১৭ মে, ১৯৮৭ সাল। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ তখনও চলছে। যুদ্ধের অংশ হিসেবে দুই পক্ষ একে অন্যের তেল রপ্তানিতে বিঘ্ন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা খুবই খারাপ, খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে তেলনির্ভর বিশ্ব অর্থনীতি। অনেকে বলেন, “তেল যেখানে, আমেরিকাও সেখানে।” তাই স্বাভাবিকভাবেই সেখানে নাক গলানোর জন্য হাজির বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কিছুদিন আগেই মার্কিনপন্থী ইরানের শাসক রেজা শাহকে উৎখাত করেছে ইসলামী বিপ্লবীরা। তাই আয়াতুল্লাহ খোমেনির বদলে পরোক্ষভাবে স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের ইরাককে সাপোর্ট করছিল যুক্তরাষ্ট্র। পার্সিয়ান গালফ অঞ্চলে নিজেদের নৌবাহিনীর উপস্থিতি জানান দিতে হাজির হলো বেশ কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। এদেরকে মিডলইস্ট টাস্কফোর্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদের কাজ ছিল ইরাক-ইরানের এক্সক্লুশন বাউন্ডারির বাইরে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সরবরাহ ঠিক রাখা।
সেসবের মধ্যে একটি ছিল ৪,২০০ টনের ‘অলিভার হ্যাজার্ড পেইরি‘ ক্লাস ফ্রিগেট ইউএসএস স্টার্ক। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সেরা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ছিল এটি। উন্নত রাডার, সেন্সর, ইলেকট্রনিক কাউন্টারমেজার, অ্যাডভান্স ওয়েপন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমসহ এককথায় অসাধারণ।
কিন্তু বিপদ তো আর বলে কয়ে আসে না। আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকাবস্থায় মার্কিন যুদ্ধজাহাজটিকে ইরানি অয়েল ট্যাংকার মনে করে আচমকা হামলা করে বসলো একটি ফরাসি ‘ড্যাসল্ট ফ্যালকন ৫০’ মডিফাইড বিজনেস জেট। এটি মূলত ব্যক্তিগত বিমান বা প্যাসেঞ্জার প্লেন। কিন্তু ইরাকিরা একে মডিফাই করে অ্যান্টি শিপ মিসাইল লাগানোর ব্যবস্থা করে। যদিও মার্কিন নৌবাহিনী একটি মডিফাইড সিভিলিয়ান প্লেনের হাতে মিসাইল হামলার কথা স্বীকার না করে মানসম্মান বাঁচানোর একে ইরাকি বিমানবাহিনীর ফরাসি যুদ্ধবিমান ‘ড্যাসল্ট মিরেজ এফ-ওয়ান’ বলে দাবি করে। কিন্তু মার্কিনিদের দাবি যে মিথ্যা ছিল সেটা পরবর্তীতে প্রমাণও হয়েছিল।
প্রেক্ষাপট
১৯৮৬ সাল, ইরাকি এয়ারফোর্সের প্রধান এয়ার মার্শাল হামিদ শাবানের নির্দেশে গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার মুধের আল ফারহান ইরানি অয়েল ট্যাংকারগুলোর গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করছিলেন। সম্প্রতি তাদের কয়েকটি হামলা ব্যর্থ হয়েছিল, ট্যাংকারগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছিল ইরানি যুদ্ধজাহাজ। তার উপর প্রশিক্ষিত অগ্নিনির্বাপণ কর্মী ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকায় ট্যাংকারগুলোয় আগুন ধরলেও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম ছিল ইরানিরা। মূল সমস্যা হচ্ছে- ইরানিরা বড় ট্যাংকার বহরের সাথে ছোট ছোট শাটল ট্যাংকার যোগ করতো ফায়ার ফাইটার হিসেবে। ফলে কোন ট্যাংকার আসলে তেল পরিবহন করছে সেটি বুঝতে এরিয়াল রিকনসিস মিশন পরিচালনা করা ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু সমস্যা হলো- তৎকালীন ইরাকি এয়ারফোর্সে এ ধরনের