“মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।”
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান দুই সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান। এই দুই সম্প্রদায়ের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল। ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কতিপয় অংশের মধ্যে একে অপরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ থাকলেও বিভিন্ন সময়ে অনেক উদারপন্থী মানুষই এই দুই সম্প্রদায়কে এক করতে চেয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশ এমনই এক মানুষ ছিলেন যিনি ব্রিটিশ শাসিত বাংলার হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। শতধা বিভক্ত হিন্দু ও মুসলিমদের একত্রিত করার জন্য তিনি বেঙ্গল প্যাক্ট প্রণয়ন করেন। বেঙ্গল প্যাক্ট বুঝার জন্য এর পটভূমিটা জানা জরুরি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের (অবিভক্ত ভারত) স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। স্বায়ত্তশাসন এবং আরো কিছু প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে ১৩ লক্ষাধিক ভারতীয় সৈন্য লড়াই করে। এর মধ্যে প্রায় ৭৪ হাজার ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন প্রণয়ন করে। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ভারতীয়দের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। এই আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনসভায় কোনো প্রস্তাব অনুমোদিত হলে তা গভর্নর জেনারেল অগ্রাহ্য করতে পারতেন। ফলে আইনসভা প্রকৃত ক্ষমতা লাভ থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯২০ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। একইসময় ওসমানীয় খিলাফত টিকিয়ে রাখার জন্য উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। একসময় অসহযোগ আন্দোলনের সাথে খিলাফত আন্দোলনও যুক্ত হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করে। অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধীজী ত্রিবর্জন নীতি গ্রহণ করেন অর্থাৎ আইনসভা, আদালত ও সরকারি স্কুল কলেজ বর্জন করতে হবে।
কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একসময় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। আন্দোলন শেষে আইনসভায় অংশগ্রহণ করা নিয়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে। চিত্তরঞ্জন দাশ ও কয়েকজন নেতা আইনসভায় অংশগ্রহণ করে ইংরেজদের সমালোচনা করার পক্ষে ছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল, কাউন্সিলে থেকে ধারাবাহিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রবর্তিত দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটানো। পার্লামেন্টে ইংরেজদের বিরোধিতার নীতি অব্যাহত রাখার জন্য চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেসের ভেতর নিজস্ব গ্রুপ গঠন করেন।
এছাড়া এ সময় বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে যেতে থাকে। দলে ক্রমশ চরমপন্থী ও উগ্রপন্থীরা শক্তিশালী হতে থাকে। সাম্প্রদায়িক নেতারা অত্যন্ত প্রভাবশালী হতে থাকে। কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িক দল থেকে হিন্দুত্ববাদীদের দলে পরিণত হয়ে পড়ে। কংগ্রেস স্পষ্টতই সংস্কারবাদী (pro changers) এবং রক্ষণশীল (no changers) শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়।
এ সময় কয়েকজন কংগ্রেস নেতা দলের সাম্প্রদায়িক ও একমুখী নীতির বিরোধিতা করেন। তারা মুসলিমদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তারা উপলব্ধি করেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সফল হতে হলে হিন্দু মুসলিমদের একত্রিত হতে হবে, হিন্দু ও মুসলিমদের একত্রিত হওয়া ছাড়া ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এই গুটিকয়েক অসাম্প্রদায়িক নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।
১৯২২ সালে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘কাউন্সিল এন্ট্রি’ প্রোগ্রাম পেশ করেন। কংগ্রেস নেতারা তার প্রস্তাব গ্রহণ না করায় মতবিরোধের জের ধরে তিনি সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। কিছুদিন পরে ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতেই তিনি সমমনা কয়েকজন নেতাকে নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই স্বরাজ্য দল (উপদল) গঠন করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ উপলব্ধি করেন, ব্যবস্থাপক পরিষদে হিন্দু ও মুসলিমদের মিলিত সংগ্রাম ছাড়া বাংলার স্বাধিকার অর্জন সম্ভব নয়।
তাই চিত্তরঞ্জন দাশ জোর দিয়ে উল্লেখ করেন যে শাসনকার্যের অংশীদার হিসেবে মুসলমান ও হিন্দু নিম্ন শ্রেণিকে হিন্দু ভদ্রলোক (উচ্চশ্রেণি) শ্রেণির স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে। এজন্য তারা দীর্ঘ অবহেলিত মুসলিমদের সংগত অধিকারসমূহের প্রতি সহানুভূতি দেখানো অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করেন। স্বরাজ্য পার্টিকে শক্তিশালী করতে চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলমানদের সহযোগিতা কামনা করেন।
