১৯৪১ সালের আগস্ট মাস। পুরো পৃথিবীজুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে ঘায়েল করতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে এরকম শত শত ঘাঁটি গড়ে উঠলো। অক্ষশক্তির রাষ্ট্রপ্রধানরা বুঝতে পারলেন, এই ঘাঁটিগুলো দখল করতে না পারলে সোভিয়েত দখল করা সহজ হবে না। হিটলারের নির্দেশে একে একে বিভিন্ন ঘাঁটিতে অপারেশন শুরু করে দিলো নাৎসিরা। সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত মাইকোপ ঘাঁটিতেও এমন অভিযান চালানো হলো। সোভিয়েতদের অদম্য প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত ঘাঁটি মাইকোপ। কয়েক হাজার সুদক্ষ রুশ সেনাসদস্যের নিয়মিত টহলকে ফাঁকি দিয়ে একটি মাছিও প্রবেশ করতে পারে না সেখানে। সেদিন সকাল থেকে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হওয়ায় জার্মানরা এক পা-ও এগোতে পারছিলো না। তাই তারা বেশ দীর্ঘ সময় যাবৎ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছিলো। ওদিকে রুশ সেনাবাহিনীর অনেকেই যুদ্ধ ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলো। বেশ ছোট সংখ্যার একটি দল কিছুদিন আগে মাইকোপ থেকে পলায়ন করেছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো।
দুপুরের দিকে সোভিয়েত জাতীয় প্রতীক সম্বলিত একটি সামরিক ট্রাক তখন মাইকোপ ঘাঁটিতে প্রবেশ করলো। তারপরই যেন মাইকোপ ঘাঁটিতে বেশ হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেলো। ট্রাক থেকে নেমে আসলেন রুশ সমরনায়ক মেজর ত্রুচিন। সেখান থেকে সোজা মাইকোপ সদর দপ্তরে ফরমান দিলেন তাকে স্টালিনগ্রাড থেকে পাঠানো হয়েছে। স্টালিনগ্রাডের মেজরের নাম শুনে মাইকোপের অন্যান্য অফিসাররা দ্রুত সেখানে উপস্থিত হলেন। মেজর ত্রুচিন স্পষ্ট রুশ উচ্চারণে জানালেন, তাকে স্টালিনগ্রাড থেকে সরকার কর্তৃক পলায়নকারী সেনাদের গ্রেফতার করার জরুরি মিশন প্রদান করা হয়েছে। তারপর তিনি বিশদভাবে তার পুরো পরিকল্পনা পড়ে শোনালেন রুশ জেনারেলদের। ত্রুচিনের নম্রতা এবং দৃঢ় মনোভাব খুব সহজেই জেনারেলের মন কেড়ে নিলো। জেনারেল পরদিন নিজের গাড়িতে চড়ে ত্রুচিনকে পুরো মাইকোপ ঘাঁটি ঘুরে দেখালেন। হাসিখুশি রুশ জেনারেল সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, তার পাশে সুসজ্জিত দৃঢ় এই অফিসারটির আসল নাম মেজর ত্রুচিন নয়। বরং তিনি নাৎসি বাহিনীর কুখ্যাত গুপ্তচর ওয়াফেন এস এস অফিসার আদ্রিয়ান ফন ফুকারসেম!
সেদিনের ভুলের খেসারত হিসেবে চরম মূল্য পরিশোধ করতে যাচ্ছিলো রুশরা। কারণ মাইকোপকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছিলো নাৎসিরা, যাদের দায়িত্বে রয়েছে দুর্ধর্ষ জার্মান রেজিমেন্ট ব্রাণ্ডনবার্গ।
ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্ট কী?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার উন্মাদনায় যখন পুরো জার্মান স্বপ্ন দেখছিলো বিশ্বজয় করার, ঠিক তখন গড়ে ওঠে নাৎসি বাহিনীর বিশেষ গুপ্তচর রেজিমেন্ট ব্রাণ্ডনবার্গ। জার্মান নথিপত্রে এদের ‘ব্রাণ্ডনবার্গারস’ নামে ডাকা হতো। দক্ষতায় অন্যান্য গুপ্তচর সংস্থার তুলনায় ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্ট ছিল অনেক এগিয়ে। একজন ব্রাণ্ডনবার্গার হতে হলে প্রতিটি সদস্যকে চেক, রুশ, লাটভিয়ান, লিথুনিয়ান, ফিনিশ, এস্তোনিয়ান, পোলিশ, ইউক্রেনিয়ানসহ বহু ভাষায় পারদর্শী হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, মিত্রশক্তির বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় রীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে, যেন তাকে দেখে কেউ চট করে বলে দিতে না পারে সে গুপ্তচর। সোজা কথায়, তাকে জার্মান অভ্যাস সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে হবে, যা বেশ দুরূহ ছিল। একজন ব্রাণ্ডনবার্গারকে স্থানীয়দের সাথে এমনভাবে মিশে যেতে হতো যেন কেউ স্বপ্নেও তাকে জার্মান না ভাবতে পারে।
