ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-৪): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এক স্মরণীয় নৌযুদ্ধ

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মোট তিনটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার অংশগ্রহণ করে। টাস্কফোর্স ১৭-তে ছিল এডমিরাল ফ্লেচারের ইউএসএস ইয়র্কটাউন। টাস্কফোর্স ১৬-তে ছিল এডমিরাল রেমন্ড স্প্ৰুয়েন্স এর ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ইউএসএস হরনেট। দুটো স্ট্রাইক গ্রুপ মিলিত হওয়ার কথা থাকলেও যখন আক্রমণ শুরু হয় তখন তারা বেশ দূরে ছিল। গোয়েন্দা বিমানের রিপোর্ট পেয়ে এডমিরাল ফ্লেচার স্প্ৰুয়েন্সকে আক্রমণ শুরু করতে নির্দেশ দেন। যদিও তার ক্যারিয়ার ছিল স্প্ৰুয়েন্সের চেয়ে জাপানিদের অনেক নিকটে। একই সঙ্গে তার পাইলটরা ছিল প্রথম আঘাত হানার ব্যাপারে দক্ষ। সঙ্গে আছে কোরাল সি যুদ্ধের একদম টাটকা অভিজ্ঞতা। কিন্তু ইয়র্কটাউনকে রিজার্ভ রাখা হচ্ছিল, কেননা ফ্লিট এডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিটজের আশঙ্কা ছিল যে জাপানিরা তাদের ৫ম ক্যারিয়ার এই যুদ্ধে ডেকে আনবে।

শত্রুর সাথে দূরত্ব বেশি বিধায় এডমিরাল স্প্ৰুয়েন্সের বিমানবাহী জাহাজের ক্যাপ্টেন মাইলস ব্রাউনিং ঘন্টায় ৪৬ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে শুরু করলেন। একইসঙ্গে সকাল সাতটায় বাতাসের গতি যখন সর্বাধিক তখন অনুকূলে বিমান লঞ্চ করা শুরু করেন। এ সময় মার্কিনিদের সাথে জাপানিদের দূরত্ব ছিল মাত্র ২৮৭ কিলোমিটার। সকাল আটটার পর এডমিরাল নাগুমো ও এডমিরাল ফ্লেচার পরস্পরের দিকে বিমান লঞ্চ করতে শুরু করেন। তবে তার আগেই নাগুমো এডমিরাল স্প্ৰুয়েন্সের প্রথম দফা হামলা শিকার হন।

এখানে উল্লেখ্য, জাপানিরা ৭ মিনিটে ১০৮টি বিমান আকাশে উড়িয়েছে, অন্যদিকে মার্কিনিরা ১১৭টি বিমান ওড়াতে প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়েছে। এর কারণে দুভাবে মার্কিনিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী যেখানে জাপানি ক্যারিয়ার থাকার কথা ছিল, এক ঘন্টায় সেখান থেকে দূরে সরে গেছে। এদিকে হরনেটের ডাইভ বোম্বার এয়ার গ্রুপের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার স্ট্যানহোপ রিংয়ের বিমানবহর দিক ভুল করে বসে আছে। ২৬৫ ডিগ্রির বদলে ২৪০ ডিগ্রিতে গিয়ে শত্রুর দেখা না পেয়ে ফিরে আসেন। এই ভুলের কারণে ১০টি বিমান জ্বালানি তেলের অভাবে সাগরে বিধ্বস্ত হয়। 

ক্রুজার এস্টোরিয়ার সামনে ফুয়েলের অভাবে ক্রাশ করা একটি মার্কিন বিমান (বামে) ও মিডওয়ে দ্বীপের সাপেক্ষে ক্যারিয়ারের অবস্থান; Image source : theatlantic.com 

