পার্বত্য চট্টগ্রাম, ১৮৬০ সালে লর্ড ক্যানিংয়ের বাইশতম প্রশাসনিক আদেশক্রমে সৃষ্টি হয়। গভীর অরণ্যে ঢাকা পার্বত্য এলাকায় বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিলেন বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার এবং দাতা সংস্থা ইউসএইড (USAID) এর সহায়তায় শুরু হয় কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে একটি সমন্বিত প্রকল্পের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচকাজ এবং ড্রেনেজ সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু এই বাঁধ নির্মাণের সময় থেকেই শুরু হয় সমস্যা। বাঁধ তৈরির সময় ৬৫৫ বর্গ কিলোমিটারে এলাকা প্লাবিত হয়, যার মধ্যে ছিলো ২২ হাজার একর চাষাবাদযোগ্য জমি। পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট চাষাবাদযোগ্য জমির যা প্রায় ৪০ শতাংশ। কাপ্তাই লেক নির্মাণে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি বিলুপ্ত হয়েছে, প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে তাদের আবাসভূমি থেকে সরে যেতে হয়েছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই চাকমা জনপদের মানুষজন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনপদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ, বিভিন্ন সময়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে।1
পার্বত্য চট্টগ্রামকে মূলত কয়েকটি নদীর উপত্যকায় ভাগ করা যেতে পারে। এর মধ্যে আছে চেঙ্গি, মৈনি, কাসালং, রানখিয়াং আর সাঙ্গু নদী। সাঙ্গু বাদে বাকি সবগুলোই কর্ণফুলীর শাখা। একেকটি পাহাড়ঘেরা উপত্যকা ৩০-৮০ কিলোমিটার লম্বা আর ৩-১০ কিলোমিটার চওড়া। পাহাড়গুলোর উচ্চতা কোথাও কয়েকশ থেকে হাজার মিটারের কাছাকাছি। পাহাড়ঘেরা এই উপত্যকাগুলো কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত। এখানে আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে জুমচাষের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৯২৩ সালে চালানো হয় জরিপ এবং বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হয়। ১৯৪৬ সালে পূর্ব বাংলায় নিযুক্ত ব্রিটিশ প্রকৌশলী ই.এ. মুর কাপ্তাইয়ের ৪০ মিটার ওজানে ‘বারকাল’ নামক স্থানে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তনের পর ১৯৫১ সালে প্রকৌশলী খাজা আজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল বাঁধের স্থানটি চুড়ান্ত করে। এই বাঁধের কাজে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে অর্থ সহায়তা দিতে রাজি হয়। বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদার কোম্পানি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের ‘উটাহ ইন্ট্যারন্যাশনাল ইনকর্পোরেশন’ নামক প্রতিষ্ঠানকে। ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে বাঁধ নির্মাণের মূল কাজ শুরু হয়।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল প্রক্রিয়াই হলো নদী কিংবা জলের গতিপথে বাঁধ দিয়ে প্রথমে পানি জমা করা হয়। এরপর জমা হওয়া বিপুল পরিমাণ পানিকে নির্দিষ্ট চ্যানেলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়। এতে জমা হওয়া পানির বিভব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে পাওয়া যায় বিদ্যুৎ।
কোনো ধরনের কার্বন নিঃসরণ না করেই পাওয়া যায় পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ। এই লক্ষ্যেই সব যাচাই বাছাই শেষে কাপ্তাইতে ৬৭০.৬৫ মিটার লম্বা আর ৪৫.৭ মিটার উঁচু বাঁধ দেওয়া হয়। এটি নির্মাণে মোট খরচ হয় ৪.৯ কোটি রুপি। ১৯৬২ সালের ৩০ মার্চ যখন এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়, তখন এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট ছিলো দুটি, প্রতিটির সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো চল্লিশ মেগাওয়াট করে। তাই শুরুতে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ছিলো ৮০ মেগাওয়াট। বর্তমানে এর ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট এবং মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ২৩০ মেগাওয়াট।2
বিশাল আকারের এই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের সময় যে ১ লক্ষ মানুষকে তাদের আবাসভূমি থেকে সরানো হয়েছিলো তাদের সঠিক উপায়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। নির্মাণের সময় আদিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা করা হয়নি। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের পরে ১ লক্ষ মানুষের পুনর্বাসনের জন্য নেওয়া পুরো ব্যবস্থাটিই ছিলো ত্রুটিপূর্ণ। দাতা এবং কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের আদিবাসীদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতির ব্যাপারটিকে আমলে নেয়নি। আদিবাসীদের জীবনযাত্রাকে তাদের কাছে মনে হয়েছিলো ‘যাযাবর’ প্রকৃতির এবং পাহাড়ের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘুরে ঘুরে জুম চাষ করে বেড়ায়। তবে একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় পাহাড়ি আদিবাসীদের জুম চাষের একেকটি চক্র ছিলো সাত থেকে দশ বছরের, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা দশ থেকে পনের বছর পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ পাহাড়ি আদিবাসীরা সত্যিকার অর্থে মোটেও যাযাবর নয়। পাশাপাশি পাহাড়ি আদিবাসীদের একটা বড় অংশ জুম চাষ ছাড়াও নদী উপত্যকার উর্বর সমতল ভূমিতে কৃষিকাজ শুরু করেছিল। বাঁধ নির্মাণের পর বন্যায় পাহাড়ি জনপদের আবাসভূমির পাশাপাশি প্রায় চল্লিশ শতাংশ কৃষিকাজ উপযোগী ভূমিও তলিয়ে যায়।
