১
সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর দিল্লি আর আগ্রার দিকে চোখ পড়ে আফগান নেতা আদিল শাহ সুরির হিন্দু সেনাপতি হিমুর। বাংলা থেকে দ্রুত মার্চ করে তিনি ইতাবা, কালপি আর আগ্রাসহ আশেপাশের এলাকাগুলো দখল করে নেন। এর কিছুদিন পরেই তুঘলকাবাদের কাছে মুঘল জেনারেল তারদি বেগকে পরাজিত করে দখল বুঝে নেন দিল্লির। এরপর নিজেই স্বাধীন শাসক হিসেবে দিল্লির মসনদে বসে যান।
সম্রাট আকবর আর তার অভিভাবক বৈরাম খান তখন অবস্থান করছিলেন কালানৌরে। দিল্লি ও আগ্রার পতনের সংবাদ দ্রুত কালানৌরে গিয়ে পৌঁছালো। দিল্লির মসনদে এখন হিন্দু রাজা হিমু- এই তথ্যটা হজম করতে মুঘলদের বেশ বেগ পেতে হলো। মুঘলদের জন্য এ এক চরম বিপর্যয়। সবে মাত্রই আফগান ধাক্কা সামলে মুঘলরা কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু, অঙ্কুরেই সব বিনাশ হয়ে গেল।
মুঘল কমান্ডার আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা হতাশ হয়ে গেলেন। জরুরী বৈঠকে তারা সেনাবাহিনীসহ কাবুলে সরে আসার কথা জানালেন। কাবুলে অবস্থান করে শক্তি সঞ্চয় করে আবারো সুবিধামতো সময়ে দিল্লিতে অভিযান চালানোর কথা বললেন তারা। কিন্তু বেঁকে বসলেন বৈরাম খান। সম্রাট বাবরের বংশধরদের প্রতি তিনি চরম আনুগত্য দেখিয়ে বললেন,
‘যতক্ষণ পর্যন্ত বৈরাম খানের শিরা-উপশিরায় রক্তের প্রবাহ বইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাবরের বংশের উপর সামান্য আঁচও আমি লাগতে দেবো না। বাদশাহ আকবর এখনো শিশু আর মৃত্যুর পূর্বে বাদশাহ হুমায়ুন আমাকেই আকবরের অভিভাবক নিযুক্ত করেছিলেন। এখন শুধুমাত্র আমার লাশের উপর দিয়েই মুঘল পরিবারকে দিল্লি থেকে উৎখাত করা সম্ভব হতে পারে।’
বৈরাম খানের এই দৃঢ় মনোভাবের কারণে সবার হুশ ফিরলো। মুঘল সেনাবাহিনী অবশ্যই আবার যুদ্ধে নামবে। এই যুদ্ধ দিল্লির জন্য।
২
বৈরাম খান আকবরসহ সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। থানেশ্বর হয়ে ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর ঘাটি গাড়লেন পানিপথের প্রান্তরে। মাত্র ৩০ বছর আগে এখান থেকেই আকবরের পিতামহ মহান বাদশাহ বাবরের হাত ধরে উত্থান হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের। মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইটিও এখন সেই একই প্রান্তরে হতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, হিমুও দিল্লি ছেড়ে এগিয়ে এলেন পানিপথের দিকে। পানিপথের প্রান্তরে আবারও রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো।
পানিপথের দ্বিতীয় এ যুদ্ধে সেনাবাহিনীর শক্তির দিক দিয়ে হিমুই ছিলেন এগিয়ে। তার সাথে ছিল ৩০,০০০ সৈন্যের দুর্দান্ত বাহিনী। এই বাহিনীতে যেমন ছিলেন রাজপুতরা, তেমনই ছিলেন আফগানরাও। সাথে ৫০০ যুদ্ধহাতি আর বিপুল সংখ্যক দক্ষ তীরন্দাজ। ভারী বর্ম দিয়ে মোড়ানো হাতিগুলোকে শুধুমাত্র ছোটখাট কোনো পাহাড়ের সাথেই তুলনা করা সম্ভব। আবার, হাতিগুলোর পিঠে তীর-ধনুক আর ম্যাচলক বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন হিমুর যোদ্ধারা। অন্যদিকে মুঘলদের শক্তি ছিল হিমুর অর্ধেক। টেনেটুনে মুঘল সেনাবাহিনীতে ১৫,০০০ এর মতো সৈন্য ছিল।
