জনপ্রিয় ভিডিও গেম সিরিজ ‘কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার’ এর ক্যাপ্টেন প্রাইস ও তার কমান্ডো টিমের কল্যাণে SAS শব্দটি অনেকের কাছে পরিচিত। ১৯৪১ সালে গঠিত হওয়া ব্রিটিশ আর্মির স্পেশাল এয়ার সার্ভিস (SAS) হচ্ছে সেই দুর্ধর্ষ কমান্ডো ফোর্স যাদেরকে অনুসরণ করে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের স্পেশাল ফোর্স গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়নও অনেকটা ব্রিটিশ SAS এর আদলে গঠিত।
স্পেশাল এয়ার সার্ভিস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো লাইমলাইটে আসে ১৯৮০ সালে লন্ডনে ইরানের দূতাবাসে যখন ৬ জন সন্ত্রাসী ২৬ জনকে ৬ দিন ধরে জিম্মি করে রাখে। জেলে থাকা নিজেদের সঙ্গীদের মুক্তির দাবিতে একজন জিম্মি হত্যা করা হলে ডাক পড়ে এর কমান্ডোদের। তারা ১৭ মিনিটের অপারেশনে জিম্মি সংকটের অবসান ঘটান। ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার পর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং SAS এর অস্তিত্ব পুনরাবিস্কার হয়। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ কমান্ডোরা অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে আজ আপনাদের শোনানো হবে তাদের অন্যতম ব্যর্থ একটি অপারেশনের গল্প।
জানুয়ারি, ১৯৯১ সাল; গালফ ওয়্যার তখন চলছে। কুয়েত দখল করে নেয়ার প্রেক্ষিতে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইঙ্গ-মার্কিন জোট। এসময় ব্রিটিশ কমান্ডো দল এসএএস-এর তিনটি পেট্রোল টিমকে ইরাকে বিহাইন্ড দ্য এনিমি লাইনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিশনে মোতায়েন করা হয়। টিম তিনটির রেডিও কলসাইন ছিল যথাক্রমে ব্রাভো ওয়ান জিরো, ব্রাভো টু জিরো এবং ব্রাভো থ্রি জিরো। এর মধ্যে ব্রাভো টু জিরো নামের দলটি একের পর এক ভুল ও যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিকূলতার কারণে পুরো মিশনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল।
মিশনের কারণ
ব্রাভো টু জিরো টিমের দায়িত্ব ছিল তাদের যেখানে হেলিড্রপ করা হয়েছে সেখানকার আশেপাশের এলাকা স্কাউট করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা, লেয়িং আপ পজিশন (LUP) তৈরি করা এবং রাজধানী বাগদাদ থেকে উত্তর-পশ্চিম ইরাক পর্যন্ত মেইন সাপ্লাই রুট (MSR) পর্যবেক্ষণের জন্য অবজারভেশন পোস্ট (OP) তৈরি করা এবং কী ধরনের মিলিটারি গিয়ার পরিবহন করা হচ্ছে সেটা সম্পর্কে আগেভাগে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা। তবে তাদের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তাদের আওতায় থাকা এলাকা ও সাপ্লাই রুটে যদি ইরাকি স্কাড ব্যালাস্টিক মিসাইল লঞ্চার ভেহিকেল দেখতে পাওয়া যায় তবে তা সাথে সাথে ধ্বংস করা।
সাদ্দাম হুসাইনের এই মিসাইল ছিল প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমতো আতঙ্ক। ১৯৯১ সালে গালফ ওয়ারের মাত্র ৭ সপ্তাহে মোট ৮৮টি স্কাড মিসাইল ফায়ার করেছিল ইরাক। এগুলোর মূল টার্গেট ছিল সৌদি আরব ও ইসরাইল। সৌদি আরবের ধাহরানে ইউএস আর্মির পেনসিলভানিয়া ন্যাশনাল গার্ডের ১৪ কোয়ার্টারমাস্টার ডিটাচমেন্টের ব্যারাকে স্কাড হামলায় প্রায় ১০০ এর মতো আহত ও ২৮ জন মার্কিন সৈনিক নিহত হয়। কুয়েত পুনরুদ্ধারে গঠিত ৩৫টি দেশের কোয়ালিশন ফোর্সের সৈনিকদের রক্ষা করতে এই মিশনের পরিকল্পনা করে ব্রিটেন।
