১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায়, তখনই মার্কিন হর্তাকর্তারা বুঝেছিলেন কেবল সমরেই নয় বরং কূটনীতির ময়দানেও এক শক্তিশালী হাতিয়ার তাদের হস্তগত হলো। বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের মালিক এখন কেবল তারাই। তাদের দাবি এড়ায় সাধ্য কার? যদিও পারমাণবিক বোমা তৈরির পেছনে আমেরিকার ভয় ছিল, তারা না তৈরি করলে জার্মানি আগে পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলবে।
কিন্তু দু’বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই দানব যখন তারা বশে এনেই ফেললেন, তখন জানলেন জার্মানি এ দৌড়ে তাদের ধারে-কাছেও নেই। এবার কী করবেন? দুই বিলিয়ন ডলারের দানবকে তো আর এমনি এমনি ফেলে রাখা যায় না। পৃথিবীকে জানানো দরকার, কাকে তারা বশে এনেছেন। জাপানেই ছুঁড়ে দেয়া যাক। পার্ল হারবারের ক্ষোভ তো আছেই। সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের আধিপত্যও ভালো ঠেকছিলো না যুক্তরাষ্ট্রের। এদের একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।
হিরোশিমা জ্বললো। জ্বললো নাগাসাকিও। নাগাসাকি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার সময় একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। পারমাণবিক কূটনীতির আদর্শ নিদর্শন বলা যায় একে। সেখানে বোমা হামলার কয়েক মুহূর্ত আগে একটি বি-২৯ চক্কর দিয়ে গেল নাগাসাকির ওপর দিয়ে। বোমা নয়, একে একে তিনটি ক্যানিস্টার নেমে এল বিমানটি থেকে। প্রত্যেকটির মধ্যে একটি করে চিঠি।
চিঠিগুলো লিখেছেন আমেরিকার বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী লুইস আলভারেজ ও তার দুই সহকর্মী। প্রাপক তাদের প্রাক্তন সহকর্মী জাপানের পরমাণু বিজ্ঞানী রিওকিচি সেগান। এ তিনটির মধ্যে একটি চিঠি তিনদিন পর জাপানের গোয়েন্দাদের হাতে পড়ে। সেগানের কাছে তা পৌঁছায় মাসখানেক পর। চিঠিগুলোতে সেগানের কাছে জাপানকে বাঁচাতে আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা।
চিঠির ভাষ্য কিছুটা এমন ছিল,
“আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি, জাপানের সমরকর্তাদের বোঝান। আপনি জানেন বিপুল পরিমাণ অর্থ আর শ্রম ব্যয় করলেই এখন পারমাণবিক বোমা বানাতে পারি আমরা। আর যুক্তরাষ্ট্রের বোমা তৈরির কারখানায় রাতদিন কাজ চলছে। সেগুলো আপনার মাতৃভূমির ওপরই এসে পড়বে। এ যুদ্ধ চালিয়ে গেলে আপনাদের শহরগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।”
চিঠিটি পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলিংয়ের আদর্শ উদাহরণ। তখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আর একটি বোমাও ছিল না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা হুমকি ঠিকই দিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরেই জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ কর। সেই আত্মসমর্পণের পেছনে এ চিঠির কতটুকু ভূমিকা ছিল, তা জানা যায়নি। তবে এটি ছিল কূটনীতির ময়দানে এক নতুন খেলার আরম্ভ। এর পর থেকে পারমাণবিক বোমা হয়ে উঠে কূটনীতির ময়দানে তুরুপের তাস।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ভাষায়, পারমাণবিক বোমা হয়ে উঠেছিল ‘Diplomatic stick’। কূটনীতির এই ছড়ি ঘুরিয়েই স্রেফ ‘অর্থনৈতিতে উন্নত’ একটি দেশ থেকে আমেরিকা হয়ে উঠল বিশ্বের নব্য পরাশক্তি। একের পর এক দেশকে তারা তার পারমাণবিক ছাতার নিচে ছায়া দিতে শুরু করল। কোনো দেশকে নিরাপত্তা দিতে তার অত সৈন্য বা অস্ত্র মজুদ করারও দরকার হতো না। কারণ ঝামেলা বেশি বেড়ে গেলে পারমাণবিক দানব তো আছেই।
অন্যদিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার পেছনে যতটা না জাপানকে আত্মসমর্পণ করানোর উদ্দেশ্য ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি। যুদ্ধ পরবর্তী জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের সংকেত। তারা বুঝেছিল যুদ্ধ পরবর্তী জমানায় সোভিয়েত জাপানে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে চাইবে। এশিয়ায় ও ইউরোপে সমাজতন্ত্র ছড়ানোর জন্য ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করবে জাপানকে।
এজন্যেই হিরোশিমা আর নাগাসাকির মাধ্যমে সোভিয়েতকে সতর্ক সংকেত দিল আমেরিকা। কিন্তু রাশিয়াও থেমে থাকেনি। ১৯৪৯ সালে রাশিয়ায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হল। তারাও এখন পারমাণবিক দানবের মালিক। শুরু হলো স্নায়ুযুদ্ধ। কার কাছে কয়টা বোমা মজুদ আছে, সেই হিসেব-নিকেশ। এ স্নায়ুযুদ্ধের সময় দু’পক্ষই বেশ কয়েকবার পারমাণবিক কূটনীতির আশ্রয় নেয়।
