‘A photographer is a secret about a secret. The more it tells you the less you know’
– Diane Abrus
একজন আলোকচিত্রী নিজের দক্ষতায় একটি নির্জীব ছবিকেও করে তুলতে পারেন জীবন্ত। শুধুমাত্র সৌন্দর্যই নয়, বরং একটি ছবিতে ফুটে উঠে প্রতীকি আরো অনেক কিছুই। আর তাতে করেই কিছু ছবি ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আজ আমরা দেখবো এমনই কিছু বিখ্যাত ছবি ধারণ করার ইতিহাস।
আকাশে মধ্যাহ্নভোজ
১১ জন লোক ৮৫০ ফুট উঁচুতে থাকা ইস্পাতের কাঠামোর উপর পা দুলিয়ে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন, এমন একটি ছবিই সেই সময় দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছিলো। যদিও পরে জানা গিয়েছিলো, ব্যাপারটি সাজানো। তারপরও এত উপরে স্বাচ্ছন্দ্যে বসে থাকা ১১ জনের অভিব্যক্তি ও ছবির কারুকার্যই যথেষ্ট ছবিটিকে বিখ্যাত করার জন্য। নিউ ইয়র্ক শহরের রকফেলার সেন্টার নির্মাণের সময় চিত্রটি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। সেই সেন্টার নির্মাণের ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ছবিটি ধারণ করা হয়।
যুদ্ধশেষ চুম্বন
১৯৪৫ সালের ১৪ আগস্ট, এই বিখ্যাত ছবিটি তোলেন আলোকচিত্রী আলফ্রেড আইজেন্টেড। লাইফ ম্যাগাজিনে সর্বপ্রথম এই ছবিটি প্রকাশ করা হয়। ছবিটিতে একজন যুদ্ধফেরত নাবিক ও একজন সেবিকার চুম্বন ধারণ করা হয়। অনেকদিন পর্যন্ত ছবির দু’জনের পরিচয় অজ্ঞাত ছিলো। পরবর্তীতে জানা যায়, তাদের নাম ছিলো জর্জ মেন্ডনসা ও গ্রিটা ফ্রিডম্যান। মজার বিষয় হলো, এই দু’জন কেউ কাউকে চিনতেনও না।
আইজেন্টেড পরে বলেন যে, সেই মুহূর্তে হাজার মানুষ সেখানে একজন আরেকজনকে চুম্বন করছিলেন, কেউ কাউকে না জেনেই! তবে অনেকে এই ছবিটিকে যৌন নিপীড়ন হিসেবে উল্লেখ করলেও ফ্রিডম্যান ব্যাপারটিকে অস্বীকার করে বলেছিলেন এখানে খারাপ কিছুই ছিলো না। ১৪ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে তোলা ছবিটি বিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ২১ বছর বয়সী ফ্রিডম্যান সেই সময়ে ছিলেন একজন ডেন্টাল অ্যাসিসট্যান্ট। তার ভাষ্যমতে, বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির খবর শুনে টাইম স্কয়ারের দিকে ছুটে যান ফ্রিডম্যান। লোকে লোকারণ্য ছিলো জায়গাটি। সেখানেই একজন আরেকজনকে চুমু খেতে শুরু করে। ফ্রিডম্যান এর মতে, সেসব চুমু কোনো ভালবাসার খাতিরে দেওয়া নয় বরং মানুষের স্বস্তি ও মুক্তির প্রতীক ছিলো।
নির্ভানার সাঁতারু বাচ্চা
ফটোগ্রাফার কার্ক ওয়েডেল এই বিখ্যাত ছবিটি তুলেছেন নির্ভানার নেভারমাইন্ড অ্যালবামের প্রচ্ছদের জন্য। ছবিটির চারমাসের বাচ্চাটি ছিলো ওয়েডেলের বন্ধুর ছেলে। আদতে বাচ্চাটি সাঁতার কাটছিলো না। পাশে বসে থাকা মা বাচ্চাটির মুখে বড় এক দম দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেন। আর তখনই ছবি তুলেন ওয়েডেল। মাত্র দু’বারের চেষ্টাতেই মনমতো ছবি পেয়ে যান এই চিত্রগ্রাহক।
আইনস্টাইনের জন্মদিন
নিজের ৭২তম জন্মদিন পালন করতে পার্টিতে আসেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। পার্টি শেষে যাওয়ার সময় আর্থার সেসি আইনস্টাইনের কাছে যান একটি ছবি তোলার জন্য। ততক্ষণে গাড়িতে উঠে গেছেন তিনি। কিন্তু সেসির অনুরোধ ফেলতে পারেননি। সারাদিন হাসিমুখে ছবি তোলা আইনস্টাইনের এবার নিজের জিভ বের করে দেন। আর সেই মুহূর্তটিই ক্যামেরায় বন্দী করেন সেসি। তবে মূল ছবিটি আরো বড় ছিলো। কিন্তু পোর্ট্রেট ছবির জন্য আশেপাশের সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু আইনস্টাইনকে রাখা হয় ছবিতে।
আফগান মেয়ে
সেই সময় যুদ্ধাবস্থা ও শরণার্থীদের ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা হাতে আফগানিস্তান যান স্টিভ ম্যাককারি। ১৯৮৪ সালে এক শরণার্থী শিবিরে একটি ১২ বছরের বালিকা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুরো পরিবারকে হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় মিলেছিলো মেয়েটির। আর সেই মেয়েরই একটি সাধারণ ছবি তুলে নিয়ে আসেন ক্যাককারি। কিন্তু এই সাধারণ ছবিই যে অসাধারণ হয়ে উঠবে তা তিনি টের পান পরবর্তীতে। ১৯৮৫ সালের জুন মাসে প্রচ্ছদ হিসেবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে এই ছবিটি ছাপা হয়। আর তাতেই সবুজ চোখের এই বালিকা বিখ্যাত হয়ে উঠে। ২০০২ সালে অবশেষে স্টিভ ম্যাককারি খুঁজে পান এই বালিকাকে। অবশ্য ততদিনে আর বালিকা নেই শরবত ঘুলা নামের এই মেয়েটি। বিয়ে করে আফগানিস্তানেই থিতু হয়েছিলেন তিনি।