কমান্ডো টিম
পেট্রোল টিমের আটজন ছিলেন সার্জেন্ট স্টিভেন মিচেল (টিম লিডার), সার্জেন্ট ভিনসেন্ট ফিলিপস, কর্পোরাল ক্রিস রায়ান, ল্যান্স কর্পোরাল রবার্ট প্রিং, ট্রুপার স্টিভেন কন্সিগলিও, ট্রুপার জন ল্যান, ট্রুপার ম্যালকম ম্যাকগন এবং ট্রুপার মাইক কবুর্ন। ট্রুপার হচ্ছে ব্রিটিশ আর্মির একটি পদ। এর নেভির পদ ‘সিম্যান’ এবং এয়ারফোর্সে ‘এয়ারক্রাফটম্যান’। আর্মিতে ট্রুপারকে প্রাইভেট/গানারও বলা হয়
ঘটনার শুরু যেভাবে
২২ ও ২৩ জানুয়ারি রয়েল এয়ারফোর্সের চিনুক হেলিকপ্টারে করে ব্রাভো ওয়ান জিরো এবং টু জিরোকে ইরাকে হেলিড্রপ করা হয়। তাদেরকে ট্রান্সপোর্ট হিসেবে একটি ‘ল্যান্ডরোভার ১১০’ দেয়া হয়। কিন্তু ব্রাভো ওয়ান টিম সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। অর্থাৎ তাদের ভেহিকেলের প্রয়োজন ছিল না, দুই পা-ই যথেষ্ট।ব্রাভো ওয়ান জিরো টিমের দেখাদেখি ব্রাভো টু জিরো টিমও ভেহিকেল প্রত্যাখ্যান করলো। (ভুল-১)
“যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাকে দু’পায়ের উপর নির্ভর করে চলতে হবে”- এমন মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি নিতে সকল সৈনিকদের, বিশেষত কমান্ডোদের, ট্রেনিং দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে ভেহিকেল প্রত্যাখ্যান করাটা আসলেই বোকামি। আপনার প্রয়োজন না থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের নেয়া অনেকগুলো ভুল সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র এই ভেহিকেলকেন্দ্রিক হয়েছিল। তাছাড়া ভেহিকেলের অভাবে কয়েকশ কিলোমিটার তাদের হাঁটতে হয়েছিল!
হেলিড্রপ করার পর তারা অবজারভেশন পোস্টের দিকে হাঁটা শুরু করলো। একজন কমান্ডো তার বইয়ে লিখেছেন, তারা ২০ কিলোমিটার হেঁটে সেখানে পৌঁছান। অপর দুজন কমান্ডো তাদের বইয়ে লিখেছেন, তারা ২ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন। কারণ তাদের কাছে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও কয়েকদিনের রেশনসহ বেশ ভারী ব্যাগ ছিল যা নিয়ে এত দূরে হাঁটা খুবই কষ্টকর। দূরত্ব নিয়ে এরকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছাড়াও আরও অনেক ঘটনার বর্ণনা একেকরকম দেয়া আছে কমান্ডোদের আত্মজীবনী গ্রন্থ ও ঘটনার বর্ণনা নিয়ে লেখা বিভিন্ন আর্টিকেলে।
যা-ই হোক, তারা চারজনের দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তিনবার ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে অবজারভেশন পোস্ট পর্যন্ত তাদের অস্ত্র-গোলাবারুদসহ কয়েকদিনের পর্যাপ্ত খাবার আনা-নেয়া করেন। এবার রেডিওতে রেগুলার রুটিন কল করার সময় তারা দেখেন, তাদের মেইন রেডিও নষ্ট হয়ে গেছে (দুর্ভাগ্য-১)। এই নিয়ে পেট্রোল টিম কমান্ডারের সাথে একজন কমান্ডোর ঝগড়া হয় (ভুল-২)। কেননা মিশনে যাওয়ার আগে রেডিও কাজ করে কি না সেটা চেক করার দায়িত্ব কমান্ডারের, কিন্তু তিনি সেটা করেননি! (ভুল-৩)
২৪ জানুয়ারি বিকেলে হঠাৎ ১০-১২ বছরের এক রাখাল বালক তার অবাধ্য ছাগলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে এসএএস কমান্ডোদের অবজারভেশন পোস্ট দেখে ফেলে। তারা ঐ বাচ্চাকে কিছুই করলো না, উল্টো চকলেট সাধলো! (ভুল-৪)
