ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান নিদর্শন হচ্ছে মসজিদ। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর হাত ধরে ইসলাম ধর্মের দ্রুত প্রচার ও প্রসার হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকে মসজিদের সংখ্যাও। তার ইন্তেকালের পরে; বিশেষত ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের (রা) সময় মুসলিম জাহান বিপুল বিস্তৃতি লাভ করে। এই বিস্তৃত ভূমিতে নির্মিত হতে থাকে নতুন নতুন মসজিদ। সময়ের বিবর্তনে সেসব মসজিদের অনেকগুলো এখনো যেমন টিকে আছে, আবার হারিয়েও গিয়েছে অনেক।
সম্প্রতি তেমনি হারিয়ে যাওয়া এক মসজিদের সন্ধান মিলেছে ইসরায়েলে। দেশটির বেদুইন অধ্যুষিত নগরী রাহাতের পার্শ্ববর্তী মরুভূমি নেগেভে আবিষ্কৃত হয়েছে মুসলমানদের প্রাচীন এই উপাসনালয়টি। ইসরায়েলের জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের (আইএএ) ভাষ্যমতে, মসজিদটি সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীর দিকে নির্মিত হয়েছিল। সেই হিসেবে মসজিদটির বর্তমান বয়স কমপক্ষে ১২০০ বছর। অর্থাৎ ইসলামের শুরুর দিকে যে গুটিকয়েক মসজিদ বিশ্বব্যাপী নির্মিত হয়েছিল তার মধ্যে এটি অন্যতম। ফলে গবেষকগণ একে ‘দুর্লভ ও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এমন ঐতিহাসিক মসজিদের সন্ধান পেয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তাগণ নড়েচড়ে বসেছেন। মুসলমানদের পবিত্র ভূমি মক্কা-মদিনার সন্নিকটে অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও মসজিদটি কীভাবে হারিয়ে গেল তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়েছে। পাশাপাশি গবেষকগণ অবাক হচ্ছেন মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী ও অবকাঠামো নিয়েও।
কেননা, মসজিদটিতে যে স্থাপত্যশৈলী ব্যবহৃত হয়েছে তা অত্র অঞ্চলের অন্যান্য স্থাপত্যশৈলী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মসজিদটি ছিল সময়ের তুলনায় আধুনিক ও উন্নত কলাকৌশল সমৃদ্ধ। এর চেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী মধ্যপ্রাচ্যের তথা মক্কা-মদিনার স্থাপত্যশৈলী থেকেও ভিন্ন। ফলে তৎকালীন নির্মাতারা এমন অনুপম নকশা কোন জায়গা থেকে গ্রহণ করেছিলেন তা গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে হাজির হয়েছে। যেমনটি বলছিলেন মসজিদটি উদ্ধার কাজের সাথে যুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক দলের সহকারি পরিচালক সাহার জুর,
এটি একটি ছোট ও গ্রাম্য মসজিদ। সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময় মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এটি একটি দুর্লভ স্থাপত্য। মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি তৎকালীন সমগ্র বিশ্বে এমন স্থাপত্যশৈলীর নজির খুব একটা পাওয়া যায় না। বিশেষত উত্তর বিরসেভা (নেগেভের রাজধানী) অঞ্চলে এখন পর্যন্ত এ ধরনের একটি ভবনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গবেষকগণ ধারণা করছেন, স্থানীয় মুসলিম কৃষকগণ এই মসজিদটি গড়ে তুলেছিলেন। মসজিদটির উপরিভাগে কোনো ছাদ ছিল না। অর্থাৎ খোলা আকাশের নিচে তারা নামাজ আদায় করতেন। গঠনের দিক থেকে এটি ছিল আয়তক্ষেত্রাকার। ছাদ না থাকলেও মসজিদের চারপাশ দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত ছিল। মসজিদের সম্মুখভাগে ছিল একটি মেহরাব। স্বভাবতই মসজিদটি মুসলমানদের পবিত্র নগরী মক্কা অভিমুখে নির্মিত হয়েছিল। মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মুসল্লিদের একমাত্র প্রবেশপথ ছিল। এ বিষয়ে গবেষক দলের প্রধান পরিচালক সেলিগম্যান বলেন,
এসব বৈশিষ্ট্য ও তথ্য-উপাত্ত ভবনটি নির্মাণের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দেয়। বহু বছর আগে এটি মুসলমানদের মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