অন্যদিকে হরনেটের টর্পেডো বোম্বার এয়ার গ্রুপের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জন ওয়ালড্রন তার গ্রুপের বিমান নিয়ে সঠিক দিকে এগিয়ে যান এবং সকাল সোয়া নয়টায় আক্রমণ শুরু করেন। কিন্তু ডাইভ বোম্বারের সাপোর্ট ছাড়া একা একা টর্পেডো বোম্বার দিয়ে আক্রমণ সফলতা পাওয়া মুশকিল। ওয়ালড্রনকে সাহায্য করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে ওড়ে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের ডাইভ বোম্বার ও ফাইটার গ্রুপ। কিন্তু ওয়ালড্রনের গ্রুপের কপাল খারাপ বলতেই হবে। টেকঅফ করার পর তাদের ফাইটার এস্কর্ট বিমানগুলোর সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটারগুলো ফুয়েলের অভাবে এন্টারপ্রাইজে ফেরত যায়।

তারা না থাকায় জাপানি এন্টি এয়ারক্রাফট গান ও কমব্যাট এয়ার পেট্রোল গ্রুপের ফাইটারের হামলায় ১৫টি TBD Devastators বিমানের সবগুলো ভূপাতিত হয়। এদের কেউই জাপানি ক্যারিয়ারের হামলার ক্ষেত্রে সফল হয়নি। একজন বাদে ৩০ পাইলট-ক্রুর সবাই নিহত হয়। পরবর্তীতে এন্টারপ্রাইজের টর্পেডো বোম্বার গ্রুপের ১৪টির মধ্যে ৯টি ও ইয়র্কটাউনের ১২টির মধ্যে ১০টি TBD Devastator বিমান ধ্বংস হয়। এদের কেউই চারটি জাপানি ক্যারিয়ারের একটিতেও টর্পেডো হামলা করতে পারেনি। আমেরিকান মার্ক ১৩ টর্পেডো ক্ষেত্রবিশেষে আঘাত করেও বিস্ফোরিত হয়নি বা জাহাজের নিচ দিয়ে চলে গেছে যা যুদ্ধের পর ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধের বাজে পারফর্মেন্সের কারণে উক্ত টর্পেডো ও বিমানকে অবসরে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। 

ইউএসএস হরনেট থেকে টেকঅফ করার আগমুহূর্তে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জন ওয়ালড্রনের বিমানটি (বামে)
তার গ্রুপের TBD Devastator বিমানগুলো ছিল জিরো ফাইটারের সহজ টার্গেট; Image source : centuryinter.net
৪ জুন, ১৯৪২ সালের সকালে তোলা ছবিতে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের ফ্লাইট ডেকে টর্পেডো বোম্বার। এই স্কোয়াড্রনের ১৪টির মধ্যে ১০টি বিমান ধ্বংস হয়েছিল; Image source : theatlantic.com

প্রথম দফার ব্যর্থ আক্রমণে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রত্যাশিত ফলাফল পায় যুক্তরাষ্ট্র।

প্রথমত, মার্কিন ক্যারিয়ারের উপর হামলা করার জন্য এয়ারক্রাফট লঞ্চ করার কিছুক্ষণ আগে মার্কিন টর্পেডো বোম্বারগুলো আক্রমণে আসে। ফলে এডমিরাল নাগুমোর পাল্টা হামলার জন্য পরিকল্পনা আরো ৩০ মিনিটের জন্য পিছিয়ে যায়। আক্রমণ চলাকালে একাধিক বিমান লঞ্চ করা অসম্ভব। এই সময়ের ইয়র্কটাউনের এডমিরাল ফ্লেচার তার বিমানগুলোকে প্রস্তুত করে ফেলেন।

দ্বিতীয়ত, একাধিক গ্রুপের আক্রমণে মার্কিন কমব্যাট এয়ার পেট্রোল বা CAP ফাইটারগুলো ছিল খাপছাড়া। তারা যে প্রতিরোধ করতে সক্ষম না সেটা বোঝা যায়। সকাল দশটায় ইয়র্কটাউনের টর্পেডো বোম্বার হামলার সময় সকল CAP ফাইটার তাদের পিছনে ছুটছিল। এই সুযোগে ডাইভ বোম্বারগুলো জাপানিদের মারাত্মক ক্ষতি করে।