স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চাটি দৌড়ে পালিয়ে গেল এবং হাইওয়েতে থাকা একটি ইরাকি পেট্রোল টিমকে ব্রিটিশ কমান্ডোদের কথা জানালো। দূরবীনে রাখালকে সৈনিকদের কাছে যেতে দেখে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো ব্রিটিশ কমান্ডোরা। এমন সময় তারা রাস্তায় এমন ভেহিকেলের শব্দ শুনলো যা শুনে মনে হচ্ছে যে ট্যাংক আসছে! কিন্তু আসলে সেটা ছিল মামুলি একটা বুলডোজার। ইতিমধ্যেই কমান্ডোরা তাদের অবজারভেশন পোস্ট থেকে বেরিয়ে গেছেন। (ভুল-৫)
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অবজারভেশন পোস্টের মতো ফুল এলার্ট ডিফেন্সিভ পজিশন ছেড়ে বেড়িয়ে পড়াটা বোকামি ছিল। কেননা বাচ্চার কথামতো ইরাকি পেট্রোল টিমের সৈনিকরা জায়গাটা সার্চ করতে আসলে ব্রিটিশ কমান্ডো টিমের সারপ্রাইজ অ্যাটাকে পুরো ইরাকি টিমকে শেষ করে দেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ইরাকি টিম ঐ বাচ্চার কথা বিশ্বাস করেনি, বরং অট্টহাসি দিয়ে তাকে ভাগিয়ে দিয়েছে। তাদের কল্পনাতেও ছিল না এমন জায়গায় বিদেশি সেনারা ঢুকে পড়েছে। তাছাড়া রাখাল ছেলেটি যে জায়গা দেখিয়েছে সেদিকে ঐ বুলডোজার ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। অবজারভেশন পোস্ট ছিল পাহাড়ি টিলার আড়ালে। কিন্তু বুলডোজারের ড্রাইভার কমান্ডোদের দেখে ফেলে এবং উল্টো ঘুড়িয়ে বুলডোজার নিয়ে সোজা নিকটস্থ ইরাকি মিলিটারি বেজে হাজির হয়ে গেল। অন্যদিকে ঐ নাছোড়বান্দা রাখাল ছেলেটি হাইওয়েতে আরেকটা গাড়ি থামালো। ড্রাইভার ছিল তার পরিচিত লোক। তাই সে তার কথা বিশ্বাস করলো এবং তাকে নিকটস্থ ইরাকি মিলিটারি বেজে নিয়ে গেল। দুটো বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে কমান্ডোদের উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার পর একটি আর্মাড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) ও এক ট্রাক সৈন্য পাঠানো হলো।
কমান্ডোরা সেকেন্ডারি অবজারভেশন পোস্ট এর দিকে এগিয়ে চলছিল। হঠাৎ পেছন দিক দিয়ে ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকেল (আইএফভি), আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) নিয়ে আক্রমণ করে ইরাকি সৈন্যরা। কিন্তু উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্রিটিশ কমান্ডোদের এম-১৬ রাইফেল, এম-২০৩ গ্রেনেড লঞ্চার, এফএন মিনিমি মেশিনগানের সাথে ১০ মিনিটও টিকতে পারেনি তারা। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পিছু হটে তারা।
স্কাড মিসাইল ভেহিকেল ধ্বংসের জন্য তাদের সবাইকে ৬৬ এমএম এম-৭২ এলএডব্লিউ রকেট লঞ্চার দেয়া হয়েছিল। সেগুলো ব্যবহার করে আইএফভিকে অচল করে দিয়েছিল তারা। গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে ট্রাকও উড়িয়ে দিয়েছিল তারা। এছাড়া ব্রিটিশ কমান্ডোরা বিশেষ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। দুজন দৌড়ে সামনে যাবে, দুজন কাভারিং ফায়ার সাপোর্ট দিবে। এমনভাবে বিরামহীনভাবে গুলি ছুড়ে প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রেখে একদম সামনে গিয়ে টিলার আড়ালে কাভার নেয়া ইরাকি সেনাদের মেরেছিল তারা। পরবর্তীতে এপিসি এর ভেতরে গ্রেনেড ছুড়ে ভেতরের সবাইকে মেরেছিল।
