বে অব পিগস যুদ্ধ: সিআইএ’র পরিকল্পনায় যেদিন কিউবা লড়েছিল কিউবার বিরুদ্ধে!

১৬ এপ্রিল, ১৯৬১ সাল; রাতের প্রথম প্রহর। সিআইএ পরিচালিত কিছু ছোট যুদ্ধজাহাজের একটি বহর, বাইয়া ডি কোচিনোস (স্প্যানিশ) বা ‘বে অব পিগস’ উপকূলের অদূরে অবস্থিত ডেল রিও উপকূলের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে। এই বহরের জাহাজগুলো একপ্রকার কৃত্রিম শব্দ সৃষ্টি করে, যাতে মনে হয়েছিল যে আক্রমণ হতে চলেছে। ফলে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তার বাহিনীর পুরো মনোযোগ চলে যায় রিও প্রদেশের দিকে। বে অব পিগসে আক্রমণের মোক্ষম সুযোগ তৈরি হয়।

বে অব পিগসের অবস্থান; source: pinterest

বাইয়া ডি কোচিনোস বা বে অব পিগস উপকূলকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। একটি ‘প্লায়া জিরোন’, যার কোডনেম ‘ব্লুবিচ’। অপরটি ‘প্লায়া লার্জা’, যার কোডনেইম ‘রেডবিচ’। ১৭ এপ্রিল ঠিক রাত ১২টায়, দুটি সিআইএ অপারেশনাল এলসিআই (ল্যান্ডিং ক্রাফট ইনফ্যান্ট্রি), ব্লাজার এবং বারবারা যথাক্রমে ব্লুবিচ এবং রেডবিচে প্রবেশ করে। তাদের নির্দেশের জন্য উপকূল থেকে কিছুটা দূরেই অপেক্ষা করছে ১৪শ কিউবান নির্বাসিত সৈন্য (বাতিস্তার বিদায়ের সময় নির্বাসিত) নিয়ে গড়া ‘ব্রিগেড-২৫০৬’ এর চারটি জাহাজ এবং সেগুলোতে বোঝাই ট্যাংক, অন্যান্য পরিবহনসহ অস্ত্রশস্ত্র।

ঠিক রাত ১টায় ব্লাজার এবং বারবারার সবুজ সংকেত পাওয়া গেল। ব্লুবিচে চলে এলো যুদ্ধের ইউনিট কমান্ডাররা এবং তাদের পেছন পেছন এলো কয়েকটি এলসিভিপি (ল্যান্ডিং ক্রাফট ভেহিকল পারসোনেলস) এবং এলসিইউ (ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি)। ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে রেডবিচেও পা রাখবার কথা বাকি সৈন্যদের। কিন্তু দেখা গেল, সেখানে উপকূলীয় গার্ডরা ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে টহল দিচ্ছে। তাই রেডবিচের সৈন্যরা নামলো আরো কয়েক কিলোমিটার দূরে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। গার্ডদের চোখে পড়তেই তারা উপরমহলে জানিয়ে দিল বহিরাক্রমণের কথা। সিআইএ এবং ব্রিগ্রেডের সৈন্যরা দ্রুতই গার্ডদের হটিয়ে উপকূলের দখল নিলো। রাত ৩টায় জেগে উঠলেন ঘুমন্ত ফিদেল ক্যাস্ট্রো, আক্রমণের খবর পৌঁছেছে তার কানে।

কিউবার পতাকা অঙ্কিত এবং বিমানবাহিনীর নাম লেখা, ব্রিগেডের একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ; source: airforcemag.com

