আগের দিনের মানুষরা কি হাসতে জানতো? এমন প্রশ্নের উদ্ভব হওয়া স্বাভাবিক, কারণ আগেকার দিনের ছবিগুলোতে মানুষরা একদমই হাসতো না। দেখলে মনে হবে, তাদের জীবনে কোন সুখ-আহলাদ বলতে কিছু নেই। কোনো এক গভীর বেদনা তাদেরকে চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। যেন সারা দুনিয়া জুড়ে দুর্ভিক্ষ চলছে কিংবা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ জানে যে তারা কবে মারা যাবে! অথবা হয়তো তারা জেনে গেছে মায়ান ক্যালেন্ডারের মতো কোনো এক ক্যালেন্ডারের কথা, যেখানে বলা হয়েছে পৃথিবী আর বেশিদিন বাঁচবে না। অথবা এর চেয়েও কোনো বেদনাদায়ক সংবাদ তারা জানতো, এমনটাই মনে হয় তাদের ছবিগুলো দেখলে।
বর্তমানে সেলফির যুগে মুখ বন্ধ করে গোমড়া মুখে ছবি তুললে যেমন পাপের সমতুল্য কাজ হবে, তেমনি তখন কি মানুষ ভাবতো ছবি তোলার সময় হাসা পাপ? নাকি আগের দিনে ছবি তোলার নিয়মই ছিল এটা? তারা কি কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে অনুসরণ করে এভাবে ছবি তুলতো? নাকি খুব তুচ্ছ কারণ হিসেবে বলা যায়, আগের দিনের ক্যামেরা গুলোতে হাসির ছবিই উঠতো না? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই এই লেখা।
ক্যামেরা দিয়ে সর্বপ্রথম ছবি তোলা হয় উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। তখনও ক্যামেরা মানুষের হাতে হাতে বাণিজ্যিকভাবে পৌঁছায়নি। এখন যেমন ক্যামেরা সবার হাতে হাতেই থাকে, তখন শুধুমাত্র পেশাদার ফটোগ্রাফাররাই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার কাজটি করতেন। খুব ঘটা করেই তখন ছবি তোলা হতো। কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে কিংবা বিশেষ কোনো কাজে পারিবারিক ছবি তোলার বিষয়টি চালু ছিল। খুব বেশি সম্ভ্রান্ত না হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজের ব্যক্তিগত ছবি তোলার প্রচলন ছিল না। সমগ্র উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এই নতুন প্রযুক্তিটি কেবল শিল্পসম্মত কাজে ব্যবহার হয়েছে। সামাজিক কার্যকলাপ, যেমন জন্মদিনের উৎসব কিংবা পার্টি ইত্যাদিতে ক্যামেরার ব্যবহার তেমন একটা দেখা যায়নি।
ফটোগ্রাফির প্রথমদিকে দুয়েকটি ছবিতে হাসি দেখা গেলেও বেশিরভাগ ছবিতেই মানুষদের হাসতে দেখা যায় না। ছবিতে হাসি একটি আদর্শিক অভিব্যক্তি হিসেবে প্রচলিত হতে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। ছবি তুলতে গিয়ে মানুষ গোমড়া মুখ হয়ে থাকবে, এমন ব্যাপারটি এখনকার সময়ে চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু আগের দিনের ছবিগুলোতে মানুষ নির্দ্বিধায় গোমড়া মুখেই ছবি তুলে গেছে। এর পেছনে রয়েছে নানা মুনির নানা মত।
আপনার যদি দাঁত সুন্দর না হয়, তবে আপনি স্বভাবতই চাইবেন মুখ না খুলে ছবি তুলতে। কেউ কেউ ধারণা করেন এটাই ছিল উনবিংশ শতাব্দীর মানুষদের গোমড়া মুখে ছবি তোলার একটি অন্যতম কারণ। তখনও দাঁতের চিকিৎসা প্রযুক্তিগত ভাবে এতটাও উন্নত হয়নি, আর তাই বেশিরভাগ মানুষের দাঁত ছিল বিদঘুটে। যারা এই কারণটিকে সম্মতি দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারির পরিচালক এবং ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ স্মাইল বইয়ের লেখক আঙ্গাস ট্রাম্বেল। তিনি বলেন, সময়ের সাথে সাথে দন্ত চিকিৎসার উন্নতি ঘটে এবং মানুষও মুখ খুলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছবি তুলতে অভ্যস্ত হয়। তবে তার এই ব্যাখ্যার সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। তারা বলেন বিদঘুটে দাঁত খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। যা এখনো দেখা যায়। এটি কখনোই একমাত্র কারণ হতে পারে না। তবে হতে পারে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ কেবল নিজের বিদঘুটে দাঁতের জন্যই না হেসে ছবি তুলতো।