গোয়েন্দা মিশন চালানোর মতো কোনো বিমান ছিল না। এসময় এয়ারফোর্সের সাহায্যে এগিয়ে আসে General Military Intelligence Directorate (GMID) এর দুজন কর্মকর্তা। তারা তাদের কর্মকর্তাদের পরিবহনে ব্যবহৃত একটি ‘ড্যাসল্ট ফ্যালকন ৫০’ নামক বিজনেস জেট বিমান ধার দেয়। উল্লেখ্য, বিজনেস জেট বা প্রাইভেট জেট হচ্ছে ছোট আকারের একধরনের বিলাসবহুল যাত্রীবাহী বিমান যেখানে স্বল্প সংখ্যক ভিআইপি পরিবহন করা যায়। ৩ ইঞ্জিনের ৬১ ফুট লম্বা উক্ত বিমানটি দুজন পাইলট ছাড়াও ৮/৯ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারতো। ফ্যা
লকন ৫০ সিরিজের ৩৫২টি বিমান বিভিন্ন দেশের কর্পোরেট/রাষ্ট্রীয় ভিআইপি ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি একটানা ৫,৭০০ কি.মি. পর্যন্ত উড়তে পারতো বিধায় আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ সমাদৃত ছিল ১.৬-৩.৯৫ মিলিয়ন ডলার দামের বিমানটি (১৯৮০-২০০৩ সালের হিসেবে)। ইরাকি গোয়েন্দারা এই বিমানটি বেছে নেন, কারণ ইরাকের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও ইরাকি সামরিক বাহিনী ছাড়াও ইরানের বিমানবাহিনীও এটি ব্যবহার করতো। ফলে গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করতে তাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না।
২৪ জুন, ১৯৮৬ সালে দুজন অভিজ্ঞ ইরাকি মিরেজ যুদ্ধবিমানের পাইলট বিমানটিকে নিয়ে পার্সিয়ান গালফের কমার্শিয়াল করিডোর দিয়ে উড়ে যান। তাদের সাথে ছিল আরেকজন অভিজ্ঞ এরিয়াল রিকনসিস ফটোগ্রাফার। বেশ কয়েকদিন তারা কুয়েত, জর্ডানের আম্মান ও ভারতের মুম্বাইয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করার নাম দিয়ে ইরাকি ট্যাংকার, ভাসমান টি-১৪ লোডিং ডকের লোকেশন সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেন। এই অপারেশন টের পেয়ে গিয়ে ইরানিরা তাদের টি-১৪ ভাসমান টার্মিনালগুলোকে আরো দক্ষিণে সরিয়ে নেয়ার তোড়জোড় শুরু করে। ১২ আগস্ট বিষয়টি টের পেয়ে ইরাকিরা দ্রুত হামলার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ইরানি যুদ্ধবিমানগুলো এবার আকাশে নিয়মিত পেট্রল করতে শুরু করে। ফলে তাদের চোখ এড়িয়ে হামলা করাটা বেশ দুঃসাধ্য হয়ে যায়।
এবার এগিয়ে আসেন ইরাকি এয়ারফোর্সের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার আত্যিয়া। তিনি ইরাকি এয়ারফোর্স এর Mirage F.1EQ-5 যুদ্ধবিমানের Cyrano IV-C5 ফায়ার কন্ট্রোল রাডার উক্ত ড্যাসল্ট ‘ফ্যালকন ৫০’ বিমানে লাগানোর প্রস্তাব দেন, যাতে যাত্রীবাহী বিমান থেকেই এবার মিসাইল হামলা করা সম্ভব হয়! ইরাকি ইঞ্জিনিয়াররা অ্যান্টি শিপ মিসাইল লঞ্চার ইন্সটল করতে সক্ষম ছিল, কিন্তু যাত্রীবাহী বিজনেস জেটে ফায়ার কন্ট্রোল রাডার (FCR) লাগানোর কারিগরি জ্ঞান তাদের ছিল না। তাই YI-ALE নামে রেজিস্টেশন করা বিমানটি ফ্রান্সের প্যারিসে পাঠানো হয়। ফরাসি ইঞ্জিনিয়াররা ইরাকিদের চাহিদামতো রাডার ইন্সটল করে দেন এবং ককপিটের ডানপাশের অংশকে মিরেজ এফ-১ এর মতো বানিয়ে দেন। ফলে একই বিমানে যুদ্ধবিমান ও বেসামরিক বিমানের ককপিটের আমেজ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, অন্যান্য সব বেসামরিক বিমানের মতো ‘ফ্যালকন ৫০’ বিজনেস জেটেও রাডার ছিল। কিন্তু সেটি হচ্ছে সার্চ এন্ড ট্র্যাক রাডার। অপরদিকে যুদ্ধবিমানে উক্ত রাডার ছাড়াও মিসাইল গাইডেন্স কন্ট্রোল এন্ড ফায়ারিং জন্য আরেক প্রকার রাডার লাগে যা ফায়ার কন্ট্রোল রাডার (FCR) নামে পরিচিত। এটি না থাকলে মিসাইলকে গাইড করা সম্ভব নয়। ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭ সালে আপগ্রেড শেষে এটি ইরাকে ফিরে আসে এবং ইসলামী ইতিহাসের বিখ্যাত ইয়ারমুক যুদ্ধের নামানুসারে ‘Yarmouk‘ নামে নতুন রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এর রেডিও কলসাইন দেয়া হয় ‘suzanna‘। বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ফ্লাইট শেষ করে ১৭ মে, ১৯৮৭ সালের সন্ধ্যায় এটি ফাইনাল মিশনে রওনা দেয়।
আকাশে ‘ফ্যালকন ৫০’ বিমানটিকে পাহারা দিচ্ছিল দুটো মিগ-২৩ ও দুটো মিগ-২৫ যুদ্ধবিমান। বাহরাইনের আকাশসীমার উত্তর দিক দিয়ে ঘুরে এটি বামে ঘুরে যায় এবং এসকর্ট করা বিমানগুলো ফিরে যায়। আক্রমণের কৌশল হিসেবে খুবই কম উচ্চতা দিয়ে উড়তে শুরু করে মডিফাইড ‘ফ্যালকন ৫০’ বিজনেস জেট।
রাত ৯টার দিকে যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস স্টার্ক এর রাডার অফিসার কম উচ্চতায় ধাবমান ইরাকি বিমানটি ট্র্যাক করেন। কিন্তু এটি ছিল সিভিলিয়ান রেডিও ট্রান্সপন্ডারে। রাডার ক্রস সেকশন (RCS) ডাটা (রাডারে বিমানের সাইজ)-ও বলছে এটি যাত্রীবাহী বিমান। ফ্রিগেট ক্যাপ্টেন Glenn R. Brindel বিমানটিকে রেডিওতে মেসেজ পাঠান। মেসেজটি ছিল, ‘Unknown aircraft, this is U.S. Navy warship on your 078 (degrees) for twelve miles. Request you identify yourself.‘
কিন্তু ইরাকি কো-পাইলট রেডিওতে কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ বিমানটি চালাচ্ছিলেন। মূল পাইলট তখন মডিফাইড এফ-১ ককপিটে বসা, মিসাইল ফায়ারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ক্যাপ্টেন এবার ঐ অঞ্চল দিয়ে উড়ে যাওয়া বিভিন্ন বেসামরিক বিমানের শিডিউলড ফ্লাইটের লিস্ট দেখে নিশ্চিত হলেন যে এটি ইরাকি বিজনেস জেট। তারপরও দ্বিতীয়বারের মতো একই মেসেজ পাঠালেন। কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে ইরাকি পাইলটের কোনো সাড়াশব্দ নেই।
সামরিক/বেসামরিক রেডিও চ্যানেলে মেসেজটি ট্রান্সমিট করা হয় এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভূপাতিত করার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়। কিন্তু একাধিক মেসেজ পাঠানোর পরও বিমানটি থেকে কোনো উত্তর আসেনি। এরই মধ্যে ইউএসএস স্টার্কের অত্যাধুনিক মিসাইল ওয়ার্নিং রিসিভার টের পেল যে তাকে Cyrano IV-C5 ফায়ার কন্ট্রোল রাডার দ্বারা টার্গেট হিসেবে ‘লক করা’ হয়েছে! (উল্লেখ্য মিসাইল ফায়ারের আগে টার্গেটকে FCR দিয়ে লক করতে হয়। আধুনিক যুদ্ধজাহাজ/বিমানের আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম এসব রাডার দ্বারা লকড হলে সতর্কবার্তা দিতে সক্ষম )।
এবার ক্যাপ্টেনের দিশেহারা হওয়ার জোগাড়। কেননা FCR ওয়েভ এনালাইসিস সেন্সর বলছে এটি মিরেজ এফ-১ বিমান, অথচ রাডার সিগনেচার বলছে এটি মাঝারি আকারের বিজনেস জেট যা ‘ফ্যালকন ৫০’ এর সাথে মিলে যায়। তারপরও তিনি বুঝতে পারছিলেন না কেন ইরাকি এয়ারক্রাফট তাকে আক্রমণ করবে? কারণ ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে পছন্দ না করলেও যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পক্ষেই ছিল। তবে কি মিরেজ এফ-১ যুদ্ধবিমানটি ইরানের?