এদিকে স্থান পরিবর্তন করতে গিয়ে রেড বিচে ভেড়ানো জাহাজগুলো থেকে সৈন্য খালাস বিলম্বিত হয়। তার উপর অপ্রত্যাশিত কোরালের ঘর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাহাজগুলো। ফলে ছোট ছোট নৌকাযোগে সৈন্য খালাস, রাতের জন্য বন্ধ রাখা হয়। সকাল ৬টার দিকে পুনরায় সৈন্য খালাস শুরু হলেও তা নির্ঝঞ্ঝাট শেষ হতে পারেনি। কারণ ক্যাস্ট্রোর নির্দেশে ততক্ষণে কিউবান বিমান হামলা শুরু হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি বি-২৬ বোম্বার বিমান একত্রে হামলা করলে রেড বিচের দুটি জাহাজ ডুবে যায়। হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও, জাহাজ থেকে সাঁতরে তীরে ওঠা ১৮০ জন সৈন্যের অধিকাংশই হালকাপাতলা আহত হয়। কিন্তু তাদেরকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেয়ার মতো চিকিৎসা সরঞ্জামই অবশিষ্ট ছিল না। কারণ ডুবে যাওয়া জাহাজ দুটিতে ছিল চিকিৎসা সরঞ্জাম আর অধিকাংশ গোলাবারুদ!

ব্লুবিচেও বোমাবর্ষণ করে কিউবান বাহিনী। যদিও সৈন্যরা নিরাপদে তীরে পৌঁছুতে সক্ষম হয়, সব রেডিও ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ভিজে যাওয়ায় রেডবিচের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এদিকে সকালে ৭টায় আকাশে উড়ে আসে লকহেড বিমান, যেগুলো থেকে ৭৭ জন প্যারাট্রুপার, ব্লুবিচের প্রধান সংযোগ সড়কের মুখে, একটি চিনিকলে অবতরণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সেই চিনিকলকে কেন্দ্র করে, সে রাস্তাটি অবরোধ করে উপকূলের দিকে আসতে থাকা কিউবান বাহিনীকে আঁটকে দেয়া। দুর্ভাগ্যক্রমে, ‘অপারেশন ফ্যালকন’ নামের এই প্যারাট্রুপারদের অভিযানটিও ব্যর্থ হয়। প্রধান সড়কটি উন্মুক্তই থেকে যায়। আর যুদ্ধের প্রথম দিনই কোণঠাসা হয়ে পড়ে মার্কিন সমর্থিত বিদ্রোহী কিউবান ব্রিগেড।

ব্রিগেডকে আক্রমণ করা কিউবান বিমানবাহিনীর একটি বোমারু বিমান; source: Warnepieces.com

বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ও রেডিও মারফত ফিদেল ক্যাস্ট্রো এক জরুরি ঘোষণা দেন। তিনি আক্রমণকারীদের ব্যাপারে জাতিকে অবহিত করেন এবং সম্মিলিত প্রতিরোধের ডাক দেন। তার এই ডাকে কিউবান বাহিনী আরো তেজোদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। যুদ্ধের প্রথম দিন ক্যাস্ট্রো-বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে বিদ্রোহী ব্রিগেড। বিমান হামলায় ডুবে যায় আরো দুটি খাদ্য এবং গোলাবারুদ বোঝাই জাহাজ। উপায়ান্তর না দেখে কয়েকটি এলসিআই এবং এলসিইউ পিছু হটে এবং কিউবার সমুদ্রসীমা থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে। কিন্তু একগুঁয়ে বিমানগুলো সেখানেও পিছু ছাড়লো না, ডুবিয়ে দিলো আরো দুটি এলসিইউ। আক্রমণকারীদের জন্য দিনের একমাত্র সফলতা ছিল একদল কিউবান মিলিশিয়া ক্যাডেটকে হত্যা করা, যারা ব্লুবিচের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল। পরবর্তীতে কিউবায় এই হত্যাকাণ্ড ‘স্লটার অব দ্য লস্ট ব্যাটালিয়ন’ নামে পরিচিত হয়।

বিদ্রোহী ব্রিগেডের ইচ্ছা ছিল, তারা রাতের বেলা উপকূল ছেড়ে শহরের দিকে এগোবে। কিন্তু কিউবানরা তাদের সে সুযোগই দেয়নি। সারারাতই থেমে থেমে গোলাগুলি চলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রিগেডের সৈন্যরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ক্যাস্ট্রো বুঝতে পেরেছিলেন যে আক্রমণকারীদের গোলাবারুদের মজুদ শীঘ্রই ফুরিয়ে আসবে। রসদ শেষ হলে তারাই আত্মসমর্পণ করবে। এই ভাবনায় তিনি তার বাহিনীকে কেবল ছোট পরিসরে গোলাগুলি চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন।

