মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের প্রেক্ষাপট

পানিপথের যুদ্ধের পর ১৫২৬ সালের মাঝামাঝির দিকে গুজরাটের সিংহাসনে বসেন মুজাফফরি রাজবংশের শাসক সুলতান কুতুবউদ্দিন বাহাদুর শাহ। তিনি বেশ সাহসী, দক্ষ যোদ্ধা এবং দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তাছাড়া মানুষ হিসেবে তিনি বেশ উদারও ছিলেন। ফলে তিনি সিংহাসনে আরোহণের পর হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার দরবারে জ্ঞানী-গুণী মানুষের ভিড় বাড়তে লাগলো।

বাহাদুর শাহ আফগানদের প্রতিও কিছুটা উদার ছিলেন। পানিপথের যুদ্ধের পর মুঘল সাম্রাজ্য গঠিত হওয়ার সাথে সাথে বিপুল সংখ্যক আফগান কর্মহীন হয়ে পড়লো। বাহাদুর শাহের উদারতার কথা জানতে পেরে তারা গুজরাটে ব্যাপকভাবে আশ্রয় নিতে থাকলো। এই আশ্রয়প্রার্থীদের মাঝে এমন কিছু মানুষও ছিলেন, যারা হয় মুঘল বিদ্রোহী কিংবা গুরুত্বপূর্ণ আফগান ব্যক্তিবর্গ, যারা মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিলো।

পানিপথের যুদ্ধ। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল সংঘঠিত এই যুদ্ধে দিল্লির লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে সম্রাট বাবর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মুঘল সাম্রাজ্য; Source: Wikimedia Commons

১৫৩২ সালে গুজরাটের বাহাদুর শাহের দরবারে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশী হন এমনই একজন যিনি কালপির সাবেক মুঘল গভর্নর ছিলেন। আলিম খান জিলাল খান জিঘাত নামক এই আমির একসময় বাবরের সহযোগী ছিলেন, কিন্তু হুমায়ুনকে অপছন্দ করায় তিনি বাহাদুর শাহর কাছে চলে আসেন। বাহাদুর শাহ তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। বাহাদুর শাহর দরবারে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশী আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন সুলতান বাহালুল লোদির পুত্র এবং শেষ লোদি সুলতান ইব্রাহীম লোদির চাচা সুলতান আলাউদ্দিন আলম খান লোদি। আলাউদ্দিন আলম খানের সাথে তার পুত্র তাতার খানও ছিলেন। গুজরাটের বাহাদুর শাহ তাদের উভয়কেই আনন্দের সাথে গ্রহণ করেন।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাতার খান বেশ দক্ষ একজন জেনারেল ছিলেন। তাছাড়া তিনি বেশ পরিশ্রমী আর উদ্যমী মানুষ ছিলেন। তিনি চাইছিলেন দ্রুত সদ্য প্রতিষ্ঠিত শিশু মুঘল সাম্রাজ্যের মূলোৎপাটন করে দিল্লির সিংহাসনে তার পিতা আলম খানকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু বাহাদুর শাহ তখনও মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে চাইছিলেন না। তাছাড়া দিল্লির সিংহাসনের প্রতি আলম খানের দাবিও তেমন জোরালো না। কারণ তিনি পূর্বে কখনোই দিল্লির সিংহাসনে আক্ষরিক অর্থে বসেননি।

এদিকে বিহারের মুঘল প্রশাসক জামান মির্জা ১৫৩৪ সালে আগ্রার নিকটবর্তী বায়ানা দুর্গ থেকে পালিয়ে গুজরাটের দরবারে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশী হন। বাহাদুর শাহ তাকেও আশ্রয় দেন। ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে, এমন সব ব্যক্তিবর্গের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছিলো এই গুজরাটের দরবার।