যেহেতু একটি ছোটখাট যুদ্ধ হয়ে গেছে, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরাকি বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে পুরোদমে খোঁজ শুরু করবে- একথা প্রায় নিশ্চিত ছিল। তাই তারা ইমারজেন্সি পিকআপের জন্য ব্যাকআপ রেডিও বের করলো। এবার কপাল আসলেই খারাপ। দেখা গেল ব্যাকআপ রেডিও কেবল মেসেজ পাঠাতে পারছে, কিন্তু গ্রহণ করতে পারছে না। (দুর্ভাগ্য-২)
ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (SOPs) অনুযায়ী কোনো কারণে রেডিও কন্টাক্ট মিস হলে অরিজিনাল ‘ইনফিল্ট্রিশন’ পয়েন্টে ফিরে আসতে হবে এবং সেখানে প্রতি ২৪ ঘণ্টা পর পর হেলিকপ্টার যায় পিকআপ করার জন্য। কিন্তু সেখানে যাওয়া আর বাঘের গুহায় যাওয়া একই কথা। কেননা কমান্ডোদের অবস্থানের কথা ইরাকি বাহিনীর কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। তাই তারা ‘ইমারজেন্সি পিকআপ’ পয়েন্টে সরাসরি চলে যায়। এ ধরনের অপারেশনে মিশন অ্যাবোর্ট বা অন্য যেকোনো সমস্যার কারণে দ্বিতীয় এক্সট্রাকশন পয়েন্ট রাখা হয়। কিন্তু তাদের সঠিক লোকেশন হেলিকপ্টারের পাইলটের জানা ছিল না এবং রেডিও যোগাযোগ ছিল না। (দুর্ভাগ্য-৩)
এমনও শোনা যায় যে কপ্টার পাইলট ছিল সেদিনের জন্য রাতকানা! মানে পাইলটের চোখে সেদিন হঠাৎ করে সমস্যা দেখা দেয় যা সে আগেভাগে তার কমান্ডিং অফিসারকে জানায়নি। ফলে সেই পাইলট কমান্ডোদের খুঁজে না পেয়ে ফিরে চলে আসে। অথচ তারা কিন্তু সেখানেই ছিল! ফ্লেয়ার, টর্চলাইট বা অন্যভাবে গ্রাউন্ড থেকে সিগন্যাল দেয়ার মতো তাদের কাছে কিছু ছিল কি না এমনটা জানা যায়নি। এ ঘটনার পর পাইলটকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
অপরদিকে ইমারজেন্সি ব্যাকআপ রেডিও কেবলমাত্র মেসেজ পাঠাতে পারতো, কিন্তু গ্রহণ করতে পারত না। এই মেসেজ মাথার উপর দিয়ে যাওয়া মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধবিমান রিসিভ করে। সেটি কয়েকবার কমান্ডোদের মাথার উপর চক্কর দেয়, কিন্তু তার পক্ষে তো আর কমান্ডোদের পিকআপ করা সম্ভব ছিল না। সে ব্রাভো টু জিরো টিমের বিপদের কথা ব্রিটিশ এয়ারবেজে জানিয়ে দেয়।
এস্কেপ প্ল্যান
কমান্ডোরা কোনো মিশনে যদি রেডিও কন্টাক্ট হারিয়ে ফেলেন কিংবা দলছুট হয়ে পড়েন তাহলে তাদের জন্য একটি এস্কেপ রুট নির্ধারণ করা থাকে, যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরতে পারেন। এ ধরনের রুট ছিল মিত্র সৌদি আরবের দিকে, কিন্তু তারা পথ ভুল করে সিরিয়ার সীমান্তের দিকে যাওয়া শুরু করেন। (ভুল-৬)
এমন ভুল আর যা-ই হোক, কমান্ডোদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। পরবর্তীতে তারা বলেছেন, তাদের কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশনা নাকি এমনই ছিল। সেটা সত্য হলে অবশ্য কমান্ডোদের কোনো দোষ নেই।
পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া
২৪/২৫ জানুয়ারি রাতে তীব্র শীতের মধ্যে মরুভূমিতে তারা সিরীয় সীমান্তের দিকে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিল। ক্লান্তিতে একেকজনের ভেঙে পড়ার দশা। সবাইকেই আনুমানিক ৫০-৭০ কেজি বাড়তি বোঝা বহন করতে হচ্ছিল। যখন তাদের হেলিড্রপ করা হয় তখন তাদের ব্যাগের ওজন ছিল ৯৫-১২০ কেজি!