কিউবান বাহিনীর আক্রমণে সাজোয়া যান ছেড়ে পিছু হটে ব্রিগেড; source: Latinamericanstudies.org

দ্বিতীয় দিনে তাই তেমন গুরুতর কোনো হতাহতের ঘটনাও ঘটেনি। তবে দ্বিতীয় দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল আমেরিকাকে সোভিয়েত ইউনিউনের হুমকি। তৎকালীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডির কাছে পত্র পাঠান। পত্রে বলা হয়, আমেরিকা কিউবায় প্রবেশের চেষ্টা করলে তা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না, এবং তার জবাব পারমাণবিক বোমার মাধ্যমে দেয়া হবে!

ব্রিগেডকে বিমান সহায়তা দিতে উপকূলের দিকে উড়ে যাচ্ছে বি-২৬ বিমান; source: combatreform.org

১৯ এপ্রিল; কিউবানদের পিছু হটিয়ে শহরে প্রবেশ করতে হলে বিমান সহায়তার বিকল্প নেই। সেদিকেই এগোলো ব্রিগেড-২৫০৬। ‘অপারেশন ম্যাড ডগ ফ্লাইট’ নামের সেই বিমান হামলায় অংশ নেয় পাঁচটি বি-২৬ বিমান, যেগুলোর চারটির মধ্যেই ছিল সিআইএ’র কন্টাক্ট পাইলট। কিন্তু ক্যাস্ট্রোর রণকৌশলের কাছে ম্যাড ডগ ফ্লাইট মার খেয়ে গেল। সিআইএ’র পাইলট থাকা চারটি বিমানই ভূপাতিত করলো কিউবানরা। প্রাথমিকভাবে কিছুটা অগ্রসর হলেও পরে সব ইউনিট একত্রে পিছু হটে এবং উপকূলে এসে পৌঁছে।

এবার ক্যাস্ট্রোর উপলব্ধি হয়েছে যে, ব্রিগেডের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে গেছে। তারা এবার বসে না থেকে, টি-৩৪ ট্যাংকের বড় বহর নিয়ে ব্লুবিচের দিকে এগোতে থাকে। রেডবিচের প্রতিরোধ আগেই ভেঙে গিয়েছিল। টি-৩৪ এর বিধ্বংসী আগমনী আওয়াজেই পলায়ন শুরু করে ব্রিগেড সৈন্যরা। ইউনিট কমান্ডাররা সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে শুরু হবার তিনদিনের মাথায় যুদ্ধের লজ্জাজনক সমাপ্তি ঘটে। ২০-২২ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র উদ্ধার অভিযান চালায় বে অব পিগসের আশেপাশের উপকূলবর্তী দ্বীপগুলোতে। মাত্র ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয় তারা। সেই ৩০ জনের সবাই কি কিউবানই ছিল না আমেরিকানও ছিল, তা জানা যায় না।

ট্যাংক থেকে উপকূলের ব্রিগেড সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো; source: businessinsider.com

ফ্লাশব্যাক

১৮৯৮ সালের ‘স্প্যানিশ-আমেরিকান’ যুদ্ধের কথা মনে আছে? আমেরিকানরা স্প্যানিশদের পরাজিত ও বিতাড়িত করে নামেমাত্র ‘রিপাবলিক অব কিউবা’ প্রতিষ্ঠা করে, যা একপ্রকার মার্কিন কলোনিই ছিল। শাসনব্যবস্থার সিংহভাগ পদই ছিল আমেরিকানদের মদদপুষ্ট। ১৯০৫ সালের মধ্যে দেখা গেল যে, কিউবার প্রায় ৬০ ভাগ সম্পদের মালিকই আমেরিকান ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদরা! এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকে এবং কিউবানদের মনে সঞ্চার হতে থাকে অসীম ক্রোধ। তবে অবস্থার পরিবর্তন হয় ১৯৫২ সালে, যখন জেনারেল ফুলজেনসিও বাতিস্তা দেশের ক্ষমতা দখল করেন।