বাবরের মৃত্যুর পর তাইমূরি বংশের জামান মির্জা নিজেই মুঘল সিংহাসনে বসার চেষ্টা করেছিলেন। হুমায়ূনের সিংহাসন আরোহণের সময় তিনি হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। হেরাতের শাসক হুসাইন বাইকারার নাতি, এবং হুমায়ুনের সৎ বোন মাসুমা বেগমের স্বামী এই জামান মির্জার আরেকটি পরিচয়ও আছে। তার বোন সুলতানা বেগম ছিলেন হুমায়ুনের ছোট ভাই হিন্দাল মির্জার স্ত্রী। অর্থাৎ, জামান মির্জা বিভিন্নভাবে মুঘল রাজপরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ একজন মানুষ ছিলেন। হিন্দালের সাথে তার বোন সুলতানা বেগমের বিয়ের পর হুমায়ুন জামান মির্জাকে তার পূর্বের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা করে দিয়ে বিহারের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সুযোগ পেয়ে আবারও বিদ্রোহের পরিকল্পনা করলে হুমায়ুনের নির্দেশে তাকে বায়ানার দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়। তিনি এই বায়ানা থেকেই পালিয়ে হুমায়ুন এবং নিজের পরিবারেরই শত্রু বাহাদুর শাহের কাছে আশ্রয় নিলেন।

এদিকে গুজরাটের দরবারে নিজের এই বিশেষ পরিচয়ের কারণে জামান মির্জা গুজরাটের দরবারে বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছিলেন।

গুজরাটের দরবারে জামান মির্জা রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়ার পর সম্রাট হুমায়ুন বাহাদুর শাহর সাথে দূতের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেন। তিনি জামান মির্জাকে মুঘল রাজদরবারে ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলেন। অবশ্য এর আগেও বাহাদুর শাহর সাথে সম্রাট হুমায়ুনের যোগাযোগ হয়েছিলো, তবে তা ছিলো সৌজন্যমূলক কথাবার্তা। তবে পলাতক বিদ্রোহীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে কিছু কথাবার্তা হয়েছিলো। এসময় এই দুই শাসকের মাঝে উপঢৌকন বিনিময়ও হয়েছিলো।

জামান মির্জাকে আশ্রয় দেয়ার প্রসঙ্গে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে জিজ্ঞাসা করলে বাহাদুর শাহ যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা রীতিমত হাস্যকর ছিলো। তিনি হুমায়ুনকে এই উত্তর দিয়ে পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি ভেবেছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের প্রজা হিসেবে জামান মির্জাকে তিনি তার পুত্রসম ভেবেই আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিলো না এতে!

গুজরাটের বাহাদুর শাহ; Source: historydiscussion.net

হুমায়ুন চাইলে জামান মির্জাকে ফেরত দেয়া হবে, এমন ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় তিনি সরাসরি তখনো কোনো সংঘাতে জড়াতে না চাইলেও নিজের সেনাবাহিনীকে মুঘল সেনাবাহিনীর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করছিলেন তিনি।

এদিকে তাতার খান বারবার বাহাদুর শাহর কাছে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছিলো। শেষপর্যন্ত তাতার খানের বিপুল আগ্রহের কারণেই তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাতার খানকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। তবে বাহাদুর শাহ তখনো সরাসরি নিজে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চাইছিলেন না। কারণ মুঘল যোদ্ধাদের সীমাহীন দক্ষতার ব্যপারটা তার জানা ছিলো। তাছাড়া সেইসময় তিনি চিতোর দুর্গ অবরোধ নিয়ে ভাবছিলেন।

এদিকে বাহাদুর শাহর অনুমতি পেয়েই তাতার খান একটি ছোট সেনাবাহিনী নিয়ে মুঘল সীমান্তের দিকে ধেয়ে এগিয়ে গেলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো দিয়ে আক্রমণ চালান এবং চিতোরগড় অধিকার করে নেন। তাতার খানের প্রাথমিক সাফল্য দেখে বাহাদুর শাহ সন্তুষ্ট হন। তিনি দিল্লি ও আগ্রা আক্রমণ করতে এবং তাতার খানকে নিজের সেনাবাহিনী গুছিয়ে নিতে রণথম্বরের গভর্ণর ইমাদ-উল-মুলকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রায় ৩ কোটি গুজরাটি মুদ্রা প্রদান করেন। তাতার খান এই অর্থ হাতে পেয়ে দ্রুত চলনসই একটি বাহিনী দাঁড় করে ফেলেন। তবে তাতার খানের এই বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যেরই পূর্বের কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ ছিলো না। ফলে তাতার খান এমন একটি বাহিনী পেলেন যাদের সামরিক শৃঙ্খলা বলতে আসলে তেমন কিছুই ছিলো না। তাতার খানের নির্বুদ্ধিতা এই যে, তিনি এই রকম একটা বিশৃঙ্খল বাহিনী নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর মতো যুদ্ধে পোড় খাওয়া একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলেন!