এরই মধ্যে ইরাকি বিমানটি প্রথম Exocet অ্যান্টি শিপ মিসাইল ফায়ার করে। ফ্রান্সের তৈরি ৭০-১৮০ কি.মি. রেঞ্জের এই জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইলের কম্ব্যাট হিস্টোরি বেশ চমৎকার। কয়েক বছর আগের ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টিনা ব্রিটিশ নৌবাহিনীর নাকের পানি-চোখের জল এক করে দিয়েছিল এই মিসাইল দিয়ে! প্রথম মিসাইলটি ২২ মাইল (৩৫ কি.মি.) দূর থেকে এবং ২য় মিসাইলটি ১৫ মাইল (২৪ কি.মি.) দূর থেকে ফায়ার করা হয়।
ইউএসএস স্টার্কের পাল্টা হামলা থেকে বাঁচতে মিসাইল ফায়ারের পর ‘ফ্যালকন ৫০’ বিমানের পাইলট বাম দিকে হার্ডটার্ন নেন এবং ফিরতি পথে সর্বোচ্চ গতি তুলে পালাতে শুরু করেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো- মিসাইল ফায়ারিংয়ের ঘটনা শনাক্ত করলেও ইনকামিং মিসাইল দুটো যুদ্ধজাহাজের রাডার থেকে মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল। কারণ অন্যান্য অ্যান্টি শিপ মিসাইলের মতো এক্সোসেট ক্রুজ মিসাইলও সি-স্কিমিং প্রকৃতির। অর্থাৎ এটি সমুদ্রের পানি ঘেঁষে মাত্র ১-২ মিটার উচ্চতায় ফ্লাই করে এবং টার্গেটের ৬,০০০ মিটার দূরে আসার আগে ওটা খালি চোখেও দেখা যায় না। ফলে মিসাইলটি রাডারে দেখা যাচ্ছিল না, ক্যাপ্টেন কার্যত অন্ধ হয়ে যান! কিছুক্ষণের ব্যবধানে মিসাইল দুটো পোর্টসাইডে (জাহাজের বামপাশ) প্রায় একই জায়গায় আঘাত করে।
প্রথম মিসাইলটি আঘাত করলেও তার এক্সপ্লোসিভ ওয়ারহেড (বিস্ফোরক উপাদান) কারিগরি কারণে বিস্ফোরিত হয়নি। তবে মিসাইলের ব্যবহৃত রকেট ইঞ্জিনের ফুয়েলের কারণে ছোটখাট বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। জাহাজের পোস্টগার্ড, স্টোরেজ রুম এবং যুদ্ধজাহাজের হৃৎপিণ্ড বলে খ্যাত কম্ব্যাট অ্যাকশন সেন্টারে আগুন ছড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় মিসাইলটিও প্রায় একই স্থানে আঘাত করে এবং ওয়ারহেড বিস্ফোরিত হয়। ৭৮০ কেজি ওজনের এক্সোসেট মিসাইলে ১৬৫ কেজি ওয়ারহেড থাকে, ফলে এবারের বিস্ফোরণে জাহাজটিতে ১০ ফুট × ১৩ ফুটের বিশাল এক গর্ত সৃষ্টি হয়!
