১৯৫১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। এদিনই ক্যামব্রিজের নিউমার্কেট রোড সিমেট্রিতে ইম্যান্যুয়েল কলেজের শিক্ষক এডওয়ার্ড ওয়েলবোর্ন নিজ উদ্যোগে সমাধিস্থ করেছিলেন তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্রকে। সেই ছাত্র অবশ্য মারা গিয়েছিলেন আরো দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে, ৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এতদিন লোকবল ও টাকাপয়সার অভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছিল না তার শেষকৃত্য। শেষ পর্যন্ত ওই ওয়েলবোর্নের প্রভাবেই তাঁর প্রাক্তন কলেজ যুগিয়েছিল ছাত্রের শেষকৃত্যের খরচ। ইতিপূর্বে তাঁর চিকিৎসার খরচও জোগাড় করে এনে দিয়েছিলেন ওয়েলবোর্নই।
কিন্তু তাঁর জীবনের শেষটা হয়তো এভাবে ধুঁকে ধুঁকে, পরানুগ্রহে হওয়ার কথা ছিল না। কারণ যে মানুষটির কথা বলছি, তিনি চৌধুরী রহমত আলী। পাকিস্তান সৃষ্টিতে অবদান রাখায় তাঁরই আরেক স্বদেশী এবং বছর দুই আগে গত হওয়া মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজ দেশে যে বিপুল শ্রদ্ধা ও সম্মান লাভ করেছিলেন, তার কিয়দংশের দাবিদার ছিলেন তিনিও। কেননা মৃত্যুর ১৮ বছর আগে তিনিই প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন পাকিস্তান ধারণার, এমনকি পাকিস্তান নামটিও তো তাঁরই দেওয়া।
১৯৩৩ সালে রহমত আলী প্রকাশ করেছিলেন একটি পুস্তিকা, যার শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন “Now or Never: Are we to live or perish for ever?” এর সাথে একটি চিঠিও সংযুক্ত করেছিলেন তিনি, যেখানে লিখেছিলেন:
৩, হামবারস্টোন রোড,
ক্যামব্রিজ, ইংল্যান্ড।
২৮ জানুয়ারি ১৯৩৩প্রিয় জনাব/জনাবা,
আমি আবেদন করছি ভারতের পাঁচটি উত্তরাঞ্চলীয় প্রশাসনিক একক – পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত (আফগান) প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে বসবাসকারী ‘পাকস্তান’-এর ৩০ মিলিয়ন মুসলিমের পক্ষ থেকে। এই আবেদনে রয়েছে তাদেরকে একটি পৃথক জাতি হিসেবে মর্যাদা দেয়ার দাবি, যা ভারতের অন্যান্য অধিবাসীদের থেকে স্বতন্ত্র; পাশাপাশি ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে পাকস্তানের জন্য একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুমোদন করারও দাবি।
হিন্দু-মুসলিম যে বিরাট সমস্যা সেটির সমাধানকল্পে আমাদের প্রস্তাবিত সমাধান সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাকে জানালে আমি খুব খুশি হব। আমার বিশ্বাস, যেহেতু আপনারাও এই জটিল সমস্যার একটা ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী সমাধানে আগ্রহী, সেহেতু এই আবেদনে যে লক্ষ্যগুলি বর্ণিত হয়েছে সেগুলির প্রতি আপনাদের পূর্ণ সম্মতি ও সক্রিয় সমর্থন থাকবে।
আপনার একান্ত, রহমত আলি (চৌধুরী)। (প্রতিষ্ঠাতা, পাকস্তান জাতীয় আন্দোলন)
এভাবেই নিজেকে পাকস্তান জাতীয় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা দাবি করে, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত (আফগান) প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সহযোগে মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি পেশ করেছিলেন আলী, যেটির প্রাথমিক নাম তিনি দিয়েছিলেন পাকস্তান।
ইংরেজিতে Pakstan শব্দটির মাধ্যমে তিনি তাঁর উল্লিখিত পাঁচটি অঞ্চলকে নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন। পাঞ্জাবের P, আফগান প্রদেশের A, কাশ্মীরের K, সিন্ধুর S, এবং বেলুচিস্তানের tan নিয়ে তৈরি হয়েছিল Pakstan. অবশ্য পাকস্তান উচ্চারণ কঠিন বলে, ১৯৩৩ সাল শেষের পূর্বেই মাঝে ‘ই’ যোগ করে সৃষ্ট ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় (অনেকটা আফগান-ই-স্তান বা আফগানিস্তানের মতো), এবং আলীও সেটিকেই মেনে নেন।