গবেষকগণ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, অত্র অঞ্চলে মুসলিম ধর্মাবলম্বী একদল কৃষকের বসবাস গড়ে উঠেছিল। কেননা মসজিদটির আশেপাশে বেশ কিছু বসত বাড়ি, ফসলের সংরক্ষণাগার, বিস্তৃত উঠান এবং খাদ্য তৈরির রন্ধনশালার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে; যা মূলত কৃষকদের জীবনযাপনের সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে আরবদের মধ্যে যেহেতু প্রাচীনকাল থেকেই বেদুইন জীবনযাপনের অভ্যস্ততা রয়েছে এবং অত্র অঞ্চলে এখন পর্যন্ত আরব্য বেদুইনরা বসবাস করছে, সেহেতু উক্ত মসজিদের নির্মাতাগণও হয়তো কোনো বেদুইন সম্প্রদায়ের ছিল। জীবিকা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে তারা যখন অন্যত্র চলে গিয়েছে তখন মসজিদটি অব্যবহৃত থাকতে থাকতে একপর্যায়ে মাটিচাপা পড়ে গিয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা অন্য কোনো কারণেও মসজিদটি হারিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রটি ভৌগলিকভাবে মক্কা-মদিনার নিকটবর্তী হওয়াতে ইসলাম আগমনের শুরুর দিকেই সেখানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছায় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ভূখণ্ডটি মুসলমানদের অধীনে আসে। যেমনটি বলছিলেন ইসরায়েলের প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইসলামের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ গিডেন আভনি-
এটি অন্যতম প্রাচীন একটি মসজিদ। যা আজকে ইসরায়েলের সীমারেখায় অবস্থান করছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৬৩৬ সালে আরবরা প্রথমবারের মত অত্র অঞ্চল দখল করে নেয়।
অর্থাৎ অত্র অঞ্চল মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসলে, যে সকল স্থানীয় কৃষকগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন, তারাই এই মসজিদটি গড়ে তুলেছিলেন বলে অনুমান করা যায়। অত্র অঞ্চলে এটিই ছিল মুসলমানদের প্রথম আনুষ্ঠানিক মসজিদ। এখন পর্যন্ত নেগেভ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আর কোনো প্রাচীন মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
মূলত নেগেভের যে অঞ্চলে এই মসজিদটির অবস্থান সেটি ক্রমাগত একটি উন্নত শহরে পরিণত হচ্ছে। আশেপাশে নতুন নতুন বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। ঠিক এই জায়গাটিতেও একটি ভবন নির্মাণের জন্য খননকাজ শুরু করেছিল একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর তখনই মাটির নিচে তারা এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সন্ধান লাভ করে। পরবর্তীতে স্থাপনাটির যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন করে ইসরায়েলের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বর্তমানে দেশটির কর্তৃপক্ষ মসজিদটির পূর্ণ খননকাজ ও সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গ্রামটিও উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। কিন্তু এমন অনুপম নকশায় কৃষকরা কীভাবে এই মসজিদটি গড়ে তুলেছিল তা এখনো রহস্যই থেকে গেল। এ জন্যই মসজিদটির গুরুত্ব উল্লেখ করতে গিয়ে গিডেন আভনি বলেন-
এই প্রাচীন গ্রামের অস্তিত্ব ও মসজিদটির আবিষ্কার এবং তার অনুপম স্থাপত্যশৈলী ইতিহাস চর্চায় নতুন এক মাত্রা যোগ করবে। এছাড়া এটি ইসরায়েলের অস্থিতিশীল দিনগুলোর ইতিহাস পুনঃপাঠে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিতর্কিত ইহুদী প্রধান রাষ্ট্র। বিশেষত জোরপূর্বক ফিলিস্তিনের ভূমি দখল ও জনগণের উপর নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যদিও এখনো ইসরায়েলের প্রায় ১৭ শতাংশ জনগণ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। মুসলমানরা সেখানকার প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। দেশের অভ্যন্তরে তাদের জন্য একাধিক মসজিদ রয়েছে। সেখানে তারা নিয়মিত নামাজ আদায়ের সুযোগ পেয়ে থাকেন। তবুও এই মসজিদটি তাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়েছে। সেখানে গিয়ে অনেককে নামাজ আদায় করতে দেখা যায়।
হয়তো আরও অধিক গবেষণার মাধ্যমে এই মসজিদটি প্রত্নতত্ত্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও মুসলিম সভ্যতার সুবিশাল মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। বেরিয়ে আসবে আরও নতুন নতুন তথ্য। বিশেষত এর রহস্যেঘেরা নির্মাণশৈলী সম্পর্কে। জানা যাবে একটি কৃষক সম্প্রদায়ের অনন্য স্থাপত্যশৈলীর কলাকৌশল সম্পর্কে।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
মসজিদ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো