ব্যাটল অফ স্যাভো আইল্যান্ড (পর্ব-২): যুক্তরাষ্ট্রের নৌযুদ্ধের ইতিহাসের ভয়াবহতম পরাজয়

প্রথম পর্বে বলা হয়েছিল স্যাভো আইল্যান্ড যুদ্ধে জাপানি হামলার শিকার হয় মিত্রবাহিনীর পাঁচটি ক্রুজার ও সাতটি ডেস্ট্রয়ার। ৮ আগস্ট, ১৯৪২ সালের রাতে এডমিরাল ভিক্টর এদেরকে গুয়াডালক্যানেল চ্যানেল পাহারা দিতে তিন ভাগে ভাগ করেন। সাউদার্ন গ্রূপে ছিল অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীর ক্রুজার এইচএমএএস অস্ট্রেলিয়া ও এইচএমএএস ক্যানবেরা। সাথে ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর ক্রুজার ইউএসএস শিকাগো। এছাড়া মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস প্যাটারসন ও ইউএসএস ব্যাগলির এর দায়িত্ব ছিল স্যাভো আইল্যান্ড ও লুঙ্গা পয়েন্টের মাঝে টহল দেয়া যেন গুয়াডালক্যানেল চ্যানেলে শত্রু জাহাজ (বিশেষত সাবমেরিন) এর প্রবেশ রোধ করা যায়। নর্দান গ্রুপে ছিল মার্কিন ক্রুজার ইউএসএস ভিনসেনেস, ইউএসএস এস্টোরিয়া এবং ইউএসএস কুইন্সি। এছাড়া মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস হেল্ম ও ইউএসএস উইলসন তুলাগি ও স্যাভো আইল্যান্ডের মধ্যকার সমুদ্রসীমায় বক্স আকৃতির পেট্রোল রুট ধরে পাহারা দিতে শুরু করে যেন স্যাভো ও ফ্লোরিডা দ্বীপের মধ্যকার চ্যানেল দিয়ে শত্রুজাহাজ ঢুকতে না পারে।

এই দুই গ্রুপের জাহাজই এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এর বাইরে ইস্টার্ন গ্রূপে ছিল ক্রুজার ইউএসএস স্যান জুয়ান ও এইচএমএএস হোবার্ট। এখানেও দুটো ডেস্ট্রয়ার ফ্লোরিডা আইল্যান্ড ও গুয়াডালক্যানেলের মধ্যকার চ্যানেল পাহারা দিচ্ছিল। তিনদিকে প্রহরা বসানোর পর বাদ থাকলো পশ্চিম দিক। কিন্তু হাতে থাকা জাহাজের সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে কম। অবশিষ্ট সাতটি ডেস্ট্রয়ার ট্রান্সপোর্ট গ্রুপের রসদবাহী জাহাজগুলোকে সম্ভাব্য জাপানিজ সাবমেরিন হামলা থেকে রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত ছিল। তাই নতুন টেকনোলজি হিসেবে আগত রাডারবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস রালফ ট্যালবট ও ইউএসএস ব্লু-কে এমনভাবে পেট্রোলিংয়ের নির্দেশ দেয়া হয় যেন পশ্চিম দিকসহ নর্দান ও সাউদার্ন প্যাসেজে যেন রাডার দিয়ে নজরদারি করা যায়।

স্যাভো আইল্যান্ডের আশেপাশে বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজের অবস্থান; Image source : warhistoryonline.com

কিন্তু তাদের সমন্বয়হীন নজরদারিতে দুটো জাহাজ যখন তাদের পেট্রোল রুটের শেষ মাথায় থাকত তখন তাদের মাঝে ১২-৪০ কিলোমিটারের বিশাল গ্যাপ তৈরি হতো। দুর্ভাগ্যক্রমে জাপানি নৌবহর এই ফাঁকা জায়গা দিয়েই ঢুকে গিয়েছিল। এছাড়া রাডার নামক এই নতুন টেকনোলজি চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য দ্বীপ বেষ্টিত অঞ্চলে সারফেস টার্গেট (যুদ্ধজাহাজ) এর বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর তা জানতো না মার্কিনিরা। এছাড়া জাপানিরা রাডার প্রযুক্তি আবিস্কার করেছে তা জানত মিত্রবাহিনী। ফলে নিজেদের অবস্থান ফাঁস না করতে ইউএসএস শিকাগোসহ অন্যান্য রাডার সমৃদ্ধ ক্রুজারগুলো প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর একবার সার্চ করতো।