এছাড়া প্রথম মিসাইলটি আঘাত করার সাথে সাথেই জাহাজের ইলেকট্রনিক সিস্টেম এবং মার্ক ১৩ সিঙ্গেল আর্ম মিসাইল লঞ্চার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধজাহাজের মেইন ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই সিস্টেম অটোমেটিক শাটডাউন হয়ে যায় এবং ব্যাকআপ জেনারেটর চালু হয়। এরই মধ্যে ইউএসএস স্টার্কের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে ৪০টি SM-1MR এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল থাকার পরও ক্যাপ্টেন পাল্টা হামলা চালাতে পারেননি। এই হামলায় ৩৭ জন মার্কিন নাবিক মারা যান এবং ২১ জন আহত হন।
উক্ত মিসাইল হামলার ঘটনা দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে একটি মার্কিন AWACS বিমান। এ ধরনের বিমান কয়েকশ কিলোমিটার দূর থেকে রাডার নজরদারি চালাতে সক্ষম। কিন্তু তার নিজস্ব কোনো অস্ত্র নেই। তাই সেই বিমান থেকে নিকটবর্তী সৌদি এয়ারফোর্স বেজকে অনুরোধ করে তারা ইরাকি বিমানকে ইন্টারসেপ্ট করতে একটি যুদ্ধবিমান পাঠান। কিন্তু সৌদি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন সেটার জন্য অনুমতি নেই বলে সেটা নাকচ করে দেয়। ফলে নির্বিঘ্নে হামলা করে ইরাকে ফিরে যায় ‘ফ্যালকন ৫০’। ইউএসএস স্টার্কে বিপুল বেগে পানি ঢুকতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন ব্রিন্ডেল এবার জাহাজকে সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে ইচ্ছাকৃতভাবে সামনের দিকের হ্যাচ খুলে জাহাজের স্টারবোর্ড (ডানপাশ) সাইড ডুবিয়ে দেন যেন পানির লেভেল সমান হয়ে যায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাশ দিয়ে পানি ঢোকা বন্ধ হয় এবং জাহাজটি ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।
ইউএসএস স্টার্কের রেডিও মেসেজ পেয়ে ক্রুদের উদ্ধারে হাজির হয় আশেপাশের অঞ্চলে থাকা ইউএসএস ওয়েডনেল এবং ইউএসএস কনিংহাম। ইঞ্জিন সচল থাকায় কোনো রকমে ইউএসএস স্টার্ক নিকটবর্তী দেশ বাইরাইনের বন্দরে ভিড়ে এবং সেখানেই ভ্রাম্যমাণ ওয়ার্কশপে ইউএসএস আকাডিয়া স্টার্ককে প্রাথমিক মেরামত করে। ডেস্ট্রয়ার টেন্ডার নামে এই জাহাজগুলো মাঝসাগরে ক্ষতিগ্রস্ত যুদ্ধজাহাজ কাজ চালানোর মতো কোনো রকমে মেরামত করে চলার উপযোগী করতে পারে। পরবর্তীতে ইউএসএস স্টার্ককে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মে-পোর্ট নেভাল স্টেশনে, তারপর মিসিসিপির ইংগালস শিপবিল্ডিং কর্পোরেশনের ড্রাইডকে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৪২ মিলিয়ন ডলার খরচ করে জাহাজটিকে পুনরায় মিডলইস্ট টাস্কফোর্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুদ্ধজাহাজটিকে ১৯৯৯ সালে অবসরে পাঠানো হয় এবং ২০০৬ সালে স্ক্র্যাপ হিসেবে ভেঙে ফেলা হয়।
মিসাইল হামলার পরপরই অ্যাডমিরাল গ্রান্ট শার্পের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে যুক্তরাষ্ট্র। এই কমিটি জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্রিন্ডেল ও ট্যাক্টিক্যাল অ্যাকশন অফিসার লেফটেন্যান্ট মনক্রিফকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করে। আপনার মনে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো- জাহাজের ক্যাপ্টেন ও ক্রুরা ইনকামিং মিসাইল ওয়ার্নিং পাওয়ার পরও কেন প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা নিলেন না? উত্তর পাবেন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে:
