ইউটিউব হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। এমন কোনো জিনিস নেই, যা আপনি ইউটিউব থেকে শিখতে পারবেন না। কিন্তু কাজের জিনিস শেখানোর পাশাপাশি অকাজের জিনিস শেখানোর মতো মানুষেরও অভাব নেই ইউটিউবে। সেরকমই একজন সিমোন ইয়াচ, যার কাজ হচ্ছে দুনিয়ার যত অকাজের যন্ত্রপাতি তৈরি করা এবং সেগুলো ইউটিউবে দেখানো।
সিমোন নিজেই নিজেকে দাবি করেন ‘দ্য কুইন অফ শিটি রোবটস’ হিসেবে, ভদ্র বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে অপ্রয়োজনীয় বা জঘন্য রোবটের রানী। তবে এটিই তার একমাত্র পরিচয় না। নিজের ওয়েবসাইটে তিনি তার পরিচয় দিয়েছেন পুরোপুরি ‘গেম অফ থ্রোন্স’ সিরিয়ালের মতো করে: সিমোন সুইডবর্ণ ইয়াচ, দ্য কুইন অফ শিটি রোবটস, ব্রেকার অফ ট্রানজিস্টর্স, মিসট্রেস অফ ম্যালফাংশন, মাদার অফ টেরিবল ইনভেনশন্স!
নামের বিবরণ থেকেই সিমোনের কাজকর্ম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি অপ্রয়োজনীয় সব রোবট তৈরি করেন। সেগুলো তৈরি করতে গিয়ে তিনি ট্রানজিস্টরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে বা নষ্ট করে ফেলেন। তার তৈরি রোবটগুলো অধিকাংশ সময়ই ম্যালফাংশন করে বা ব্যর্থ হয়। এবং তার আবিষ্কারগুলো অধিকাংশ সময়ই টেরিবল তথা ভয়ংকর বা বিদঘুটে।
সুইডিশ তরুণী সিমোন ইয়াচের জন্ম ১৯৯০ সালে। তিনি একাধারে একজন উদ্ভাবক, টিভি উপস্থাপিকা এবং জনপ্রিয় ইউটিউবার। সিমোন বিজ্ঞানী নন, তার কোনো শিক্ষাগত ডিগ্রী নেই, কিন্তু তারপরেও তার আবিষ্কারগুলো বিপুল সংখ্যক মানুষ বেশ আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করে। তিনি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র এক বছর পড়ার পরেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি স্টকহোমের হাইপার আইল্যান্ডে রোবটিক্সের উপর পড়াশোনা করেন এবং ছোটখাট রোবট নির্মাণে আগ্রহী হন।
সিমোন এমন পরিবারের সন্তান, যেখানে উদ্ভাবন এবং উপস্থাপনা দুটোই তার মধ্যে সহজাত। তিনি একদিকে এরিকসন কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত সুইডিশ উদ্ভাবক লার্স ম্যাগনাস এরিকসনের পরিবারের উত্তরাধিকারী। অন্যদিকে তার মা ক্যারোলিন ইয়াচ একজন ঔপন্যাসিক এবং বিখ্যাত টিভি উপস্থাপিকা। পরিবারের এই দুই গুণাবলিই যেন একত্রিত হয়ে সিমোনকে একজন সফল উদ্ভাবক এবং উপস্থাপিকা হিসেবে তৈরি করে দিয়েছে।
সিমোনের প্রথম আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি ছিল টুথব্রাশ হেলমেট (Toothbrush Helmet)। নিছকই মজা করে শিশুদের একটি টিভি শোর জন্য তৈরি করা এই হেলমেটটি পরিধান করে দাঁত বের করে রাখলে হেলমেটটি থেকে ঝুলন্ত একটি টুথব্রাশ এদিক-ওদিক নড়াচড়ার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাঁত পরিষ্কার দিতে পারে। সিমোনের টিভি শোটি অবশ্য বাতিল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোড করে দেওয়ার পরেই তা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। খুব দ্রুত ভিডিওটির গিফ সংস্করণ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে এবং সিমোনও বুঝতে পারেন, টিভি শো না, বরং ইউটিউবই হতে যাচ্ছে তার ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্র।
হেলমেট টুথব্রাশের সাফল্যের পর থেকেই সিমোন একের পর এক হাস্যকর রোবট বানিয়ে যেতে থাকেন এবং ইউটিউবে আপলোড করে যেতে থাকেন। তার প্রথমদিকের একটি ভিডিও মাত্র এক দিনেই রেডিটে ৫ লাখ ভিউ অর্জন করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে তার অনেকগুলো ভিডিওই ইউটিউবে কয়েক মিলিয়নের বেশি ভিউ অর্জন করেছে। তার ইউটিউব পেজের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যাও ১.১ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় সিমোনকে যেকোনো রোবট তৈরির আগে প্রচুর খাটতে হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে গুগলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। এরপর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেলে তিনি প্রথমে পেন্সিল এবং কাগজে রোবটটির বিভিন্ন অংশের খসড়া চিত্র অঙ্কন করেন। এরপর তিনি কম্পিউটারে রোবটটির মডেল তৈরি করেন এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের তালিকা তৈরি করে অর্ডার দেন। অর্ডার করা যন্ত্রাংশগুলো এসে পৌঁছানোর পরই শুরু হয় তার মূল কাজ, চূড়ান্ত রোবটটি তৈরি করা।