জাপানিরা আক্রমণ শুরু করার আগে নির্ধারিত সময়ের আগেই একবার সার্চ করেছিল শিকাগো। যার ফলে ধাবমান জাপানি ক্রুজারগুলোকে রাডারে দেখতেই পায়নি মার্কিনিরা। এছাড়া গত দুদিন ধরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্রীষ্মের গরমে টানা ডিউটি করে ক্লান্ত নাবিকরাও ছিল অবিশ্বাস্য রকমের অসতর্ক। ইতিহাসবিদ স্যামুয়েল মরিশনের ভাষায় “inviting weary sailors to slackness.” এলার্ট কন্ডিশন ৩ থেকে ২-এ নামানোর ফলে অর্ধেক ক্রু বিশ্রামে ফিরে গিয়েছিল। বাকিরা যার যার ব্যাটল স্টেশনে থাকলেও শৈথিল্য প্রদর্শন করেছিল।

জাপানি নৌবহর টহলের ফাঁকা জায়গা দিয়েই ঢুকে গিয়েছিল; Image source : warhistoryonline.com

৮ আগস্ট সন্ধ্যায় রিয়ার এডমিরাল টার্নার মার্কিন মেরিন সেনাদের কমান্ডার মেজর জেনারেল আলেকজান্ডারসহ অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে তার জাহাজে মিটিংয়ের আয়োজন করেন। রাত নয়টার সময় এডমিরাল ভিক্টর ট্রান্সপোর্ট গ্রূপের কাজ কিভাবে রাতের মধ্যেই শেষ করে আগামীকালের মধ্যেই এই অঞ্চল ত্যাগ করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা করতে মিটিংয়ে যোগ দিতে নিজের জাহাজ এইচএমএএস অস্ট্রেলিয়া ত্যাগ করেন। এ সময় সাউদার্ন গ্রুপের কমান্ড ইউএসএস শিকাগোর ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড বোডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ভুলক্রমে এডমিরাল ভিক্টর অন্যান্য জাহাজগুলোকে জানাননি যে আগামী কয়েক ঘন্টা ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ডের নির্দেশ মানতে হবে। ফলে জাপানি আক্রমণের সময় নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয় যা মিত্রবাহিনীর নাবিকদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল।

তাছাড়া ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড বোড নিজেই আকস্মিক পাওয়া নেতৃত্ব কাজে লাগানোর চেয়ে ঘুমানোর কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। তিনি নিয়মানুযায়ী ইউএসএস শিকাগোকে সামনে এগিয়ে নিয়ে সাউদার্ন গ্রুপের সামনে অবস্থান নেয়ার কথা থাকলেও সেটি না করে অপর জাহাজকে কাজটি করতে নির্দেশ দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন! এদিকে মিটিং চলাকালে এডমিরাল টার্নার হাডসন বিমানের পাওয়া গোয়েন্দা তথ্যে জাপানিদের সি-প্লেন ক্যারিয়ারের উপস্থিতির কথা জানতে পারেন। প্রথমত, সি-প্লেন রাতে আকাশে ওড়ে না। দ্বিতীয়ত, এগুলো যুদ্ধজাহাজকে আক্রমণ করার সাহস দেখায় না। তাই রাতের বেলা হামলার আশঙ্কা নেই ভেবে এখনই ট্রান্সপোর্ট গ্রুপের জাহাজগুলো সরিয়ে না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

