ফ্রান্সের ভ্যারসাই প্রাসাদ এক জগদ্বিখ্যাত প্রাসাদ। সপ্তদশ শতকে যখন এটি তৈরি হয়, তখন ভ্যারসাই ছিল এক ছোট্ট গ্রাম। যদিও এখন প্যারিস থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে অন্যতম অভিজাত জায়গা এই ভ্যারসাই। বিখ্যাত নোতরদাম গির্জার ঠিক সামনেই অবস্থিত এই ভ্যারসাই প্রাসাদের ইতিহাস বেশ বৈচিত্রময়। ফ্রান্সের রাজনীতিতে ভ্যারসাইয়ের অবস্থান ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি নৃপতি চতুদর্শ লুই প্যারিস থেকে এখানেই তার রাজদরবার সরিয়ে আনেন। এর প্রায় ১০০ বছর পরে ১৭৮৯ সালে আবাররাজপরিবার আবার প্যারিসে ফিরে যায়। তখন ফ্রান্সের মাটিতে ফরাসি বিপ্লবের ঝড় বইছে। রাজা ত্রয়োদশ লুই এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন ১৬২৩ সালে। শিকারের লজ হিসেবেই মূলত রাজা এটিকে ব্যবহার করতেন। পরে অবশ্য চতুর্দশ লুই এটিকে আরো পরিমার্জিত ও পরিবর্ধন করেন। ভ্যারসাই রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য দেখে তখন কে জানত যে এই সামান্য ভবনটিই হয়ে উঠবে পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল এবং চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের প্রাসাদ ভ্যারসাই।
চতুর্দশ লুই শিকারের লজ থেকে নিজ বাসভবনে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করেন, তখন তার জন্য আর্কিটেক্ট হিসেবে নিযুক্ত করেন লুইস লা ভউ এবং ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট হিসেবে নিযুক্ত হন এ্যান্ড্রি লে নটরে। ১৬৭০ সালে লা ভউয়ের মৃত্যুর পর তার সহযোগী ফ্রান্সেস ডি ওরবে প্রাসাদ নির্মাণের বাকি কাজটুকু সম্পন্ন করেন। শার্ল লা ব্রাঁ নামে একজন বিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর ও ডিজাইনার এই প্রাসাদের ইন্টেরিওর ডিজাইনের কাজটি সম্পন্ন করেন।
৩৭ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে শুরু হয় প্রাসাদ পরিচর্যা। আনা হয় ১ হাজার ৪০০ ঝর্না এবং ৪০০ নতুন ভাস্কর্য। চতুর্দশ লুই হান্টিং লজকে বাড়াতে বাড়াতে ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাড়িতে রূপান্তরিত করেন। আর এ কাজ করতে সময় লেগেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর।
বেশকিছু সংস্কারের পর হারডুইন মানসার্ট নামক একজন আর্কিটেক্ট এই প্রাসাদে দ্বিতীয় তলা এবং অতুলনীয় ঐশ্বর্যমন্ডিত আয়নাঘরটি সংযুক্ত করেন। কিন্তু প্রাসাদটি শেষ হওয়ার পূর্বেই চতুর্দশ লুইয়ের জীবনাবসন ঘটে। প্রাসাদটির অলঙ্করণের কাজ তিনি দেখে যেতে পারেননি।
চতুর্দশ লুইয়ের মৃত্যুর পর পঞ্চদশ লুই জুন ১৭২২-এ মসনদ সরিয়ে নিয়ে আসেন ভ্যারসাইয়ে। ৩৬ হাজার শ্রমিক নিয়ে ভ্যারসাইয়ের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলতে থাকে পরবর্তী শতাব্দী পর্যন্ত। এই প্রাসাদে ৫ হাজার মানুষের আতিথ্য গ্রহণের মতো ব্যবস্থা ছিল।
পঞ্চদশ লুইয়ের নাতি ষোড়শ লুই রাজক্ষমতা পান পৈতৃক সূত্রে। সেসময় শুরু হয় ফ্রান্সের নিদারুণ আর্থিক দুর্গতি। তা সত্ত্বেও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ভ্যারসাইয়ের বাগানটিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন এবং একটি নতুন পাঠাগার নির্মাণ করান। তার স্ত্রী মেরি এ্যানটরনিটেও তার ব্যক্তিগত বাসস্থানে নতুন কিছু সংযোজন করাতেন এবং পরে নতুন করে সাজাতেন।
১৭৮৮ সালে ফ্রান্স সরকারীভাবে দেউলিয়া ঘোষিত হয়। পরের বছরই বিক্ষুব্ধ প্রজার একটি দল খাদ্যের দাবিতে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে বসে, বিশেষ করে রানীর প্রাসাদের অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফরাসি এই বিপ্লবের সময় প্রাসাদটি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেসব শুধরে এটিকে আবার নতুন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে লুই ফিলিপ নামে একজনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে ইতিহাসে। পরবর্তীকালে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এই প্রাসাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে এর সংস্কার করেন।