তৃতীয়ত, CAP এর জিরো ফাইটারগুলোতে ফুয়েল ও অস্ত্র সংকট শুরু হয়েছে। এডমিরাল নাগুমো মার্কিনিদের উপর কাউন্টার স্ট্রাইকের জন্য এয়ারক্রাফট লঞ্চ শুরু করায় জাহাজের ফ্লাইট ডেকে এত ব্যস্ততা যে জাপানি CAP ফাইটারগুলো ফুয়েল ও অস্ত্র রিলোড করার সময় পায়নি। ইতিহাসবিদ জোনাথন পার্শাল ও এন্থনি টুলির মতে, এডমিরাল নাগুমো যদি পাল্টা হামলার চেয়ে CAP এর জিরো ফাইটারগুলোকে বাড়তি মনোযোগ দিতেন, তবে এরা আকাশযুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে জাপানি ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারত।

জাপানি কমব্যাট এয়ার পেট্রোল গ্রুপের মূল শক্তি ছিল জিরো ফাইটারগুলো; Image source : wallpaperflare.com

মার্কিনিদের দ্বিতীয় দফা হামলা

এডমিরাল ইয়ামামোতো মিডওয়ের যুদ্ধের রণকৌশলে কোনো সাবমেরিন রাখেননি। কিন্তু জাপানিদের চাপে রাখতে এডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিটজ ঠিকই সাবমেরিন ব্যবহার করেছিলেন। প্রথম দফা মার্কিন বিমান হামলায় যখন জাপানি যুদ্ধজাহাজগুলো এঁকেবেঁকে টর্পেডো ফাঁকি দিতে, ব্যস্ত তখনই এডমিরাল নাগুমোর বহরের ব্যাটলশিপ কিরিশিমাকে লক্ষ্য করে টর্পেডো ফায়ার করে মার্কিন সাবমেরিন ইউএসএস নটিলাস! দুষ্ট বালকের মতো হঠাৎ বড় বড় যুদ্ধজাহাজের লড়াইয়ের মাঝখানে ঝামেলা পাকানো শুরু করেছে ছোট্ট সাবমেরিনটি। তাকে ডেপথ চার্জ মেরে ধ্বংসের জন্য এগিয়ে যায় ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ আরাশি।

উল্লেখ্য, এখানে সাবমেরিনের হামলা বা ডেস্ট্রয়ারের পাল্টা হামলা- কারোটাই সফল হয়নি। কিন্তু পুরো যুদ্ধে এই ঘটনার প্রভাব ব্যাপক। প্রায় একই সময়ে দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছিল এন্টারপ্রাইজ ও ইয়র্কটাউনের ডাইভ বোম্বার গ্রুপের তিন স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান। কমান্ডার ওয়েড ম্যাকলাস্কির এন্টারপ্রাইজ এয়ার গ্রুপের বিমানগুলো ফুয়েল সংকটে ভুগছে। কারণ তারা জাপানি ক্যারিয়ার এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জন ওয়ালড্রনের ধ্বংস হওয়া টর্পেডো বোম্বার গ্রুপকে খুঁজতে গিয়ে ফুয়েল অপচয় করেছে। তারপরও ম্যাকলাস্কির ভাগ্য ভালো বলতেই হবে। তিনি নিজের অনুমানের উপর ভিত্তি করে করে উত্তর-পশ্চিম দিকে কোর্স পরিবর্তন করেন এবং সাবমেরিন নটিলাসের উপর ব্যর্থ ডেপথ চার্জ হামলা শেষে নাগুমোর বহরে ফেরত যাওয়া ডেস্ট্রয়ার আরাশিকে দেখতে পান। তাকে মেঘের আড়ালে থেকে উপর থেকে অনুসরণ করে জাপানি ক্যারিয়ারের খোঁজ পেয়ে যান।