জেনারেল বাতিস্তা; source: thefamouspeople.com

বাতিস্তা ‘ডিসিপ্লিনড ডেমোক্রেসি’র নামে একনায়কতন্ত্র চালাতে থাকেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে বেশ কিছু বিদ্রোহী গ্রুপ। ‘ন্যাশনাল রেভ্যুলশনারী মুভম্যান্ট’ এবং ‘ফেডারেশন অব ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস’, দুটি উল্লেখযোগ্য দল। তবে সবচেয়ে পরিচিত সংগঠনটি হচ্ছে ‘এমআর-২৬-৭’, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পরে পুরো কিউবায়। উত্তাপ টের পেতে সময় লাগেনি বাতিস্তার। বরং ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণে পিছু হটে বাতিস্তার সরকারি বাহিনী। ১৯৫৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাতিস্তা পদত্যাগ এবং পলায়ন করেন। সাথে দেশ ছাড়ে তার সমর্থক বাহিনী। তবে দেশত্যাগের সময় সাথে নিয়েছিল চিরকাল নিশ্চিন্তে আয়েশ করবার মতো অর্থ, প্রায় ৩০ কোটি ডলার!

বাতিস্তাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলছেন ক্যাস্ট্রো; source; history.com

যা-ই হোক, ক্যাস্ট্রো, ম্যানুয়েল লিও নামক এক আইনজীবীকে প্রেসিডেন্ট পদে বসান, এবং নিজে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। আর এমআর-২৬-৭ এর সদস্যরা মন্ত্রীসভার বিভিন্ন পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই ক্যাস্ট্রোর এই বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধেও শুরু হলো প্রতিবিপ্লব। আর এবারের বিদ্রোহীদের অর্থায়ন করলো নির্বাসিত কিউবান গোষ্ঠী এবং সিআইএ। দেশজুড়ে অসংখ্য চোরাগুপ্তা হামলা চালায় এই বিদ্রোহীরা। এর জবাবও শক্ত হাতেই দেন ক্যাস্ট্রো। গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, ভীতিপ্রদর্শনের ব্যাপারগুলো নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়। বাড়তে থাকা সমালোচনার মুখে ক্যাস্ট্রো জনসম্মুখে বিচার করার ব্যবস্থা করেন। চলমান নাটকীয়তার মাঝে আরো এক দফা প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্র।

শুরুটা হয় দেশের তেল পরিশোধন কোম্পানিগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে। ক্যাস্ট্রোর এই পদক্ষেপের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা থেকে চিনি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। চলতে থাকে উত্তর-প্রতিউত্তর। রপ্তানি বন্ধের বিপরীতে ক্যাস্ট্রো, কিউবায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ সম্পত্তি, যেমন- চিনিকল, ব্যাংক ইত্যাদি রাষ্ট্রীয়করণ করেন। এরপর হাভানা পোতাশ্রয়ে একটি ফরাসি জাহাজ বিস্ফোরণ নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে আরেক দফা চিড় ধরে। ক্যাস্ট্রো যুক্তরাষ্ট্রকেই এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করেন। ক্যাস্ট্রোর এই দাবির মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র, খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী ব্যতীত, কিউবায় সবধরনের পণ্য রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এরকম ঘাত-প্রতিঘাত চলতে থাকে। বহুবার ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করবার চেষ্টাও করে যুক্তরাষ্ট্র। এসবের সাথে বে অব পিগসের আসলে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এসব ঘটনা বর্ণনার তাৎপর্য এখানেই যে, যুক্তরাষ্ট্র আর কিউবার সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই তিক্ত। বিশেষ করে ক্যাস্ট্রো ছিলেন মার্কিনীদের গলার কাঁটার মতোই। আর তাই কাঁটা সরিয়ে ফেলতে বে অব পিগসের আয়োজন।

এনএসসিতে পেশ করা সিআইএ’র চূড়ান্ত পরিকল্পনার ম্যাপ; source: LatinAmericanStudies.org