যুদ্ধের শুরুতেই মুঘল সেনাবাহিনীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হলো। ডানবাহুর দায়িত্বে রইলেন সিকান্দার খান উজবেক , বামবাহুর দায়িত্বে রইলেন আবদুল্লাহ খান উজবেক, মধ্যভাগের নেতৃত্ব দিলেন আলী কুলি খান শাইবানী। শাহ কুলি মাহরাম আর হুসাইন কুলি বেগের নেতৃত্বে ছোট আরেকটি বাহিনী মূল বাহিনীর অবস্থানের পেছনে মোতায়েন করা ছিল। আর আকবরকে নিয়ে মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিয়েছিলেন বৈরাম খান। কাজটা করেছিলেন আকবরের নিরাপত্তার জন্যই। নিজের রক্ত দিয়ে হলেও দিল্লি অধিকার করবেন বললেও হিমুর দাপট বৈরাম খান ঠিকই টের পাচ্ছিলেন। শক্তি দিয়ে মুঘলরা এই লড়াইয়ে টিকতে পারবে না এটা তিনি ভালো করেই জানতেন। এই লড়াইয়ে জেতার একমাত্র উপায় হচ্ছে উপযুক্ত কৌশল।
তবে, সব চেষ্টাই যদি শেষ পর্যন্ত বিফলে যায়, তাহলে দ্রুতগামী একটি বাহিনী আকবরকে কাবুলে নিয়ে যাবে। এর ফলে সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে গেলেও আকবর অন্তত বেঁচে ফিরতে পারবেন। ফলে এই লড়াইয়ে পরাজিত হলেও ভবিষ্যতে আবারও দিল্লি আর আগ্রা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়ে যাবে।
৩
অন্যদিকে হিমু তার বাহিনীকে ৩ ভাগে ভাগ করে প্রথম সারিতেই রাখলেন তার আর্টিলারী ইউনিটকে। এর পরে মোতায়েন করলেন তার ৫০০ যুদ্ধ হাতিকে।
যুদ্ধ শুরু হলো। তবে হিমুর কামানগুলো কোনো গোলাবর্ষণ করতে পারলো না। যুদ্ধ পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগে হঠাৎ করেই আলী কুলি খান ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে হিমুর এই কামানগুলো দখল করে নিলেন। তবে কিছু কিছু সূত্রানুযায়ী কামান দখলের এই ঘটনাটি ঘটেছিল যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই।
কামানগুলো হারিয়েও বিচলিত হলেন না হিমু। কামানের পরিবর্তে তিনি এবার তার হস্তীবাহিনীকে সামনে ঠেলে দিলেন। মুহূর্তেই পাহাড়ের মতো হাতিগুলো ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করলো। হিমু নিজেও হাওয়াই নামের একটি যুদ্ধহাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
হস্তীবাহিনী আক্রমণ চালালো মুঘল সেনাবাহিনীর ডান ও বাম বাহুর উপর। পরিকল্পনা হলো মূল সেনাবাহিনী থেকে ডান ও বাম বাহুকে বিচ্ছিন্ন করে মূল অংশকে জাপটে ধরা।
এদিকে, হস্তীবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে মুঘল যোদ্ধাদের দিশেহারা হওয়াই বাকি ছিল। হাতির শুড়ের সাথে বাঁধা তরবারির আঘাতে মুঘল সৈন্যরা তো ধরাশায়ী হচ্ছিলই, তার উপর হাতির ভয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর ঘোড়াগুলোও তাল হারিয়ে এলোমেলো ভাবে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। লাভ যা হওয়ার হিমুরই হলো। পাইকারি হারে মুঘল সৈন্য মারা যেতে লাগলো। এদিকে এই হৈ-চৈয়ের মধ্য দিয়েই হিমু মুঘল সেনাবাহিনীর বাম অংশকে অন্য অংশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে গেলেন।