মেজর জেনারেল আলেকজান্ডার ব্যক্তিগতভাবে রসদ নামানোর কাজ কেমন চলছে পর্যবেক্ষণ করার জন্য মধ্যরাতে মিটিং ত্যাগ করে তুলাগিতে যান। একই কাজ পর্যবেক্ষণ করতে এডমিরাল ভিক্টর গুয়াডালক্যানেলে যান, কিন্তু তার বহরের যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেনদের নিজের বর্তমান অবস্থানের তথ্য জানাননি।

অপারেশন প্ল্যান নিয়ে কথা বলছেন রিয়ার এডমিরাল টার্নার ও মেজর জেনারেল আলেকজান্ডার (বামে) ও
রিয়ার এডমিরাল ভিক্টর ক্রুচলে (ডানে); Image source : wikipedia.org
 

‘মার্কিনিরা রাতের অন্ধকারে নিশ্চয়ই বাতি নিভিয়ে কাজ করবে না’ এমনটা ভেবে জাপানি এডমিরাল মিকাওয়া রিকনসিসের জন্য ঝুঁকি নিয়ে তিনটি সি-প্লেন আকাশে ওড়ান। তাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল যে আক্রমণের সময় তারা আকাশ থেকে ফ্লেয়ার গান ফায়ার করবে যেন মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর উপর আকাশ আলোকিত হয় এবং জাপানি নেভাল গানগুলো তাদের টার্গেট খুঁজে পায়।

রাত পৌনে বারোটার সময় বিমানগুলোর শব্দ পেয়ে কারো মনে সন্দেহ জাগেনি যে এত রাতে বিমান ওড়াবে কোন পাগল। এদিকে বিমান পাঠিয়ে মিকাওয়ার ব্যাটলগ্রুপের জাহাজগুলো তিন কিলোমিটার লম্বা সিঙ্গেল কলাম ধরে এগিয়ে আসছিল। কলামের নেতৃত্বে ছিল ব্যাটলক্রুজার ‘চকাই’। তাকে অনুসরণ করছিল ক্রুজার আওবা, ফুরুতাকা, কাকো ও কিনুগাসা, টেনরায়ু ও ইয়ুবারি এবং ডেস্ট্রয়ার ইউনাগি। রাত পৌনে একটার সময় কলাম থেকে নয় কিলোমিটার দূরে একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ শনাক্ত করে। এটি ছিল সাউদার্ন ও নর্দান প্যাসেজে পেট্রোলিং করা ইউএসএস ব্লু। জাহাজটির চোখে ধরা পড়া এড়াতে মিকাওয়া কোর্স পরিবর্তন করে স্যাভো আইল্যান্ডের উত্তর দিক দিয়ে চ্যানেলে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন। একইসঙ্গে তিনি কলামের সকল জাহাজকে গতি কমিয়ে ২২ নট (৪১ কি.মি./ঘন্টা) এ নিয়ে আসতে বলেন যেন জাহাজের কারণে সৃষ্ট স্রোতের ঢেউয়ের মাত্রা কম থাকে।

চার মিনিট পর ইউএসএস ব্লুর সঙ্গী ইউএসএস রালফ ট্যালবটকে ১৬ কি.মি. দূরে শনাক্ত করে বহরের অন্য একটি জাহাজ। এডমিরাল মিকাওয়া বুঝতে পারেন যে তিনি ভাগ্যের জোরে দুই ডেস্ট্রয়ারের পেট্রোল রুটের শেষমাথায় থাকা অবস্থায় মাঝের গ্যাপ দিয়ে চ্যানেলে ঢুকে পড়েছেন! কিন্তু মিত্রবাহিনীর নৌবহরের দিকে যেতে হলে আবারও কোর্স পরিবর্তন করতে হবে এবং ইউএসএস ব্লু এর কাছাকাছি দিয়ে যেতে হবে। মিকাওয়া কোর্স পরিবর্তন করেন, তবে তার বহরের সবগুলো জাহাজের প্রায় ৫০টি শক্তিশালী কামান ব্লুর দিকে তাক করে রাখেন। এ সময় ইউএসএস ব্লু ছিল ২ কিলোমিটারের ও কম দূরত্বে। মিকাওয়ার নির্দেশ ছিল ব্লু যদি তাদের দেখে ফেলে রেডিওতে সতর্কবার্তা প্রচার শুরু করে, তবে একযোগে সবাই কামান দাগাবে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ইউএসএস ব্লু জাপানিদের দেখেনি, বরং জাহাজ ঘুরিয়ে অন্যদিকে টহল দিতে চলে যায়।