আমেরিকার দৃষ্টিতে, ক্যাস্ট্রো সরকার অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিল। অন্য কিছু ভাবার আগেই ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় মার্কিনীদের ‘সকল কাজের কাজী’, সিআইএ! তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার সিআইএ’র পরিকল্পনায় বেশ চমৎকৃত হন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি শুরু করতে বলেন। ১৯৬০ সালের ১৭ মার্চ, পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’ তথা ‘এনএসসি’তে পেশ করে সিআইএ। পরিকল্পনাটি এমন ছিল, কিউবা থেকে নির্বাসিত বাতিস্তা সমর্থকদের একত্র করে এবং নিজেরা প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করে ক্যাস্ট্রোর পতন ঘটানো। তারপর নিজেদের অনুগত একজনকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে চলে আসা।

“প্রত্যেক কিউবানকেই গেরিলা হতে হবে। কিউবার সকল নাগরিকের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে হবে এবং প্রয়োজন পড়লে, দেশের স্বার্থে তা ব্যবহার করতে হবে।” – চে গুয়েভারা

ক্যাস্ট্রোর সাথে চে গুয়েভারা; source: sputniknews.com

১৮ আগস্ট আইজেনহাওয়ার প্রাথমিকভাবে ১৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেন। প্রস্তুতি চলতে থাকে পুরোদমে। এরই মাঝে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন জন এফ কেনেডি। পরিকল্পনা তাকে পুনরায় দেখানো হয়। কেনেডি সম্মতি দিলে, মায়ামিতে অবস্থানরত কিউবা থেকে নির্বাসিত, ক্যাস্ট্রো বিদ্বেষীদের নিয়ে ‘কিউবান রেভ্যুলশনারি কাউন্সিল’ গঠনের কাজে হাত দেয় সিআইএ। এ কাজ পরিচালনা করেন, উর্ধ্বতন সিআইএ কর্মকর্তা হাওয়ার্ড হান্ট এবং গ্যারি ড্রোলার। সাউথ ফ্লোরিডার বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচী চলতে থাকে। নির্বাসিতরা নিজেরাই নিজেদের ইউনিটের নাম ‘ব্রিগেড-২৫০৬’ রাখে। অন্যদিকে, আক্রমণ আসন্ন, এটা অনুধাবন করতে পারে কিউবা। তাই রাশিয়া থেকে তারা অত্যাধুনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান ক্রয় করে (যেগুলো যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়)। আর আক্রমণ আশঙ্কা করেই উপরের উক্তিটি করেছিলেন চে।

আক্রমণের পরিকল্পনায়, কিউবার বিমানবাহিনীর সক্ষমতাকে খাটো করে দেখা ছিল সিআইএ’র একটি বড় ভুল। আক্রমণের আগের দিন, অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল কিউবার দুটি প্রধান বিমানঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায় সিআইএ এবং ব্রিগেড সৈন্যদের দ্বারা পরিচালিত কয়েকটি বোমারু বিমান। কিউবানদের বিভ্রান্ত করতে, বিমানগুলোর রঙ করা হয়েছিল কিউবান বিমানবাহিনীর মতো এবং সেগুলোতে লাগানো হয়েছিল কিউবার পতাকা! আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল, কিউবার ছোট বিমানবাহিনীকে হতোদ্যম করে দেয়া, যেন পরদিন মূল আক্রমণে তারা বাধ সাধতে না পারে। এই আক্রমণের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন পুমা’।

বিদ্রোহী ব্রিগেডের সৈন্যদের বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে কিউবান বাহিনী; source: frontpagemag.com

সব নাটকীয়তা শেষে ব্রিগেড-২৫০৬ কে নিয়ে বে অব পিগস আক্রমণ করলো সিআইএ। তিনদিন স্থায়ী এ যুদ্ধে কী হয়েছিল, তা আমরা আগেই দেখেছি। এবার দেখবো হতাহতের সংখ্যা। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, হতাহতের সংখ্যা একাধিক সূত্রে একাধিক রকমের। কোনটি আদতে সঠিক, তা জানা দুষ্কর। মোটামুটি একটি ধারণা এরকম যে, ব্রিগেডের ১১৪ জন সৈন্য মারা যায়, আর আমেরিকান (সিআইএ এবং অন্যান্য) মারা যায় দশজনের মতো। কিউবান আর্মির হতাহতের সংখ্যা ১৭৬ জন। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ এবং কিউবার মিলিশিয়া বাহিনী সহ সর্বমোট ৪ হাজার মানুষ আহত/ নিহত/ নিখোঁজ হয় বলে একটি বেসরকারি সূত্র জানায়। আর ১৫ এপ্রিলের বিমান হামলায় কিউবার বিমানবাহিনীর ৭জন মারা যায়, আহত হয় ৫৩জন।