১) ইউএসএস স্টার্ক যখন ঐ অঞ্চলে ছিল তখন Defcon 4 অর্থাৎ ডিফেন্স কন্ডিশন ফোর জারি করা ছিল।এর মানে হলো, “কোনো হুমকি নেই, তবে সর্বোচ্চ মাত্রায় সতর্ক থাক।” এখানে ইউএসএস স্টার্ক পুরোপুরি সতর্ক ছিল না। তার সবগুলো ওয়েপন সিস্টেম অনলাইনে ছিল না।
২) ইরাকি দাবিকৃত জলসীমায় ৩.২ কি.মি. ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল ইউএসএস স্টার্ক, যা তার উপর আদেশ ছিল না। মূলত এই কারণেই ক্যাপ্টেন ব্রিন্ডেলকে কোর্ট মার্শালে নেয়া হয়।
৩) শত্রুর রাডার লক হওয়ার অর্থ হচ্ছে মিসাইল থ্রেট। কিন্তু সেটি শনাক্ত হওয়ার পরও অ্যান্টি শিপ মিসাইল ধ্বংসে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র Phalanx ক্লোজ ইন ওয়েপন সিস্টেম স্ট্যান্ডবাই মুডে ছিল। এর অপারেটর কম্ব্যাট ইনফরমেশন সেন্টার (CIC)-কে না জানিয়ে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন। এমনকি ট্যাক্টিক্যাল ওয়েপন অফিসার (TAO) লেফটেন্যান্ট ব্যাসিল মনক্রিফ তার পোস্টে ছিলেন না, অন্য ক্রুদের সাথে গল্পগুজবে রত ছিলেন।
৪) সবচেয়ে বড় কথা হলো- ক্যাপ্টেন নিজেই এই অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশই দেননি! আর নির্দেশ দিলেও সেটা চালনার লোক ছিল না। উল্লেখ্য, CIWS-ই যুদ্ধজাহাজের একমাত্র প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র, যার অপারেটর ক্যাপ্টেনের অনুমতি না পেলেও ফায়ার করতে পারে। এই অপারেটর অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়েপন অফিসার পদের হন এবং জাহাজের ভালো-মন্দ তার উপর নির্ভরশীল।
মার্কিন বিশ্লেষকদের ধারণা, Phalanx CIWS সচল থাকলেও ইউএসএস স্টার্ক এত বড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যেতে পারত। কেননা ৬ ব্যারেলের এই বিধ্বংসী মেশিনগানটির নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার এমনভাবে প্রোগ্রাম করা যে এটি সাড়ে ৫ কি.মি. দূর থেকে থেকে মিসাইল ট্র্যাক করতে ও ১.৫ কি.মি. দূর থেকে মিনিটে ৪,৫০০ রাউন্ড ২০ এমএম গুলি ছুড়ে মিসাইল ধ্বংস করতে পারে। অপারেটর যদি অনুমতি না-ও দেয়, তবে ৫০০ মিটারের মধ্যে মিসাইল চলে আসলে নিজে থেকেই গুলি চালাবে- এমন কমান্ড এর প্রোগ্রামে যোগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অফলাইনে থাকায় এটি নিজে থেকে গুলি ছোড়েনি।
৫) বিপদ যখন আসে তখন চারদিক দিয়েই আসে। ইউএসএস স্টার্কের Mark 36 SRBOC ইলেকট্রনিক কাউন্টারমেজার সিস্টেম আর্মড অবস্থায় ছিল না। এটা থাকলে অন্তত চ্যাফ নামক ডিকয় ফায়ার করে মিসাইলগুলোকে বোকা বানিয়ে ভুল টার্গেটে হিট করানো যেত।
হামলার প্রতিক্রিয়া
হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। ইরাকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইরানি অয়েল ট্যাংকার জাহাজ মনে করে ভুল করে মার্কিন জাহাজে তারা হামলা করেছে। তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করলেও ইউএসএস স্টার্ক যে ইরাকি জলসীমায় ঢুকে পড়েছিল সেটি সম্পর্কেও বলা হয়। ফলে ইরাকের জন্য হামলাটি একপ্রকার বৈধতা পেয়ে যায়। তবে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ঐ পাইলট তার সরকারের হয়ে কাজ করেনি এবং তাকে শাস্তি পেতে হবে। যদিও পরবর্তীতে এক ইরাকি এয়ারফোর্স অফিসারের বক্তব্য ছিল, উক্ত পাইলট দুজন জীবিত এবং বহাল তবিয়তে চাকরিতে ছিলেন।
