১৮৫৪ সালে ২৫ অক্টোবর ক্রিমিয়ান যুদ্ধ চলাকালে বালাক্লাভা রণক্ষেত্রে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং তুরস্কের মিত্রবাহিনীর এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে যা ব্যাটল অব বালাক্লাভা হিসেবে পরিচিতি পায়। এই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অসমসাহসী কয়েকজন যোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ কাহিনী। তার সাথে ব্রিটিশ সমর ইতিহাসে এক বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তের ফলে লাইট ব্রিগেডের করুণ পরিণতির গল্পও ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
যুদ্ধের পটভূমি
১৮৫৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং তুরস্কের সেনাদল নিয়ে গঠিত মিত্রশক্তি রাশিয়ার নৌশক্তিকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য সেভাস্তোপোল নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রধান প্রিন্স আলেক্সান্ডার মেনশিকভ আলমা নদীর ধারে মিত্রবাহিনীকে আটকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিত্রবাহিনীর বিশাল ফৌজের সামনে রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী পেরে উঠতে পারেনি। ফলে ২০ সেপ্টেম্বরের আলমা রণক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীর কাছে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর পরাজয় ঘটে।
দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রাশিয়ান সৈন্যবাহিনী বালাক্লাভা অঞ্চলের উপত্যকাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ লর্ড রাগ্লান মিত্রবাহিনীর সাহায্যে লক্ষ্যহীন রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফরাসি সেনাধ্যক্ষ মার্শাল জ্যাকস সেন্ট আরনাউড আরও সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন।
এই সময় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক গোপন তথ্যে জানা যায়, রাশিয়ান বাহিনী সেভাস্তোপোলের উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ দিকে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তাই মিত্রবাহিনী সেভাস্তোপোলের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনাধ্যক্ষ একমত হন যে, দক্ষিণের শহরগুলো দখলের চেয়ে অবরোধ করাই শ্রেয় হবে।
ফলে ফরাসি বাহিনী কেমিয়েশ অঞ্চলের পশ্চিম উপকূল এবং ব্রিটিশ বাহিনী দক্ষিণের বালাক্লাভা অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। কিন্তু রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রধান প্রিন্স আলেক্সান্ডার মেনশিকভ রাশিয়ান সৈন্যদলকে পুনরায় একত্র করতে শুরু করেন। তিনি তার বাহিনীকে ব্রিটিশ লাইন অতিক্রম করার নির্দেশ দেন। মেনশিকভ ধারণা করেন যে, ব্রিটিশ লাইন অতিক্রম করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি দখল করে নিতে পারলেই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব।
বালাক্লাভা যুদ্ধের শুরু
দিনটা ছিল ১৮৬৪ সালে ১৮ অক্টোবর। রাশিয়ান কমান্ডার জেনারেল পাভেল লিপ্রান্দি ২৫০০০ সৈন্য নিয়ে বালাক্লাভার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার বাহিনী তুর্কি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সেভাস্তোপোলের পূর্ব প্রান্ত জয় করে নেয়। রাশিয়ান বাহিনী দ্রুত উত্তরে বালাক্লাভা অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং সেভাস্তোপোলের মধ্যকার সীমানা অধিকারের জন্য আক্রমণ চালাতে শুরু করে। ২৫ অক্টোবর ভোরবেলা রুশ সেনাদের এক ঝটিকা-আক্রমণের মুখে পড়ে ব্রিটিশ ও তুর্কি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
