখনোই ডালের চাষ হতো না বলেই জানে সবাই। তাই আশা করা যায়, পরবর্তীকালে ডালের সংস্পর্শে আসে বাঙালি এবং অতঃপর তা এক আবশ্যকীয় পদে পরিণত হয়। ধারণা করা হয়, দক্ষিণের সেন রাজবংশ এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে ইসলামের আগমনের সাথেই আগমন ঘটে ডালের। ‘ব্যঞ্জন রত্নাকার’ নামক আধুনিক বাংলা ভাষার এক রান্নার বইতে মুগ, অড়হর, মসুর এবং কলাই ইত্যাদি ডালের বিভিন্ন রান্নার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়।
এবার দেখা যাক সবজির সূচনা কীভাবে হলো। পঞ্চদশ শতকের ‘মনসামঙ্গল’ এবং ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে কচু, বেগুন, লাউ, কুমড়ো, পটল, উচ্ছে, ঝিঙে, শিম, কাঠালবিচি, নিম, কাঁচকলা ইত্যাদি অজস্র নিরামিষ পদ দিয়ে বাঙালির ভাত খাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। পর্তুগীজদের আগমনে বাঙালিরা দেখা পেল নতুন কিছু সবজির। যেমন সপ্তদশ শতকে এলো আলু। এরপর ছিল আরও টমেটো এবং কাঁচালঙ্কা। যে কাঁচামরিচ আর আলুভর্তা ছাড়া বাঙালির খিদে মেটে না, তা কিন্তু আসলে নিজেদের আবিষ্কৃত খাদ্যই নয়! ভাগ্যিস পর্তুগীজরা এসেছিলো এ বাংলায়।
বাঙালি মাছ কবে থেকে খাওয়া শুরু করে, তার কোনো সঠিক দিনক্ষণ পাওয়া যায়নি। তবে, বাংলায় যত নদী-নালা-খাল-বিল ছিল, তাতে ধারণা করা যায়, আদিকাল থেকেই মাছ খেতো বাঙালি। সেজন্যই এ জাতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে “মাছেভাতে বাঙালি” কথাটি। মাছ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রাণী। পশ্চিমবাংলার চন্দ্রকেতুগড়ে একটি পোড়ামাটির ফলকে মাছের উৎকীর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ফলকটি চতুর্থ শতকের। আবার বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতিতে পাওয়া বিভিন্ন ফলকেই মাছ কোটার, ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে যাওয়ার ছবি ফুটে ওঠে। মাছ যে বাঙালির অতি প্রাচীন এক খাদ্যাভ্যাস, তা এসকল ফলকই প্রমাণ করে।
তবে বঙ্গে মুসলমানরাই মাছ বেশি খেতো। ব্রাক্ষ্মণ আর বৌদ্ধধর্মানুসারীদের জন্য মাছ খাওয়ার সুযোগ ছিল না ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে। তবে বাঙালি শাস্ত্রকারদের মধ্যে ভবদেব ভট্ট প্রমাণ করেছিলেন মাছের গুণাগুণ এবং মাছ খাওয়ার সুফল।
মাছ বাঙালির কাছে যে প্রিয় খাদ্য ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন রন্ধন বইয়ে। গৃহিণীরা সেকালে বহুভাবে মাছ রান্না করতেন। যেমন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী তাঁর এক রান্নার বইতে ৫৮ পদের মাছ রান্নার পদ্ধতি জানিয়েছেন।
মধ্যযুগে বাঙালির বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে মৎস্য ভোজনের বিপুল বর্ণনা রয়েছে। রুই, কাতলা, চিতল, মাগুর, চিংড়ি, পাবদা, শোল ইত্যাদি মাছের নাম আছে সেগুলোতে। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেও আছে খাড়কি, চিংড়ি, কচ্ছপের ডিম, ভেটকি সহ অসংখ্য মাছের কথা। প্রাচীনকাল থেকেই শুঁটকি মাছ বাঙালির কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষোড়শ শতকে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে মাছ রান্নার বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়; যেমন- কৈ মাছ আদার রসে রান্না করা হতো, রুই মাছ দিয়ে হতো কলতার আগা, ঝাঁঝালো সর্ষের তেলে হতো খরসুন মাছ।
বাঙালির বিয়েবাড়িতে কিংবা গায়ে হলুদে রুই মাছ সাজিয়ে পাঠানো শুভাশিষের প্রতীক। বিয়ের পরদিন শ্বশুরবাড়িতে ‘জামাই বাজার’ রীতিতেও কিন্তু মাছ থাকা আবশ্যকীয়। ইলিশ হোক কি রুই, জামাইবাবু বাজার কেমন করেন, মাছ কেমন চেনেন, তা পরখ করতে হবে তো শালাবাবুদের!