ডান ও বামবাহুতে বিপর্যয় নেমে এলেও মুঘল যোদ্ধারা হাল ছাড়লো না। তারা পিছিয়ে না গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দুই পাশে ছড়িয়ে গিয়ে হস্তিবাহিনী এড়িয়ে হিমুর বাহিনীর ডান ও বাম অংশে আঘাত হানতে হানতে ভেতরে ঢুকে গেল। মুঘল সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড এই ধাক্কা হজম করতে পারলো না হিমুর বাহিনী। নিজেদের নিয়েই তারা ব্যস্ত হয়ে গেল, ফলে সামনের দিকে আক্রমণের তেজ কমে গেল।
এতে বিপদে পড়লেন হিমু। হিমু তার নিরাপত্তারক্ষীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ঢুকে গেছেন ঠিকই, তবে তার বাহিনীর অন্য যোদ্ধারা আর ঢুকতে পারলো না। মুঘল সেনাবাহিনীর যোদ্ধারা ইতোমধ্যেই তৈরি হওয়া ফাটল পূরণ করে ফেলেছে। বৈরাম খান আগেই জানতেন হিমুর অর্ধেক সৈন্য নিয়ে এই যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা খুব কমই। আফগানরা এমনিতেই বীর যোদ্ধা। তার উপর হিমুর বাহিনীতে আফগানরা যোগ দেওয়ায় পুরো সেনাবাহিনী আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে অবস্থান করছে। তাদের এই আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরাতে পারলেই যুদ্ধে জয় তুলে আনা সম্ভব।
বৈরাম খান তাই তার বাছাই করা দুর্ধর্ষ তীরন্দাজদের একটি দল মোতায়েন করেছিলেন শুধু একটি কাজেই। যে করেই হোক, হিমুকে তীরবিদ্ধ করতে হবে। তাহলেই এই যুদ্ধে জেতা সম্ভব। বৈরাম খানের পাঠানো সেই দলটি ইতোমধ্যেই তাদের কাজে নেমে গিয়েছে।
হাতির পিঠে চড়ে বেড়ানো হিমু ছিলেন আপাদমস্তক ভারী বর্মে সজ্জিত। যার ফলে মুঘল তীরন্দাজরা কোনভাবেই হিমুকে তীরবিদ্ধ করতে পারছিল না। তবে চোখে তো আর বর্ম পড়া যায় না! হঠাৎ-ই একটি তীর গিয়ে আঘাত করলো হিমুর একটি চোখে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি জ্ঞান হারালেন।
এদিকে হিমু যে হাতিটির পিঠে ছিলেন, সেই হাতির মাহুতও মারা গেলেন। কোনো নির্দেশনা না পেয়ে হাতিটি অচেতন হিমুকে নিয়েই পাশের জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেল। বিষয়টি বৈরাম খানের চোখ এড়ালো না। তিনি শাহ কুলি মাহরামকে হাতিটির পেছনে পাঠিয়ে দিলেন। শাহ কুলি মাহরাম জঙ্গলে গিয়ে হাতিটির পিঠে অচেতন হিমুকে আবিষ্কার করলেন। সাথে সাথে হিমুকে বন্দী করে বৈরাম খানের সামনে নিয়ে আসা হলো।
এদিকে হিমু যখন হাতির পিঠে অচেতন হয়ে গেলেন, নিজেদের রাজা ও সেনাপতিকে দেখতে না পেয়ে এবং দ্রুত সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কেউ এগিয়ে না আসায় হিমুর যোদ্ধারা বিশৃঙ্খল হতে শুরু করলো। এই বিশৃঙ্খলা একসময় উর্ধ্বশ্বাসে পলায়নে রূপ নিলো। বৈরাম খান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মুঘল সাম্রাজ্য আরেকবার অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে টিকে গেলো।