সাঁপো পাহাড় থেকে বালাক্লাভা রণক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে ব্রিটিশ ও তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত হতে দেখে ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ লর্ড রাগ্লান দ্রুত তার প্রথম ও চতুর্থ ডিভিসনকে সেভাস্তোপোলের সীমানা থেকে সরে এসে উত্তরের বালাক্লাভা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নির্দেশ দেন।
এদিকে, রুশ বাহিনীর সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে কমান্ডার জেনারেল পাভেল লিপ্রান্দি লেফটেন্যান্ট জেনারেল রিজভসকে তার অশ্ববাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। রিজভস ২০০০ থেকে ৩০০০ সৈন্যের একটি দল নিয়ে উত্তরের উপত্যকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি দেখতে পান তার সৈন্যবাহিনীকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে মিত্রবাহিনীর ৯৩তম হাইল্যান্ডের এক বিশাল বাহিনী এবং কাদিকোই গ্রামে অবস্থান নেয়া ৪০০ জনের তুর্কিবাহিনীকে পরাস্ত করতে হবে।
রিজভস তার বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিন্তু রিজভসের বাহিনী হাইল্যান্ড বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। হাইল্যান্ড বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেমস স্কারলেটের বিশাল অশ্ববাহিনীও এসে যোগ দেয়। ব্রিটিশ বাহিনীর এই মিলিত আক্রমণে রিজভস ও তার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে এই পিছু হটে যাওয়ার সময়ও রাশিয়ান বাহিনী ব্রিটিশ অশ্বারোহী বাহিনীর বেশ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হয় এবং এই সময় বেশ কিছু অস্ত্রও তারা দখল করতে সক্ষম হয়।
ব্রিটিশ সেনাধ্যাক্ষ লর্ড রাগ্লান পিছু হটা এই রুশ বাহিনী ব্রিটিশ লাইট ব্রিগেডের অবস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে বলে অনুমান করেন। এদিকে জেনারেল কার্ডিগানের লঘু অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত সৈন্যদল (লাইট ব্রিগেড) একেবারেই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে।
লাইট ব্রিগেডের আক্রমণ
তখন লর্ড রাগ্লান ঠিক করলেন, এই পিছিয়ে যাওয়া রুশ বাহিনীকে আক্রমণ করতে হবে এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া অস্ত্রভাণ্ডার পুনরায় দখল করতে হবে। এজন্য তিনি লাইট ব্রিগেডকে রুশ বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য সহকারী ক্যাপ্টেন নোলানের মাধ্যমে জেনারেল লুকানের কাছে খবর পাঠালেন। জেনারেল লুকান লাইট ব্রিগেড অশ্বারোহী বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং পদমর্যাদায় লাইট ব্রিগেডের প্রধান জেনারেল কার্ডিগানের চেয়েও উচ্চপদাভিষিক্ত। তাই, জেনারেল লুকান কার্ডিগানকে জানালেন যে আদেশ দেয়া হয়েছে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এবং শত্রুরা যেসব অস্ত্র নিয়ে গেছে, তা উদ্ধার করার। ক্যাপ্টেন নোলান জেনারেল লুকানকে লর্ড রাগ্লানের যে নির্দেশটি পাঠানোর কথা ছিল, তাতে রুশ বাহিনীকে আক্রমণের কথা ছিল। কিন্তু নোলান যে নিদের্শটি লুকানকে জানিয়েছিলেন, তাতে ছিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
ফলে লুকান সঠিক আদেশটি পেলেন না। রাগ্লান যেসব বন্দুকের কথা বলেছিলেন, সেগুলোও তিনি দেখতে পেলেন না। তিনি ভাবলেন, রাগ্লান হয়তো উপত্যকার শেষে, লাইট ব্রিগেডের পূর্ব দিকের রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর কামানগুলোকে নির্দেশ করেছেন। আসলে, এই উপত্যকার দু’দিকেই রুশ সেনারা, উপত্যকার শেষেও দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দল গোলন্দাজ বাহিনী।