অর্থাৎ বাঙালীর যেকোন উৎসব মাছ ছাড়া অচল যেন। সাহিত্য-কবিতায়ও মাছের ছড়াছড়ি ছিল। ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন,
‘‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।”
মাংস খাওয়ার বর্ণনাও পাওয়া যায় চর্যাপদে ভুসুকুপার গানে। গরু, খাসি এবং হরিণের মাংস খাওয়ার চল ছিল মধ্যযুগ থেকেই। হরিণের মাংস খুব সুস্বাদু তাই চর্যাপদে লেখা ছিল “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”। অর্থাৎ হরিণের মাংস এতই সুখ্যাতি ছিল যে সবাই বনে এসে হরিণ খুঁজে মারে। সেসময় বাঙালির বিয়ের ভোজে হরিণের মাংসের পদ অনিবার্যভাবে পরিবেশন করা হতো। সাথে খাসি, পাখির মাংসও থাকতো।
বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গলে দেখা যায়-
“মাংসতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল,
ছাল খসাইয়া রান্ধে বুইড়া খাসীর তেল”
বেজি, শজারুর মাংস রান্নার বর্ণনাও পাওয়া যায় কাব্যগ্রন্থগুলোয়। এছাড়া, কাঁকড়া, শামুক, হাঁস, শুকর খেতো সকলেই। মুসলমানরা অবশ্য শুকর খেতো না ধর্মীয় বিধিনিষেদের কারণে, তবে অন্যান্য ধর্মে জনপ্রিয় ছিল এই মাংস। ঠিক যেমন বৈদিক যুগে গরুর মাংস নিষিদ্ধ ছিল সনাতন ধর্মে। বৌদ্ধ ধর্মানুসারে আবার জীবহত্যা মহাপাপ। তাই তারা ছিল নিরামিষভোজী।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভাতের উপরই জোর দিয়েছে বাঙালি। তবে শখ হলে লুচি-পরোটা খাওয়ার চল ছিল ঠিকই। বিংশ শতকে রুটি খাওয়ায় পুরোদস্তুর অভ্যস্ত হয়ে পড়ে বাঙালি। গ্রামবাংলায় যদিও তিনবেলাই ভাত খাওয়া হয়, কিন্তু শহুরে মানুষের এত সময় কোথায়? তাই তারা রুটি-পাউরুটিকেই বেছে নিয়েছে নাশতা হিসেবে জনজীবনের ব্যস্ততায়। যদিও বর্তমানে রকমারি খাবারের ছোঁয়ায় ভাতের ওপর মানুষের অনীহা লক্ষণীয়। ঘি মেশানো ভাত কী স্বাদের, সে কথা না জানে আজকের প্রজন্ম, না পাওয়া যাবে সেই প্রকৃত স্বাদের ঘি। নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় আছে মুরগি। তাও দেশি নয়, হাইব্রিড, ব্রয়লার মুরগি। বকের মাংস খাওয়া এখন বিলাসিতা।