এমন সময় তীব্র ঠাণ্ডায় ফিলিপস নামের একজন কমান্ডো হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য দুজন কমান্ডো থেমে যায় এবং বাকিদেরও থামতে বলে। কিন্তু বাকি পাঁচজন তাদের কথা শুনতে পায়নি, নাকি শুনেও না শোনার ভান করেছে তা জানা যায়নি। তারা তাদের মতো করে পথ চলছিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ৩+৫ জনের দুটো দলে বিভক্ত হয়ে যায়। (ভুল-৭)
এ ধরনের মিশনের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক ভুল।
ব্রিটিশ এসএএস-সহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের কমান্ডোদেরদের ইমার্জেন্সি রদেভু (ERV) ট্রেনিং দেয়া হয় যাতে তারা দলছুট হয়ে গেলে পুনরায় একত্রিত হতে পারেন। কিন্তু পাঁচজনের দলটা সেই নিয়ম মেনে চলেনি। তিনজনের অপর দলটি হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত কমান্ডোকে সেবা-শুশ্রূষা দিতে থেমে গিয়েছিল এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কুকুরের মতো গুটিসুটি মেরে ফিলিপসের সাথে বাকি দুজনকে জড়াজড়ি করে শুয়ে উষ্ণতা ভাগাভাগি করছিল। কিন্তু তার জন্য এটা যথেষ্ট ছিল না। ইরাকি আর্মির হাতে ধরা পড়া থেকে বাঁচতে অসুস্থ ফিলিপসকে নিয়ে তারা আবার হাঁটতে শুরু করে। একপর্যায়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ফিলিপস মারা যায়। প্রায় ২০ মিনিট খোঁজাখুঁজির পর তার লাশ পেয়ে সেটি ফেলে রেখে বাকি দুজন চলতে শুরু করে বাকি দুজন।
অন্যদিকে পাঁচজনের দলের সবাই এম-১৬ রাইফেল (২টি) নাহয় এফএন মিনিমি মেশিনগান (৩টি) বহন করছিল। যে কমান্ডো ক্রমাগত রেডিও কল করেই যাচ্ছিল। একজন তার এন্টি ট্যাংক রকেট লঞ্চারটা আরেকজনের সাথে ভাগাভগি করতে চেয়েছিল। এটা নিয়েও ঝগড়া লেগে যায় তাদের মধ্যে। (ভুল-৮)
ধরা পড়া
ব্রাভো ওয়ান জিরো এর দেখাদেখি ভেহিকেল প্রত্যাখ্যান করার মতো ভুলের মাশুল এখন পদে পদে দিতে হচ্ছে ব্রাভো টু জিরো টিমের সবাইকে। ২৬ জানুয়ারি দুপুরে কয়েকশ কিলোমিটার হাঁটার পর ক্লান্ত দুই গ্রুপের কমান্ডোই ভেহিকেল চুরির চেষ্টায় ছিল। উল্লেখ্য, দুটো দলই (২+৫ জন) উত্তর-পশ্চিম সিরীয় সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দুই দলের পথ ছিল ভিন্ন। তাই তাদের মধ্যে দেখা হয়নি।
ফিলিপস মারা যাওয়ায় বাকি দুজন রায়ান ও ম্যাকগন ভেহিকেলের সন্ধান করছিল। কিন্তু রায়ান তাতে সাড়া দিচ্ছিলো না। কেননা ভেহিকেল চুরি করতে গেলেই ইরাকি আর্মির কাছে খবর চলে যাবে। তারপরও ম্যাকগন রায়ানকে বহু কষ্টে রাজি করালো এই মর্মে যে, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যেই সে ফিরে আসবে। সে নিজের অস্ত্র রেখে ফিলিপসের এম-১৬ (ভুল-৯) নিয়ে স্থানীয় শহরে যায় এবং একজন নিরস্ত্র ইরাকিকে খুন করে একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে।