প্রায় অচেতন হিমুকে উদ্ধার করে বৈরাম খান ও আকবরের সামনে উপস্থিত করা হলো। বৈরাম খান আকবরের হাতে তরবারি তুলে দিয়ে হিমুকে হত্যা করতে আকবরকে প্ররোচিত করলেন। কিন্তু অচেতন হিমুর দিকে তাকিয়ে আকবরের মায়া হলো। তরবারি হাতে নিয়ে হিমুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আকবর বললেন, একজন অর্ধমৃত মানুষকে কেন হত্যা করতে হবে? জ্ঞান থাকলে না হয় আমি সম্মুখযুদ্ধে তাকে হত্যা করতাম।
আকবরকে দ্বিধা করতে দেখে বৈরাম খান নিজেই তরবারি হাতে নিলেন। এক আঘাতে ধর থেকে মাথা নামিয়ে ফেললেন। এর সাথে সাথেই মুঘলদের জন্য হঠাৎ করে হুমকিস্বরূপ আবির্ভাব হওয়া হিমুর পতন ঘটলো।
৪
মাত্র ১ মাসেরও কম সময় (১৫৫৬ সালের ৭ অক্টোবর থেকে একই সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত) দিল্লি শাসন করে অবশেষে হিমুর চূড়ান্ত পতন ঘটলো। যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা গেল হিমুর ৫০০০ সৈন্য। সেনাবাহিনীর বাকিরা যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। বৈরাম খান বুঝতে পারলেন এই বিশাল সেনাবাহিনীকে এভাবে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিলে এরা আবারো মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। তাই তিনি পলায়নরত এসব সৈন্যদের তাড়া করে যতজনকে মারা যায় মারার নির্দেশ দিলেন। মুহূর্তেই মুঘল যোদ্ধারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
পানিপথের এই ঐতিহাসিক প্রান্তরে কয়েক দশক আগেই সম্রাট বাবর ইব্রাহীম লোদির বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাবরেরই নাতি আকবর আরেকবার এই প্রান্তরেই বিজয়ী হয়ে হুমকির মুখে থাকা মুঘল সাম্রাজ্যকে বিজয়ী করে বিনা বাধায় দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করে নিলেন। তবে এর জন্য মূল্যও দিতে হয়েছে চড়া। পানিপথের এই যুদ্ধে মুঘল সেনাবাহিনীর ১৫০০০ সৈন্যের মধ্যে ৫০০০ জনই নিহত হয়েছিলেন। বিপুল সংখ্যক সৈন্য আহত হয়েছে এ কথা তো বলাই বাহুল্য।
পানিপথের প্রান্তরে বিজয়ী হয়ে আকবর দিল্লিতে প্রবেশ করলেন। দিল্লিতে অবস্থানের মাত্র ১ মাস পরেই খবর এলো সিকান্দার শাহ সুরি ও তার সেনাবাহিনীকে আবারো দেখা গিয়েছে। খিজির খাজা খানকে পরাজিত করে সিকান্দার শাহ সুরি এবার পাঞ্জাব বরাবর অগ্রসর হচ্ছেন। অগত্যা ১৫৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর বৈরাম খানকে সাথে নিয়ে আকবরকে আরেকবার দিল্লি ত্যাগ করতে হলো। আকবরের অগ্রসর হওয়ার সংবাদ শুনে সিকান্দার শাহ সুরি মানকোট দুর্গে আশ্রয় নিলেন। মুঘল সেনাবাহিনী মানকোট অবরোধ করলো। ৬ মাস অবরোধের পর ১৫৫৭ সালের ২৫ জুলাই সিকান্দার শাহ বাধ্য হলেন আত্মসমর্পণ করতে। তাকে বঙ্গে নির্বাসন দেওয়া হলো। এর দুই বছর পর বঙ্গেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
মাত্র কয়েক মাসের ভেতরে আকবরের প্রতিদ্বন্দ্বী দুইটি শক্তির পতন হলো। নিষ্কন্টক হলো মসনদের উপর আকবরের অধিকার। মুঘল সাম্রাজ্য আকবরেরই রয়ে গেল। তবে, আকবরেরও মাথার উপর ছাতার মতো করে রয়ে গেলেন খান-ই-খানান বৈরাম খান।
৫
