আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে পেরুতে ছিল ‘চিমু’ নামক এক সভ্যতা। সম্প্রতি এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণারত একদল প্রত্নতাত্ত্বিক খুঁজে পেয়েছেন প্রায় ১৪০টি শিশুর দেহাবশেষ, যেগুলো মূলত সেই সময়কার বলি দেয়া শিশুদের দেহাবশেষ। চিমু সভ্যতা এভাবেই উৎসর্গ করেছিলো তাদের শতাধিক শিশু। ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে নারকীয় শিশু হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু কেন? কী ছিল এর পেছনে? সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টাই করে যাচ্ছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
উত্তর পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে চিমোর অঞ্চলে এ চিমু সভ্যতার বিকাশ ঘটে। এর ঐতিহাসিক সময়কাল ছিল আনুমানিক ১২৫০-১৪৭০ খ্রিস্টাব্দ। এরা মূলত ছিল উত্তর পেরুর উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা। চিমু সভ্যতার মানুষেরা চন্দ্র উপাসক ছিল। তারা চন্দ্রের পূজা করত। চন্দ্র, প্রকৃতি ও দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উৎসর্গ করা ছিল তাদের ধর্মাচরণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
চিমু সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। কৃষিকাজের জন্য তারা জলসেচের এক বিরাট ও জটিল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। মোচে নদী থেকে জলসেচের মাধ্যমে তারা প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে চাষের ব্যবস্থা করেছিল। তাদের মূল ফসল ছিল ভুট্টা ও তুলা। চিমু সভ্যতার সময় মৃৎশিল্পের বেশ বিকাশ ঘটেছিল। চিমুদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলো একটু অন্য ধরনের। প্রায়শই এগুলো দেখতে হতো কোনো না কোনো জীবজন্তুর মতো। এছাড়া ছয়তলযুক্ত কোনো বোতল বা পাত্রের উপরে কোনো দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা ব্যক্তির মূর্তিও অনেকসময় দেখতে পাওয়া যায়। চিমু মৃৎপাত্রগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কালো রঙের ব্যবহার বিশেষ করে চোখে পড়ে। মৃৎশিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করত তারা। মূলত সোনা, রুপা ও তামার মিশ্রণে তৈরি সংকর ধাতুর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় চিমু সভ্যতায়।
চিমু সভ্যতার রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল চান চান। ধারণা করা হয়, এই শহরে এক লক্ষাধিক মানুষ বাস করত। সে হিসেবে এককালে বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম শহর ছিল এই চান চান। পেরুর এই শহরটি পুরোটাই মাটির তৈরি। শহরটিতে ইটের তৈরি বিশাল বিশাল প্রাসাদ দেখতে পাওয়া যায়। ১৪৭০ সালে তাদের শেষ রাজা মিনচামাঙ্কামানের পতন ঘটে ও ইনকা সম্রাট তুপাক ইনকা ইউপানাকির বাহিনী চিমুদের এলাকা দখল করে তাকে ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের আগমণের মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে ঘটা এই যুদ্ধেই স্বাধীন রাজ্য হিসেবে চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে। চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটলেও তারা এ পৃথিবীতে আজীবনের জন্য রেখে যায় এক নারকীয় শিশু হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস।
পুরাতাত্ত্বিকরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিশু বলিদানের ঘটনার সন্ধান পেয়েছেন এই শহরেই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অর্থায়নে পরিচালিত এ আবিষ্কার প্রক্রিয়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির গ্যাব্রিয়েল প্রিয়েতোর নেতৃত্বাধীন একটি দলের অভিযানের মাধ্যমে নারকীয় এ শিশু হত্যাযজ্ঞ সকলের নজরে আসে।
