শুরুর কথা
প্যারাস্যুটে করে ওরা যখন নেমে এলো, তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় দশটা ছুঁয়েছে ।
ওরা বলতে দু’জন। দু’জন চেক মুক্তিযোদ্ধা, জ্যান কুবিস আর জোসেফ গ্যাবচিক। দুঃসাহসিক এক পরিকল্পনা নিয়ে চেকোস্লোভাকিয়ায় নেমেছে ওরা, হত্যা করবে হিটলারের থার্ড ইন কমান্ড রেইনহার্ড হেড্রিককে।
ডিসেম্বর, ১৯৪১। ধবল তুষারে ঢাকা পড়ে আছে চারিদিক, তার মধ্য দিয়ে বেশি দূরে দৃষ্টি চলে না। চেকোস্লোভাকিয়ায় এবার প্রচণ্ড শীত পড়েছে, সারা শরীর জমে যাবার দশা। এর মধ্যেই ব্রিটিশ বোম্বার বিমানে করে নেহভিযদি নামের জায়গায় নেমে পড়েছে ওরা, এখান থেকে যেতে হবে প্রাগ।
পাঠক, জ্যান আর জোসেফ প্রাগের দিকে যেতে থাকুক। ততক্ষণে আমরা একটু ঘুরে আসি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বিক্ষুব্ধ ইউরোপ থেকে।
প্রেক্ষাপট
১৯৩৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। জার্মানির মিউনিখে অ্যাডলফ হিটলারের সাথে এক আলোচনায় বসলেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এডুয়ার্ড দালাদিয়ার আর ইতালির প্রধানমন্ত্রী বেনিতো মুসোলিনি। এই আলোচনার মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয় এক চুক্তি, যার নাম ‘মিউনিখ অ্যাগ্রিমেন্ট’।
সেই বছর, অর্থাৎ ১৯৩৮ সালের প্রথমদিকে অস্ট্রিয়া দখলে নেয় জার্মানি, তারপরে ‘দ্য থার্ড রাইখ’এর বিস্তারের জন্য হাত বাড়ায় চেকোস্লোভাকিয়ার দিকে। আর এতেই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন ইউরোপের অন্য নেতারা। হিটলার তাদের সাফ জানিয়ে দেন, “হয় চেকোস্লোভাকিয়া দাও, নয়তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।” যুদ্ধ এড়াতে চাইলেন চেম্বারলেইন, দালদিয়াররা। মিউনিখ অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়াকে তুলে দেয়া হলো জার্মানির হাতে। মিত্রহীন অবস্থায় জার্মান মেশিনের সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না চেকোস্লোভাকিয়ার। কিন্তু যে আশায় এই চুক্তি করা হলো, হিটলার নিজেই সেই আশার গুড়ে বালি ঢাললেন। এর এক বছরের মাথায় পোল্যান্ড আক্রমণ করলেন তিনি, শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন হয়তো টনক নড়েছিল অন্যান্য নেতার, কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, হয়ে গেছে ততক্ষণে।
অস্ত্র এবং যুদ্ধের উপকরণ প্রস্তুতের জন্য চেকোস্লোভাকিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল হিটলারের জন্য। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে মোরাভিয়া আর বোহেমিয়ার রাইখসপ্রটেক্টর (গভর্নর) হিসেবে তিনি নিয়োগ দেন কনস্ট্যানটিন ভন নিউরাথকে। হাতে ক্ষমতা পেয়ে সংবাদপত্রের কণ্ঠ চেপে ধরে সে, সেই সাথে নিষিদ্ধ করে সকল প্রকার রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়ন। প্রতিবাদ করার দায়ে প্রায় ১২০০ ছাত্রকে তিনি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠায়, এদের মধ্যে ন’জনকে দেয় মৃত্যুদণ্ড।