তিনি তাঁর পরবর্তী একটি বইয়ে পাকিস্তান শব্দটির ব্যাখ্যা আরো বিশদে বিবৃত করেন:
“পাকিস্তান একই সাথে ফার্সি ও উর্দু শব্দ। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের আবাসভূমিগুলোর নাম, যথা পাঞ্জাব, আফগানিয়া, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বালুচিস্তান থেকে গঠিত হয়েছে। এর অর্থ পাকদের ভূমি – যারা আত্মিকভাবে পবিত্র ও বিশুদ্ধ।”
সুতরাং, পরিষ্কারভাবেই আলীর এ দাবিতে যে পাকিস্তানের কথা বলা হয়েছিল, সেখানে উল্লেখ ছিল না মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার কথা, যা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর প্রথমে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তরিত হয়েছিল, এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে রয়েছে।
তবে ভারতের অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর জন্যও পৃথক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন আলী দেখেছিলেন। যেমন বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের জন্য তিনি প্রস্তাব করেছিলেন ‘বঙ্গিস্তান’ নামটি, এবং দক্ষিণ ভারতের নিজাম-শাসিত অঞ্চলের মুসলিমদের জন্য ‘ওসমানিস্তান’।
এছাড়া মুসলিমদের জন্য তাঁর প্রস্তাবিত আরো ছোট ছোট বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ছিল হায়দারিস্তান, সিদ্দিকিস্তান, ফারুকিস্তান, মুইনিস্তান, মাপলিস্তান, সাফিস্তান, নাসারিস্তান (শেষ দুইটি শ্রীলঙ্কার অন্তর্ভুক্ত) ইত্যাদি।
তাঁর হাত থেকে বাদ পড়েনি এ অঞ্চলের সাগরগুলোও। বঙ্গোপসাগরের সম্ভাব্য নতুন নাম তিনি দিয়েছিলেন বঙ্গিয়ান সাগর, পাকিস্তানি উপকূলে আরব সাগরের নাম পাকিয়ান সাগর, আর লক্ষদ্বীপ সাগরের নাম সাফিয়ান সাগর।
আর বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নাম তিনি দিতে চেয়েছিলেন ‘পাকাশিয়া’ (Pakasia) বা ‘দিনিয়া’ (Dinia). খেয়াল করে দেখুন, দ্বিতীয় শব্দটি India শব্দের অক্ষরগুলোকে নতুন করে সাজিয়ে সৃষ্ট। এছাড়া শব্দটি ধর্মের আরব্য ধারণা দ্বীন হতেও অনুপ্রাণিত।
যখন “Now or Never” প্রকাশিত হয়, আলীর বয়স ৩৬ বছর। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে, ভারতের পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুর জেলার অন্তর্গত বালাচৌর শহরে একটি মুসলিম গুরজার পরিবারে। ১৯১৮ সালে লাহোরের ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি একই শহরের আইচসন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য। আইন বিষয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তিনি এক বেলুচি জমিদারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। এর মাধ্যমে বেশ ভালোই অর্থোপার্জন করতে শুরু করেন তিনি, এবং টাকা জমিয়ে ১৯৩০ সালে চলে যান ইংল্যান্ডে, ভর্তি হন ক্যামব্রিজের ইম্যান্যুয়েল কলেজে। এই কলেজ থেকেই ১৯৩৩ সালে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন, এবং ১৯৪০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন এমএ ডিগ্রি। ১৯৪৩ সালে লন্ডনের মিডল টেম্পল বার থেকেও ডাক পান তিনি।