কিছু গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, এক লক্ষ লোকের পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ছিলো না। প্রাথমিকভাবে যখন বাঁধের কাজ শুরু হয় তখন অনেক মানুষকেই কাসালং উপত্যকায় নিয়ে আসা হয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চল সাফ করে সেখানে জমি তৈরি করে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হয় আদিবাসীদের। ১৯৬২ সালের বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার পর সেই এলাকাও প্লাবিত হয়। পাকিস্তান সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন এরপর জোরালোভাবে আর কখনোই পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়নি।
এই উদ্যোগ না নিতে পারার পেছনেও আছে কিছু কারণ, এর মধ্যে একটি ছিলো অর্থনৈতিক সংকট। এই প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ছাড় দেওয়া উচিত ছিলো, সরকার সেটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে তাদেরকে সমপরিমাণ উর্বর চাষাবাদযোগ্য জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেটিও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এমন ভূমি সংকটের কারণে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। আবার অনেক পরিবারকেই নদী উপত্যকার উর্বর জমির বদলে দেওয়া হয়েছে পাহাড়ি অনুর্বর জমি। ব্রিটিশদের আসার পর থেকেই দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়ি জনপদ সমতলে কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। ফলে এই অনুর্বর জমি আপাতভাবে জীবনধারণের জন্য কোনো কাজেই আসছিলো না পাহাড়ী জনপদের। ন্যায্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত ছিলো আদিবাসীরা। বাঁধ এলাকায় যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদেরকে হেক্টরপ্রতি পাঁচশত থেকে সাতশত টাকা দেওয়া হয়েছে, যেখানে একই পরিমাণ উর্বর জমি কিনতে খরচ করতে হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।
বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকেই আদিবাসীরা নেতারা ছিলেন এর বিরুদ্ধে। তবে সরকার এবং বাঁধ নির্মাণকারী স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বাঁধ নির্মাণের পরে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছিল। পাশাপাশি এর মাধ্যমে এলাকার উন্নয়ন হবে বলেও বোঝানো হয়েছিল। তবে অনেক পরিবেশবিদ এবং বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়েছিলেন বাঁধ নির্মাণের পর বিশাল এলাকা প্লাবিত হয়ে পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। তাই বর্তমান বাঁধের আরো উজানে বিকল্প একটি স্থান বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তব করা হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত সেই স্থানটি ভারতের সীমান্তরেখার কাছাকাছি হওয়ায় রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কথা ভেবেই তা বাদ দেওয়া হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্বপুরুষদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। অরুণাচলে আশ্রয় নেওয়া এই চাকমা শরণার্থীদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘পরিবেশগত কারণে সৃষ্ট শরণার্থী’ হিসেবে। অরুণাচল প্রদেশে আশ্রয় নেওয়া এই চাকমারা এখনো রাষ্ট্রহীন, ভারত কিংবা বাংলাদেশ কোনো দেশেরই নাগরিকত্ব নেই এই ভুক্তভোগীদের।
তবে আদিবাসী এলাকায় বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘটনা এটাই বিশ্বে প্রথম নয়। নরওয়ের ‘আল্টা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’, ভারতে ‘সরদার সারোভার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ কিংবা কানাডার ‘জেমস বে প্রকল্প’ সবকয়টির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল আদিবাসী এলাকা। আদিবাসী জনপদকে তাদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। অনেক ক্ষেত্রেই করা হয়েছে পুনর্বাসন, দেওয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণ।2
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই ব্যাপারটি পুরোপুরি সম্ভব না হওয়ায় সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে কর্ণফুলীর ভাটির সমতলের চাষীরা লাভবান হয়েছে, মাছ চাষ আর বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পর্যটকদের সমাদর পেয়েছে স্থানটি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে লক্ষাধিক আদিবাসীর নিজেদের বাস্তুভিটা ও আবাদভূমি হারানোর কান্না।