ভন নিউরাথ খুব খারাপ কাজ দেখায়নি। কিন্তু বিশুদ্ধ আর্য রাষ্ট্র গঠনের জন্য যতটা নিষ্ঠুরতা দেখাতে হয়, ততটাও দেখাতে পারেনি। হিটলার তাই এমন কাউকে চেয়েছিলেন, যে চোখের পাতা না ফেলে মানুষ হত্যা করতে পারবে। এবং তার হাতে এমন একজন ছিল। তার নাম, রেইনহার্ড হেড্রিক। নির্বিকার চিত্তে অচিন্তনীয় নিষ্ঠুরতার কারণে হিটলার তার নাম দিয়েছিলেন, ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য আয়রন হার্ট’। ‘দ্য ফাইনাল সল্যুশন’ নামে ইহুদীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার যে পরিকল্পনা হিটলারের ছিল, সেই পরিকল্পনা বের হয়েছিল এই হেড্রিকের মাথা থেকে। কী পরিমাণ নিষ্ঠুর সে ছিল, তা পাঠক এখান থেকে অনুমান করে নিতে পারেন।
রেইনহার্ড হেড্রিকের জন্ম হয়েছিল ১৯০৪ সালে। ১৯১৯ সালে জার্মান ফ্রি কর্পস নামের এক দলে যোগ দেয় সে। এই দলটা ছিল সহজ বাংলায় বলতে গেলে, পাতি গুণ্ডাদের দল। রাস্তাঘাটে মারামারি আর বামপন্থীদের হুমকি-ধামকি, ক্ষেত্রবিশেষে লাশ ফেলে দেয়ার জন্য এই দলটাকে ব্যবহার করত জার্মান সরকারের উপরমহল।
১৯২২ সালে জার্মান নৌবাহিনীতে যোগ দেয় হেড্রিক। তার উত্থানটা হয় মূলত ১৯৩০ সালে, লিনা ভন অস্টেনের সাথে পরিচয়ের পরে। নাৎসি পার্টির একজন সদস্য ছিল লিনা, উপরমহলে ভালো জানাশোনা ছিল তার। ১৯৩১ সালে বিয়ে হয় লিনা আর হেড্রিকের, এবং এর পরপরই হিমলারের সাথে স্বামীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে সে। তার সাথে কথা বলে তাকে পছন্দ করে ফেলেন হিমলার, এরপরে হিটলারের গুডবুকেও নাম উঠে যায় তার। এসএসের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন, তারপরে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের দায়িত্ব এবং তারপরে বার্লিনের গেস্টাপো প্রধান হয়ে যায় হেড্রিক। ১৯৪১ সালে তাকে মোরাভিয়া আর বোহেমিয়ার রাইখসপ্রটেক্টর করে চেকোস্লোভাকিয়ায় পাঠান হিটলার।
হেড্রিক চেকোস্লোভাকিয়ায় ঢোকে ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ঢুকেই সে চেক নামের ‘নোংরা কীট’দের জার্মানাইজ করার ঘোষণা দেয়। এক সপ্তাহের মধ্যে দেড়শ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যায় তার আদেশে। ক্ষমতা গ্রহণের ছ’মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, এদের মধ্যে দশ শতাংশের হয় মৃত্যুদণ্ড, বাকিরা চলে যায় বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। হেড্রিকের এই নিষ্ঠুরতা তাকে ‘হ্যাংম্যান হেড্রিক’, ‘দ্য ব্লন্ড বিস্ট’ এবং ‘দ্য বুচার অফ প্রাগ’ এর মতো গালভরা উপাধি এনে দেয়।
অপারেশন অ্যানথ্রোপয়েড
হেড্রিককে যেকোনো মূল্যে থামাতে হবে, বুঝতে পারছিল মিত্রবাহিনী। পরিকল্পনাটা বের হয় ফ্রান্তিসেক মোরাভেক নামের এক ভদ্রলোকের মাথা থেকে, তিনি ছিলেন চেক মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। ১৯৪১ সালের অক্টোবরে পরিকল্পনাটা নিয়ে তিনি যান ব্রিটেনের এসওই’র (SOE – স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ) কাছে, একটা গুপ্তহত্যার মতো কিছু করা যায় কিনা, সে প্রস্তাব রাখেন। রাজি হয় তারা, অপারেশনের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন অ্যানথ্রোপয়েড’। চেক সরকার খুব করে চাচ্ছিল, কমান্ডোরা যেন চেক অথবা স্লাভ হয়। এর মাধ্যমে চেক জনগণকে এই বার্তা দেয়া যাবে যে, “লড়াই চলছে। এখনও হাল ছাড়িনি আমরা।”