তবে এই সবকিছুকে ছাপিয়ে, ইতিহাসে আলী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অবশ্যই পাকিস্তান ধারণার উদ্ভবের কারণে। এই ধারণাটি কবে কোথায় বসে প্রথম তাঁর মাথায় এসেছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেউ কেউ বলেন তিনি নাকি কোনো এক লন্ডন বাসের দোতলায় যাত্রা করতে করতে প্রথম পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আবার কারো কারো মতে টেমস নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তাটি খেলে গিয়েছিল তাঁর মাথায়। তবে সেই চিন্তাটিকে যে তিনি প্রথম বাস্তবে রূপ দেন ১৯৩৩ সালের ২৮ জানুয়ারি, ৩, হামবারস্টোন রোডে, তা তো তাঁর লেখা চিঠির ঠিকানা ও তারিখ থেকেই বোঝা যায়।
আলী যখন পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছিলেন, তখন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান প্রণয়নের কথাবার্তা চলছিল (যার সূত্র ধরে ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়, যেখানে ভারতীয়দেরকে স্বায়ত্তশাসনের সীমিত সুযোগ দেয়া হয়)। আলী ভয় পাচ্ছিলেন, এই শাসনের মাধ্যমে মুসলিমদের অধিকার খর্ব হবে। যেহেতু ভারতবর্ষে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, ‘দশজনে একজন’, তাই এমন সংবিধানের ফলে মুসলিমদেরকে হিন্দু নেতৃত্বের আওতায় চলে যেতে হবে, যা কখনোই তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
আলীর যুক্তি ছিল, রাশিয়াকে বাদ দিলে বাকি ইউরোপও তো প্রায় ভারতেরই সমান আকৃতির, কিন্তু সেটি বিভক্ত ২৬টি পৃথক জাতিরাষ্ট্রে। তাহলে ভারতের সব জাতিকেই কেন এক রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হবে? এছাড়া তিনি আরো বলেছিলেন, প্রার্থনা, খাদ্য, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আরো অনেক ব্যাপারেই হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে, যে কারণে একটি পৃথক ‘পাকিস্তান’-এর দাবি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। তাঁর দাবি ছিল, পাকিস্তানকে পৃথক করে দিলেও হিন্দু আর মুসলিমরা আগের মতোই একত্রে, শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে পারবে, শুধু দুই ধর্মের মানুষের শাসনের নাটাই থাকবে নিজেদের হাতে।
১৯৩৪ সালে আলী জিন্নাহর সাথে দেখাও করেছিলেন, এবং তাঁর ধারণাটি জিন্নাহর সামনে তুলে ধরেছিলেন। সব শুনে জিন্নাহ আলীকে বলেছিলেন,
“দেখো বাছা, এত তাড়াহুড়া করো না। পানিকে নিজের মতোই বইতে দাও। একসময় সে তার নিজের উচ্চতা খুঁজে নেবে।”
জানিয়ে রাখা ভালো, ১৯৩০ সাল থেকে ইংল্যান্ডে থাকার পর, সেই সময়ে জিন্নাহ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভারতে প্রত্যাবর্তনের। পূর্বের চার বছর তিনি রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে সরে ছিলেন, এবং ইংল্যান্ডে আইন পেশায় বেশ উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছিলেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি গান্ধীর কংগ্রেস যে গণ-রাজনীতির চর্চা করত, সেটির বিরোধিতাও করতে শুরু করেছিলেন।
ঐ সময়টায় মুসলিম লিগ ছিল অনেকটাই মুমূর্ষু একটি দল। ১৯২৯ সালে মুসলিম লিগের একটি সভায় জিন্নাহর ১৪ দফা প্রস্তাবটি (১৯২৮ সালের মতিলাল নেহেরুর প্রতিবেদনে একটি ভারতীয় সাম্রাজ্যের প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে) তিক্ত মতবিরোধে রূপ নেওয়ার পর থেকেই, জিন্নাহ নিজেকে মুসলিম লিগের থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
অবশ্য ঐ সময়ে (১৯৩৪ সালে), লিয়াকত আলি খানের (পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী) পীড়াপীড়িতে জিন্নাহ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মূলধারার মুসলিম রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় প্রত্যাবর্তনের। এমন পরিস্থিতিতে জিন্নাহ যে আলীর ধারণাটিকে অবাস্তব কল্পনা হিসেবে উড়িয়ে দেবেন, তা আর অস্বাভাবিক কী!
