নানা সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কিংবা দুর্ঘটনাবশত অনেক জাহাজ এবং বিমানের সলিল সমাধি হয়েছে সমুদ্রে। সাগরের তলদেশে ঠাঁই হওয়ার পর এসব জাহাজ কিংবা বিমানের ধ্বংসাবশেষ সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে অনেকখানি। সামুদ্রিক নানা পরজীবীর আক্রমণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী এসব ধ্বংসস্তুপ।
পানির নিচে ফটোগ্রাফি খুবই জনপ্রিয় হচ্ছে ধীরে ধীরে এবং এর সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে ডুবে যাওয়া এসব জাহাজ এবং বিমান সম্পর্কে জানার সম্ভাবনাও বেড়ে গেছে। ফটোগ্রাফাররা সাগরে ডুব দিয়ে ক্যামেরায় বন্দী করছেন এসবের ধ্বংসাবশেষ, চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়ার আগেই। অন্ধকার সমুদ্রগর্ভে এসব ধ্বংসাবশেষের ছবি একধরনের শিহরণ জাগিয়ে তোলে। হতভাগ্য যাত্রীদের এবং ইতিহাসের কোনো একটি অংশের সমাধিস্থল বলা চলে ঐ জায়গাগুলোকে। সেরকমই কিছু ছবি সম্পর্কে বলা হবে। এই তালিকায় আছে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে থেকে ২০-৩০ বছর আগের কোনো দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া জাহাজ কিংবা বিমান।
১. বি-১৭জি ফ্লাইং ক্যাসল (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ)
১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসের ৩ তারিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বি-১৭জি ফ্লাইং ক্যাসল নামক এই বোমারু বিমানটি শত্রুপক্ষের আক্রমণের শিকার হয়। একপর্যায়ে বিমানটিতে আগুন ধরে যায় এবং ক্রোয়েশিয়ার ভিস দ্বীপের কাছে বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় নিহত হন বিমানটির কো-পাইলট আর্নেস্ট ভিয়েনা। ২০১৬ সালে ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার স্টিভ জোনস এই ছবিটি তোলেন। এত বছর পরেও প্রায় ৭২ মিটার গভীরে মূল আকৃতি অক্ষুণ্ন রেখে এখনও টিকে আছে। ছবিটি তোলার পর বিমানটির কো-পাইলটের পরিবার কথা বলে স্টিভ জোনসের সাথে এবং জানায় এই প্রথমবারের মতো আর্নেস্ট ভিয়েনার সমাধিস্থল দেখতে পেল তারা।
২. ব্রিটিশ সুপার ড্রেডনট এইচএমএস অডেসিয়াস (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ)
ব্রিটিশ সুপার ড্রেডনট এইচএমএস অডেসিয়াস ছিলো প্রথম ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ যেটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হারিয়ে যায়। ঐ সময়ে এই ধরনের যুদ্ধজাহাজগুলো ছিলো সবচেয়ে বড় এবং ব্যয়বহুল। বিশাল আকারের কামান, শক্তিশালী ইঞ্জিন এবং অসাধারণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সব মিলিয়ে শত্রুশিবিরে ত্রাস সৃষ্টি করার মতো যা যা দরকার তার সবই ছিলো ওই যুদ্ধজাহাজগুলোতে। কিন্তু ছোট একটা ভুলের কারণে শত্রুপক্ষের মাইনের আঘাতে বিষ্ফোরিত হয় জাহাজটি। ডুবে যাওয়ার আগে জাহাজটিকে যতটুকু সম্ভব আয়ারল্যান্ডে বীচের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ডুবতে থাকায় শেষপর্যন্ত কর্মকর্তারা জাহাজটি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ছবিটিতে যুদ্ধজাহাজটির সিলিন্ডার আকৃতির বিশাল বর্ম দেখা যাচ্ছে। এই ছবিটিও তুলেছেন স্টিভ জোনস। তিনি বলেন, কয়েক বছরের পর প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ডুবে যাওয়া এসব জাহাজের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না সমুদ্রগর্ভে।
৩. সালেম এক্সপ্রেস (১৯৯১)
১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মিশরের সাফাগা থেকে সৌদি আরবের জেদ্দা বন্দরে যাওয়ার পথে লোহিত সাগরে সালেম এক্সপ্রেস নামক একটি ফেরি ডুবে যায়। লোহিত সাগরের প্রবাল-প্রাচীরের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলো ফেরিটি। রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৬৯০ জন যাত্রী ছিলো ওই ফেরিটিতে এবং ধারণা করা হয় কমপক্ষে ৪৭০ জনের মতো মারা গিয়েছিলো ওই দুর্ঘটনায়। ২০১০ সালে ফটোগ্রাফার অ্যাডাম হরউড যখন ছবি তোলার জন্য প্রায় ৬০-৭০ মিটার নিচে ফেরিটির কাছে পৌঁছান, তখন তিনি যাত্রীদের ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্র দেখতে পান। সেখানে গিয়ে এক আশ্চর্য বিষাদে ভরে ওঠে মন। তার ভাষ্যমতে, সময় যেন সেখানে স্থির হয়ে আছে।
৪. গিয়ানিস ডি (১৯৮৩)