চব্বিশজন সৈনিক নিয়ে স্কটল্যান্ডে শুরু হয় কঠোর প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে মিশনের জন্য প্রস্তুত হয় দুজন সৈনিক, মিশনের তারিখ নির্ধারণ করা হয় অক্টোবরের শেষে। ঠিক তখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটে। যে দু’জনের যাওয়ার কথা ছিল, তাদের একজনের মাথায় ইনজুরি হয়। ফলে মিশনের তারিখ পেছাতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ, মিশন যায় ডিসেম্বরে। শেষ পর্যন্ত স্টাফ সার্জেন্ট কুবিস আর ওয়ারেন্ট অফিসার গ্যাবচিককে নিয়ে যখন ব্রিটিশ বোম্বার উড়াল দেয়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে সেখানেও। ওদের যেখানে প্রাগের কাছাকাছি পিলসেন নামের জায়গায় নামার কথা, নেভিগেশনের ভুলে ওরা নামতে বাধ্য হয় নেহভিযদিতে।
কুবিস আর গ্যাবচিক চেকোস্লোভাকিয়ায় নেমেছিল ডিসেম্বরে, হেড্রিকের উপরে ওরা হামলা চালায় মে মাসের শেষে। পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এত দেরি করল ওরা? কেন দীর্ঘ পাঁচমাসের অপেক্ষা?
আসলে কোনোকিছুই কুবিস আর গ্যাবচিকের পরিকল্পনামাফিক হচ্ছিল না। নেহভিযদি থেকে প্রাগে আসার পরে জার্মানবাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধরত চেক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে ওরা, কী উদ্দেশ্যে এসেছে- তা জানার পর হতভম্ব হয়ে যায় কেউ, আবার কেউ আঁতকে ওঠে রীতিমতো।
হেড্রিককে খুন করতে এসেছে? এরা কি পাগল না উন্মাদ? আর এমনিতেই চেকোস্লোভাকিয়া যে বিপদে আছে, হেড্রিককে যদি খুন করা সম্ভব হয়ও, হিটলার স্রেফ উন্মাদ হয়ে যাবে, সেটা কি এরা জানে না?
এসব অসহযোগিতা সামাল দেবার পর আরও বড় সমস্যা দেখা দিল। নিজেদের সুবিধামতো হেড্রিককে বাগে পাচ্ছিল না ওরা। অবশেষে যখন বাগে পেল, তখন পার হয়ে গেছে পাঁচমাস। বেটার লেট দ্যান নেভার- আঘাত হানতে প্রস্তুত হলো কুবিস আর গ্যাবচিক।
হেড্রিকের অফিস ছিল প্রাগ ক্যাসলে। নিজের বাসভবন থেকে কর্মস্থলে যেত সে একটা ছাদখোলা মার্সিডিজে চড়ে। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, কোনো দেহরক্ষী ছিল না তার। থাকার কথাও নয় অবশ্য। হেড্রিকের মতে, চেকরা হলো ভীতু, কাপুরুষ। ওরা যে তার উপরে হামলা করতে পারে, সে চিন্তা মাথায়ও আসেনি তার।
হামলার জন্য গ্যাবচিক আর কুবিস যে জায়গাটা বেছে নিল, সেটা একটা মোড়। মোড়টা ঘুরে কিছুদূর গেলেই বুলোভকা হাসপাতাল। পরিকল্পনাটা ছিল এরকম- হেড্রিককে আসতে দেখলে ইশারা করবে জোসেফ ভালসিক নামের আরেক সৈনিক। গাড়ি মোড় ঘুরবে, আর তখনই রাস্তার মাঝখানে গিয়ে গাড়িকে থামার ইশারা করবে গ্যাবচিক, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই খালি করে ফেলবে স্টেনগান।
সেদিন কোনো এক কারণে প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে কর্মস্থলে যাচ্ছিল হেড্রিক। তার এই দেরি দেখে কুবিস আর গ্যাবচিক হামলার আশা ছেড়েই দিয়েছিল, কারণ সময়ানুবর্তী বলে সুনাম ছিল এই জার্মানের। শেষ পর্যন্ত সেই মার্সিডিজের দেখা পাওয়া গেল, সাথে সাথে ইশারা করল ভালসিক। তৈরী হলো কুবিস আর গ্যাবচিক।
মোড় ঘুরল মার্সিডিজ। গাড়ি চালাচ্ছিল জার্মান ড্রাইভার, পাশে বসে ছিল হেড্রিক। এমন সময় রাস্তার মাঝখানে গিয়ে থামার ইশারা দিল গ্যাবচিক। তারপরেই টেনে ধরল স্টেনগানের ট্রিগার।
অবাক ব্যাপার! গুলি বেরোলো না কেন?