এসব বিষয়ে দক্ষ হওয়ার পর শুরু হবে সমর প্রশিক্ষণ। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় কিংবা নিজের পরিচয় ফাঁস হয়ে গেলে তাকে মেতে উঠতে হবে হত্যাযজ্ঞে। তাই সবধরনের অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দেয়া হতো তাদের। গেরিলা যুদ্ধের সার্বিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তোলা হতো। কোনো সাহায্য ব্যতিরেকে কীভাবে শত্রুদের মাঝে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায়, কীভাবে অস্ত্র ছাড়া লড়াই করা যায় এরূপ বহু বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন চৌকস গুপ্তচর হিসেবে গড়ে তোলা হতো তাদের। প্রশিক্ষণ শেষে তারা একাকী বেরিয়ে পড়তো নিজেদের মিশনে। এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে হানা দিতো শত্রু ঘাঁটিতে। কিন্তু কেউই জানতে পারতো না তার আসল পরিচয় কী।
উচ্চাভিলাষী হিপেল
ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্টের জনক হিসেবে ধরা হয় নাৎসি অফিসার থিওডর ফন হিপেলকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নায়ক হিপেল যুদ্ধকালীন সময়ে আফ্রিকা অঞ্চলে যুদ্ধরত ছিলেন। সেখানে তিনি জেনারেল পল লেতো-ভরবেকের তত্ত্বাবধানে একবার গেরিলা যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সেবার জার্মানরা নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। এই যুদ্ধের ফলাফল হিপেলকে বেশ প্রভাবিত করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হিপেল শত্রুদের হাতে ধরা পড়েন। যুদ্ধের বাকি সময় তিনি কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করেন। যুদ্ধ শেষে তাকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি তার জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং রাজনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যয়নরত অবস্থায় হিপেল ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্টের খসড়া তৈরি করেছিলেন। শিক্ষালাভ শেষে তিনি জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা আবভে (Abwehr)-তে যোগদান করেন। সেখানে তিনি গুরু জেনারেল লেতোর সাথে পুনরায় কাজ করার সুযোগ লাভ করেন।
একদিন কথাপ্রসঙ্গে তিনি আফ্রিকার স্মৃতিচারণ করছিলেন। তখন হিপেল জেনারেল লেতোকে তার পরিকল্পনার কথা জানান। জেনারেল লেতো হিপেলকে আশাহত করতে চাননি। তাই তিনি তার পরিকল্পনার একটি খসড়া কপি জেনারেল রিকশভেরের নিকট প্রেরণ করেন। গেরিলা যুদ্ধ তৎকালীন জার্মান সেনাবাহিনীর রণকৌশলের বহির্ভূত পদ্ধতি ছিল। তাই পুরো পরিকল্পনাটি রিকশভেরের মনঃপুত হলো না। তাই তিনি হিপেলকে নাকচ করে দিলেন। আশাহত হিপেল হাল ছেড়ে দিলেন না। তিনি এডমিরাল কানারিসের নিকট তার পরিকল্পনার খসড়া কপি জমা দেন। কানারিস তখন জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার সর্বাধিনায়ক ছিলেন। তিনি নিজেও হিপেলের উচ্চাভিলাষকে প্রশ্রয় দিতে চাননি। কিন্তু ক্ষুদ্রাকারে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করার অনুমতি দেন। হিপেলকে সেই টাস্ক ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে শুরু হলো ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্টের পথচলা।
ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্ট
হিপেলের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গঠিত নতুন ব্যাটালিয়নের সদস্যগণ কাজে নেমে পড়েন। জার্মান রণকৌশল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কায়দায় কাজ করতে পারদর্শী এই ব্যাটালিয়নকে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ ভালো চোখে দেখতেন না। অনেকেই পুরো প্রকল্পটি স্রেফ বাজে খরচ বলে ব্যঙ্গ করতেন হিপেলকে। “জার্মানরা কখনও ভীতুদের মতো গেরিলা আক্রমণ করে না”- এ ধরনের অনেক ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে জর্জরিত করা হয়ে তাকে। কিন্তু অপরদিকে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার নিবিড় তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠতে থাকে হিপেলের স্বপ্নের রেজিমেন্ট। উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা এবং তাৎক্ষণিক আক্রমণের মাধ্যমে তারা সরকার কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন গোপনীয় মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করতেন। একজন ডাচ নাবিক থেকে শুরু করে সার্বিয়ান দিনমজুর পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয় এই নতুন ব্যাটালিয়নের সদস্যগণকে। প্রাথমিকভাবে এই দলের নামকরণ করা হয় ‘এবিনঘাউ ব্যাটালিয়ন‘। রাশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা যোগদান করেন।