কিন্তু তখন আলীও হয়ে উঠেছিলেন অদম্য। জিন্নাহর অনাগ্রহে এতটুকুও ভাটা পড়েনি তাঁর উৎসাহে, বরং ১৯৩৫ সালে তিনি প্রকাশ করেন নতুন আরেকটি বই Pakistan: The Fatherland of Pak Nation. এ বইয়ে তিনি আরো বিস্তারিত আঙ্গিকে পাকিস্তান ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করেন।
একাধারে তিনি পাকিস্তানের একটি সুস্পষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা দাঁড় করান, পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন, বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সাদৃশ্য চিহ্নিত করেন, পাকিস্তান জাতির বিভিন্ন প্রতীক ও পবিত্র স্থান নির্দেশ করেন, একটি জাতীয় পতাকার কথা বলেন, এবং একটি জাতীয় ভাষারও উল্লেখ করেন।
মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, “…পাক, যেটি পুরনো প্রজন্মের কাছে পরিচিত উর্দু হিসেবে।” অর্থাৎ পরবর্তীতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর যে উর্দু ভাষাকে জিন্নাহ গোটা পাকিস্তানের জনগণের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, আলী সেই উর্দু ভাষার নামই পালটে দিতে চেয়েছিলেন!
আলীর বইটির কিছু অংশ ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ — যেমন তিনি দাবি করেছিলেন একটি ‘পাক সাম্রাজ্য’-র উপস্থিতি নাকি ছিল সেই সুদূর অতীত থেকেই, এবং তিনি তাঁর বইতে জনগণকে ‘পাক’ হিসেবেও অভিহিত করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর কিছু ধারণা ছিল আদর্শবাদী — যেমন, ইসলামকে তিনি গণ্য করেছিলেন পাকিস্তানের মানুষের সবচেয়ে বড় ঐক্যের জায়গা হিসেবে, যেটি পেছনে ফেলবে জাতিগত পরিচিতির আর সকল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তথা অঞ্চল, বর্ণ, শ্রেণী ও ভাষাকে।
আলী আরো জানিয়েছিলেন যে তাঁর এই মুসলিম-অমুসলিম আপেক্ষিক সহাবস্থানের ধারণা পশ্চিমা ধারার যুক্তরাষ্ট্র থেকে গৃহীত নয়, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রই সম্পূর্ণ স্বাধীন। বরং তিনি এটিকে দেখেছিলেন মুসলিম মিল্লাত ব্যবস্থার আয়নায়, যেখানে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সম্প্রদায়ের থাকবে নিজস্ব বৈধ আইন ও স্বায়ত্তশাসন (যেমন মুসলিমদের জন্য শরিয়া আদালত, এবং অনুরূপ ব্যবস্থা হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ এবং অন্যদের জন্য)।
এদিকে ভারতীয় রাজনীতি তখন একটি নতুন মোড় নিচ্ছে, যার সাথে আলীর একমত হওয়ার সুদূরতম সম্ভাবনাও ছিল না। ১৯৩৭ সালে জিন্নাহ কংগ্রেসের সাথে বিবাদভঞ্জনের যাবতীয় আশা ছেড়ে দেন, এবং খুব দৃশ্যমানভাবেই একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ শুরু করেন। অবশ্য সেটি যে বাস্তবেই সম্ভব, তিনি নিজেও তা অনুধাবন করেছিলেন অনেক পরে। তবে পরিষ্কারভাবেই আলীর ধারণাকে পাশ কাটিয়ে জিন্নাহ প্রভাবিত হতে শুরু করেছিলেন স্যার মুহাম্মদ ইকবালের দ্বারা, যিনি প্রথম এক যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে থেকেই পৃথক সত্তা রক্ষার ধারণাটির প্রবর্তন করেছিলেন।
১৯৪০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জিন্নাহ ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোকে জানান যে মুসলিম লিগ যুক্তরাষ্ট্রের বদলে পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষপাতী। এভাবে লাহোর প্রস্তাবে দ্বিজাতি তত্ত্বকে গ্রহণ করা হয়েছিল। এতে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বের প্রদেশগুলোর জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের প্রস্তাব করা হয় এবং অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য সুরক্ষার কথাও বলা হয়।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লিগের অধিবেশনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আর ১৯৪৩ সাল থেকে জিন্নাহ প্রকাশ্যে আলী প্রণীত ‘পাকিস্তান’ শব্দটি প্রয়োগ করতে শুরু করেন।