ক্যাপ্টেন নোলান ব্যক্তিগতভাবে লুকানের বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাই লুকান একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। সমস্ত অবস্থানটা ভাল করে দেখে লুকান মন্তব্য করলেন, “এটা শুধু মূর্খতাই নয়, আত্মহত্যাও বটে।” কিন্তু নোলান লুকানের কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি বারবার জানাতে লাগলেন, যে আদেশ প্রদান করা হয়েছে তা যেন পালন করা হয়। নোলান ক্রুদ্ধভাবে বারবার আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে গেলেন, সুস্পষ্টভাবে কিছু ব্যাখ্যা করলেন না।
লুকান কার্ডিগানের কাছে গেলেন এবং তাকে আক্রমণের আদেশ দিলেন। কার্ডিগান খুব একটা দক্ষ যুদ্ধবাজ সেনানায়ক কখনও ছিলেন না, তবু তার কাছেও আদেশটা অদ্ভুত বলে মনে হলো। তিনি লুকানকে বুঝাতে লাগলেন যে, আমাদের সৈন্যদেরকে রাইফেল ও বন্দুকধারী একদল হায়েনার মুখে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। লুকান কার্ডিগানের কথায় একমত হলেও লুকান উত্তর দিলেন, “জানি, কিন্তু এটা স্বয়ং সেনাপতির আদেশ। আর ব্যাখ্যার দরকার নেই।”
কার্ডিগান লাইট ব্রিগেডকে সামনে এগোনোর আদেশ দিলেন। মুহূর্তে নোলান বুঝলেন, তার দেয়া তথ্যে কিছুটা ভুল ছিল, যার কারণে গোটা আক্রমণ ভুল দিকে পরিচালিত হতে যাচ্ছে। তিনি হাত নেড়ে সঠিক দিক বোঝানোর চেষ্টা করতে গেলেন, কিন্তু তার আগেই আচমকা একটা কামানের গোলায় তার মৃত্যু হলো। নোলানের পক্ষে তার ভুল আর শোধরানোর সুযোগ রইলো না।
উপত্যকার তিনদিক থেকে ভেসে আসছে কামানের গোলা ও রাইফেলের বুলেটের ঝাঁক, তার মধ্যেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে লাইট ব্রিগেড। তাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব, তাই দিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেসব বন্দুকের কথা আদেশে বলা হয়নি, তারা তারই মোকাবেলা করতে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে এক বিশাল রুশ অশ্বারোহী সেনাবাহিনী। আর এগোনো সম্ভব নয়। কার্ডিগান তার সেনাদলকে পিছু হটার আদেশ দিলেন।
যুদ্ধ করতে করতে লাইট ব্রিগেড ফিরে এলো তার নিজের জায়গায়। বালাক্লাভা রণক্ষেত্রে ৬৭৩ জন লাইট ব্রিগেডের সৈন্যের মধ্যে শত্রুপক্ষের হাতে ২৬০ জনের মতো কম-বেশি আহত এবং মৃত্যুবরণ করেন। ৪৭৫টির মতো ঘোড়া এই যুদ্ধে মারা পড়ে। বিভিন্ন ডিভিশনের ৬১৫ জনের মতো ব্রিটিশ সৈন্য মারা যায়। প্রায় একই রকম হতাহতের ঘটনা ঘটে রুশ বাহিনীতেও। শুধুমাত্র মৃত্যুর সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়া এই আক্রমণে আর কোনো লাভ হয়নি। জেনারেল কার্ডিগান সেই রাত্রেই তার নিজস্ব নৌকোয় করে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যান।
শুধুমাত্র ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষের পাঠানোর সঠিক তথ্য যথাযথভাবে না পৌঁছার কারণে লাইট ব্রিগেডের করুণ পরাজয় ঘটলো। তবে এই যুদ্ধে লাইট ব্রিগেডের সৈন্যরা যে অসম সাহসী ভূমিকা রেখেছিল, তা আজও ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। আর এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে অমর করে রেখেছেন লর্ড টেনিসন তার ‘দ্য চার্জ অব দ্য লাইট ব্রিগেড’ কবিতায়।
Half a league, half a league,
Half a league onward,
All in the valley of Death
Rode the six hundred.
“Forward, the Light Brigade!
Charge for the guns!” he said.
Into the valley of Death
Rode the six hundred.
“Forward, the Light Brigade!”
Was there a man dismayed?
Not though the soldier knew
Someone had blundered.
Theirs not to make reply,
Theirs not to reason why,
Theirs but to do and die.
Into the valley of Death
Rode the six hundred.
[The Charge of the Light Brigade- ALFRED, LORD TENNYSON]
ফিচার ইমেজ- nam.ac.uk