গিয়ানিস ডি হচ্ছে একটি জাপানে তৈরী কার্গো জাহাজ। ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে জাহাজটি যুগোস্লাভিয়ার রিজেকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলো। সুয়েজ খাল হয়ে সৌদি আরবের জেদ্দায় যাওয়ার কথা ছিলো জাহাজটির। সুয়েজ খাল পার হয়ে জাহাজটি যখন লোহিত সাগরে এসে পড়লো তখন জাহাজের ক্যাপ্টেন জুনিয়র এক অফিসারকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে কেবিনে গেলেন একটু বিশ্রাম নিতে। কিছুক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারলেন জাহাজটির সাথে কিছু একটার ধাক্কা লেগেছে। কেবিনের বাইরে বের হয়ে দেখলেন গতিপথ পাল্টে গিয়ে জাহাজটি সাদ আবু নুহাস প্রবাল-প্রাচীরের উপর দিয়ে পূর্ণ গতিতে চলছে! প্রবাল-প্রাচীরের ধাক্কায় এরপরই কার্গো জাহাজটি ডুবতে শুরু করে। যদিও এই ঘটনায় কেউ মারা যায়নি। প্রায় ২৪ মিটার গভীরে থাকা এই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পর্যটকদের জন্য এখন একটি আকর্ষণীয় জায়গা। ছবিটির ফটোগ্রাফার অ্যান্ডার্স নাইবার্গ যেকোনো খুটিনাটি বিষয় ক্যামেরাবন্দী করতে পছন্দ করেন আলোর কারসাজির মাধ্যমে। এই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, জাহাজের বাইরে থেকে আলো জানালাগুলো দিয়ে ভিতরে আসছে যা পানির নীচের অন্ধকারকে দূর করে ছবিটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
৫. এসএস হর্নস্টেইন (১৯০৫)
এসএস হর্নস্টেইন ছিলো একটি জার্মান কার্গো স্টিমার। এটি বাল্টিক সাগরে যাতায়াত করতো। ১৯০৫ সালের ১৬ নভেম্বর সালভো প্রাচীরের কাছে প্রবালের ধাক্কায় ডুবে যায় এই কার্গো স্টীমারটি। ডুবে থাকা স্টিমারটির ধ্বংসাবশেষের এই ছবিটিও তোলেন অ্যান্ডার্স নাইবার্গ। তার মতে, সাগরের নিচে এ ধরনের ছবির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ধ্বংসাবশেষের গায়ে জমে থাকা শ্যাওলা, প্রবাল, রং-বেরংয়ের নানা সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি। ছবি তোলার সময় হঠাৎ তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো একধরনের উজ্জ্বল নীল আলো এবং পরে দেখা গেলো এই আলো আসছে এক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের চোখ থেকে, যা তাদেরকে শিকারকে কাবু করতে সহায়তা করে। সমুদ্রতলের ফটোগ্রাফিতে এগুলো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
৬. ট্রাক লেগুন দ্বীপের কাছে জাহাজ এবং বিমানের ধ্বংসাবশেষ
নিকটতম দেশ থেকেও হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে চুক লেগুন নামক দ্বীপে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক অনন্য নিদর্শন। পূর্বে এই দ্বীপটির নাম ছিল ট্রাক লেগুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্রাক লেগুনে ছিল জাপানের প্রধান এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি, যেখান থেকে সবরকম অপারেশন পরিচালনা করা হতো। যুদ্ধের একপর্যায়ে আমেরিকা যখন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো দখল করে নিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করা শুরু করলো, তখন জাপানের আধিপত্য ক্রমেই কমে আসতে লাগলো। এই সুযোগে আমেরিকা আক্রমণ করলো জাপানের ট্রাক লেগুন ঘাঁটিতে, যা পরিচিত অপারেশন হেইলস্টোন নামে। ১৯৪৪ সালের ১৭ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি এই দুদিন ধরে চলে জাপানের বিরুদ্ধে আমেরিকার এই অপারেশন। জলপথ এবং আকাশপথ উভয়দিক দিয়ে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৬০টির মতো জাপানী জাহাজ এবং কমপক্ষে ২৫০টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে আমেরিকান বাহিনী।
ট্রাক লেগুন দ্বীপটির আশেপাশে ছড়িয়ে আছে এসব জাহাজ এবং বিমানের ধ্বংসাবশেষ। সমুদ্রের নিচে এটাই জাহাজ এবং বিমানের সবচেয়ে বড় সমাধিস্থল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দলিলের একটি। অনেক বোমা থাকার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত ডুবুরীরা এই জায়গাটিতে যাওয়ার সাহস পেত না। তবে সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে পর্যটক, ডুবুরী এবং ফটোগ্রাফারদের কাছে ট্রাক বা চুক আইল্যান্ডে খুবই জনপ্রিয় একটি স্থান।
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনো পাওয়া যায় নিহত জাপানী সৈন্যদের মাথার খুলি কিংবা অন্যান্য হাড়গোড়। অনেক ডুবুরীকে সেগুলো তুলে নিয়ে আসতেও শোনা যায়!
ফিচার ইমেজ © Dive Photo Guide