জ্যাম হয়ে গেছে স্টেন গান!
সামনে দাঁড়ানো এই আগন্তুক কী করতে এসেছে, তা ততক্ষণে বুঝে গেছে হেড্রিক। বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে নিজের ল্যুগার পিস্তল টেনে নিল সে। জায়গায় জমে গেল গ্যাবচিক, কী করতে হবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সঙ্গীর অবস্থা বেগতিক বুঝে গ্রেনেড ছুঁড়ল কুবিস। তাড়াহুড়োর কারণে যেখানে ছুঁড়তে চেয়েছিল, সেখানে পারল না। গ্রেনেড চলে গেল মার্সিডিজের নিচে।
বুম!
বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ, মার্সিডিজের ডান পাশটা লাফিয়ে উঠল শূন্যে। একটু ধাতস্থ হয়ে কুবিসকে ধরতে দৌড় দিল গাড়ির ড্রাইভার। আর গাড়ি থেকে নেমে এলো হেড্রিক, হাতে সেই পিস্তল। তখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে গ্যাবচিক। হেড্রিক পিস্তল তুলতেই ঝাঁপ দিয়ে কাভার নিল সে, একটুর জন্য গুলিটা নাগাল পেল না তার। সামনে বাড়ল হেড্রিক, আরেকবার গুলি করবে। ঠিক তখনই রাস্তার উপরে লুটিয়ে পড়ল সে।
গ্রেনেডের শব্দে পালাচ্ছিল আতঙ্কিত লোকজন, কুবিস আর গ্যাবচিক মিশে গেল তাদের মাঝে। ব্যর্থ হয়েছে ওরা, প্রাথমিক অবস্থায় এটাই ভেবে নিয়েছিল। এদিকে বুলোভকা হাসপাতালে নরক ভেঙে পড়ল যেন। গুলি না লাগলেও বাজেভাবে আহত হয়েছিল হেড্রিক, শার্পনেল ঢুকে গিয়েছিল শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। লম্বা সময় লাগল সেগুলো সরাতে। হেড্রিকের উপরে আক্রমণের খবর পেয়ে জার্মানি থেকে প্রাগে চলে এলো কয়েকজন জার্মান ডাক্তার। সবার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে হামলার অষ্টমদিনের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে হেড্রিক।
পরিণাম
নিজের বিশ্বস্ত লোক মারা যাওয়ায় আক্ষরিক অর্থেই পাগলা কুকুর হয়ে গেলেন হিটলার। সাথে সাথে দশ হাজার চেক নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড দিলেন তিনি। কিন্তু তা করলে কারখানায় কাজ করার আর লোকের সঙ্কট দেখা দেবে, এই অজুহাত দেখিয়ে তাকে নিবৃত্ত করলেন তার কয়েকজন জেনারেল। এর পরিবর্তে দশ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হলো, এদের মধ্যে এক হাজার লোককে মারা হলো গুলি করে। আততায়ীদের আশ্রয় দিয়েছিল, এই অজুহাত তুলে লিডিচ আর লেজাকি নামের দু’টি গ্রাম মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হলো একেবারে।
এই গ্রাম দুটোতে ষোল বছরের উপরে যে সকল পুরুষের বয়স, সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হলো তাদের। নারী আর শিশুদেরকে পাঠানো হলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। আর একেবারে দুধের শিশুদেরকে দত্তক হিসেবে দিয়ে দেয়া হলো জার্মান পরিবারের কাছে। এদের বেশিরভাগেরই পরে আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
১৯৪৯ সালে লিডিচ গ্রামটি পুনরায় গড়ে তোলা হয়। একটা মুকুটযুক্ত ক্রস বসিয়ে চিহ্নিত করা হয় পুরুষদের গণকবর। আর যেসব শিশু কেমনো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মারা গিয়েছিল, তাদের উদ্দেশে বিরাশিটি ব্রোঞ্জ মূর্তিবিশিষ্ট একটা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়।
