খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ থেকে ৪৮৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কাল। প্রাচীন পারস্যের আখমেনীয় সাম্রাজ্যের রাজা ‘দারিয়ুস দি গ্রেট’ সিংহাসনে জাঁকিয়ে বসেছেন। চারিদিকে নানা রাজ্য জয় করে চলেছেন তিনি। এমন সময় তার ইচ্ছে হলো নিজের সমাধি তৈরি করার। তিনি ঠিক করলেন, আখমেনীয় সাম্রাজ্যের সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজধানী পার্সেপলিসের কাছেই এক সুউচ্চ পর্বতের চূড়ায় তৈরি করবেন নিজের সমাধি। যেই ভাবা সেই কাজ! নিজের সমাধি তৈরির জন্য লোক লাগিয়ে দিলেন তিনি। ধীরে ধীরে শক্ত পাথর খোদাই করে তৈরি হলো দারিয়ুসের সমাধি। তৈরি হলো প্রাচীন পারস্য সভ্যতার এক আশ্চর্য নিদর্শন, নাকশে রুস্তম!
প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পার্সেপলিস থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই রহস্যময় রাজসমাধি, নাকশে রুস্তম। নাকশে রুস্তম অর্থ ‘রুস্তমের চিত্র’। এটি মূলত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম সাল সময়কার দারিয়ুস সহ চার আখেমেনীয় রাজা ও তাদের পরিবারের কবরস্থান। দারিয়ুস দি গ্রেট, তার তিন বংশধর জারজেস, আর্তাজারজেস ও দ্বিতীয় দারিয়ুস- মোট চার জনের সমাধি রয়েছে এখানে।
নাকশে রুস্তমের ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ সালে আখমেনীয় সাম্রাজ্যের তৃতীয় রাজা হন দারিয়ুস। তৎকালীন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো পার্সেপলিস। রাজা দারিয়ুসের ইচ্ছে অনুযায়ী পার্সেপলিস থেকে কিছুটা দূরে এক পাহাড়ের চূড়া খোদাই করে তৈরি করা হয় নাকশে রুস্তম। এটি তৈরির প্রায় সাত বছর পর মারা যান দারিয়ুস। মৃত্যুর পর তার ইচ্ছে অনুযায়ী তার মৃতদেহ পার্সেপলিস থেকে নাকশে রুস্তমে এনে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে তার তিন ছেলেকেও এখানে সমাধিস্থ করা হয়।
এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা দুর্ঘটনাবশত আলেকজান্ডার দি গ্রেট পার্সেপলিস নগরীটি আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেন। দুয়েকটি পাথরের স্তম্ভ ছাড়া গোটা পার্সেপলিস নগরীটি পরিণত হয় ছাইয়ে ঢাকা ধ্বংসস্তূপে। কিন্তু কিছুটা দূরে অবস্থিত এই সমাধিক্ষেত্রটি একেবারেই অক্ষত থেকে যায়। ফলে পরবর্তীতে এটিই হয়ে উঠে সুপ্রসিদ্ধ পার্সেপলিস নগর সভ্যতার টিকে থাকা শেষ চিহ্ন।
এরপর খ্রিস্টপূর্ব ২২৮ সালে তৎকালীন পারস্যের গভর্নর আর্দাশির শেষ পার্থিয়ান রাজাকে পদচ্যুত করেন এবং নিজেকে আখমেনীয় রাজবংশের ধারক হিসেবে ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে তিনি এবং তার বংশধর সাসানীয় রাজা প্রথম সাপুর নাকশে রুস্তমের বাইরের দেয়ালে নানা কারুকার্য খোদাই করেন।
এসব কারুকার্যের কোনো কোনোটিতে তৎকালীন অশ্বযুদ্ধের চিত্র খোদাই করা রয়েছে। পরবর্তীতে ইরানের বিখ্যাত কবি ফেরদৌসি তার বিশ্ববিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘শাহনামা’ রচনা করেন। শাহনামার অনেক যুদ্ধের দৃশ্যের সাথেই নাকশে রুস্তমের দেয়ালের এসব খোদাইকৃত চিত্র মিলে যায়। ফলে যারা শাহনামা পড়েছিলেন, তারা যখন নাকশে রুস্তম দেখতে পান, তখন তারা মনে করেন শাহনামায় বর্ণিত বিখ্যাত বীর রুস্তমকে নিয়েই হয়তো এই নাকশে রুস্তমের এসব কারুকার্য করা হয়েছে। আর এই ধারণা থেকেই জায়গাটি নাকশে রুস্তম নামে জনপ্রিয়তা পায়।
যা কিছু আছে এখানে
নাকশে রুস্তমে রয়েছে মোট চারটি সমাধি। সমাধিগুলো আসলে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ঘর। একেকটি সমাধিতে মোট তিন থেকে নয় জন মানুষের মৃতদেহ রাখা যেতো। প্রতিটি সমাধির প্রবেশপথ ক্রুশ আকৃতির। এজন্য নাকশে রুস্তমকে আঞ্চলিকভাবে ‘পারস্যের ক্রুশ‘ও বলা হয়। ক্রুশ আকৃতির এই প্রবেশপথের ঠিক মাঝখানে রয়েছে দরজা। দরজা দিয়ে ঢুকলেই বিশাল সুন্দর কারুকাজ যুক্ত শবাধার। এই শবাধারের মধ্যেই রাখা হতো রাজাদের মৃতদেহ।