উনবিংশ শতকের ছবিগুলোতে হাস্যরসের অভাবের আরেকটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। তা হলো, প্রযুক্তিগতভাবে তখনকার ক্যামেরাগুলো এতটাই অনুন্নত ছিল যে একটি ছবি ক্যাপচার করার জন্য অনেক সময় লেগে যেত। ইতিহাসে সর্বপ্রথম ক্যামেরায় ছবি তোলা হয় ১৮২৭ সালে। সেই ক্যামেরার অ্যাপারচার টাইম ছিল প্রায় ৮ ঘণ্টা, অর্থাৎ ৮ ঘণ্টা ধরে ছবিটি ক্যামেরায় উঠেছে। এই সুদীর্ঘ অ্যাপারচার টাইমের জন্য ক্যামেরার সামনে থাকা মানুষদের দীর্ঘক্ষণ মুখে স্বাভাবিক হাসি ধরে রাখা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। অনেকসময় হাসি ধরে রাখতে গিয়ে ছবি নষ্ট হয়ে যেত। গোমড়া মুখে ছবি তোলার এই কারণটির সাথে একমত জর্জ ইস্টম্যান জাদুঘরের প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক টড গুস্টাডসন। তিনি বলেন, “যদি ক্যামেরার অ্যাপারচার টাইম অনেক বেশি হয়, তাহলে আপনি ছবি তোলার ক্ষেত্রে এমন একটি সুবিধাজনক অঙ্গভঙ্গি বেছে নেবেন, যা আপনার জন্য কম কষ্টদায়ক হবে।” যেমন বর্তমান সময়ে আমরা সূর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ছবি তুলতে পারি না। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এমন কোনো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হবে, যেখানে সূর্যের আলো আর মানুষের চোখের মাঝে কোন শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক থাকবে না এবং মানুষ নির্দ্বিধায় সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ছবি তুলতে পারবে। আর মজার ব্যাপার হলো, তখন হয়ত মানুষ এখনকার মতোই প্রশ্ন করবে কেন একবিংশ শতাব্দীর মানুষ সূর্যের দিকে মুখ করে ছবি তোলার সময় ভ্রু কুঁচকে থাকতো?
ক্রিস্টিনা কোচেমিদোভা নামক একজন অধ্যাপক তার ‘হিস্স্ট্রি অফ স্মাইল ইন স্ন্যাপশট ফটোগ্রাফি’ বইয়ের উপর লিখিত একটি প্রবন্ধে বলেন “সাধারণভাবে ক্যামেরার বাইরে হাসি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও ক্যামেরার সামনে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হাসতে পারে না”। তার মতে, ক্যামেরার সামনে মানুষের হাসি কখনো প্রাকৃতিক হয় না আর তাই মানুষ ছবি তোলার সময় হাসির কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাতো না। তিনি তার প্রবন্ধে আরও বলেন, “অতীতের রীতি অনুযায়ী, মানুষের পোর্ট্রেট অঙ্কনের সময় মুখ বন্ধ রাখা বাধ্যতা মূলক ছিল।” যেহেতু ক্যামেরা ছিল একটি নব্য প্রযুক্তি, কিন্তু চিত্রাঙ্কন অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল তাই পোর্ট্রেটের রীতিনীতি ক্যামেরায় ছবি তোলার ক্ষেত্রে মান্য করা হতো, আর সেজন্যই আগের দিনের মানুষরা গোমড়া মুখে ছবি তুলতো বলে তার এবং অনেকের ধারণা।
উনবিংশ শতাব্দীতে ফটোগ্রাফি ছিল পেইন্টিংয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি শিল্পকর্ম। যেখানে হাসিকে ধরা হতো পাগলামি এবং মাতলামির প্রতিক্রিয়া হিসেবে, তাই ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও যেমন হাসা নিষেধ ছিল, তেমনি চিত্রকর্মের নব্য প্রযুক্তি ক্যামেরার ক্ষেত্রেও এই নিয়ম অনুসরণ করা হতো। উঁচু মানের পেশাদার ছবি কারিগররা ছবি তোলার জন্য একটি ভদ্র ও মার্জিত অঙ্গভঙ্গি নির্বাচন করে দিতেন, যা তখনকার সময়ে ভদ্র মুখাবায়ব হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে আমাদের কাছে রাশভারি এবং গম্ভীর মুখাবয়ব হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু ক্যামেরার প্রারম্ভিক সময়ে এমন কিছু স্বল্প অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার ছিলেন যারা ছবি তোলার ক্ষেত্রে কোনো রীতি মানতেন না। ছবি তোলার সময় তারা ক্যামেরার সামনের মানুষদের সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত মুখাবয়ব প্রকাশের সুযোগ দিতেন। ১৮৪৭ সালের মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধে দুই