সিমোনের মতে, রোবট নির্মাণের সবচেয়ে কঠিন অংশটি হচ্ছে এর মেকানিক্যাল ডিজাইন। ছোট ছোট প্রজেক্টগুলো তৈরি করতে অবশ্য তার খুব বেশি সময় লাগে না। উদাহরণস্বরূপ লিপস্টিক রোবট (Lipstick robot) এবং ব্রেকফাস্ট মেশিন (Breakfast Machine) জাতীয় রোবটগুলো তিনি একদিনেই তৈরি করতে পারেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত জটিল প্রজেক্টগুলো তৈরিতে তার এক-দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়। কিন্তু যেহেতু রোবটগুলো কোনো সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্দেশ্যের পরিবর্তে নিছকই মজা করার জন্য তৈরি করা হয়, তাই পুরো প্রক্রিয়াটিই হয় অত্যন্ত আনন্দময়।
সিমোনের মজাদার কয়েকটি প্রজেক্টের একটি হলো দ্য ওয়েক আপ মেশিন (The Wake up Machine)। এটি মূলত একটি অ্যালার্ম ঘড়ির মতো, যা মাথার কাছে বসানো থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় হলে অ্যালার্ম বাজার পরিবর্তে ঘড়ির সাথে সংযুক্ত একটি মেকানিকাল হাত অনবরত ঘুরতে থাকে এবং ঘুম থেকে জেগে সুইচ বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত ঘুমন্ত ব্যক্তির মুখে অনবরত চড় মারতে থাকে। সিমোনের ধারণকৃত ভিডিওতে ঘূর্ণায়মান হাতের সাথে তার মাথার চুল পেঁচিয়ে একাকার হয়ে বেশ হাস্যরত্মক দৃশ্যের অবতারণা হয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ভিডিওটি ইউটিউবে দেখা হয়েছে ১.৬ মিলিয়ন বার।
আরেকটি মজার মেশিন হচ্ছে দ্য লিপস্টিক মেশিন (The Lipstick Machine)। বই পড়া বা মোবাইল চালানোয় মগ্ন থাকা অবস্থায়ও যদি কেউ রূপচর্চা করতে চায়, তাহলে কাজে লাগতে পারে এই মেশিনটি। এতে একটি যান্ত্রিক হাতের অগ্রভাগে একটি লিপস্টিক সংযুক্ত করে দেওয়া থাকে। সুইচ টিপ দেওয়ামাত্রই লিপস্টিক সমেত হাতটি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। তবে সিমোনের অন্য সব যন্ত্রের মতোই এর ফলাফলও ভয়াবহ হয়। শুধু ঠোঁটে না, এর মাধ্যমে পুরো মুখমন্ডলই লিপস্টিকে মাখামাখি হয়ে যায়। এটিও সিমোনের জনপ্রিয়তম ভিডিওগুলোর মধ্যে একটি। এটি এ পর্যন্ত দেখা হয়েছে ১.২ মিলিয়ন বার।
তবে সিমোনের নিজের সবচেয়ে প্রিয় যন্ত্রের নাম অ্যাপ্লজ মেশিন (Applause Machine) তথা হাততালি দেওয়ার যন্ত্র। এটি মূলত একটি গিয়ারের সাথে সংযুক্ত দুটি প্লাস্টিকের তৈরি হাত। সুইচ টিপ দেওয়ামাত্রই হাত দুটো একে অন্যের সাথে এমনভাবে বাড়ি খেতে থাকবে, যাতে মনে হবে কেউ বুঝি হাততালি দিচ্ছে। সিমোনের ভাষায়, অনেক সময় কোনো অনুষ্ঠানে হাততালি দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে যেতে পারে। অথবা এক হাতে মোবাইল ফোন বা পানির গ্লাস থাকলে হাততালি দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। আর সেজন্যই তার এ যুগান্তকারী আবিষ্কার, যেন নিজে ব্যস্ত থাকলেও হাততালি দিতে কোনো সমস্যা না হয়।
সিমোনের এই অপ্রয়োজনীয় রোবটগুলো নির্মাণের পেছনে একটি উদ্দেশ্য তার দর্শকদেরকে কৌতুক এবং বিনোদনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আগ্রহী করে তোলা। তবে তিনি মজা করে এটাও বলেন, কোনো ক্ষেত্রে সফল হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো এমন একটি কর্মক্ষেত্র বাছাই করা, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা খুবই কম। সেজন্যই তিনি এই অপ্রয়োজনীয় রোবট নির্মাণের কাজটি বেছে নিয়েছেন। তাছাড়া তার মতে, যেকোনো উদ্ভাবনে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। কিন্তু তার বেছে নেওয়া পথে যেখানে ব্যর্থ রোবট তৈরি করাই মূল লক্ষ্য, সেখানে প্রতিবার ব্যর্থ হলেও তিনি শান্তি লাভ করেন এই ভেবে যে, তিনি আসলে সফলই হয়েছেন!
ফিচার ইমেজ- popsci.com