চারটি সমাধির মধ্যে শুধুমাত্র একটি সমাধিই রাজা দারিয়ুসের সমাধি হিসেবে শনাক্ত করা গেছে। সমাধির গায়ে রয়েছে দুটি শিলালিপি। শিলালিপি দুটিতে দারিয়ুসের আত্মজীবনীমূলক দুটি কথা খোদাই করা রয়েছে। এই উক্তির মাধ্যমে দারিয়ুস তার ন্যায়বিচার ও ন্যায়ের শাসনের প্রতি ইচ্ছের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “কোনো মানুষের অনিষ্ট হোক তা আমি চাই না। তবে কোনো মানুষ কারো অনিষ্ট করে সাজা না পেয়ে পালিয়ে যাক, সেটিও আমি হতে দিতে পারি না।”
দারিয়ুসের মূল সমাধির পাশের সমাধিগুলো পরবর্তীতে তৈরি করা হয়। এগুলোর গায়ে কোনো শিলালিপি না থাকায় এগুলো কার সমাধি তা জানা যায়নি। তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় বাকি তিনটি সমাধি দারিয়ুসের তিন বংশধরের।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, রাজাদেরকে সমাধিস্থ করার পর প্রতিটি সমাধিই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের আক্রমণে আখমেনীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটার পর এই সমাধিগুলোর দরজা ভেঙে ফেলা হয়। এরপর সমাধির ভেতরের মূল্যবান জিনিস লুট করে নেয় সৈন্যরা।
আখমেনীয় সাম্রাজ্যের পতনের পরও এই সমাধিগুলো পারস্যবাসির কাছে ছিলো অতি পবিত্র। এখানের প্রতিটি সমাধি ভূমি থেকে কিছুটা উপরে তৈরি করা হয়েছিলো। আর এই ভূমি ও সমাধির মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে পরবর্তীতে সাসানীয় রাজা ও তার বংশধররা নানা চিত্র খোদাই করেন। এসব চিত্রের মাধ্যমে তারা পূর্বের আখমেনীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সাথে নিজেদের যুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
এসব সাসানীয় খোদাই চিত্রগুলোতে তাদের ভালো ও মন্দের দেবতাদের মধ্যে যুদ্ধের ঘটনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও কয়েকটিতে সাসানীয় রাজা সাপুর ও তিন রোমান শাসকের চিত্রও খোদাই করা রয়েছে। বাকি খোদাই চিত্রগুলো তৎকালীন রাজাদের হাতে তাদের শত্রুর মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে এক মধ্যযুগীয় যুদ্ধের ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এগুলোতে। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, এসব খোদাই চিত্র আসলে ফেরদৌসির শাহনামার কেন্দ্রীয় চরিত্র রুস্তমকেই ইঙ্গিত করছে।
এই চারটি সমাধির মধ্যে চতুর্থ সমাধিটির সামনে রয়েছে একটি পাথরের স্তম্ভ। এটির নাম ‘কাবায়ে জারদাস্ত’, যার অর্থ ‘জরথুস্ত্রের কাবা’। ইসলাম ধর্মের পবিত্র কাবা শরীফের আকারে এটি তৈরি করা হয়েছিলো বলে অনেকে মনে করেন। তবে কী উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করা হয়েছিলো, তার রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। স্তম্ভটি প্রায় পুরোটাই নিরেট পাথরের তৈরি, শুধু উপরের দিকে রয়েছে ছোট্ট একটি কুঠুরি। কী কাজে ব্যবহৃত হতো এটি, তা নিয়ে রয়েছে নানা মতবাদ। কেউ কেউ মনে করেন, মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ এখানে রাখা হতো, কেউ মনে করেন এখানে আগুনের পূজা করা হতো ও ধর্মীয় বই রাখা হতো। অনেকে আবার মনে করেন, এটির নিচে হয়তো কারো সমাধি রয়েছে।
প্রাচীন রাজাদের এই সমাধিগুলোর সামনের জায়গাটিতে ছিলো একটি উদ্যান। নানা রকম গাছ ছিলো এই উদ্যানে। এছাড়াও নাকশে রুস্তম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে রয়েছে কিছু অসম্পূর্ণ ভবনের ধ্বংসাবশেষ। এটি ‘তখতে রুস্তম‘ নামে পরিচিত। এটি কী ছিলো বা এখানে কী তৈরি করা হচ্ছিলো, তা আজও জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এটি হয়তো রাজা ক্যাম্বাইসিসের সমাধির কোনো অংশ। এখানের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে রয়েছে কয়েকটি বড় বড় পাথর খণ্ড। রাজা ক্যাম্বাইসিসের পিতা সাইরাস দি গ্রেটের সমাধির সাথে মিল রয়েছে এই ধ্বংসাবশেষটির। অনেকে আবার মনে করেন, এই উঁচু মঞ্চটি ছিলো তৎকালীন অগ্নিপূজারীদের পূজার স্থান। এখানেই তারা আগুনের উপাসনা করতো।
বর্তমানে নাকশে রুস্তম পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসেন। এই ধূলিধূসর নীরব পাথরের নাকশে রুস্তম আগত পর্যটকদের মনে করিয়ে দেয় বহু বছরের পুরানো সেই পারস্য সভ্যতার কথা। একসময়ের দুর্দান্ত জাঁকজমকপূর্ন সেই সাম্রাজ্য আজ পরিণত হয়েছে নীরব এক মৃত্যুপুরীতে।
ফিচার ইমেজ: Trover