প্রত্যেক ইস্টারের সোমবারে, ইংল্যান্ডের বিডেনডেন গ্রামে এক অভিনব দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিবছর এই দিনটায় ‘বিডেনডেন কুমারীদের দান’ নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একটা পুরোনো দালান থেকে চা, পনির আর পাউরুটি দেয়া হয় বৃদ্ধ আর অসহায় বিধবাদের। তাছাড়াও অসংখ্য বিডেনডেন কেক বিলি করা হয় স্থানীয়দের মাঝে। শত বছর ধরে চলে আসা এই অনুষ্ঠান দেখতে ভিড় করা অজস্র মানুষও কেক পায়। কেকগুলোতে খোদাই করা থাকে দুজন নারীর ছবি, দেখলে মনে হয় তাদের শরীর একসাথে যুক্ত। প্রচলিত গল্পে বলা হয়, এই দুই নারী এভাবেই যুক্ত হয়ে জন্মেছিলেন ১১০০ সালের দিকে। তারপর একসাথেই ৩৪ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। এরাই বিখ্যাত বিডেনডেন কুমারী।
গল্প অনুযায়ী, মেরী আর এলিজা চোখার্স্ট ১১০০ সালের কাছাকাছি সময়ে বেশ ধনী পরিবারে জন্মেছিলেন। তাদের কাঁধ আর কোমরের নিচ থেকে যুক্ত ছিল, কেউ কেউ বলে তাদের দুজনার খুব মিল ছিল। আবার কোনো কোনো সূত্র বলে তাদের তেমন মিল ছিল না, এমনকি ছোটখাটো ঝগড়াকেও তারা মারামারির পর্যায়ে নিয়ে যেত। ১১৩৪ সালে মেরি ভয়ানক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ডাক্তার আর পরিবারের লোকজন চেয়েছিল সার্জারির মাধ্যমে মেরির মৃতদেহকে আলাদা করে দিতে। কিন্তু বাদ সাধে এলিজা। সে বলে,“যেহেতু আমরা একসাথে এসেছি, তাই একসাথেই চলে যাব।” মেরি মারা যাওয়ার ছয়ঘণ্টা পর এলিজা মারা যায়।
তাদের একসাথে করা উইলে বলা ছিল মৃত্যুর পর দুজনের অধিকারে থাকা পাঁচটা প্লট, বা ২০ একর জমি চার্চের কাছে চলে যাবে। এর ভাড়া থেকে যে টাকা আসবে, তা অসহায় লোকদের মাঝে বিলি করা হবে। ১৬০৫ সালের ইস্টারে ক্যান্টারবেরির আর্চডিকন বিডেনডেন চার্চ পরিদর্শনে যান। সেদিন তিনি এমন কোনো আয়োজন দেখতে পাননি। বিডেনডেন চার্চ কর্তৃপক্ষ তখন এতটাও দানশীল ছিল না। কিন্তু ক’ বছর যেতেই এর কার্যক্রম আবার শুরু হয়। বিডেনডেন কুমারীদের দান করা জায়গাটার নাম রাখা হয়েছিল ‘রুটি আর পনিরের জায়গা’।
১৬৪৫ সালে রেক্টর উইলিয়াম হরনার নামে এক ব্যক্তি চার্চের নামে মামলা ঠুকে দেন। তার বক্তব্য ছিল রুটি আর পনিরের এই বিখ্যাত জমি আসলে বিডেনডেন কুমারীদের নয়, বরং সাধারণের ক্ষেত জমি। মামলাটা তিনি হেরে যান। অষ্টাদশ শতক থেকে ইস্টারের দিনে বিকালে দান করা শুরু করা হতো। বিডেনডেন কুমারীদের দানে আগ্রহী পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছিল। অনেকেই মূল দানসামগ্রী পেত না। তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হত কুমারীদের ছবি আঁকা বিডেনডেন কেক নিয়ে। চার্চ কর্তৃপক্ষ ছাদ থেকে জনতার ভিড়ের মাঝে কেক ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিত। অষ্টাদশ শতকের এই জনপ্রিয়তা নিয়ে চার্চ একটি সমাধিফলক বসায়। সেটাকে বিডেনডেন তরুণীদের চিহ্ন বলে মনে করা হয়।
অষ্টাদশ শতকের সূত্রগুলো পরীক্ষা করলে বোঝা যায়, তখনকার মানুষের জন্য এই প্রথা আরো আগে থেকে চলে আসছে। ১৭৭০ সালে ‘জেন্টেলম্যানস ম্যাগাজিন’ নামের একটি পত্রিকায় অজানা কোনো ব্যক্তির লেখা থেকে জানা যায় এই নারীরা শুধু কোমরের নিচ থেকে যুক্ত ছিলেন, শরীরে আলাদা দুটি স্থানে জোড়া থাকার কথা শোনা যায়নি। তিনি আরো লেখেন এই নারীদের নির্দিষ্ট কোনো নাম জানা যায় না। তখনকার প্রচলিত সত্য হিসেবে ম্যাগাজিনের লেখক কোন সূত্র থেকে তার তথ্যগুলো পেয়েছেন, তা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু বিডেনডেন কুমারীরা আসলেও ছিলেন কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে যখন এডওয়ার্ড হ্যাস্টেডের কেন্টের ইতিহাসে বলা হয় বিডেনডেন কুমারী বলে আসলে কেউ ছিল না। এটা আমাদের সমাজের সত্যকে অতিরঞ্জিত করে রূপকথায় রূপান্তরিত করার সহজাত অভ্যাস। তার মতে, এই দান করা জমি কোনো নারীর ছিল না। বিডেনডেনে আগে থেকেই এমন দানের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। আর কেকে