কিন্তু এরই মধ্যে একে-৪৭ সহ দুজন লোক এসে পড়ে এবং তাদের সাথে ম্যাকগনের গোলাগুলি হয়।কিন্তু তার জানা ছিল না আগেরদিনের গোলাগুলি হওয়ার পর ফিলিপস অস্ত্র রিলোড তো দূরের কথা পরিস্কারও করেনি। ফলে অ্যামুনিশন শেষ এবং এম-১৬ জ্যাম হওয়ার কারণে ধরা পড়েন ম্যাকগন।এমনকি তিনি নিজের অ্যামুনিশন বেল্টও নিয়ে আসেননি! সেটা থাকলে এক্সট্রা ম্যাগাজিনও থাকত।অপরদিকে রায়ান নির্দিষ্ট সময় পর ম্যাকগনের দেখা না পেয়ে নিজেই রওনা দেন এবং নিরাপদে বেজে ফিরে আসেন। তিনি ব্রিটিশ এসএএস-এর ইতিহাসে একমাত্র কমান্ডো যিনি প্রায় ২৯০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বিহাইন্ড দ্য এনিমি লাইন থেকে নিরাপদে বেজে ফেরেন! এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে গড়া ব্রিটিশ কমান্ডো জ্যাক সিলিটোর রেকর্ড ভেঙে দেন।
অপর পাঁচজনের ঘটনা
ঝগড়া থামিয়ে অপর পাঁচজনও ভেহিকেল খোঁজার দিকে মন দিলো। রাস্তায় তারা একটি ট্যাক্সিক্যাব ছিনতাই করলো এবং সবাই রওনা দিল। কিন্তু ট্যাক্সি আকারে এত ছোট যে তাদের নিজেদের বসাই মুশকিল। তাই বাধ্য হয়ে তারা বাড়তি রসদ ও অ্যামুনিশন ফেলে যেতে বাধ্য হলো। (ভুল-১০)
সীমান্তের দিকে যেতে তাদেরকে ইউফ্রেতিস নদীর উপর বানানো একটি ব্রিজ পেরোতে হত। সেখানে আবার ইরাকি আর্মির একটি চেকপয়েন্ট ছিলো। (দুর্ভাগ্য-৪)
ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে তারা চেকপয়েন্টে গোলাগুলি শুরু করলো। এখানেও সারপ্রাইজ অ্যাট্যাকের কারণে তারা বিপুল পরিমাণ ইরাকি সেনা মারতে সক্ষম হলো। কিন্তু তাদের অ্যামুনিশন শেষ হয়ে গেল।ফলে পালাতে শুরু করলো তারা। কমান্ডো ল্যান এবং প্রিং ইউফ্রেতিস নদীতে নেমে সাঁতরে নদী পার হতে শুরু করলো। ইরাকিরা অনেক চেষ্টা করেও তাদের গায়ে গুলি লাগাতে পারেনি। প্রচণ্ড স্রোতের কারণে দ্রুত তারা দূরে সরে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ল্যান তীব্র ঠাণ্ডায় হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং প্রিং ক্লান্ত হয়ে ধরা পড়েন। কর্পোরাল কবুর্ন গোড়ালিতে গুলি খেয়ে ধরা পড়েন। রবার্ট গুলিতে আহত হয়ে মারা যান এবং দলনেতা মিচেল সবার শেষে ধরা পড়েন। তিনি এক ব্রিজের নীচে লুকিয়ে ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ ধরা পড়েন। কর্বুন এবং মিচেলকে গণধোলাই দেয়া হয়। ইরাকি সেনাদের পাশাপাশি জনগণও আচ্ছামতো পিটিয়েছিল!
নির্যাতন
চেকপয়েন্ট অ্যাটাকে পাঁচজনের দলের তিনজন এবং গাড়ি চুরি করতে গিয়ে অপরদলের রায়ান ধরা পড়েন। এই চারজনের উপর বেশ ভালো রকমের নির্যাতন চালানো হয় তথ্য আদায়ের জন্য। দলনেতা মিচেলকে প্রচন্ডভাবে মারা হয়। নির্যাতন করার জন্য তার একটা একটা করে দাঁত তোলা হয়, পেটানো হয় পুরুষাঙ্গে।
শেষ কথা
অপর দুটো টিম তেমন কোনো সাফল্য না পেলেও সাফল্য পাওয়ার কথা ছিল ব্রাভো টু জিরো টিমের। কিন্তু তারা সেটা পারেনি। উল্টো শত্রুর হাতে চারজন ধরা পড়ে। পরে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক কূটনৈতিক চাপের মুখে তাদেরকে পড়ে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকিদের মধ্যে একজন পালিয়ে আসেন।দুজন হাইপোথার্মিয়ায় ও একজন গুলিতে মারা যান।
ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস (SAS) হচ্ছে সেই স্পেশাল ফোর্স, যাকে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কমান্ডো ফোর্স কোনো না কোনো সময় অনুসরণ করেছে। এই মিশন ব্রিটিশ এসএএস-এর দীর্ঘদিনের সুনাম অনেকাংশে নষ্ট করেছে। বিশেষত বেশ কিছু ভুল তাদের কাছ থেকে কোনোমতেই আশা করা যায় না।