মিষ্টি খাওয়া বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে সেকালে মিষ্টি বলতে প্রচলিত ছিল হাতে তৈরী নাড়ু, রকম রকম পিঠে-পুলী আর পায়েস। চাল দিয়ে তৈরী হতো মুড়ি, চিড়া-খই-নাড়ু ইত্যাদি। আর মিষ্টি সাধারণত হতো দুধের তৈরী। দুধের তৈরী যেকোনো খাদ্য ছিল দেবখাদ্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় খাদ্য ননী ও মাখনের কথা কে না জানে! তাই সে সকল খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত ছিল। কিন্তু অন্যদিকে ছানা তৈরী হতো দুধ বিকৃত করে, তাই ধর্মীয় বিধানে ছানা ছিল অখাদ্য। সুকুমার সেন তাঁর ‘কলিকাতার কাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছিলেন,“ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই-এগুলো কাঁচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনটিই দুধের বিকৃতি নয়। ‘ছানা’ কিন্তু ফাটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি।”
পূর্বে যখন চিঠি বিলির রীতি ছিল, তখন কোনো চিঠি বা খবর পাঠানোর সাথে ব্যবহার হতো মিষ্টি। সেই মিষ্টি এবং খবর পাঠানোর রসায়নের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল ‘সন্দেশ’। পূর্বে সন্দেশ তৈরী হতো বেসন, নারকেল ও মুগের ডালের সঙ্গে চিনি মিশ্রিত করে।
‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে আছে আমৃত গুটিকা, আমের খণ্ড, পাতপিঠা, দুঘলকলকি, মনোহরা, ক্ষীরখণ্ড, ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি, ছানাবড়া, পায়েস, নালবড়া। খেজুরের রস এবং আখের রস দিয়ে তৈরী হতো গুড় ও পাটালি গুড় আবার পানীয় হিসেবেও খেজুর ও আখের রস বিখ্যাত ছিল।
যতদূর জানা যায়, রসগোল্লা সর্বপ্রথম তৈরী হয় ভারতের উড়িষ্যায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলায়। মোঘল আমলের জনপ্রিয় মিষ্টি কালোজাম বা গুলাব জামুন। ময়রার তৈরী নানারকমের মিষ্টিও বঙ্গদেশে বিখ্যাত ছিল। বাঙালির প্রাচীন মিষ্টি হচ্ছে সন্দেশ। দুধের ছানা এবং গুড়ের তৈরী সন্দেশ ছাড়া বাঙালির কোনো উৎসব যেন পূর্ণতা পায় না। নাটোর জেলার কাঁচাগোল্লা সন্দেশ বিশেষভাবে বিখ্যাত বহুকাল ধরেই।
আর মিষ্টি! বাঙালির সুসংবাদে মিষ্টি, আতিথ্যে মিষ্টি, ভদ্রতায় মিষ্টি, বিয়েশাদি- এমনকি কুলখানি বা মিলাদেও মিষ্টির ছড়াছড়ি।
ফরাসিরা বলেছিল, ‘এপাতাঁ!’ জার্মানরা, ‘ক্লর্কে!’ ইতালিয়ানরা, ‘ব্রাভো!’ স্প্যানিশরা, ‘দেলিচজো!’ আরবরা, ‘ইয়া সালাম, ইয়া সালাম!’
শুকনো খাবারের মধ্যে আতপ চালের চিড়া, কোলি চূর্ণ, খৈ, হুড়ুম, মুড়কির কথা জানা যায়।
অতিথি ঘরের লক্ষ্মী। তাই অতিথি আপ্যায়ণে বাঙালীর জুড়ি ছিল না। মিষ্টান্নের সাথে কর্পূর মেশানো সুগন্ধি জল পরিবেশন করা হতো উচ্চবিত্তদের মধ্যে। আহারের পর মশলা পান, সুপারি খাওয়ার রীতিও ছিল। গ্রাম-বাংলায় হয়তো এখনো শোভা পায়, কিন্তু শহুরে লোকের কাছে এ বড় ‘খ্যাত’! ঐতিহ্যবাহী ঠান্ডা পানীয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে অস্বাস্থ্যকর সব কোকাকোলা, ফান্টা, মিরিন্ডা।
উনিশ-বিশ শতকে ‘রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতি’র ফলে মোগলাই-ইংরেজি খাবারের ধুম পড়ে। মোগলাই খাবারগুলো মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৭ সালে একটি ভোজের আয়োজনের বিবরণ পাওয়া যায় ‘বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি’ গ্রন্থ থেকে। সেখানে লেখক উল্লেখ করেন ১১৭ পদের রান্নার কথা; যেমন- কোর্মা, কাবাব, কোপ্তা, ফ্রাই, গ্রিল, কাটলেট, বেগুন ভাজা, লেমনেড ইত্যাদি। এছাড়াও সেসব খাবারের মধ্যে কেক, বিস্কুট, চপ, কাটলেট উল্লেখযোগ্য ছিল।
বাঙালির বিয়ের ভোজন
“আসুন-বসুন সবাই,
আজকে হলাম ধন্য
যৎসামান্য এই আয়োজনে
আপনাদেরই কাম্য
মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট
লুচি এবং মিষ্টি
খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি।”
বিয়ে সকল কালেই সকল যুগেই বিশাল আনন্দের ব্যাপার, আর খাওয়ার বিষয়ে তো কোনো আপোষ নেই। কিন্তু সেকালের বিয়ে আর এই সময়ের বিয়ের আয়োজনে আছে দারুণ পার্থক্য। আগের বিয়েতে নিজ বাড়ির উঠানেই যে যার সাধ্যমতো আয়োজন করতো বাড়ির ছেলে/মেয়ের বিয়ের। মিষ্টি, হালুয়া, নানান পদের আমিষ-নিরামিষ রান্না হতো। পরিবেশন করা হতো মাটির অথবা কাসা পিতলের থালাবাসনে বা অনেক ক্ষেত্রে কলাপাতাতেও। আসন হিসেবে থাকতো চাটাই পাতা। বিয়ে যেন এক উৎসব। যেমন সেকালের বনেদি পরিবারের বিয়ের ভোজের ছবি তুলে ধরেছেন লেখিকা শরৎকুমারী চৌধুরাণী-
“রান্না হইয়াছে পোলাও, কালিয়া, চপ, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়া ছোলার ডাল, রুইয়ের মুড়া দিয়ে মুগের ডাল, আলুর দম ও ছক্কা। মাছের চপ, চিংড়ির কাটলেট, ইলিশ ভাজা, বেগুনভাজা, শাকভাজা, পটলভাজে, দই, মাছ আর চাটনী। তারপর লুচি, কচুরি, পাঁপরভাজা। মিষতান্নের একখানি সরায় আম, কামরাঙা, তালশ্যাস ও বরফি সন্দেশ। ইহার উপর ক্ষীর, রাবড়ি, ও ছানার পায়েস।’’
একালের বিয়ের আয়োজনও হয় অনেক ধুমধামে, কিন্তু সেই জৌলুস দেখা যায় না। ছোট ছোট বাড়ি হওয়ার ফলে লাখো টাকা দিয়ে ভাড়া করতে হয় কমিউনিটি সেন্টার। সাথে আবার ফটোগ্রাফার। কাঁসার থালাবাসনে জায়গা করে নিয়েছে সিরামিক, কাচের বাসনকোসন। খাবারের আয়োজনে তো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। মেন্যুতে থাকে বুফে অথবা পোলাও-রোস্ট, খাসির কাবাব, সালাদ কখনো নান, মুরগির কাবাব, চপ, চাইনিজ ফুড ইত্যাদি। পানীয় হিসেবে বিয়েবাড়ির আয়োজনে থাকে বোরহানি। খাওয়ার শেষে পাওয়া যায় এক প্যাকেট মশলা পান। অনেক সময় আবার ক্ষীর বা পায়েসও পাওয়া যায়। আর কিছু কিছু পরিবার বিখ্যাত খাঁটি দই আনিয়ে পাতে দেয় অতিথিদের। এতে যেন খাওয়াটা পূর্ণতা পায়। কিন্তু খাওয়ার পরই ‘দে দৌড়’!