অবশেষে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান বাস্তবে পরিণত হয়। কিন্তু আলী পুরোটা সময়ই অবস্থান করছিলেন ইংল্যান্ডে। পাকিস্তান সৃষ্টিতে তাঁর অবদান সীমাবদ্ধ ছিল কেবল পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রচারেই। নানা ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে যখন পাকিস্তান নামে পৃথক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হলো, সেটি কোনোভাবেই সন্তোষজনক ছিল না।
আলী (কিংবা জিন্নাহ) যা আশা করেছিলেন, তার সাথে এই পাকিস্তান রাষ্ট্রের নানা দিক থেকেই অমিল ছিল। এমনকি আকৃতিগত দিক থেকেও এই পাকিস্তান ছিল অনেক ছোট। তবে তারপরও, জিন্নাহ ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ প্রবাদে বিশ্বাসী হয়ে, যা পেয়েছেন সেটির পেছনেই নিজের অবদানকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে থাকেন, আর পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ তাঁকে মানতে শুরু করে বাবা-এ-কওম বা জাতির পিতা হিসেবে।
কিন্তু আলী কখনোই সন্তুষ্ট হতে পারেননি তাঁর স্বপ্নদৃষ্ট পাকিস্তানের বাস্তব রূপ দেখে। তিনি শুরু থেকেই এর কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন। অবশেষে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে তিনি প্রথম নব্যসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে পা রাখেন। কিন্তু সেই পাকিস্তানে তিনি না পান কোনো বিশেষ অভ্যর্থনা, না দেশের মানুষ তাঁকে দেয় বিশেষ কোনো সম্মাননা। জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। এছাড়া পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য মাঠ পর্যায়ে যুদ্ধ করা অন্যরাও তখন অধিষ্ঠিত ক্ষমতার উচ্চাসনে। শুধু আলীই পান না কোনো পদ। কেননা তাঁর উপস্থিতি পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয়দের কাছে নিছকই এক উপদ্রব বৈ আর কিছু ছিল না।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন জিন্নাহ। আর তার এক মাসের মাথায় জিন্নাহর উত্তরসূরি লিয়াকত আলী খান আলীকে নির্দেশ দেন দেশ ত্যাগের। এছাড়া তাঁর সঙ্গের সব জিনিস করা হয় বাজেয়াপ্ত। ইতিমধ্যেই দেশভাগের পর ভারতীয় পাঞ্জাবে যত যা পৈতৃক জমিজমা ও সহায়-সম্পত্তি ছিল, সবই হারিয়েছিলেন আলী। ফলে পাকিস্তানে ফিরে এমনিতেও তাঁর ছিল না স্থায়ী উপার্জনের কোনো পথ। এর মাঝে হুট করে পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ আলীর জন্য ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটি বিষয়।
একদম কপর্দকশূন্য অবস্থায়ই আলীকে ফিরে যেতে হয় ইংল্যান্ডে। সেখানে প্রবল দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে, একাকী জীবনযাপন করে যেতে হয় তাঁকে। ১৯৫৩ সালের দিকে ইংল্যান্ডে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী রূপ ধারণ করলে, তাতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আলী। কিন্তু শুধু এটুকুতে হয়তো পুরোপুরি ফুটে উঠবে না তাঁর শেষ জীবনের দুর্দশার সামগ্রিক চিত্র। তিনি যে মারা গিয়েছেন, সেটিও আবিষ্কৃত হয়েছিল মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন পর। এর আগ পর্যন্ত একটি বদ্ধ ঘরে মৃত আলীর লাশ অনুদ্ঘাটিত অবস্থায়ই পড়ে ছিল।
প্রাথমিকভাবে ইম্যান্যুয়েল কলেজের অর্থায়নে আলীকে সমাধিস্থ করা হলেও, পরবর্তীতে সেই অর্থ পরিশোধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। হয়তো তাদের আধ্যাত্মিক পিতার প্রতি সম্মানার্থে, কিংবা আলীর কাছে তাদের যে ঋণ তার কিছুটা অন্তত শোধ করতে। তবে এখনো ইংল্যান্ডের মাটিতেই শায়িত আছেন তিনি। জীবদ্দশার মতো, মৃত্যুর পরও নিজের ‘স্বপ্নের পাকিস্তান’ ঠাঁই দেয়নি তাঁকে। এমনকি প্রয়োজনবোধ করেনি তাঁর স্মৃতিকে সংরক্ষণেরও। তাই তো আজকের দিনে এসে নানাভাবে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয় তাঁর প্রণয়ন করা পাকিস্তানের ধারণাকে। এমনকি না জেনে-বুঝে ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অধীনে রাখার জন্যও অনেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল আলীর প্রণীত ধারণাকেই। অথচ এর থেকে হাস্যকর আর কিছুই হতে পারে না।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
পাকিস্তান সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