ফ্লিট কমান্ডার চেস্টার নিমিটজ যুদ্ধ পরবর্তী রিপোর্টে ম্যাকলাস্কির এই ঝুঁকিপূর্ণ ও সাহসী সিদ্ধান্ত ‘Most important decision during battle of Midway‘ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ফলে তিন স্কোয়াড্রনের যুদ্ধবিমান প্রায় একই সময়ে জাপানিদের উপর বিনা বাধায় হামলা চালায়। চারটি জাপানি ক্যারিয়ারের CAP গ্রুপের ফাইটারগুলো ইয়র্কটাউনের টর্পেডো বোম্বার নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আবার ফ্লাইট ডেকে উড্ডয়নের অপেক্ষায় থাকা জাপানি বিমানগুলোতে হয় অস্ত্র লাগানো হচ্ছে নাহয় ফুয়েল লোড হচ্ছে। ফলে মার্কিন আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।

মার্কিন ডাইভ বোম্বারের আক্রমণ

সকাল ১০:২২ মিনিটে এন্টারপ্রাইজের দুই স্কোয়াড্রন সিদ্ধান্ত নেয় তারা ডিভিশন ১ এর জাপানি ক্যারিয়ার ‘কাগা’ ও ‘আকাগি’তে আলাদাভাবে বোমা ফেলবে। কিন্তু যোগাযোগ বিভ্রাটের কারণে দুটো স্কোয়াড্রনের বিমানই দুদিক থেকে ‘কাগা’র উপরেই বোমা ফেলে। দ্বিতীয় স্কোয়াড্রনের লিডার লেফটেন্যান্ট রিচার্ড হ্যালসি বেস্ট ও তার দুই উইংম্যান (অপর বিমানের পাইলট) ভুল বুঝতে পেরে যখন ডাইভ দেয়া বাতিল করেন, ততক্ষণে কমান্ডার ওয়েড ম্যাকলাস্কির গ্রুপের আক্রমণে জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কাগা কমপক্ষে চারটি বোমা হজম করে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে। ৫০০ পাউন্ডের একটি বোমা কাগার ব্রিজ (ক্যাপ্টেন যেখান থেকে জাহাজ চালান) এর সামনে থাকা গ্যাসোলিন ট্যাংকে আঘাত করে এবং ক্যাপ্টেন ওকাদাসহ জাহাজের বেশিরভাগ সিনিয়র অফিসার নিহত হন। এই বোমাটি লেফটেন্যান্ট ক্লারেন্স ডিকিনসন ফেলেছিলেন।

আকাগিতে হামলার সময় ক্ষতিগ্রস্ত ডাইভ বোম্বার (বামে) ও ইউএসএস হরনেটে একটি বিমান ল্যান্ড করতে এসে আরেকটু হলেই সিগন্যাল অফিসারকে মেরে ফেলতো (ডানে); Image source : theatlantic.com

এর কয়েক মিনিট পর ভুল শুধরে লেফটেন্যান্ট রিচার্ড হ্যালসি বেস্ট ও তার দুই উইংম্যান আকাগির উদ্দেশ্যে ডাইভ শুরু করেন। কিন্তু ভুলক্রমে দুই স্কোয়াড্রনের ৮৫% শক্তি একটি ক্যারিয়ারের পেছনে শেষ হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে জাপানি এন্টি এয়ারক্রাফট মেশিনগানের মুহুর্মুহু গুলিবৃষ্টির মুখে তার দুই উইংম্যান তাদের বোমাগুলো জাহাজে ঠিকমতো ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। লেফটেন্যান্ট রিচার্ড হ্যালসি বেস্ট এবার দেখিয়ে দিলেন কেন তার নাম বেস্ট!

ডাইভ বোম্বারগুলো সাধারণত ১৪ হাজার ফুট উপর থেকে ঈগলের মতো ডাইভ শুরু করে। তারপর ৩ হাজার থেকে ১ হাজার ফুট উচ্চতায় এসে বোমা ছেড়ে দেয়। লেফটেন্যান্ট রিচার্ড বেস্ট ৫০০ ফুটের কম উচ্চতায় এসে একটিমাত্র বোমা ফেলেন। সেটিই আকাগির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আর্মার পিয়ারসিং বোমাটি ফ্লাইট ডেকের এলিভেটর ভেদ করে হ্যাঙ্গারে ঢুকে গিয়ে বোমা ও ফুয়েল ভর্তি রিজার্ভ বিমানগুলোর উপর বিস্ফোরিত হয়। খুব নিচে নেমে আসায় ক্ষণিকের জন্য বিমানের কন্ট্রোল হারিয়েছিলেন রিচার্ড বেস্ট। তিনি জাপানি ফ্লাইট ডেকের সামান্য উপর দিয়ে উড়ে যান। তার বোমাটির বিস্ফোরণের পর জাপানি ফুয়েল, অস্ত্রের দ্বিতীয় দফার বিস্ফোরনের আগুনের গোলা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে আরেকটু হলেই নিজের বোমায় নিজেই মারা পড়তেন। বিশাল জাহাজ আকাগির ভেতরভাগ বিদীর্ণ করে দিয়েছিল ঐ একটিমাত্র বোমা।