আঁকা দুই রমণী খুব সম্ভবত দরিদ্র দুই বিধবা ছিলেন, যাদের শরীরও আলাদা ছিল। তারা এই দানের অংশ ছিলেন। আকস্মিক মৃত্যুর পর দান কার্যক্রমের পেছনে তাদের নাম অনায়াসে যুক্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বিডেনডেন কেকে তাদের ছবি আঁকার চল শুরু হয়। কিন্তু ষোড়শ শতকে ফিরে তাকিয়েও আমরা বিডেনডেন কুমারীদের অস্তিত্ব পাই। তাদের থাকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল হর্নারের মামলার রায়। এখানে উল্লেখ করা আছে ষোড়শ শতাব্দীতেই এটা কয়েক শতক ধরে চলে আসা ঐতিহ্য। এবং এমন সব সাক্ষী আছে যারা পারিবারিক সূত্রে জেনে আসছে বিডেনডেন কুমারীদের অস্তিত্ব বা তাদের চার্চে জমি দান করে যাওয়ার ঘটনার সত্যতা। ১৬৫০ সালের ভেতর কুমারীদের শরীরের সংযুক্ততার কথা প্রচলিত সত্য হয়ে যায়। তাই এডোয়ার্ড হ্যাস্টেডের দাবিকে বেশ জোরালোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয়। সাক্ষাতে কোথাও কুমারীদের নাম মেরি ও এলিজা চোখার্স্ট বলে উল্লেখ করা নেই। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত তাদের নাম অজানাই ধরা হতো। তাদের নামের ব্যাপারটা অষ্টাদশ শতকের মানুষদের সংযোজন।
বিডেনডেন কুমারীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করার একটা বড় উপায় হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের আশ্রয় নেওয়া। খোদাই করা কেকে আর লোককথায় বিডেনডেন কুমারীদের সংযোজন কাঁধে আর কোমরের নিচে। দুইজনের শরীরের আলাদা দুটি স্থান সংযুক্ত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল, তাই খুব কম বিশেষজ্ঞই এমন বিরল মিলের কথা স্বীকার করবেন। যেসব জমজরা কোমরের দিক থেকে যুক্ত হয়ে জন্মায়, তাদের অন্য কোথাও জোড়া লাগা থাকে না। বরং হাঁটাচলার সুবিধার্তে তারা একটা করে হাত একে অন্যের কাঁধে দিয়ে চলে।
সংযুক্ত শরীর নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের খুব কম অংশ বেঁচে থাকে। তাদের মধ্যে আরও কম মানুষ পূর্ণবয়স অবধি পৌঁছায়। তাও আবার মধ্যযুগে, যখন চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল ছিল, তখন তাদের এত বছর বেঁচে থাকাটা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী উদাহরণ। হাঙ্গেরির দুই বোন হেলেনা আর জুডিথ অষ্টাদশ শতকে সংযুক্ত বোন হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল। তারা ইউরোপের সবচেয়ে ভালো ভালো চিকিৎসকদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ১৭২৩ সালে ২২ বছর বয়সে তারা মারা যায়। নর্থ ক্যারোলিনাতে মিলি আর ক্রিশ্চিন নামে আরেক সংযুক্ত বোনের জন্ম হয়েছিল ১৮৫১ সালে । মানুষের কৌতূহলের খোরাক জোগাতে তারা তাদের জীবনের বিরাট একটা অংশ ভ্রমণ করে কাটিয়েছে। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে তারা এ কাজ বন্ধ করে দেয়। ১৯১২ সালে যক্ষ্মাক্রান্ত হয়ে মিলি মারা যায়। তার আটঘন্টা পর সংযুক্ত অবস্থাতেই মারা যায় ক্রিশ্চিন। সুতরাং সেই মধ্যযুগে বিডেনডেন বোনেদের ৩৪ বছর বেঁচে থাকা, বা এক বোনের মৃত্যুর পর ৬ ঘণ্টা আরেকজন জীবিত থাকার ঘটনা বিরল হলেও অসম্ভব নয়।
ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দীর কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইয়ে সংযুক্ত যমজের উদাহরণ না পাওয়া গেলেও একাদশ দ্বাদশ শতকের উদাহরণ পাওয়া যায়। ১১১২ সালে সংযুক্ত ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডে, যাদের কাঁধ আর কোমর থেকে জোড়া লাগার কথা বলা আছে। যা অনেকটা বিডেনডেন বোনেদের সাথে মিলে যায়। ১০৯৯ সালের একটা বর্ণনায় বলা আছে দুই বোনের জন্মের কথা, যাদের কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত জোড়া লাগানো। কোনো কোনো বর্ণনায় সালটি ১১০৩ বা ১১০০। এতসব প্রমাণের পর দয়ালু বিডেনডেন কুমারীদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়। তারা হয়ে উঠেছে বিডেনডেন শহরের প্রতীক।
ফিচার ইমেজ-Wikimedia Commons