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই ব্যাটালিয়নের জন্য হিপেল সেনাবাহিনীর সবচেয়ে অলস এবং অদক্ষ সৈনিকদের বাছাই করতেন। হয়তো এই কারণে অন্যান্য সেনাসদস্যদের নিকট এবিনঘাউ ব্যাটালিয়ন হাসির পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো। কিন্তু শত বিদ্রূপের পরেও তারা নিজেদের দায়িত্বে অটল ছিলেন। হিপেল তাদের পুরো জীবনকে বদলে দিলেন তার জাদুতে। নতুন সদস্য বাছাই করার পর তাদের সরাসরি ব্রাণ্ডনবার্গে প্রেরণ করা হতো। সেখানে একজন অলস, অকর্মা সৈনিককে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলা হতো একজন দক্ষ গুপ্তচর হিসেবে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য দ্রব্য ব্যবহার করে যেকোনো ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা তৈরি করার মাধ্যমে তারা খুব কম সময়ে বিভিন্ন শত্রু স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারতো।
পোল্যাণ্ডে এক বিপদজনক মিশনে সরকারকে সহায়তা করার মাধ্যমে তারা সর্বপ্রথম জার্মান সেনাবাহিনীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে তারা অন্যান্য রেজিমেন্টের ন্যায় সরকারি ভাতা লাভ করার সুযোগ পায়। এই অর্জনের মাধ্যমে তারা নতুনভাবে নিজেদের আবিষ্কার করে। তাদের নামও বদলে ফেলা হয়। ১৯৩৯ সালের ১৫ অক্টোবর এদের নতুন নাম রাখা হয় ‘ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্ট’। নতুন রেজিমেন্টের সদস্যদের ডাকা হতো ‘ব্রাণ্ডনবার্গারস’ হিসেবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে দেখা হয় এই রেজিমেন্টকে। পোল্যাণ্ড আক্রমণের পূর্বে তারা সাধারণ জনগণের বেশ ধরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিভিন্ন তথ্য পাচারের মাধ্যমে তারা জার্মান সৈনিকদের আক্রমণকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। পোল্যাণ্ডে অবস্থানকালে মাত্র দুই সপ্তাহে তারা সিমানোভিচ অঞ্চলে ৬ জন, নয়ি বাইতম অঞ্চলে ১৮ জন এবং কাটোভিচ অঞ্চলে প্রায় ১০০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যা করেন। জার্মান সরকার কর্তৃক স্বীকৃতিলাভের পর এদের চার ভাগে বিভক্ত করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন (বাল্টিক সাগর উপকূল), পর্তুগাল, উত্তর আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকেন গুপ্তচররা। সকলের অগোচরে তারা একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটন করতে থাকেন। নতুন নাম গ্রহণের পর তাদের প্রথম মিশন ছিল রোমানিয়ার তেল খনিতে জার্মান আদিপত্য বজায় রাখা। একই সময়ে তুরস্কের বিভিন্ন খনিতে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন তারা।
প্রায় ৪২টি স্থানে তারা সফলভাবে কাজ করতে থাকেন। এমনকি ব্রাণ্ডনবার্গারসরা জার্মান সেনাবাহিনীর অন্যতম দুর্ধর্ষ ইউনিট পেঞ্জারের চেয়েও দক্ষ ছিলেন বলে অনেকে মন্তব্য করেছিলেন। তাদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দিতে ভুল করেননি হিটলার নিজেও। পুরো রেজিমেন্টের শতকরা ৭৫ ভাগ অফিসারের ইউনিফর্মে শোভা পেতে থাকে হিটলারের নিজস্ব সম্মাননা ‘আয়রন ক্রস’। ব্রাণ্ডনবার্গের সবচেয়ে বড় সমালোচক এডমিরাল কানারিসও একসময় তাদের প্রশংসায় মেতে উঠেন।
মাইকোপে জার্মান অভিযান