তরুণ ও মধ্য বয়সে লেফটেন্যান্ট রিচার্ড হ্যালসি বেস্ট (ডানে) ও তাঁর ডাইভ বোম্বার স্কোয়াড্রন (বামে-প্রথম বিমান); Image source : wikipedia.org 

লেফটেন্যান্ট রিচার্ড বেস্টের অপর উইংম্যানের একটি বোমা জাহাজের পেছনের পানিতে বিস্ফোরিত হয়, যা প্রপেলার ও রাডার ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে আকাগির ইঞ্জিন চালু থাকলেও জাহাজটি ডানে-বামে যাওয়ার সক্ষমতা হারায়। এদিকে কমান্ডার ম্যাক্স লেসিলির নেতৃত্বাধীন তৃতীয় স্কোয়াড্রন (ইয়র্কটাউন গ্রুপ) এর ডাইভ বোম্বারগুলো ক্যারিয়ার ডিভিশন ২ এর ক্যারিয়ার সরয়ুর উপর আক্রমণ চালায়। বিশাল জাহাজটি তিনটি বোমা হজম করে এবং সেগুলোর আগুন ফুয়েল রিজার্ভ স্টেশন ও যুদ্ধবিমানের অস্ত্রগুদামে ছড়িয়ে পড়ে।

ইয়র্কটাউন টর্পেডো বোম্বার গ্রুপ অপর ক্যারিয়ার হিরয়ূতে আক্রমণ করে এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়। মাত্র ছয় মিনিটের মধ্যে সরয়ূ এবং কাগাতে পুরো জাহাজ জুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে নাবিকদের জাহাজ ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এডমিরাল নাগুমো হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তার ফ্ল্যাগশিপ আকাগি একটিমাত্র বোমা হজম করেছিল বিধায় ধীরে ধীরে পুড়ছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব জেনে ক্রুদের জাহাজ ত্যাগে নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি নিজেই সন্তানতুল‍্য আকাগিকে ত্যাগ করতে পারছিলেন না। রিয়ার এডমিরাল কুসাকা তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করান। সকাল পৌনে এগারোটায় নিজের ‘এডমিরাল ফ্ল্যাগ’ লাইট ক্রুজার শ্রেণীর জাহাজ ‘নাগারা তে হস্তান্তর করে জাহাজ ত্যাগ করেন। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল আকাগিকে অন্য জাহাজ দিয়ে টেনে জাপানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি, পরদিন ভোর পাঁচটায় আকাগি ডুবে যায়। আগের দিন বিকাল চারটায় সরয়ূ এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কাগা ডুবে যায়।

ততক্ষণে আরেক দফা হামলা হয়েছে অপর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হিরয়ূতে। আগুনে পুড়ছে জাপানের শেষ সম্বল। এভাবে মিডওয়েতে মাত্র ১৫ ঘন্টায় চার চারটি শক্তিশালী এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হারিয়ে প্যাসিফিক থিয়েটারে জাপানের কোমর ভেঙে যায়। এই যুদ্ধের ক্ষতির প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে।

(চলবে)

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-১): যে কারণে মার্কিন বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করেছিল জাপান

২) ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-২): জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি

৩) ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-৩): মার্কিন ঘাঁটিতে জাপানি বিমান হামলা

Related Articles

Exit mobile version