তবে তাতার খান যে নিজের দুর্বলতা বুঝতেন না, তা না। নিজের দুর্বলতা অনুভব করেই তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলেন না। আর তাই, তিনি তার এই হঠাৎ আক্রমণে মুঘল সেনাবাহিনী যেন দিশেহারা হয়ে যায়, সেজন্য একইসাথে আরো দুটি গুরুত্বহীন কিন্তু কার্যকরী আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একটি আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় বোরহান উল-মুলক নরপালিকে। তার লক্ষ্য ছিলো দিল্লি সীমান্তে গোলযোগ তৈরি করা এবং সম্ভব হলে দিল্লি দখল করে নেয়া। অন্য আক্রমণ পরিচালনা করেন আলাউদ্দিন আলম খান স্বয়ং। তার লক্ষ্য ছিলো কালিঞ্জর দুর্গটি দখলে নেয়া।

এই দুটি বাহিনীকে দুদিকে প্রেরণ করে তাতার খান নিজে দ্রুত বায়ানা দখল করতে বায়ানার দিকে ধেয়ে আসেন। হুমায়ুন তার ভাই হিন্দাল মির্জাকে দ্রুত বায়ানার দিকে তাতার খানের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে প্রেরণ করেন। কিন্তু হিন্দাল মির্জার নেতৃত্বাধীন মুঘল সেনাবাহিনীটি বায়ানা পৌঁছানোর আগেই তাতার খান বায়ান দখল করে ফেলেন। তাতার খান যখন বায়ানা দখল সমাপ্ত করেন, হিন্দাল মির্জা তখন মাত্র বায়ানার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিলেন। এসময় তাতার খানের অধীনে প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি সৈন্য ছিলো। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো এরপর তাতার খানের লক্ষ্য হতে যাচ্ছে মাত্র ৭৬ কিলোমিটার দূরবর্তী আগ্রা! তাতার খানের আগ্রাসী অগ্রযাত্রায় সমগ্র আগ্রাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে।

বায়ানার দুর্গের একাংশ; Source: Wikimedia Commons

একদিকে হিন্দাল মির্জা আর আশকারি মির্জার অধীনে জাহিদ বেগ আর দোস্ত বেগের মতো জাঁদরেল জেনারেলদের নেতৃত্বে প্রায় ১৮ হাজার সৈন্যের মুঘল সেনাবাহিনীটি বায়ানা থেকে অল্প কয়েক মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে, বায়ানার দুর্গে একটি অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা ঘটে যায়। শক্তিশালী মুঘল সেনাবাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে তাতার খানের সৈন্যরা ঘাবড়ে যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাতার খানের সাথে থাকা বাহিনীটি অভিজ্ঞ কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিলো না। বরং তড়িঘড়ি করে গড়ে তোলা কিছু জনসমষ্টি ছিলো মাত্র, যাদের অধিকাংশেরই পূর্বে কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো না। শুধুমাত্র অর্থের লোভে অনেক সাধারণ মানুষই এই বাহিনীটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। ফলে মুঘল সেনাবাহিনীর এগিয়ে আসার কথা শুনেই ভোজবাজীর মতো তাতার খানের অধিকাংশ সৈন্যই গায়েব হয়ে হয়ে গেলো! বাকী যারা ছিলো তারাও দ্রুত বায়ানা ত্যাগ করতে চাইলে তাতার খান বাধ্য হন বায়ানা ত্যাগ করতে। তাতার খানের হাতে পাওয়া বিজয় ব্যর্থতায় পরিণত হলো।

অপ্রত্যাশিত এই ঘটনা ঘটলে মুঘল সেনাবাহিনী দ্রুত বায়ানা পুনর্দখল করে নেন।

বায়ানা ত্যাগ পর মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে তাতার খানের বাহিনীর সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করার মতো পরিস্থিতির তৈরি হয়।

এসময় তাতার খানের বাহিনীর আকার ৪০ হাজার সৈন্য থেকে নেমে মাত্র ৩ হাজার সৈন্যে পৌঁছায়। এই সৈন্য নিয়েই তিনি অসীম সাহসিকতায় বায়ানার বাইরে শক্ত অবস্থান ধরে রাখেন। এদিকে বায়ানাতে ১৩ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে হিন্দাল মির্জা ৫ হাজার সৈন্য নিয়ে তাতার খানকে মুকাবিলা করতে এগিয়ে যান।