এক সিআইএ অফিসারের মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একদল কিউবান সৈন্য; source: aljazeera.com

ব্রিগেডের ১,২০০ সৈন্যকে জীবিত বন্দী করে কিউবান আর্মি। এই সৈন্যদেরকে গাদাগাদি করে বন্ধ ট্রাকে পরিবহনকালে, শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা যায় ৯ জন। জীবিতদের বিচারের জন্য মাত্র দু’সপ্তাহের মাথায় গঠন করা হয় বিশেষ আদালত। ১৪ জনকে বে অব পিগস আক্রমণের পূর্বেই, কিউবা থাকাকালীন করা হত্যা, ধর্ষণ সহ অন্যান্য অপরাধে আলাদা বিচার করা হয়। এই ১৪ জনের ৫ জনকে ফাঁসি এবং বাকিদের ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। অন্যদিকে, ব্রিগেডের অবশিষ্ট সৈন্যদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় এবং প্রত্যেককে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে আহত হওয়া বিকলাঙ্গ সৈন্যদের মুক্ত করে দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্যাস্ট্রো নিজে ব্যবস্থা করে সেই বিকলাঙ্গ ৬০ জনকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন!

যুদ্ধজয়ে উল্লাসরত সৈন্যদের উদ্দেশে কথা বলছেন ক্যাস্ট্রো; source: cubasolidaritycampaign.blogspot.com

সাজাপ্রাপ্তদের সহায়তায় দ্রুতই আমেরিকা এগিয়ে আসবে, সে কথা ক্যাস্ট্রোর জানা ছিল। সিআইএ’র মধ্যস্থতায়, ৫৩ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের খাদ্য এবং চিকিৎসা সামগ্রীর বিনিময়ে জেলে বন্দী ব্রিগেড সৈন্যদের মুক্তি দিতে রাজি হন ক্যাস্ট্রো। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। সিআইএ জানায়, এই অর্থ আসছে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত দান থেকে! ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর, ব্রিগেড-২৫০৬ এর ১১১৩ জন সৈন্যকে একত্রে মুক্তি দেয় কিউবা। সেদিনই তারা চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামিতে, যেখানে পূর্বেও তারা নির্বাসিত হবার পর বসবাস করেছিল। সেদিন কিউবা ত্যাগ করে আরো ১,০০০ পরিবার, যারা ক্যাস্ট্রোর কমিউনিজমের সমর্থক ছিলেন না। ২৯ ডিসেম্বর, প্রেসিডেন্ট কেনেডির উপস্থিতিতে এই সৈন্যদের জন্য ‘ওয়েলকাম ব্যাক’ সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়। এই সংবর্ধনা পুরো কিউবা জুড়ে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল।

কেনেডি প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করা এই আক্রমণকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোতভাবে ‘বিদ্রোহী’ কিউবানদের আক্রমণ বলে চালানোর চেষ্টা করে। আর ১৫ এপ্রিলের বিমান হামলার ঘটনাকে তারা কিউবান বাহিনীর ভুল বোঝাবুঝি বলে আখ্যায়িত করে। তাছাড়া, কিউবার উপর আরোপিত পূর্বের অবরোধগুলো আরো জোরদার করে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ক্যাস্ট্রো একপ্রকার খুশিই হয়েছিলেন। এই দুর্বল আক্রমণ যে কিউবাকে আরো সতর্ক করে দিয়েছিল! আর চে গুয়েভারা তো কেনেডির কাছে চিঠি পাঠিয়ে রীতিমতো ধন্যবাদ জানান!

“বে অব পিগসের জন্য ধন্যবাদ! এই আক্রমণের পূর্বে বিপ্লব স্তিমিত হয়ে পড়ছিল। এখন তা যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক সংহত!”- চে গুয়েভারা

ফিচার ছবি: cronicaviva.com.pe

Related Articles

Exit mobile version