তুঘলকাবাদের যুদ্ধ আর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের এ ডামাডোলে মুঘল পরিবারের ও অনেক অভিজাত মুঘল নারীই কাবুলে আটকে ছিলেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর মুঘল সাম্রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারনের পর এসব নারী কাবুল থেকে মানকোটের দিকে যাত্রা শুরু করেন। মানকোটেই আকবর তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আকবর আর তার দলবল মানকোট থেকে লাহোর হয়ে জলন্ধরে গিয়ে আস্তানা করলেন।
বৈরাম খান এখানে বিয়ে করলেন। বিয়ের পাত্রী ছিলেন মরহুম সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুনের বোন গুলরুখ বেগমের কন্যা সেলিমা সুলতানা বেগম। বিয়ের সময় সেলিমা সুলতানা বেগম বৈরাম খানের চেয়ে প্রায় ৩৮ বছরের ছোট ছিলেন। এ বিয়ের মাধ্যমে রাজপরিবারের অংশ হয়ে যাওয়ায় বৈরাম খানের মর্যাদাও গেলো বেড়ে।
১৫৫৮ সালের অক্টোবর নাগাদ আকবর তার দরবার নিয়ে আগ্রা পৌঁছান। আগ্রা তখনো পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি। আগ্রায় এসে বৈরাম খান আকবরের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ দিলেন। আকবরের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো পারস্য থেকে আগত আবদুল লতিফ নামের জ্ঞানী একজন ব্যক্তিকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর আগেও আকবরের জন্য একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, পড়াশোনার প্রতি আকবরের তেমন মনোযোগ কখনোই ছিল না। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধূলায় মেতে থাকতে বেশি পছন্দ করতেন।
কিছু কিছু ঐতিহাসিক ধারণা করেন, আকবর সম্ভবত ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) নামক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এ রোগটির ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি পড়াশোনা করার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া স্বত্ত্বেও কোনো অক্ষর শেখা বা পরবর্তীতে তা দেখে চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। রোগটির কারণ সম্পর্কে বলা হয়, আমাদের মস্তিষ্ক যখন কোনো বস্তু দেখে, তখন বস্তুটির একটি স্থায়ী ছবি মস্তিষ্ক নিজের ভেতরে সংরক্ষণ করে রাখে। কিন্তু, এই রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্ভব হয় না। কোনো অক্ষর লেখা হলে তারা অক্ষরটিকে নড়াচড়া করতে বা উল্টা আকারে দেখে। ফলে তাদের পক্ষে অক্ষরটিকে শিখে রাখা এবং পরবর্তীতে অক্ষরটিকে দেখে চেনাও সম্ভব হয় না।
আবদুল লতিফ আকবরকে পড়াশোনা শেখাতে ব্যর্থ হলেন। আকবর আজীবন নিরক্ষরই থেকে গেলেন। তবে তাই বলে কিন্তু সাম্রাজ্য পরিচালনায় আকবর পরবর্তীতে কোনো ভুল করেননি।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। অন্তত কয়েক মাসের জন্য। তবে শীঘ্রই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়তে যাচ্ছেন একজন। তিনি অবশ্যই আকবর নন। খান-ই-খানান বৈরাম খানের পতন ঘটছে যাচ্ছে এবার!
[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]