মিকাওয়া তাই এবার আগের প্ল্যানে ফিরে আসেন এবং স্যাভো দ্বীপের দক্ষিণ দিক ঘুরে চ্যানেলের আরো ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় স্পিড বাড়িয়ে ৩০ নট (৫৬ কিঃমিঃ/ঘন্টা) পর্যন্ত তুলতে সব জাহাজকে নির্দেশ দেন। রাত দেড়টার মিকাওয়া সব জাহাজকে নিজে নিজে স্বাধীনভাবে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। এ সময় কলামের শেষ জাহাজ ‘ইউনাগি’ মিকাওয়ার নৌবহরকে পিছন থেকে আসা হামলার নিরাপত্তা দিতে চ্যানেলের মুখে অবস্থান নেয়। যদিও পরবর্তীতে হামলায় অংশ নিতে তাকে আমন্ত্রণ জানায় এডমিরাল মিকাওয়া। সি-প্লেনের দেয়া গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে বাকিরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে সাউদার্ন ও নর্দান ফোর্সকে আক্রমণ করতে রওনা দেয়। এ সময় জাপানি যুদ্ধজাহাজ ফুরুতাকা আগের দিনের যুদ্ধে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়া ডেস্ট্রয়ার জার্ভিসের দেখা পেয়ে টর্পেডো হামলা চালান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সবগুলো টর্পেডো মিস হয়।

জাপানি কলাম জার্ভিসের ১,১০০ মিটার দূর দিয়ে যায়। ক্রুজার ‘টেনরায়ু’ এর ক্যাপ্টেনের লগবুক থেকে জানা যায় যে, তিনি জার্ভিসের ডেকে কোনো ক্রুদের নড়াচড়া বা আক্রমণ করার প্রচেষ্টা দেখতে পাননি। অর্থাৎ রাতের অন্ধকারে জার্ভিসের ধারণাও ছিল না যে এত কাছে শত্রু জাহাজ। সে হয়তো টের পায়নি। নয়তো তার রেডিও কমিউকেশন ইকুইপমেন্ট নষ্ট ছিল। তাই জার্ভিসকে অযথা কামান দাগিয়ে অন্যান্য মার্কিন যুদ্ধজাহাজকে সতর্ক করার মতো ভুল করেনি জাপানিরা। তবে ‘ইউনাগি’ যুদ্ধে প্রবেশের সময় অভাগা জার্ভিসকে একলা পেয়ে কামান দাগিয়ে আরো ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল। অভাগা বলা হলো এজন্য যে জাহাজটি পরদিন টার্গেট খুঁজে না পেয়ে ঘাঁটিতে ফেরা জাপানি পাইলটদের আক্রোশের শিকার হয়ে ২৫৪ জন নাবিক নিয়ে ডুবে যায়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডুবে যাওয়া সেই দুটি মার্কিন জাহাজের একটি যেখানে একজনও বাঁচেনি! 

ইউএসএস ব্লু (বামে) ও ইউএসএস জার্ভিস (ডানে) ছিল একই শ্রেণীর জাহাজ; Image source : wikipedia.org
 

জার্ভিসের সাথে দেখা হওয়ার দুই মিনিট পর বিমান হামলায় ডুবে যাওয়ার আগে জ্বলন্ত যুদ্ধজাহাজ জর্জ ইলিয়টের আগুনের আলোতে সাউদার্ন ফোর্সের জাহাজগুলোকে দেখতে পায় জাপানিরা। রাত ১:৩৮ মিনিটে চূড়ান্ত হামলা শুরু হয়। প্রথমেই একসাথে একাধিক টর্পেডো হামলা শুরু করে জাপানিরা। একই সময়ে মিকাওয়ার জাহাজ ‘চকাই’ ১৬ কি.মি. দূর থেকে নর্দান ফোর্সকে শনাক্ত করে। ফলে তিনি টর্পেডো হামলার বদলে কামান দাগানোর সিদ্ধান্ত নেন।