চিত্তরঞ্জন দাশের এই অসাম্প্রদায়িক নীতি ও আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সোহরাওয়ার্দীর মতো যুব নেতারা স্বরাজ্য পার্টিতে যোগদান করতে থাকেন। চিত্তরঞ্জন দাশের এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনাকে বাংলার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বহু নেতা সমর্থন দেন। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ড. আনসারি হাকিম, আজমল খাঁ, বিঠলভাই প্যাটেল, পন্ডিত মতিলাল নেহেরু, মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী, ডা: বিধানচন্দ্র রায় প্রভৃতি অনেক নেতা দেশবন্ধুকে সমর্থন করেন। ১৯২৩ সালে বাংলার আইনসভা নির্বাচনে নবগঠিত স্বরাজ্য পার্টি প্রথম অংশগ্রহণ করে এবং আশানুরূপ ফলও পায়। স্বরাজ্য পার্টি থেকে হিন্দু-মুসলিম সমান সদস্য মনোনয়ন করা হলেও স্বরাজ্য পার্টির মুসলিম প্রার্থীদের অনেকেই পরাজিত হয় কারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা অংশ তখনো স্বরাজ্য পার্টিকে সমর্থন দেয়নি। ফলে স্বরাজ্য পার্টি থেকে মাত্র কয়েকজন মুসলিম সদস্যই নির্বাচিত হয়। মুসলিমদের অনেকেই স্বরাজ্য পার্টির বাইরে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিল।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে স্বায়ত্তশাসনের যে সীমিত সুযোগ সৃষ্টি হয় তার সুফল যেন বাংলার মুসলিমরাও ভোগ করতে পারে সে ব্যাপারে মুসলিম নেতৃবৃন্দ আগ্রহী ছিলেন। সে লক্ষ্যে তৎকালীন বাংলার মুসলিম নেতা এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, স্যার আব্দুর রহিম, মৌলবী আব্দুল করিম, মৌলবী মুজিবুর রহমান, মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী প্রভৃতি মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং জে এম সেনগুপ্ত, শরৎচন্দ্র বসু, জে এম দাসগুপ্ত, ডা: বিধানচন্দ্র রায় প্রভৃতি হিন্দু নেতৃবৃন্দ মিলে বেঙ্গল প্যাক্ট নামক হিন্দু-মুসলিম চুক্তিনামা রচনা করতে চিত্তরঞ্জন দাশকে সাহায্য করেন। ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরিত হয়।
বেঙ্গল প্যাক্ট এর শর্তসমূহ:
- বঙ্গীয় আইন সভার প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচক মণ্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার অনুপাতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
- স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ।
- সরকারি দফতরে মুসলিমদের জন্য শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ চাকরি সংরক্ষিত থাকবে। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা চাকরিক্ষেত্রে এই পর্যায়ে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্য থেকে শতকরা আশি জনকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হবে। উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে ন্যুনতম যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে। এরপর মুসলমানরা চাকরির শতকরা ৫৫ টি এবং অমুসলিমরা শতকরা ৪৫ টি পদ পাবে। মধ্যবর্তীকালে হিন্দুদের জন্য শতকরা ২০ টি চাকরি বরাদ্দ থাকবে।
- কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয়ে কোনো আইন পাশ করতে হলে সেই সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তিন চতুর্থাংশ বা ৭৫ শতাংশ সদস্যের সমর্থন থাকতে হবে।
- মসজিদের সামনে বাদ্য সহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না। খাদ্যের জন্য গরু জবাই নিয়ে আইন সভায় কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। আইন সভার বাইরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। গরু জবাই করার সময় যাতে তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ধর্মীয় কারণে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
- এসব নীতিমালা যাতে সুষ্ঠুভাবে পালিত হয় তার জন্য একটি কমিটি থাকবে। উক্ত কমিটির অর্ধেক সদস্য থাকবেন মুসলিম এবং বাকি অর্ধেক সদস্য থাকবেন হিন্দু।
বেঙ্গল প্যাক্টের ফলে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই চুক্তির ফলে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির নতুন দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। শতাব্দীকালব্যাপী চলা হিন্দু ও মুসলিমদের ঘৃণা ও বিদ্বেষকে পেছনে ফেলে সম্প্রতির এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল এর মাধ্যমে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দুদের একটা অংশ এবং জমিদার শ্রেণির হিন্দুদের একটা অংশ এর তীব্র বিরোধিতা করে। এ সময় রক্ষণশীল হিন্দু নেতারা প্রকাশ্যে মুসলিমবিদ্বেষী বিভিন্ন বক্তৃতা দিতে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয় কংগ্রেসের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দল (উপদল) যারা চিত্তরঞ্জনের পর কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসে।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়, মারওয়ারী সম্প্রদায় ও আরো কিছু উগ্রপন্থী ব্যক্তি ও গ্রুপ এই চুক্তির কারণে দেশবন্ধুর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এর প্রতিক্রিয়া শুধু নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং তৎকালীন হিন্দুত্ববাদী পত্রিকাগুলোও এই চুক্তির বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। এ সময় কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দুদের গ্রুপগুলো দেশবন্ধু ও বেঙ্গল প্যাক্টের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় মেতে ওঠে। অমৃতবাজার পত্রিকাসহ আরো কয়েকটি পত্রিকা এই চুক্তির বিরুদ্ধে প্রচারণায় ভূমিকা রাখে। অনেক হিন্দু নেতা স্পষ্ট করে বলেন, চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলমানদের নিকট দেশকে বিকিয়ে দিচ্ছেন এবং এ চুক্তি তিনি কখনো প্রাদেশিক পরিষদে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারবেন না। কতিপয় হিন্দুদের বিরোধিতার জবাবে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেন, এই চুক্তির ফলে মুসলিমরা ন্যায়ানুগ অংশীদারিত্বের বেশি কিছুই পাবে না।