যে আন্তরিকতা, যে নির্মল আনন্দের উৎস ছিল পূর্বের বিয়ের অনুষ্ঠানে, তা এ যুগের বিয়েতে অতটা দেখা যায় না। তাও এসকল সামাজিকতা মন্দের ভালো!
বাঙালীর বর্ষবরণ এবং পান্তা-ইলিশ
বাংলা নতুন বছরকে বরণ করা এখন একটি সার্বজনীন উৎসবের সামিল। যে যার মতো বাঙালিয়ানাকে উদযাপনের যথাযাসধ্য চেষ্টা করে। সেই বাঙালিয়ানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এখন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘পান্তা-ইলিশ’ খাওয়ার রীতি। কিন্তু এর চর্চা প্রাচীন-মধ্য কোনো যুগেই দেখা যায়নি। মাছেভাতে বাঙালি প্রচলিত, কিন্তু বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ অবশ্য আহার্য, এটা কোথাও কখনোই প্রচলিত ছিল না। কেননা বৈশাখ একটি খরার মাস, যখন কোনো ফসল হতো না আর কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না। সুতরাং তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সেই সময়ে ইলিশ সস্তা হলেও বছরে ২-১ বারই ইলিশ খাওয়ার সুযোগ হতো সাধারণ বাঙালির। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতো। গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবই ছিল খুবই সাধারণ আর ছোট আকারে। কৃষাণী আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ও চাল ভিজিয়ে রাখতেন। সকালে কৃষক সেই চালপানি খেয়ে হালচাষ করতে যেত। দুপুরবেলায় কাজের ফাঁকে পান্তা খেতো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে আবার কখনো কখনো একটু শুঁটকি, বেগুন ভর্তা বা আলু ভর্তা দিয়ে। কবির ভাষায়-
“পান্তা ভাতে মরিচ-পেঁয়াজ
গরম ভাতে ভর্তা
সকাল বিকাল খেয়ে জবর
ঘুমায় গাঁয়ের কর্তা।”
এই পংক্তিগুলো থেকে বোঝা যায়, বাঙালির গরম ভাতের সাথে মরিচ-পেঁয়াজ আর ভর্তা খাওয়ার খাদ্যাভাসটি প্রকৃত অর্থে স্বাভাবিক এবং সহজলভ্য। এই লোকসংস্কৃতি প্রকাশিত হয়েছে কবিতার মাধ্যমে। কিন্তু পান্তা-ইলিশ নিয়ে না আছে কোনো শিল্প-সাহিত্য না এটি কোনো সংস্কৃতির অংশ।
বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ খাওয়াকে অনেকে উল্টো অপসংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু বছরের পর বছর এই রীতি চলে আসছে, তাই মানুষ অনুসরণ করে যাচ্ছে পান্তা-ইলিশ খাওয়াকে। পান্তা-ইলিশ খাওয়া আসলে কোনো বাঙালি ঐতিহ্য নয় বরং এই প্রথা আধুনিক যুগের মানুষ সৃষ্টি করেছে।
বাঙালি চিরকালই ভোজনরসিক। তাই সেকাল হোক কি একাল, সব যুগের খাবারেই পেট ভরে যায় তার। কিন্তু যে যা-ই বলুক ভাই, বাঙালির মন ভরাতে কিন্তু ভাত-মাছ-ভর্তা-ভাজির সাথে কোনো আপোষ নাই!