কর্মকর্তার একটি ছবিতে দেখা যায়, একজন হাসছেন। ১৮৫৩ সালে পোকার খেলার একটি ছবিও রয়েছে যেখানে একজন হাসিখুশি মানুষকে তার কার্ড হাতে দেখা যায়। এছাড়া ১৮৬০ সালের একটি ছবিতে দেখা যায় এখন মানুষ বক্সিংয়ের পোশাক পড়ে হাসিমুখে ছবি তুলছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্কুলের ১৯০৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সব ছাত্র-ছাত্রীদের ছবিতে তাদের মুখের কার্ভেচারের উপর একটি গবেষণা করা হয়। যেখানে দেখা যায় সময়ের সাথে সাথে তাদের মুখের গড় বক্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূলত উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ধীরে ধীরে গোমড়া মুখে ছবি তোলার যে সংস্কৃতি, তা পরিবর্তিত হতে শুরু করে। পরিবর্তনটা শুরু হয় অপেশাদার ফটোগ্রাফারদের হাত ধরে। অপেশাদার ফটোগ্রাফাররা মানুষ নিজেকে ছবিতে কীরূপে দেখতে চায়, তা বেশি প্রাধান্য দিতে শুরু করে। যার ফলে মানুষ ক্যামেরার সামনে স্বতঃস্ফূর্ত ছবি তোলার সাহস অর্জন করে। ধীরে ধীরে ফটোগ্রাফি আর পেইন্টিং নিজেদের সুবিধাগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে শুরু করে। চিত্রশিল্পীরা ফটোগ্রাফির স্বচ্ছতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা অনুকরণ করার চেষ্টা করে, আর ফটোগ্রাফাররা সূক্ষ্ম চিত্রকর্মের কারুকার্য তৈরি করতে চেষ্টা করে। ১৮৯৫ থেকে ১৯১৪ সালে এডওয়ার্ডিয়ান সময়ে হাতে আঁকা পোর্ট্রেটগুলোতে মানুষদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে দেখা যায় এবং এই সময়ে ফটোগ্রাফিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
ছবিতে হাসিমুখের প্রচলক হিসেবে অপেশাদার স্বতঃস্ফূর্ত ফটোগ্রাফারদের অবদান অনস্বীকার্য, এ কথা সত্য। তবে ছবিতে স্বতঃস্ফূর্ততা আনার ক্ষেত্রে কোড্যাক ক্যামেরার প্রভাব তার চেয়েও বেশি বলে মনে করেন অনেকেই
কোড্যাক ক্যামেরার হাত ধরে স্ন্যাপশট ফটোগ্রাফির যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৮ সালে। কোড্যাক ক্যামেরা মানুষের জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে কোড্যাক শব্দটি থেকে আমেরিকান ইংরেজি ভাষায় সেসময় ‘কোড্যাকিং’, ‘কোড্যাকার’ নামক শব্দের উৎপত্তি ঘটে। কোড্যাক ক্যামেরার বিখ্যাত স্লোগান ছিল “ইউ প্রেস দ্যা বাটন, উই ডু দ্যা রেস্ট।” ফটোগ্রাফিকে গম্ভীর শিল্পের বাইরে এনে জনজীবনের নিত্যনৈমিত্তিক অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে কোড্যাকের প্রচার বিজ্ঞাপনের অবদান অনেক বেশি।
কোড্যাকের বিজ্ঞাপনগুলোর প্রতিটিরই মূল ইঙ্গিত ছিল এমন যে ছবি হলো সুখী সময়কে ধরে রাখার একটি অন্যতম মাধ্যম। আর সুখ মানেই হাসি । কোড্যাকের বিজ্ঞাপনগুলো তাদের পণ্য বিক্রিতে যতটা সহায়তা করেছিল, তার চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলে উনবিংশ শতাব্দীর ছবি তোলার রীতি নিয়ম-কানুন ভাঙতে। কোড্যাকের পর বিভিন্ন রকমের স্ন্যাপশট ক্যামেরার আবিষ্কার হয় এবং ধীরে ধীরে ক্যামেরার অ্যাপারচার টাইম আরও কমে আসে। অপেশাদার ফটোগ্রাফাররা স্বতঃস্ফূর্ত ছবি তোলার ক্ষেত্রে আরও বেশি সুবিধা ভোগ করে এবং সময়ের সাথে সাথে গোমড়া মুখে ছবি তোলার নিয়মটিও উঠে যায়।
আগের দিনের মানুষেরা গোমড়া মুখে ছবি তুলতো, তাই বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে আগের দিনের মানুষদের মধ্যে হাস্যরসের বড়ই অভাব ছিল কিংবা তারা মোটেই হাসতে জানতো না। ক্যামেরার সামনে তাদের হাসতে দেখা না গেলেই ক্যামেরার বাইরে তারা বড়ই রসিক মানুষ ছিল। আব্রাহাম লিঙ্কন কিংবা রানী ভিক্টোরিয়ার মতো গম্ভীর রাশভারী মানুষদেরও রসবোধ ছিল। ১৮০০ শতকের মানুষেরা মোটেও অসুখী ছিল না বরং ছিল একটু বেশি প্রথাভাঙ্গন বিরোধী, যার ছাপ হিসেবেই ক্যামেরার সামনে তাদের এত গম্ভীর, রাশভারী আর গোমড়া মুখাবয়ব।
ফিচার ইমেজ- 2guysphoto.wordpress.com