মৃদুভাষী আর সদা বিনয়ী লোকটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না তিনি কী করেছেন, কিংবা তার কর্মফল কী বয়ে আনতে চলেছে একটি জাতির ভাগ্যে।
তিনি একমনে তার কাজগুলো করে গিয়েছিলেন। বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে যা পেতেন, সেটা আহামরি কিছু ছিল না তার ব্যবসার তুলনায়। যাদের জন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন, নীতিগতভাবে তিনি তাদের সমর্থনও করতেন না!
তবে কি বিশেষ কারও কাছ থেকে কোনো সম্মানের আশায়? না, সেটাও না! তাহলে কেন তিনি এমনটা করলেন? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- কে এই ‘তিনি’?
…
ফ্রিৎজ ব্লক; চল্লিশে পা রাখি-রাখি করা এক ভদ্রলোক। মৃদুভাষী, সদা হাস্যোজ্জ্বল আর বিনয়ী এই মানুষটি জাতিতে জার্মান। তবে তার জীবিকার উৎস পোঁতা ছিল নেদারল্যান্ডের সবচেয়ে জনবহুল শহর অ্যামস্টারডামে। সেখানে একটি লেডিস ড্রেস ফ্যাক্টরি চালাতেন তিনি। সেই ফ্যাক্টরিতে তৈরি অধিকাংশ পোশাকই পরবর্তীতে চলে যেত ইংল্যান্ডে। ব্লকের স্ত্রী ছিলেন আমেরিকার নাগরিক, যারা বাবা-মা থাকতেন আবার লন্ডনে।
বেশ পেচিয়ে যাচ্ছে, তাই না? ব্লক জার্মান, ব্যবসা নেদারল্যান্ডে; বউ আমেরিকান, শ্বশুর-শাশুড়ি থাকে ইংল্যান্ডে! যা-ই হোক, এত জটিলভাবে না গিয়ে শুধু শুরুর আর শেষের অংশ দুটো মনে রাখুন। জার্মানির নাগরিক ব্লক তার শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখতে প্রায়ই লন্ডনে যেতেন।
১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়, ব্লক পা রাখলেন লন্ডনে। উপরের বর্ণনা পড়ে ভাবতে পারেন, লোকটি নির্ঘাত তার শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে দেখা করতে গিয়েছেন। না, তিনি সেই কাজে যাননি। আসলে তিনি সেবার লন্ডনে ‘যাননি’, তাকে ‘পাঠানো হয়েছিল’!
এরিখ ফেইফার, জার্মানির সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সি আব্ভের-এর উইলহেল্মশ্যাভেন শাখার সেকেন্ড ইন কমান্ড, পদবী তার ‘এজেন্টদের নেতা’। তিনিই ব্লককে পাঠান লন্ডনে। কিন্তু কেন?
…
বেশ কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। গোয়েন্দাগিরির জীবন সবসময়ই চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে ফ্রিৎজ ব্লককে। তাই তো সকল বিপদের আশঙ্কা তুচ্ছ করে, নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও তিনি যোগাযোগ করলেন আব্ভের-কর্তৃপক্ষের সাথে, জানালেন নিজের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার কথা। না, তিনি স্থায়ীভাবে গোয়েন্দাগিরিকে বেছে নিতে চাননি, চেয়েছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবী গোয়েন্দা হতে।
ব্লকের ইচ্ছার কথা শুনে আব্ভের কর্তৃপক্ষ তাকে ফিরিয়ে দেয়নি। প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি চেক শেষে তাকে পাঠানো হয় লন্ডনে। শুধু তাকে না, আসলে সব নতুন এজেন্টকেই বাধ্যতামূলক এক ফিল্ড টেস্টে লন্ডনে পাঠানো হতো, বোঝার চেষ্টা করা হতো ট্রেনিং থেকে অর্জিত বিদ্যা তিনি কতটা কাজে লাগাতে পারছেন। ব্লকের দায়িত্ব ছিল লন্ডনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ছবি তুলে আনা।
…
সময়মতো নিজের লন্ডন অধ্যায় শেষ করে আবার উইলহেল্মশ্যাভেনে ফেরত আসলেন ফ্রিৎজ ব্লক, ছবিগুলো তুলে দিলেন ফেইফারের হাতে। খাম থেকে ছবিগুলো বের করে ফেইফারের তো চোখ ছানাবড়া অবস্থা। সাধারণ কিছু ছবি পেলেই যেখানে খুশি হতেন তিনি, সেখানে নতুন এই স্বেচ্ছাসেবী গোয়েন্দার ছবির সংখ্যা ও গুরুত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। এর মাঝে রাজা জর্জ ও রানী মেরির ওয়াটার স্টোরেজ রিজার্ভার, লন্ডনের আটটি পানি সরবরাহের উৎস (সর্বমোট ছিল তেরটি) এবং মেট্রোপলিটান ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের রিলে স্টেশনের ছবিও ছিল।
ব্লকের মতো একজন শখের গোয়েন্দার তোলা এই ছবিগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা জানাতে একটা তথ্যই যথেষ্ট। গত শতকের চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান লুফৎভাফে তথা বিমানবাহিনী হামলা চালায় ব্রিটেনে। এই অপারেশনে লুফৎভাফে যে সিক্রেট ম্যাপ ব্যবহার করেছিল, সেখানে ব্লকের তোলা ছবিগুলোর গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য।