২০১১ সালে ৩,৫০০ বছরের পুরনো একটি মন্দিরের কাছ থেকে ৪২টি শিশু ও ৭৬টি লামার দেহাবশেষ উদ্ধারের পরই এই অভিযান শুরু করে দলটি। এই অভিযানের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী সেসময় বলি দেয়া ১৪০ জন শিশুর কংকাল উদ্ধার করা হয়, যাদের বয়স ছিল ৫-১৪ বছর। তবে বেশিরভাগেরই বয়স ছিল ৮-১২ বছরের মধ্যে। অনেক শিশুর হাড় কেটে ফেলার চিহ্ন দেখা যায়। বুকের পাঁজর ও হাড় দেখেই শনাক্ত করা হয় যে, এগুলো শিশুদের দেহাবশেষ। অনেক কংকালের পাঁজর নষ্ট হয়ে গেছে। মনে করা হচ্ছে, এই শিশুদের হৃৎপিণ্ড খুলে নেয়া হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, ২৬৯ জন শিশুকে এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছিল।
শিশুদের পাশাপাশি লামা নামক এক পশুর ও প্রায় ২০০ কংকাল উদ্ধার করেছে অভিযানকারী দল। এ থেকে পরিষ্কার হয় যে, শিশুদের সাথে লামা নামক পশুকেও বলি দেয়া হয়। লামা মূলত উট জাতীয় একধরনের পশু, যেগুলো এই এলাকার শিশুদের খুব প্রিয়। আর লামাগুলোর বয়স ছিল ১৮ মাসেরও কম। ইতিমধ্যে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে এই নারকীয় শিশু হত্যাযজ্ঞ।
প্রত্নতাত্ত্বিক দলের অন্যতম প্রধান গবেষক গ্যাব্রিয়েল প্রেইতো বলেন,
মানব ইতিহাসে এটি সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। যখন মানুষ শোনে এখানে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, তখন তারা প্রথম যে প্রশ্নটি করে, তা হলো, কেন?
সত্যিই এই ঘটনা জানবার পর একজন মানুষের মনে প্রথম এই প্রশ্নই আসবে, কেন? শিশুগুলোর কী অপরাধ ছিল? নানা সময়ে তারা নানা কিছু উৎসর্গ করতো চন্দ্র ও প্রকৃতিকে খুশি করতে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, এই এলাকাকে অতিবৃষ্টি অথবা বন্যা থেকে রক্ষার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিলো এই শিশুদের। শিশুদের কংকালের সাথে পাওয়া বিভিন্ন কাপড়ের কার্বন পরীক্ষা করে দেখা যায়, ঘটনাটি ১৪০০ থেকে ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঘটেছে।
পৃথিবীর দীর্ঘ মানব ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে নরবলির এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। একসময় প্রকৃতি কিংবা দেব দেবীকে খুশি করবার জন্য নরবলির প্রচলন ছিল অনেক সভ্যতায়। কিন্তু এমন নারকীয় শিশুবলির দৃষ্টান্ত আর কোথাও পাওয়া যায় না। বর্তমান অব্দি সবচেয়ে বড় শিশুবলির ঘটনা হিসেবে দেখা হত মেক্সিকো সিটির টেম্পল মায়োরে ৪২ জন শিশুকে উৎসর্গ করবার সেই নৃশংস ঘটনাকে। কিন্তু চিমু সভ্যতার এই শিশুবলি সকল নৃশংসতাকে ছাপিয়ে গেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেক গবেষণা করেও কোনো লিখিত দলিল কিংবা দস্তাবেজ খুঁজে পাননি যাতে এই শিশুহত্যা সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল থেকে এটা জানা যায় যে, ইনকা সভ্যতায় শত শত শিশুবলি দেয়া হত কোনো রাজার মৃত্যুর পর। কিন্তু চিমুরা ঠিক কী কারণে শিশুবলি দিত তার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল পাওয়া যায়নি।
তবে যেখান থেকে শিশুদের কংকাল উদ্ধার করা হয়, সেখানে শুকনো কাদামাটির স্তুপ পাওয়া যায়। শুকনো কাদামাটি এখানে এককালে অতিবৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, কোনো এককালে এখানে অতিবৃষ্টির কারণে কিংবা এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল এবং ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে চিমু সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছিল, আর তাই নিজেদের সভ্যতা রক্ষায় তারা তাদের শিশুদের বিসর্জন দিয়েছিল। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, সেই সময়কার চিমু জাতির শাসক কিংবা ধর্ম গুরুরা নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থের জন্যই এই উৎসর্গের নির্দেশ দেন।
চিমু সভ্যতার এই শিশুবলি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা ও অনুসন্ধান চলছে। ঠিক কী হয়েছিল চিমু সভ্যতার শিশুদের সাথে তা হয়তো একদিন এই পৃথিবীবাসী জানতে পারবে। কিন্তু যে শিশুদের বিসর্জন দেয়া হয়েছিল, তারা মানব সভ্যতার ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে রইল।