এবি রোড
‘দ্য এবি রোড’ অ্যালবামের জন্য করা কভারটিই বিটলসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি হিসেবে বিবেচিত। কালজয়ী এই ব্যান্ডের ১২তম অ্যালবামের কভার ছবির জন্য স্টুডিও’র পাশের রাস্তাতেই ছবিটি তোলা হয়, যার জন্য কিছুক্ষণ রাস্তা বন্ধ রাখা হয়। সেই সময়ে একজন আমেরিকান ট্যুরিস্ট যাচ্ছিলেন ওই রাস্তা ধরে। রাস্তা বন্ধ থাকার কারণ জানতে পাশে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়ির সামনে যান লোকটি। পরবর্তীতে খেয়াল করেন যে রাস্তার মাঝখানে চারজন লোক হেঁটে যাচ্ছে। এক বছর পর সেই লোক নিজেকে আবিষ্কার করেন দ্য বিটলসের বিখ্যাত এই পোস্টারের মধ্যে।
মোহাম্মদ আলী বনাম সনি লিস্টন
স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের আলোকচিত্রী নিল লেইফার এই বিখ্যাত ছবিটি ধারণ করেন। একেবারে ঠিক সময়ে ক্লিক করা এই ছবিটিই যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া ছবি হয়ে উঠবে, তা কে জানতো! তবে ভাগ্যও সহায় ছিল তার। একজন সিনিয়র আলোকচিত্রীর কারণেই আগের জায়গা ছেড়ে রিংয়ের এই পাশটাতে বসতে হয় লেইফারকে। সেই সময় মাত্র ২২ বছর বয়সী লেইফার ছাড়াও স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের অনেক প্রবীণ আলোকচিত্রী ছিলেন সেই ম্যাচটিতে। তার মধ্যে হার্ব শার্ফম্যান অনেক ভালো ছবি তুললেও লেইফারের এই এক ছবির কাছেই হার মানেন। মজার বিষয় হচ্ছে, লেইফারের তোলা ছবিতে মোহাম্মদ আলীর পায়ের ফাঁক দিয়ে হার্ব শার্ফম্যানকেও দেখা যাচ্ছিলো।
ট্যাংক ম্যান
প্রতীকি এই ছবিটি তুলেছেন জেফ ওয়াইডেনার। সরকারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে গিয়ে চলমানরত ট্যাংকের সামনেই দাঁড়িয়ে যান লোকটি। আর সেই মুহূর্তটিই ক্যামেরায় বন্দী করেন ওয়াইডেনার। পুলিৎজার জয়ী আলোকচিত্রী লিউ হিউং শিং-ও সেই ঘটনা কভার করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। জেফ ওয়াইডেনারের ছবিটি দেখে তিনি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ছবিটি লুকিয়ে রাখতে। ওয়াইডেনার হোটলের লবি পেরিয়ে একজন আমেরিকান লোককে দেখতে পান। তাকে কিছু টাকা দিয়ে সেই ছবিটি পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রেসের কাছে পৌঁছে দিতে বলেন ওয়াইডেনার। আর তাতেই পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছবিটি। তবে ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া লোকটি অজ্ঞাতই থেকে যায়।
অস্কার সেলফি
২০১৪ সালের অস্কারের মঞ্চ। সেবার উপস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন অ্যালেন ডিজেনেরাস। হুট করেই কারো থেকে একটি স্যামসাং মোবাইল নিয়ে উপস্থিত তারকাদের নিয়ে একটি সেলফি তুলে ফেললেন তিনি। যে সেলফিতে ছিলেন মেরিল স্ট্রিপ, কেভিন স্পেসি, ব্র্যাড পিট, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, ব্র্যাডলি কুপার, জেনিফার লরেন্সের মতো তারকারা। মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায় ছবিটি। টুইটারে ৩ মিলিয়নের বেশি রিটুইট হয় ছবিটি, যা কিনা টুইটারে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এমনকি স্যামসাং মোবাইল কোম্পানির জন্যও আশীর্বাদ হয়ে আসে ছবিটি। কোম্পানির বাজারদর বেড়ে যায় অনেকগুণ। কোম্পানি পরবর্তীতে জানায় যে এই একটি সেলফির বাজারদর ছিলো ৮০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যমানের কাছাকাছি।
সালভাদর দালি
ছবিটি তুলতে ফিলিপ হেলসম্যানের লেগেছিলো ২৮টি শট ও ছয় ঘণ্টা। তিনটি বেড়াল, পানি ও চেয়ারের সমন্বয়ে হেলসম্যান তুলেছিলেন তার স্বপ্নের ছবিটি। ছবিটির কেন্দ্রে ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি। হেলসম্যান ছিলেন দালির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৪৮ সালে দুই বন্ধুর সাক্ষাতে একটি ছবির আইডিয়া আসে হেলসম্যানের। আর ২৮ বারের চেষ্টায় নিজের সেই স্বপ্নের ছবিটি পান বিখ্যাত এই আলোকচিত্রী।