অন্যদিকে, বাহাদুর শাহর পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন। তিনি আশা করছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তার প্রেরিত বাহিনী ৩টি সফল হবে। এরপর তিনি স্বয়ং নেতৃত্ব দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যে কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করবেন। তাই তিনি তাতার খানকে বার্তা পাঠিয়ে যে করেই হোক তিনি আসার পূর্ব পর্যন্ত তাতার খানের অবস্থান ধরে রাখার নির্দেশ দেন। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ এই সময় চিতোর দুর্গ অবরোধে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে তার পক্ষে খুব দ্রুত তাতার খানের সহায়তায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না, এটা তাতার খান নিজেও জানতেন।

চিতোর দুর্গ। মেওয়ারের রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত এই দুর্গটিকে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ ১৫৩৪ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয়বারের মতো অবরোধ করেন; Source: Wikimedia Commons

তাতার খান পরে যান উভয় সংকটে। তিনি নিজেও জানতেন জাঁদরেল মুঘল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তার বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। আবার বাহাদুর শাহর ইচ্ছানুযায়ী নিজের বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে না পারলে বাহাদুর শাহর কাছে তিনি অকৃতকার্য প্রমাণিত হবেন। এতে তার পিতার দিল্লির সিংহাসন অধিকারের স্বপ্ন আজীবন স্বপ্নই রয়ে যাবে। তাই শেষপর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে হলেও নিজের অবস্থান ধরে রাখতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

১৫৩৪ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে হিন্দাল মির্জার নেতৃত্বে ৫ হাজার মুঘল সৈন্য আর তাতার খানের নেতৃত্বাধীন ৩ হাজার সৈন্যের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ আসন্ন, উভয়পক্ষ তা বুঝতে পারে। সৈন্য বিন্যাস করে তাতার খানই প্রথম আক্রমণ সূচনা করেন, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে পোড় খাওয়া মুঘল সেনাবাহিনীর দক্ষতায় দ্রুতই তার বাহিনীর সৈন্যরা মারা যেতে থাকে। যুদ্ধের একপর্যায়ে তাতার খান নিজেও নিহত হন।

এদিকে বোরহান উল মুলক নরপালি এবং আলাউদ্দিন আলম খান লোদি উভয়ই ব্যর্থ হন। আর অন্যদিকে তাতার খান নিহত হলে দিল্লির সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা পুরোপুরি মাঠে মারা যায়।

তাতার খানের বাহিনী হিন্দালে মির্জার বাহিনী দ্বারা বিধ্বস্ত হলে চিতোর অবরোধে ব্যস্ত বাহাদুর শাহ হুমায়ুনের নিকট একটি পত্র লিখে পাঠান। তিনি লিখেন,

যেহেতু আমি অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত আছি, তাই আশা করবো হুমায়ুন এই অবস্থায় আমাকে আক্রমণ করবেন না।

দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাহাদুর শাহর এই পত্রটির কোনো উত্তর না দিয়ে মালওয়ার সারাংপুরের দিকে অগ্রযাত্রা করেন। হুমায়ুন সারাংপুরে এসে পৌঁছেছেন, এই সংবাদে বাহাদুর শাহ বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তবে সম্রাট হুমায়ুন শেষপর্যন্ত বাহাদুর শাহর বিরুদ্ধে কোনোরকম কার্যকলাপ পরিচালনা না করে ১৫৩৫ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে উজ্জয়িনীর দিকে যাত্রা করেন। বাহাদুর শাহর চিতোর অভিযান শেষ হয় এর পরের মাসে, অর্থাৎ ১৫৩৫ সালের মার্চ মাসে। এই সময় পর্যন্ত হুমায়ুন উজ্জয়িনীতে ঘাটি গেড়ে বসে থাকেন।

তথ্যসূত্র

১। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩

২। History of the Rise of the Mahomedan Power in India, Till the Year AD 1612, Mohamed Kashim Ferishta, Translator: John Briggs

 

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক || ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল ||  ২২। দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

 

ফিচার ইমেজ: merwynsrucksack.blogspot.com

Related Articles

Exit mobile version