শুধু তা-ই নয়। আন্তর্জাতিকভাবেও সাড়া ফেলে লিডিচ গণহত্যা। মেক্সিকোতে ‘স্যান জেরোনিমো লিডিচ’ এবং ভেনেজুয়েলাতে ‘ব্যারিও লিডিচ’ নামে দুটো গ্রামের নামকরণ করা হলো লিডিচের নামে। ১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডের কিছু কয়লাশ্রমিক প্রতিষ্ঠা করল ‘লিডিচ শ্যাল লিভ’ নামের সংগঠন, এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল লিডিচ গ্রামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আমেরিকার উইসকনসিনের ফিলিপসে আছে লিডিচ মেমোরিয়াল। এছাড়া ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রিতে আছে লিডিচ স্কয়ার। চিলির সান্তিয়াগোতে আছে লিডিচ স্ট্রিট।
এখানেই মানবতার কাছে হেরে যায় নিষ্ঠুরতা। চেকোস্লোভাকিয়ার লিডিচ গ্রামকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন হিটলার, কিন্তু লিডিচ ঠিকই পৌঁছে যায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
কুবিস আর গ্যাবচিকের কী হলো তাহলে? ব্যর্থ হয়েছে ভেবে পালায় ওরা, আশ্রয় নেয় সেন্ট সিরিল অ্যান্ড মেথোডিয়াস চার্চের ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে। ওদের ধরার জন্য দশ লক্ষ রাইখসমার্ক পুরস্কার ঘোষণা করে এসএস। সেই পুরষ্কারের লোভে ওরা কোথায় আছে, তা জানিয়ে ক্যারেল শার্ডা নামের আরেক চেক মুক্তিযোদ্ধা। বাকিটা খুব সহজ হয়ে যায় জার্মানবাহিনীর জন্য। পুরো শক্তি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে চার্চের উপরে। লড়তে লড়তে মৃত্যুকে বরণ করে নেয় জ্যান কুবিস আর জোসেফ গ্যাবচিক।
শেষ কথা
জ্যান কুবিস আর আর জোসেফ গ্যাবচিক মারা গিয়েছিল জুন মাসের ১৮ তারিখে। তাদেরকে আজও বীর বলে শ্রদ্ধা করে চেকরা, তাদের জন্য একটা আলাদা স্মৃতিস্তম্ভই আছে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে। প্রতি বছর ১৮ই জুন ফুল আর মোমবাতিতে ভরে যায় সেই স্মৃতিস্তম্ভ, দুঃসাহসিক সেই কাজের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে সবার।
লেখাটা শেষ করা যাক অ্যালোয়েস দেনেমারেকের কথা দিয়ে। ভদ্রলোক ছিলেন জ্যান কুবিসের বন্ধু। যেদিন কুবিস আর গ্যাবচিক হেড্রিকের উপরে হামলা করে, সেদিন কুবিসের সাথে দেখাও হয়েছিল তার। হেড্রিকের মৃত্যু পরবর্তী গণহত্যায় বাবা-মা’সহ পরিবারের সবাইকে হারান তিনি। বিবিসি’র একজন সাংবাদিক তাকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন, শুধুমাত্র একজন মানুষের জীবনের বিনিময়ে এতটা মূল্য চোকানোর কি আসলেই দরকার ছিল?
দেনেমারেক সাহেবের উত্তর ছিল,
“অবশ্যই দরকার ছিল। আমি যে আজ এখানে, গোটা চেক জাতি যে আজ এখানে, তা পুরোটাই কুবিস আর গ্যাবচিকের অবদান। চেক জনগণকে নিয়ে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা ছিল হেড্রিকের। হ্যাঁ, আমি আমার পরিবারকে হারিয়েছি, কিন্তু কুবিস যা করেছে, তার জন্য আমরা ওর কাছে কৃতজ্ঞ। গর্বে আমার বুকটা ফুলে যায় এই ভেবে, আমি ওর বন্ধু ছিলাম।”
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/