১৯৪১ সালের ৫ এপ্রিল ব্রাণ্ডনবার্গারসদের সহায়তায় হিটলার বেশ সফলভাবে বলকান অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হন। দানিউব উপকূলে ৫৪ জনের একটি দল অরসোভা শহরের গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হত্যা করলে পুরো বলকান অঞ্চল জার্মানদের দখলে চলে আসে। এবার হিটলার রাশিয়া দখলের প্রস্তুতি নেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। সাথে সাথে ডাক পড়লো থিওডর হিপেলের। অভিযানে ব্রাণ্ডনবার্গারসদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়। আদেশ পাওয়া মাত্র কাজে লেগে পড়েন তারা। রাশিয়ার বিভিন্ন ঘাঁটিতে ছড়িয়ে পড়েন ছদ্মবেশে। রাশিয়া আক্রমণে হিটলারকে সহায়তা করতে বিভিন্ন বিপদজনক অবস্থান থেকে কাজ করতে থাকেন তারা। তেমনি রাশিয়ার মাইকোপ ঘাঁটিতেও তারা ব্যারন আদ্রিয়ান ফন ফুকারসেমের অধীনে ৬২ জন অফিসারকে গুপ্তচর হিসেবে প্রেরণ করেন। এই মিশনে তাদের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় Wild Bunch, যার বাংলা ভাবানুবাদ দাঁড়ায় ‘বুনো দল’। তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় মাইকোপ তেল ঘাঁটি থেকে রাশিয়ানদের বিতাড়িত করা। কিন্তু কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এবার আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেন না কেউই।
ফুকারসেম বেশ সতর্কতার সাথে একদল রুশ সৈনিকের সাথে সামরিক ট্রাকে চড়ে ঘাঁটিতে প্রবেশ করেন। তিনি মেজর ত্রুচিন নামক এক অফিসারের পরিচয় চুরি করে মাইকোপের জেনারেলের সাথে দেখা করেন। রুশ জেনারেল ফুকারসেমকে পুরো ঘাঁটি ঘুরিয়ে দেখান এবং তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত করেন। ওদিকে আরেকদল ব্রাণ্ডনবার্গারস ঘাঁটির খুব নিকট থেকে ৮ আগস্ট সকালে গ্রেনেড আক্রমণ করে বসেন। হালকা আর্টিলারির সাহায্যে গেরিলা আক্রমণ করে তারা রুশ ঘাঁটির সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেন। ফুকারসেম দ্রুত রুশ জেনারেলের নিকট উপস্থিত হন। তিনি জেনারেলকে জানান, স্টালিনগ্রাড থেকে পুরো ঘাঁটি ত্যাগ করার জরুরি আদেশ প্রদান করা হয়েছে। রুশ জেনারেল ছদ্মবেশী মেজর ত্রুচিনের কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার কারণে তিনি সদর দফতরে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। তাই দ্বিধান্বিত জেনারেল কোনো উপায় না দেখে সদলবলে দ্রুত মাইকোপ ত্যাগ করেন। নাটকীয়ভাবে কোনো রক্তপাত ছাড়াই জার্মানরা মাইকোপ দখল করে ফেলে।
ব্রাণ্ডনবার্গ রেজিমেন্ট বাতিলকরণ
১৯৪৪ সালের কথা। জার্মানরা রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের দখল হারিয়ে ফেলে। হিটলারের পক্ষ থেকে নতুন নির্দেশ জারি করা হয়। সেই নির্দেশ অনুযায়ী, জার্মান বাহিনীর জন্য বর্তমানে কোনো বিশেষ রেজিমেন্টের প্রয়োজন নেই। তাই ১৭ আগস্ট ব্রাণ্ডনবার্গারসদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ওদিকে মেমেলের যুদ্ধে রাশিয়ানরা জার্মানদের পরাজিত করলে সেখানে প্রচুর ব্রাণ্ডনবার্গার ধরা পড়ে যান। জার্মানরা পিলাউ অঞ্চলে পরাজিত হলে সেখানে পুরো ইউনিটের প্রায় সবাই নিহত হয়। এদের মধ্যে অনেকেই এই রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেকেই পালিয়ে যান। তবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাকি অফিসারদের অনেকেরই হদিস মেলেনি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ব্রাণ্ডনবার্গারসদের মতো সুদক্ষ গুপ্তচরদের পক্ষে সবার মাঝে মিশে পরিচয় গোপন করে থাকা কোনো কঠিন কাজ নয়।
তবে অনেকেই ব্রিটিশদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। যুদ্ধের পর এদের বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের আসামি করা হয়। বিশেষ করে, ফালশ্রিম অঞ্চলে গণহত্যায় ব্রাণ্ডনবার্গারসা নির্বিচারে সাধারণ জনগণের উপর অত্যাচার করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠে। ব্রাণ্ডনবার্গারসরা বিনা কারণে প্রায় ৭২ জন মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এভাবে হিটলারের উগ্র চেতনার প্রতিনিধি হিসেবে এই রেজিমেন্টের সদস্যগণ মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে মিত্রবাহিনীর উপর চড়াও হয়েছিলেন। ইউরোপে জার্মান তাণ্ডবের দূত হিসেবে পরিচিত এই গুপ্তচরদের তাই শান্তিপ্রিয় নাগরিকগণ ঘৃণাভরে স্মরণ করে থাকে।
ফিচার ইমেজ: Axis History