এতকিছুর পরও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড রিগান বলেন,
We’ve never considered them [Iraq’s military] hostile at all”, and “the villain in the piece is Iran
অর্থাৎ ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’ এর মতো এই ঘটনায় ইরানই দায়ী। অথচ এক্ষেত্রে ইরানের কোনো দোষ ছিল না। উল্টো ইরান সরকার নিখোঁজ মার্কিন নাবিকদের উদ্ধার কাজে সৌদি জাহাজের পাশাপাশি একটি হেলিকপ্টার পাঠিয়ে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে সাদ্দাম হোসেনের সাথে মার্কিন সরকারের ৪০০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল তৈরির চুক্তি হয় এবং পার্সিয়ান গালফ ওয়ারে ক্ষতিগ্রস্তদের (স্টার্কের আহত ক্রু এবং নিহতদের পরিবারসহ অন্যান্য যুদ্ধবন্দী সবাইকে) সেই তহবিল থেকে সাহায্য করা হয়।
আগেই বলা হয়েছে- এই হামলার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলে যে, তারা ইরাকি মিরেজ এফ-ওয়ান বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আবার তারা এটাও বলেছে যে, ইউএসএস স্টার্ক দুটো এক্সোসেট মিসাইলের আঘাত সহ্য করেছে। উল্লেখ্য, প্রতিটি এক্সোসেট মিসাইলের ওজন ৬৪০ কেজি। আবার ফরাসি বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ড্যাসল্টের দেয়া ওয়েপন কনফিগারেশন তথ্যানুযায়ী তাদের তৈরি মিরেজ এফ-ওয়ানের প্র্যাক্টিক্যাল পেলোড ৪ হাজার কেজি। অর্থাৎ এটি ৪ টন ওজনের বোমা-মিসাইল বহন করতে পারে। কিন্তু এই বিমানের সেন্টারলাইন ফিউজলাজ (বিমানের পেটের নিচে) হার্ডপয়েন্ট ১টি। ফলে এটি অ্যান্টি শিপ মিসাইল নিতে পারে সর্বোচ্চ ১টি। উল্লেখ্য, ডিজাইনগত কারণে এত ভারী মিসাইল ডানায় বহন করলে উক্ত যুদ্ধবিমানের ভারসাম্য নষ্ট হতো। ফলে এটি উড়তেই পারতো না। তাছাড়া ফরাসি সরকারও স্বীকার করেছিল যে তারা নিরীহ ইরাকি বিজনেস জেটকে মডিফাই করে ভয়ংকর মিসাইল লাগানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ফলে মানসম্মান বাঁচানোর জন্য মার্কিন নৌবাহিনীর মিথ্যাচার ধরা পড়ে যায়।
ইউএসএস স্টার্কের ঘটনার পর মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর সতর্কতা বাড়ানো হয়। ৩ জুলাই ১৯৮৮ সালে ইরানের একটি এয়ারলাইন্সের ‘ফ্লাইট ৬৫৫’ নামক এয়ারবাস এ-৩০০ বিমানকে যুদ্ধবিমান ভেবে পারস্য উপসাগরে মিসাইল নিক্ষেপ করে ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র। ‘ফ্যালকন ৫০’ বিমানের তুলনায় এটি প্রায় তিনগুণ বড় হওয়ায় ইউএসএস ভিনসনেস নামক যুদ্ধজাহাজটি রাডার ক্রস সেকশন ডাটা অ্যানালাইসিস করে নিশ্চিত ছিল যে তাদের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানটি একটি বেসামরিক বিমান। কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় বিমানটি লক্ষ্য করে পরপর দুটি মিসাইল ছোড়া হয়। এতে মারা যায় বিমানে থাকা ৬৬ শিশুসহ ২৯০ যাত্রীর সবাই।
ঐ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ইরানকে ক্ষতিপূরণও দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আবার ইউএসএস ভিনসনেসের কমান্ডার উইল সি রজার্সকে তার সাহসী (!) সিদ্ধান্তের কারণে পুরস্কৃতও করে তারা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউএসএস স্টার্কের উপর হামলা এরকম ভয়ংকর হামলার পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।