বাংলার মুসলিম নেতাদের মধ্যেও অনেকেই প্রথমদিকে এই প্যাক্টের বিরোধিতা করেন। এই প্যাক্ট-বিরোধী মুসলিম নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিরাজগঞ্জের মুসলিম নেতা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
ইসমাইল হোসেন সিরাজী হিন্দুদের সাথে কোনো চুক্তি করতে আগ্রহী ছিলেন না বরং এর প্রথমদিকে তীব্র বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে কয়েকজন মুসলিম নেতা যেমন, পাবনার জমিদার প্রমথ চৌধুরী ও করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নি ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে বুঝান যে, মুসলমানদের কারণে চিত্তরঞ্জন দাশ রক্ষণশীল হিন্দুদের চক্ষুশূল হয়েছেন তাই মুসলিমরা তাকে সাহায্য না করলে তিনি চরমপন্থী হিন্দুদের কাছে পরাজিত হবেন এবং এই চুক্তির ফলে মুসলিমরা লাভবান হবে। পরে ইসমাইল হোসেন সিরাজী নিরপেক্ষ থাকতে রাজি হন।
এরপর বেঙ্গল প্যাক্ট অনুমোদন সংকটে পড়ে। এই ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট কংগ্রেসের কোনোনাডা সম্মেলনে চরমপন্থীদের বিরোধিতায় পাশ হয়নি। কিন্তু বাংলার প্রাদেশিক সম্মেলনে মুসলিমদের পূর্ণ সহায়তার আশ্বাস থাকায় চিত্তরঞ্জন দাশ চুক্তির ব্যাপারে অবিচল থাকেন। ১৯২৪ সালে সিরাজগঞ্জে বাংলা কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন শুরু হয়। নির্দিষ্ট দিনে বিপুল উৎসাহ ও উদ্যমের সঙ্গে বিরাট সাফল্যের সাথে সম্মেলনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সিরাজগঞ্জ কনফারেন্সে সর্বসম্মতিক্রমে দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্ট গৃহীত হয়ে যায়।
হিন্দু মুসলিম ঐক্যের লক্ষ্যে বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দেশবন্ধুর স্বরাজ্য পার্টির প্রতি মুসলিমদের আস্থা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এরপর বিভিন্ন নির্বাচনে স্বরাজ্য পার্টি মুসলিমদের ব্যাপক সমর্থন পায়। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে কলকাতার হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিমরাও দেশবন্ধুকে ব্যাপক সমর্থন দেন। উক্ত নির্বাচনে মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সহযোগিতার জোরে উগ্রপন্থী পত্রিকাগুলোর বিরোধী প্রচারণা ও চরমপন্থী হিন্দু নেতাদের বিরোধীতা সত্ত্বেও চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। মুসলিমদের সমর্থন ও বেঙ্গল প্যাক্ট বিবেচনায় চিত্তরঞ্জন দাশ উদীয়মান তরুণ মুসলিম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ডেপুটি মেয়র মনোনীত করেন।
সুভাষচন্দ্র বসু এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং হাজী আব্দুর রশিদ ডেপুটি এক্সিকিউটিভ অফিসার হন। এই সময়ে অনেক মুসলমান গ্র্যাজুয়েট কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি পায়। এ সময় কর্পোরেশনের ২৫টি শূন্যপদে মুসলমানদের নিয়োগ করা হয়। এছাড়া যশোর, দিনাজপুর, মোমেনশাহী, নদীয়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি পৌরসভায় মুসলিমদের সমর্থনে স্বরাজ্য দল বিজয় অর্জন করে।
মুসলিমদের এই অগ্রগতি দেখে কতিপয় হিন্দু নেতৃবৃন্দ বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের পাঁয়তারা করতে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত ১৯২৫ সালের ১৬ জুন দেশবন্ধু দার্জিলিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু মুসলিমদের জন্য কাল আর রক্ষণশীল হিন্দুদের জন্য আনন্দ বয়ে আনে! দেশবন্ধুর সাথে সাথে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতিও সমাধিস্থ হয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলায় তার মতো অসাম্প্রদায়িক ও চমকপ্রদ নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়। ফলে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সম্প্রীতির সম্ভাবনা শুরুতেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা শুরু করে এবং দেশবন্ধুর অনেক ভক্তই বেঙ্গল প্যাক্ট বিরোধী মতবাদ গ্রহণ করে। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর এক বছর যেতে না যেতেই ১৯২৬ সালের ২২ মে কংগ্রেসের কৃষ্ণনগর সম্মেলনে ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল ঘোষণা করা হয়।
বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের যে সম্ভাবনা ছিল তা নস্যাৎ হয়ে যায়। বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলার হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে সম্প্রীতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের মাধ্যমে সে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। আর এর রেশ ধরেই পরবর্তীতে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়েছে। ভারত বিভক্তির প্রথম বীজ বপন করা হয়েছিল বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের মাধ্যমেই।