১৮১৫ সালের ওয়াটার লু’র যুদ্ধের কথা কে না জানে? এই যুদ্ধের নাম আসলেই মনে পড়ে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পরাজয়ের কথা। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর আর কখনো নেপোলিয়নকে যুদ্ধের ময়দানে দেখা যায়নি। পরাজয়ের পর তাকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়। সেখানেই ৫১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এই যুদ্ধটি দুই দিক থেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একদিকে, নেপোলিয়ন ১৮০৫ সালে একবার ইউরোপ দখল করতে গিয়ে ট্রাফালগার যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। তাই ওয়াটার লুর যুদ্ধ ছিল নেপোলিয়নের প্রতিশোধের সুযোগ। অন্যদিকে, ইউরোপের জন্য এবং ইংরেজদের জন্য এই যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তারা তাদের শাসনভার থেকে সরে যেতে চাইছিল না।
যুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাস দেখলে দেখা যায় এই যুদ্ধের পর কার্যত আর কোনো বড় যুদ্ধ ইউরোপে ঘটেনি। এ যুদ্ধে ইংরেজদের নেতৃত্ব দেওয়া ওয়েলিংটন নেপোলিয়নকে পরাজিত করার পর তার দেশে রীতিমতো রণনায়ক বনে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানকার প্রধানমন্ত্রীও হন।
তবে ওয়েলিংটনের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে যুদ্ধের পর তিনি শান্তির জন্য কাজ করে গেছেন। এমনকি ফ্রান্সের সাথেও শান্তির চুক্তি করেন তিনি। সেই তখন থেকে প্রায় দুশো বছর পর্যন্ত ইউরোপের মধ্যে সেই শান্তিবার্তা বজায় রাখা হয়েছে এবং ইউরোপীয়রা নিজেদের মধ্যে বড় কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। ওয়াটার লুর যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন থেকে ইউরোপের ভাগ্যের আকাশে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।
নেপোলিয়নের সেই যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পেছনে অনেক ইতিহাসবিদ অনেক ধরনের কারণ বের করেছেন। তপবে অনেকের কাছে অজ্ঞাত যে এই যুদ্ধের ফল নির্ধারণে আবহাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ইতিহাসবিদরা জানেন, ইংরেজ এবং প্রুশিয়ান- এই দুই মিত্রবাহিনীর জয়ের অনেকগুলো কারণের ভেতর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল বৃষ্টি এবং কাদামাটি। কর্দমাক্ত মাটির কারণে নেপোলিয়নের একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যার ফলে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়।
দীর্ঘদিন পর সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যুদ্ধের সময় হটাৎ সেই বৃষ্টির আগমন এমনি এমনি ঘটেনি। তার পেছনে একটি কারণ ছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেশ দূরে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়াতে সেই কারণ তৈরি হয়েছিল। কারণটি ছিল একটি আগ্নেয়গিরি। ১৮১৫ সালে ইন্দোনেশিয়াতে সংঘটিত সেই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে পুরো বায়ুমণ্ডল প্রভাবিত হয়। ফলে সারা বিশ্বের অনেক জায়গার আবহাওয়া পরিবর্তন দেখা দেয়।
১৮১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমবাওয়া দ্বীপের মাউন্ট তামবোরা থেকে তৈরি হয় এই অগ্ন্যুৎপাত। এর ফলে মারা যায় প্রায় ১ লক্ষ মানুষ। এই আগ্নেয় বিস্ফোরণের ফলে ১৮১৬ সালে গ্রীষ্মকাল ছাড়াই একটি বছর অতিবাহিত হয়েছিল। এজন্য এই সালকে বলা হয় A Year without a Summer (গ্রীষ্মকালবিহীন এক বছর)।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই মাস আগে এই অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে। বিজ্ঞানের দিক দিয়ে ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়- অগ্ন্যুৎপাতের পরপর নির্গত আগ্নেয় ছাই বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারকে বিদ্যুতায়িত করে ফেলে। ধারণা করা হচ্ছে যে প্রবল গতিতে নির্গত ছাইগুলো আগে থেকেই চার্জিত ছিল এবং বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে ছুটে গিয়ে সেখানেই মেঘ তৈরি করে ফেলেছিল। ঘটনার চক্রে সেগুলো ঝড়ে পড়ে নেপোলিয়ানের যুদ্ধক্ষেত্রের এলাকায়।