রাজবাড়ির হলঘরের একদিকের প্যাসেজের দুই পাশে সারি সারি পাথরের তৈরি সৈন্য। মনে হয় অবৈধ যেকোনো অনুপ্রবেশকারীকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে মুহূর্তেই। বিশাল ঘোরানো সিঁড়ি, সারি সারি কক্ষ রয়েছে ভবনটিতে। একটি কক্ষে সারা দেয়াল জুড়ে লাল গালিচা, তো আরেকটি কক্ষ সবুজে মোড়া।
শার্ল লা ব্রাঁ-র তত্ত্বাবধানে শতাধিক লোক নিয়ে এই প্রাসাদের প্রতিটি কর্নার, দেওয়াল, সিলিং শ্বেতপাথর, কাঠের কাজে, ফ্রেস্কো, ছবিতে সাজিয়ে তোলেন। গ্রিক ও রোমান পুরাণের চরিত্ররা উঠে এসেছে এসব অপূর্ব ছবিতে। এখানে রাজা-রানীর প্রধান কক্ষগুলো হারকিউলিস, ভেনাস, মার্স ও মার্কারিকে উৎসর্গ করা হয়।
এখানে একটি ঘরের নাম ‘হল অফ মির্রস’। ৭৫ মিটার লম্বা বলরুমটির একদিকে রয়েছে ১৭টি প্রমাণ সাইজের আয়না। অন্য দিকে একই সংখ্যক জানলা, যেখান দিয়ে সূযাস্তের আলো ঢুকে ঘরে অদ্ভুত আলো-ছায়ার নকশা তৈরি করে।
আয়নাঘরের দুদিকে একটু পর পরই সারি বাধা সাত ফুট উঁচু নারী মূর্তিগুলো যথাসম্ভব হাত উঁচু করে ধরে আছে আলোদানি। তাদের দেহভঙ্গিমা কোমল, আকর্ষণীয়। তবু মনে হয় যেন বাতাসের বেগ উপেক্ষা করেই তারা আলোকিত করে রাখবে এই স্বর্ণখচিত প্রাসাদটিকে। আয়নাঘরের ছাদ শোভিত হচ্ছে নানান রাজ শিল্পীদের হাতে আঁকা ইমপ্রেশনিস্ট স্টাইলের ঐশ্বরিক দৃশ্যসংবলিত ছবি কারুকার্য খচিত ধাতব সোনালী ফ্রেমে আটকানো রয়েছে।
প্রাসাদের সামনেই রয়েছে খোলা বাগান। এই প্রাসাদের ‘হল অফ ব্যাটলসটির’ও বেশ নামডাক রয়েছে। পুরো তিনতলা জুড়ে রয়েছে এই প্রকান্ড যুদ্ধের নামাঙ্কিত ঘরটি। বর্তমানে চলছে এই প্রাসাদের সংস্কারের কাজ। ইট আর পাথরের তৈরি এই পুরনো অট্টালিকাটিতে আজও যেন রয়ে গেছে অনেক শতক আর রাজতন্ত্রের পায়ের আওয়াজ।
বাগানে ঢোকার জন্য আলাদা একটি গেট রয়েছে, সেই গেটের বাইরে গিয়ে চোখ মেললে যতদূর দৃষ্টি যায় নয়নাভিরাম সব গাছ আর গাছ। প্রতিটা গাছ দেখলে মনে হয় হাতের তৈরি শিল্প। একেকটা একেক আকারের সুবিন্যস্ত পাতা সম্বলিত। কোথাও কোথাও ভাস্কর্য, ফোয়ারা, চারদিকে যেন এক নয়নাভিরাম চিত্রকর্ম।
১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রাসাদসংলগ্ন এই বাগান নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৬৬২ সালে প্রথম পর্ব এবং ১৬৬৪ সালে দ্বিতীয় পর্বের কাজ। তারপর থেকে চলতে থাকে নতুন নতুন সংযোজনের কাজ। পঞ্চাশটি ঝর্না রয়েছে এই বাগানে। এসব ঝর্নার প্রতিটির নকশার নেপথ্যে রয়েছে কোনো না কোনো ফরাসি পৌরাণিক কাহিনী বা লোকগাথা। ঝর্নার মধ্যে বিখ্যাত ‘অ্যাপোলো’ ঝরনা। এখানে সূর্য দেবতা তাঁর বাহনে চড়ে আকাশ আলোকিত করছেন সেই কাহিনী ফুটে উঠেছে।
এই গার্ডেনে অনেক দুষ্প্রাপ্য ভাস্কর্য মেলে, যা ফরাসি ঐতিহ্যকে বহন করছে। যতদূর জানা যায়, ১৬৬১ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর হাজার হাজার শ্রমিক আর ফরাসি সৈন্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে এই বাগান। বর্তমানে ৮০০ হেক্টর জমিতে দুই লাখ গাছ, দুই লক্ষাধিক ফুলগাছ এবং ছয় কিলোমিটার খাল নিয়ে গার্ডেন অব ভ্যারসাই। এটি বর্তমানে ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ।
ভ্যারসাইয়ের বিশালত্ব দেখলে মনে হয় একজীবনে এর পরিকল্পনা করে এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখে যাওয়া মানব জীবনের কর্ম নয়। হয়তো সেই কারণেই চতুর্দশ লুইয়ের শিল্প ভাবনায় যে ভ্যারসাই প্রাসাদ, তা তিনি দেখে যেতে না পারলেও তার পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা তা বাস্তবায়নে সক্ষম হন। ভ্যারসাইয়ে প্রতিটি ধূলিকণায় প্যারিসের রাজপরিবারের সৌন্দর্যের যে খোঁজ পাওয়া যায়, তাতে জীবিত অবস্থায় তো নয়ই, মৃত্যুর পরও তারা এই রাজবাড়ির মায়া ত্যাগ করতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ।
তথ্যসূত্র
১) global.britannica.com/topic/Palace-of-Versailles
২) en.wikipedia.org/wiki/Palace_of_Versailles
৩) en.chateauversailles.fr/discover/estate/palace
৪) livescience.com/38903-palace-of-versailles-facts-history.html
৫) linkparis.com/versailles.htm