ব্লক হয়তো গোয়েন্দাগিরিকে শখের বশে পরখ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তার মতো একজন রত্নের গুরুত্ব বুঝতে এরিখ ফেইফারের একমুহূর্ত দেরি হয়নি। তাই ব্লকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চললেন তিনি, দিতে থাকলেন নিত্যনতুন অ্যাসাইনমেন্ট। ফলে পরবর্তী কয়েক মাস ধরে ব্লককে বেশ কয়েকবার লন্ডনে যাতায়াত করতে হলো শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখতে যাবার নাম করে।
ব্লকের স্ত্রী হয়তো স্বামীর এই শ্বশুর-শাশুড়ি প্রীতি দেখে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। ওদিকে ব্লকও তার শখের বৃক্ষে ঠিকমতো পানি ঢেলে চলেছিলেন। এ যেন ‘হ্যাপি ওয়াইফ, হ্যাপি লাইফ’ কথার একেবারে বাস্তব উদাহরণ! এভাবে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ স্থাপনার চার শতাধিক ছবি, স্কেচ ও ম্যাপ সংগ্রহে সক্ষম হলেন। শুধু তা-ই না, এর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্রিটিশ ডিফেন্স ফ্যাসিলিটি সম্পর্কে দেড়শ গোপন রিপোর্টও তার হস্তগত হয়। এসবের মাঝে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন এয়ারক্রাফট ফ্যাক্টরি, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এয়ারফিল্ড ও শিপইয়ার্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার তথ্য ছিল।
এতটুকু পড়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, “আচ্ছা, এতবার যে মানুষটা ইংল্যান্ডে যাওয়া-আসা করল আর এত এত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার তথ্য সংগ্রহ করল, তাকে কি একবারও সন্দেহের চোখে দেখেনি দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? সেই দেশের সিকিউরিটি এজেন্টদের কোনো নজরই কি পড়েনি ব্লকের ওপর?” সত্যি বলতে, একেবারেই পড়েনি। আসলে লোকটির বিনয়ী চেহারা আর মিতভাষী রুপ দেখেই কেউ হয়তো তাকে নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববার অবকাশ পায়নি। আর তিনিও তাই তলে তলে ঠিকই নিজের কাজটা এগিয়ে নিতে পেরেছেন। তবে এখানে ব্লকের বুদ্ধিরও তারিফ করতে হবে। কারণ, শুধু ভাগ্য দিয়ে আর যা-ই হোক এত তথ্য সংগ্রহ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
সেই সময় ঘটে গেল আরও এক ঘটনা, যা নিঃসন্দেহে ব্লকের জন্য সৌভাগ্যই বলতে হবে। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রেডিওর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে একটি গোপন চিঠি পাঠানো হয়, যেখানে ইংল্যান্ডের বেশ কিছু প্রতিরক্ষা স্থাপনা, দুর্গ ও অ্যামুনিশন ডিপোর নাম ছিল। মিডিয়াকে বলা হয় এই নামগুলো যেন কোনো সংবাদেই উঠে না আসে। কিন্তু এক ‘বন্ধু’র সহায়তায় ব্লক ঠিকই অতি গোপন এই চিঠিও যোগাড় করতে সক্ষম হন।
আব্ভেরের কাছে এ যেন ছিল এক স্বর্ণখনি। কারণ সেখানে যে শুধু সেসব স্থাপনার নাম ছিল তা না, বরং সেগুলো কোথায় অবস্থিত, কেন নির্মাণ করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট আরও নানা রকম তথ্যই ছিল। মেঘ না চাইতেই এভাবে মুষলধারে বৃষ্টি পেলে কে না খুশি হবে বলুন!
…
অনেক আলাপ করা হলো ফ্রিৎজ ব্লক এবং তার গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের গুরুত্ব নিয়ে। তিনি নিজেই কিন্তু ছিলেন বিশাল এক রহস্য।
ব্লক ছিলেন একজন স্বাধীন নাগরিক, একজন সাধারণ মানুষ। গোয়েন্দার জীবন বেছে নিয়ে কেন তিনি নিজের সাজানো-গোছানো জীবনটাকে এভাবে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিলেন? জার্মান নেতাদের কাছ থেকে কোনো রকম প্রাপ্তির আশা তার ছিল না। আর সত্যি বলতে এত অবদান রাখার পরও দেশটির কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কাছ থেকে তার ভাগ্যে জোটেনি কোনো প্রশংসাবাণীও।
দেশপ্রেম? সেটা ছিল, তবে অন্ধ দেশপ্রেম না। আবার নাৎসি পার্টির সাথে তার কোনোরকম সংযুক্তির ব্যাপারেও জানা যায় না।
তাহলে কি অর্থ? না, সেটা তো কোনোভাবেই না। নিজের ব্যবসা দিয়ে বেশ ভালভাবেই চলে যাচ্ছিল তার জীবন। আব্ভেরের কাছ থেকে মাসে তিনি যে অর্থ পেতেন সেটা তার আয়ের তুলনায় তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।
তাহলে কী এমন ঘটেছিল এই মৃদুভাষী, লাজুক মানুষটির জীবনে যা তাকে গোয়েন্দাগিরির মতো ভয়াবহ পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করল যার পদে পদে রয়েছে মৃত্যুর হাতছানি? এর উত্তর জানা নেই। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে তার মৃত্যুর সাথে সাথে তাই হারিয়ে গেছে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাবও।
২য় বিশ্বযুদ্ধে সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন রোর বাংলার এই বইটি:
১) সাচিকো : নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর জীবনকাহিনী