এদিকে একমাত্র মার্কিন যুদ্ধজাহাজ প্যাটারসন দিনের বেলা জাপানি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি ও রাতের বেলা বিমানের শব্দ শুনে সকল ক্রুদের এলার্ট অবস্থায় রেখেছিল। রাত পৌনে দুটোয় তারা জাপানি ক্রুজার কিনুগাসাকে ৫ কি.মি. দূর থেকে শনাক্ত করে। সাথে সাথেই তারা রেডিওতে সবার উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা প্রেরণ করে। ইউএসএস প্যাটারসন স্পিড বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং স্টার শেল ফায়ার করে। এ ধরনের গোলা আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে শত্রুর দৃষ্টিসীমাকে বাধাগ্রস্থ করে। এ সময় এর ক্যাপ্টেন টর্পেডো ফায়ারের নির্দেশ দেন, কিন্তু কামান দাগানোর ভয়াবহ শব্দে তার ফায়ার কন্ট্রোল অফিসারের কাছে পৌঁছায়নি। প্যাটারসন জাপানি কলামের সাথে পুরোদমে গোলা বিনিময় শুরু করে এবং কিনুগাসাকে আঘাত করে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত করে। তার দৃঢ়তায় জাপানিরা কৌশল বদলে পিছু হটা শুরু করে। প্যাটারসনের পেছন দিকে একটি গোলা আঘাত করে এবং দশজন নাবিক সাথে সাথে মারা যায়। স্যাভো দ্বীপের উত্তর-পূর্বে সরে যাওয়ার পর প্যাটারসনের দৃষ্টিসীমা থেকে জাপানিরা হারিয়ে যায়।

আগুনে জ্বলছে জর্জ ইলিয়ট (বামে) ও ইউএসএস প্যাটারসন (ডানে); Image source : U.S. Naval History and Heritage Command

এদিকে সি-প্লেনগুলো মিকাওয়ার নির্দেশে এইচএমএএস ক্যানবেরা ও ইউএসএস শিকাগোর উপর এরিয়াল ফ্লেয়ার ফায়ার করেছে। ফলে রাতের অন্ধকারে সহজে টার্গেট মার্ক করতে পারছে জাপানিরা। ক্যানবেরা দ্রুত স্পিড বাড়িয়ে পিছু হটে নিজেকে জাপানি যুদ্ধজাহাজ ও মিত্রবাহিনীর রসদবাহী জাহাজগুলোর মাঝে অবস্থান নেয়। সে তার কামানগুলো তাক করা মাত্রই শকাই ও ফুরুতাকা একযোগে তাদের সবগুলো কামান দাগায়।

সেকেন্ডের মধ্যে একাধিক শেল ক্যানবেরায় হিট করে। ফায়ারিংয়ে যোগ দেয়া অপর দুই জাপানি যুদ্ধজাহাজ ‘আওবা’ ও ‘কাকো’ পরবর্তী তিন মিনিটে ২৪টি কামানের গোলা হজম করে। প্রথমেই এর কামানগুলোর গানারি অফিসাররা নিহত হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে অচল হয় দুই বয়লার। পাওয়ার সাপ্লাই হারানোর ফলে পুরো জাহাজ অচল হয়ে পড়ে। বিশাল জাহাজটির স্টারবোর্ড সাইডে (ডানপাশে) দশ ডিগ্রি কাত হয়ে যায়। ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার না থাকায় পাম্প দিয়ে সেচে পানি নিষ্কাশনের সুযোগও পায়নি অস্ট্রেলিয়ান নাবিকরা। জাপানিরা ছিল ক্যানবেরার পোর্ট সাইডে। কিন্তু উল্টো দিকে জাহাজটি কাত হয়ে যাওয়ায় ফলে একটি গোলা ফায়ারের সুযোগ পায়নি ক্যানবেরা। অনেকেই ধারণা করেন যে জাপানিদের গোলা জাহাজের ওয়াটারলাইন বরাবর একদিক দিয়ে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে! আরেকপক্ষ দাবি করেছে যে ক্যানবেরা টর্পেডো স্টারবোর্ড সাইডে হামলার শিকার হয়েছিল। কিন্তু মিকাওয়ার আফটার একশন রিপোর্টে জানা যায় যে তিনি প্রথমে টর্পেডো হামলার সুযোগই পাননি। ইতিহাসবিদদের ধারণা, ক্যানবেরার সবচেয়ে কাছের ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস ব্যাগলি নিজেদের পক্ষের জাহাজ ক্যানবেরায় ভুল করে টর্পেডো মেরেছিল। সেটির ক্যাপ্টেন দাবি করেন যে প্যাটারসনের হারিয়ে ফেলা জাপানি কলামকে টার্গেট করে সে টর্পেডো মেরেছিল। যুদ্ধে ইউএসএস ব্যাগলি আর কোনো ভূমিকা রাখেনি।