ইন্দোনেশিয়া থেকে যুদ্ধস্থলের দূরত্ব ৭ হাজার মাইলের মতো। এত দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাব পড়েছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল বায়ুমণ্ডলের অনেক উপরে মেঘ উৎপন্ন হওয়ার ফলে। যুদ্ধের দিনের আগের রাতের কথা খোদ নেপোলিয়নের প্রতিপক্ষ ওয়েলিংটনের কাছেই শোনা যাক। তিনি সেই রাত সম্পর্কে বলেছেন– তিনি মৌসুমীকালে ভারতে তার দেখা বৃষ্টির ধরণও এমন দেখেননি যেমনটি সেদিন রাতে দেখতে পেয়েছিলেন। রাতের সেই প্রচণ্ড বৃষ্টি পরিবেশকে ঠাণ্ডা, ভেজা এবং ভয়ংকর করে তুলেছিল।
কে জানতো পরের দিনই এখানে চরম তাণ্ডবলীলা শুরু হবে। এই বৃষ্টির কারণেই নেপোলিয়ন তার সৈন্যবাহিনীকে সামনে এগিয়ে ওয়েলিংটনকে আক্রমণের আদেশ দেননি। কারণ মাটি ছিল একদমই স্যাঁতস্যাঁতে যা সৈন্যদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুকূলে ছিল না। সেজন্য নেপোলিয়ন একটু দেরি করেছিলেন।
অন্যদিকে ওয়েলিংটন পরের দিনের যুদ্ধ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু জয় নির্ভর করছিল প্রুশিয়ান সৈন্যদের সাথে তাদের মিলিত হওয়ার উপর। যদি এমনটি হয় তাহলে যুদ্ধে জিতে যাওয়ার দিকে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু নেপোলিয়ন প্রুশিয়ানদের অন্যদিক দিয়ে আক্রমণ করে অনেকটাই কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। আবার এদিক থেকে ওয়েলিংটনদেরকেও নাস্তানাবুদ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে দুই দল এক হয়ে গেলে নেপোলিয়নের পক্ষে আর যুদ্ধে জেতা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
যুদ্ধের এমন ফলাফলের উপর আগের দিনের বৃষ্টি বেশ প্রভাব ফেলেছিল। কারণ বৃষ্টির কারণে নেপোলিয়ন যদি তার সৈন্যদেরকে অপেক্ষা না করাতেন তাহলে হয়তো প্রুশিয়ানরা এই সময়ের মধ্যে এগিয়ে আসতে পারতো না এবং ওয়েলিংটনও তার নিজের মতো রণনীতি তৈরি করার সময় পেতো না। যদি এরকমটি হতো তাহলে হয়তো ইউরোপের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। নেপোলিয়নের যেরকম বিশ্ব জয়ের ইচ্ছা ছিল তাতে হয়তো আরো অনেক যুদ্ধের সাক্ষী হতো পৃথিবীর মানুষ।
এতদিন পর্যন্ত ইতিহাসবিদরা শুধু এই বৃষ্টিপাতের কথাই জানতো। কিন্তু এর পেছনে যে একটি আগ্নেয়গিরি আছে, যা প্রায় ৭ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত, সেটা জানা গেছে মাত্র কিছুদিন আগে। ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের গবেষক ম্যাথিউ গ্যাঙে ‘জিওলজি’ সাময়িকীতে এই ব্যাপারে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেছেন। শিরোনাম Electrostatic levitation of volcanic ash into the ionosphere and its abrupt effect on climate। এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কেন আগ্নেয়গিরি থেকে ছাইগুলো এত উপরে উঠে মেঘের উৎপত্তি করে, কেন ছাইগুলো নিজেরা বৈদ্যুতিক চার্জে চার্জিত হয়, কীভাবে এটা বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারে শর্ট-সার্কিট তৈরি করে, কীভাবে প্রকৃতির এমন আচরণ আবহাওয়াকে পরিবর্তন করে ফেলে ইত্যাদি।
একটা প্রশ্ন এসে যায়। ১৮১৫ সাল, এত আগের তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার কাজটি সহজ নয়। এই গবেষণায় সেটা সম্ভবও হয়নি। তারা আগ্নেয়গিরির এই ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়েছেন ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার আরেকটি অগ্ন্যুৎপাতের উপাত্ত থেকে। তখনো ১৮১৫ সালের মতোই অবস্থা হয়েছিল। আবার আয়নোস্ফিয়ারের উপর যে বৈদ্যুতিক চার্জে চার্জিত ছাই-এর প্রভাব, পরে সেটা ১৯৯৯ সালে ফিলিপাইনে সংগঠিত আরেকটি অগ্ন্যুৎপাত থেকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।
এই গবেষণার ফলে অনেকটাই পরিষ্কার যে কেন সেই রাতে এত বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তবে এখানে আরো কিছু প্রমাণমূলক কাজ করার প্রয়োজন আছে। এমন ফলাফল পাওয়া খুবই আশ্চর্যজনক। তবুও বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটি নিয়ে আরো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন।
ফিচার ছবি- quebeccultureblog.com