১৯৪৮-৪৯ সালে বিখ্যাত বার্লিন অবরোধের সময় এর একটি উদাহরণ দেখা যায়। সোভিয়েত সেসময় গোটা বার্লিন দখল করার আয়োজন করে, পশ্চিমাদের অধিকৃত বার্লিনের সমস্ত সড়ক যোগাযোগ, রেলপথ, পানিপথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এসময় প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বার্লিনের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটিতে বেশ কিছু বি-২৯ বোম্বার জড়ো করলেন। এগুলো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের জন্য উপযুক্ত ছিল।
এর মাধ্যমে আমেরিকা জানিয়ে দেয়, অবস্থা বেগতিক হলে পারমাণবিক হামলা শুরু করতে তারা দ্বিধা করবে না। কিন্তু এ হুমকি ধামকিতে খুব বেশি একটা কাজ হয়নি। রাশিয়ানরা পিছু হটেনি। এরপরই শুরু হয় সেই বিখ্যাত বার্লিন এয়ার লিফট। যার মাধ্যমে পশ্চিমারা আকাশপথে বার্লিনবাসীদের জন্য খাদ্য, ঔষধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবাহ করেছিল।
পরবর্তীতে ১৯৫০ সালের কোরিয়ার যুদ্ধের সময়ও প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান আবার একই কাজ করেছিলেন। বি-২৯ প্রস্তুত করে রেখেছিলেন সোভিয়েতকে কোরিয়ার এই অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে তাড়া দিতে। পরবর্তীতে আইজেনহাওয়ার প্রেসিডেন্ট হলে তিনি সরাসরি পারমাণবিক হামলার কোনো হুমকি দেননি। এ দায়িত্ব পালন করেন আমেরিকান তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট জন ফস্টার ডালাস। তিনি চীনকে জানিয়ে দেন, কোরিয়া সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করবে না।
চীন তখনো পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারেনি। তাদের বিরুদ্ধে এ হুমকিতে ভালোই কাজ হয়। চীন পিছিয়ে যায়। থমকে যায় রাশিয়াও, কোরিয়ার সমস্যা সমাধানে তারা এগিয়ে আসে। প্রমাণিত হয় কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে পারমাণবিক বোমার মাহাত্ম্য। কূটনীতির ময়দানে পারমাণবিক বোমা চরমরূপে হাজির হয়েছিল কিউবায় রাশিয়ার মিসাইল স্থাপনের কাণ্ড দিয়ে।
এসময়ই সম্ভবত স্নায়ুযুদ্ধের সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতির তৈরী হয়েছিল। পৃথিবী অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল একটি পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র কিউবা দখলের একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল কিউবা দখল করে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করা। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়। এর সূত্র ধরে সোভিয়েত ক্যাস্ত্রোকে প্রস্তাব দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ হামলা ঠেকাতে কিউবাতে তাদের পারমাণবিক মিসাইল স্থাপনের জন্য।
কিউবা রাজি হলে, গোপনে শুরু হয় কিউবাতে রাশিয়ান মিসাইল ঘাঁটি তৈরির কাজ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের কাছে বিষয়টি গোপন থাকেনি। প্রেসিডেন্ট কেনেডি রাশিয়াকে মিসাইল ঘাঁটি নির্মাণ বন্ধের হুমকি দেন। কিন্তু তারা তাতে রাজি হয়নি। আমেরিকান নৌবাহিনী কিউবার নদীপথ অবরুদ্ধ করে দেয়, রাশিয়ান জাহাজ যাতে অস্ত্র নিয়ে কিউবায় ভিড়তে না পারে।
সোভিয়েতও নাছোড়বান্দা। এদিকে আমেরিকা প্রস্তুত হচ্ছে কিউবায় আক্রমণের জন্য। সোভিয়েতের মিসাইলগুলোও তো থেমে থাকবে না। পারমাণবিক যুদ্ধ কি বেঁধেই যাবে তাহলে? কেনেডি শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন কূটনীতির সমাধানের। প্রায় তেরদিনের গা ছমছম করা কূটনৈতিক আলোচনা শেষে চুক্তিতে পৌঁছান তারা। রাশিয়া রাজি হলো তার অস্ত্র কিউবা থেকে সরিয়ে নিতে। আমেরিকা আর কখনো কিউবায় আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দিল ও অন্যদিকে তুর্কি থেকে সরিয়ে নিল তাদের মিসাইল।
এসব ছিল পারমাণবিক কূটনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এরপর সময়ের সাথে আমেরিকা ও রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতাও সমান হয়ে যায়। দুই পক্ষই নিশ্চিত হয়ে যায়, যে-ই আগে আক্রমণ করুক, ফিরতি আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। দু’পক্ষই একে অপরকে ধ্বংস করতে সক্ষম। এছাড়া অন্যান্য দেশও পারমাণবিক অস্ত্রে সক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। পারমাণবিক অস্ত্র বিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করার ফলে পারমাণবিক কূটনীতিও থিতিয়ে এসেছে।