ডুবে যাওয়ার আগে এইচএমএএস ক্যানবেরার ক্রুদের উদ্ধার করছে ইউএসএস ব্লু ও ইউএসএস প্যাটারসন (বামে),
জাপানিজ ক্রুজার ‘চকাই’ থেকে তোলা ছবিতে ইউএসএস শিকাগোর উপর জলন্ত ফ্লেয়ার (ডানে);
Image source : U.S. Naval History and Heritage Command.
 

অন্যদিকে ইউএসএস শিকাগো ফ্লেয়ার দ্বারা আলোকিত হওয়ার পর ক্যানবেরার আচমকা টার্ন নেয়ায় নড়াচড়ার মতো জায়গার অভাবে পড়ে যায়। ক্যাপ্টেন বোড ঘুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে উঠে এসে নিজের পাঁচ ইঞ্চি ব্যাসের কামানগুলো থেকে স্টারশেল ক্যানবেরার উপর দিয়ে দাগানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একটি গোলাও বিস্ফোরিত হয়নি। ১:৪৭ মিনিটে কাকোর ফায়ার করা দুটো টর্পেডো শিকাগোর সামনের দিকে আঘাত করে এবং একটি বিস্ফোরিত হয়। এটি জাহাজের মেইন ব্যাটারি ডিরেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত করে। একটি গোলা এসে শিকাগোর মাস্তুল উড়িয়ে দেয়। এতে সেখানে থাকা দুই পর্যবেক্ষণ অফিসার নিহত হন। ক্যাপ্টেন বোড সাউদার্ন ফোর্সের কমান্ডার হলেও তিনি অন্যান্য জাহাজের সাথে যোগাযোগ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেননি। বরং ট্রান্সপোর্ট গ্রুপের জাহাজগুলোকে অরক্ষিত রেখে খোলা সাগরের দিকে বেরিয়ে পড়েন। এমনকি সাউদার্ন ফোর্সে হামলার কথা জানিয়ে অন্যান্য যুদ্ধজাহাজকে সতর্ক ও করেননি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন ছাড়া তার একমাত্র কৃতিত্ব ছিল যে তার পিছু নেয়া টেনরায়ুকে পাল্টা আঘাতে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত করেন।

যুদ্ধের পর তার কোর্ট মার্শাল হয় এবং লজ্জা এড়াতে তিনি আত্মহত্যা করেন। পৌনে একটার সময় মিকাওয়া নর্দান ফোর্সের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তিনি টেনরায়ু ও ইউবারিকে পশ্চিম দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ফুরুতাকা তার স্টিয়ারিং সমস্যার কারণে মিকাওয়া জাহাজ শকাইকে ত্যাগ করে বাকি দুটোর সাথে যোগ দিতে বাধ্য হয়। (চলবে) 

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্ব:

১) ব্যাটল অফ স্যাভো আইল্যান্ড (পর্ব-১): ভয়াবহ এক মার্কিন গোয়েন্দা ব্যর্থতা

Related Articles

Exit mobile version